কবি সুশীল মালতীর কবিতা
*
ভারতী
সুশীল মালতী

( ১ )
এস রাণি !     স্মৃতি--কুঞ্জে,
সরায়ে   আঁধার   পুঞ্জে,
চরণ পরশে ফুটি উঠিবে কল্পনা-- ফুল ;
ভাব--শুদ্ধ শুভ্র ফুলে,
মালিকা গাঁথিব তুলে,
মানস মোহিবে তায় ,  ভর--নর--অলিকুল  |
                                   

( ২ )
কোকিল পাপিয়া তারা,
উন্ মাদ আত্মহারা,
গাহে  যবে শাখি’ পরে তুলিয়া ললিত--তান,
মধুর শারদ--রাতে,
ভাসে নভে তারা সাথে,
ভাবে ভরা,  ডব্-ডোবে সুমধুর চাঁদখান  |


( ৩ )
সেইকালে সেই দিন,
আমার মরম বীণ,
উচ্ছাসে ভরিয়া উঠি ফুটিতে ব্যাকুল হয় |
সে সময় তুমি রাণি !
দিও ফুল্ল পা দুখানি,
চরণ পরশি হিয়া হোয়ে যাবে  মধুময় |


( ৪ )
আমিও সে খোলা প্রাণে,
মধুর ললিত তানে,
অথবা বিষাদা সুরে গাহিবে মধুর গীতি,
যে ভাব উঠিবে যবে,
সেইমত তান রবে,
গাহিবে মরম বীণে, কৃপাময়ি !   নিতি নিতি |


( ৫ )
কল্পনা মনেতে বুঝে,
জ্ঞানালোকে আলোকিত হইবে এ স্মৃতি--কুঞ্জ |
অজ্ঞানতা নাশি রাণি,
আনিবে ত্রিদিব খুঁজে,
তুমি উদ্ভাসিবে বাণী,
পরশি কমল--পদ সরিবে আঁধার পুঞ্জ |


( ৬ )
জীবনের কূলে বসি,
সাথী এ লেখনী মসি,
গাহিবে বিকল বীণে মরমের যত গাথা |
কৃপাময়ি  !    কৃপা কোরে,
সুদৃঢ় বেঁধেনে মোরে,
জীবনে না টোটে যেন,  চরণে মিনতি মাতা  !


( ৭ )
চন্দ্রমা-সম-রূপিণী,
পদেফুল্ল পঙ্কজিনী,
কমল-আসনে বসি করে বীণ্ সুশোভিত |
অধরে মধুর হাসি,
এলোথেলো কেশরাশি,
চতুর্ব্বেদ করে রাণী, কিবা জ্যোতি ঝলকিত |


( ৮ )
তুমি ত্রিদিবের মাতা,
তব যত সুত, সুতা,
ভক্তি ভরে করজোড়ে আছে ও চরণ পরে |
এ দানের কিছু নাই,
ও রাঙ্গা চরণ চাই,
দাও মা ভবতারিণি অভাগীরে চিরতরে  |

.                                               *************************                                   
সূচি    


মিলনসাগর
*
কল্পনা
সুশীল মালতী


এই সই ডাক পোড়েছে
মাথার কিরে বিনোদিনি !
সাজাব কাব্যকানন
তোমায় লয়ে মনোমোহিনি
হেসো সেই মধু হাসি
মনমাতান ছন্দে ‘চোলো  |
যা আমার মরম কথা
সরলভাবে ঠিকটি বোলো |
সেজো’ সই ছন্দে ভাল
মিষ্টি মধুর লো কোমলে  !
সুমধুর সুরে গেয়ো
কোমল তানে দিও বোলে
দেখো সই  !  মিষ্টতাতে
কৃপণ হোয়ে ছলা করি-----
কোরনা মর্ম্মাহতা
মাথার কিরে পায়ে ধরি
তুমি মোর আদরিণি !
প্রীতিমুখীর পায়ে আমি,
তোমাতে মিশে গেলে
আত্মহারার হ্রদে নামি |
আমি যে সদাই উধাও
তোমায় লোয়ে রঙ্গিণীল !
পেয়েছি সাড়া তোমার
যখন আমি বর্ষ ষোলো  |
ভুলেছি হতাশী-ভাব কান্নাকাটি
মনটা ভারি নেছ চেয়ে,
কোরেছ হাল্ কি সোলা
ভুলে য়ে রই তোমায় পেয়ে |
তোমাতে মিশিয়ে গেলে,
রঙ্গিণীলো মজে থাকি,
এসনা হাসি মুখে
তোমার আমি----- জাননা কি ?
এস আজ কল্পনে লো,
হৃদয়রতন, ডাকি সখি !
প্রকাশ’ লেখন মুখে
স্বরূপ হবে চোকোচোকি !
সাজাও আজ দিব্য কোরে
কাব্যকানন লো কল্পনে,
আজি তাই ডাকাডাকি,
মনমাতানি, রাখ্ চরণে |

.                                               *************************                                 
সূচি    


মিলনসাগর
*
মন  বুলবুল
সুশীল মালতী

( ১ )
উঠ স্মরি দুর্গানাম,
ঘুমাবে কি অবিরাম,
“রামকৃষ্ণ”  “রাধাশ্যাম”,
ধর মিঠি বুলি,
রে মন বুলবুলি !


( ২ )
অজ্ঞান অলসে ঘুমে,
পড়িয়া রবে কি ভূমে,
নাম -রসামৃত চুমে,
ঝাড় ভব ধূলি,
রে মন বুলবুলি !


( ৩ )
কর দেখি ডাকাডাকি,
মোহিবি মজিবি পাখী,
দেখ নিধি পাও নাকি,
আঁখি যাবে খুলি,
রে মন বুলবুলি !


(৪ )
সুধাসিন্ধু নাম তোল,
মধু মধু হরিবোল,
হরিনামে হ’ পাগল ,
আত্মপর ভুলি,
রে মন বুলবুলি !


( ৫ )
মোক্ষ মুক্তি নামে পাবি,
উড়ে শান্তিধামে যাবি,
খাঁচা ত্যাগে দুটি “খাবি”,
ঊর্দ্ধে আঁখি তুলি,
রে মন বুলবুলি  !


( ৬ )
তব খেলা যাবে চুকে,
শান্তিধামে র’বি সুখে,
শ্মশান সৈকত বুকে,
খাঁচা ভস্ম চুলি,
রে মন বুলবুলি !


( ৭ )
এ চিত্ত-বিকার ঘোরে,
জীবনে কি রবে মরে ?
বল কে তরাবে তোরে-----
কই ব্রহ্ম ছুলি ?
রে মন বুলবুলি !


( ৮ )
ঘূর্ণিত তরঙ্গময়,
ভবার্ণব খর বয়,
মুখে বলি ব্রহ্ম জয়,
যাবি বাহু তুলি,
রে মন বুলবুলি !


( ৯ )
লীলা সাঙ্গে পক্ষ স্থির,
দৃষ্টি না রবে আঁখির,
নিথর হবে শরীর,
এ ইন্দ্রিয়গুলি,
রে মন বুলবুলি !


( ১০ )
ধর সুর সুমধুর,
লও নাম সে বিভুর,
পোড়ে আছে কত দূর,
কেন যাও ভুলি,
রে মন বুলবুলি |


( ১১ )

ছোলা জল কলরবে,
কাটাবি কি দিন ভবে,
ডাকিতে শিখিবি কবে,
হইয়া আকুলী ?
রে মন বুলবুলি !


( ১২ )

রে বুলবুল, ধর তান,
তোলো প্রামানন্দে গান,-----
তবেই জুড়াবে প্রাণ,
যারে ফাস খুলি |
রে মন বুলবুলি !

.                                               *************************                                  
সূচি    


মিলনসাগর
*
রাজধানী
সুশীল মালতী

( ১ )

পূর্ণ শোভাময়ী বিশ্বরাজত্ব---- মেদিনী,
উত্তাল তরঙ্গ নৃত্য জলধির----
সৈকতে বালুকাভূমি ধ্যানস্থ যোগিনী,
গৌরব সুষমা ভরা, গিরি ধুম্রশির |


( ২ )

শশাঙ্ক ছড়ায় হাসি--জ্যোত্স্না ---সমুজ্জল,
কিরণ অঞ্জলি দেয় জ্যোতির্ম্ময় রবি,
দূর হোতে দেয় তারা -----  দৃষ্টি সুমঙ্গল,
মুগ্ধ ধ্যেয়ানে নত নীল নভঃ ছবি |


( ৩ )


দিবা, নিশা, সন্ধ্যা, ঊষা, চারিটী রতন,
আজ্ঞা পেয়ে আসে, কার্য্য সাধি চলি যায় ;
প্রতিনিধি সম আসে ঋতু ছয় জন,
যুগ মাস দিন পল ঘোরে পায় পায়  ||


( ৪ )

চমকে চরণ-দীপ্তি -----মেঘেতে তড়িৎ,
লীলা তব ঘন-ডাক----ধারা বরিষণ ;
অনুভব   রস তব মধু সুসঙ্গীত,
বিশ্বরাজ্য ভরি খেলে মধুর পবন |


( ৫ )

চরণ বন্দনে ছোটে ফুল পরিমল,
ধ্যেয়ানে মুগধা লতা----তরুতে জড়িত,
শুদ্ধমতী তটিনীর সাধন কল্লোল,
সুপ্রেমিক বিহগের ভজন-সঙ্গীত |


( ৬ )

জোনাকি -----যে টুকু পারে দেয় নিজ কর,
ঝিঝি--- নাম গানে মত্ত গহন কাননে,
সাধন-সঙ্গীতে ভোর---শৈলেতে নির্ঝর,
বিভোর মধুপচয় কীর্ত্তন গুঞ্জনে |


( ৭ )

রাজা !
আমি ঋণী, দীন প্রজা রাজ্যের ভিতর,---
গুণসিন্ধু, সুখময়, হে বিশ্বরাজন,
ঋণী,------পুনঃ ভিক্ষা যাচে চরণের পর,
দাও জ্ঞান, তব ঋণ করিগো পূরণ |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
সাধ
সুশীল মালতী

( ১ )
নিরব নিঝুম কাননের কোলে
তটিনী বহিবে ধীরে,
শ্যাম লতিকায় কুটীর বাঁধিব,
বারমাস তথা একাকী থাকিব,
হৃদয়ের গাথা গাহিব একাকী,
বসিয়া তটিনী তীরে,
শুক্ নো হৃদয়ের নব সুখ রাশি
আবার আসিবে ফিরে |


(২ )
সাথী সখী হবে বিহগের কুল,
সাথী সখী হবে কুসুম মুকুল,
ভ্রমর মৌমাছি প্রজাপতি আদি
মিলনে এ হিয়া ফুটিবে,
বিষাদ নিরাশা হৃদয় বেদনা,
ধীরে ধীরে ধীরে টুটিবে |


( ৩ )
মধুর প্রভাতে তরুণ তপন,
উজল কিরণ সোণার বরণ,
ঢালিবে আমার লতিকাকুঞ্জে,
নব শোভাতায় ধরিবে,
প্রভাতী সমীর পাতায় পাতায়
ঝুরু ঝুরু ধীরে নাচিবে |


( ৪)
জোছনা-হাসিটি  চারু চাঁদিমার,
নিশিতে ফুটিবে কুটীরে আমার,
নীলিমা লতার ললিত কুটীরে,
মরি কি মোহন শোভিবে |
নিশীথ সময় মধু সুধাময়
প্রাণ মন মম লোভিবে |


( ৫ )
মধুর ঊষার নিকুঞ্জে থাকিয়ে,
কুহু বলে পিক উঠিবে ডাকিয়ে,
অমৃত কাকলী শ্রবণে পরশি,
ঘুম ঘোর মোর ছুটিবে,
পাপিয়ার মধু পিউ পিউ তানে
নিমীলিত আঁখি ফুটিবে  |


( ৬ )
নব নব ফোটা কুসুমের রাশি,
ফুল্ল অধরে সুমধুর হাসি,
প্রীতিতে ভরাবে হৃদয় আমার
সুষমা মাখাবে আঁখিতে,
ফুলের মতন ফুটিবে এ হিয়া
হাসিব তাদেরি হাসিতে |


( ৭ )
যাবে আসিবে নিঘাদ প্রখর তপন,
তটিনীর তীরে করিব শয়ন,
তরু দিয়ে স্নিগ্ধ ছাযাময় কোল
তটিনী শোনাবে মধুর গীতি,
সমীরের সনে নাচিবে লহরী
নব নব শোভা হেরিব নিতি

( ৮ )
পায়ে পায়ে যবে বরষা আসিবে,
কেতকী কদম্ব ফুটিয়া হাসিবে,
নাচিবে চপলা গরজিবে মেঘ,
ঝিমি ঝিমি ধারা ঝরিবে,
কানন মাঝারে বরিষা শোভায়
আমারে বিভোর করিবে |


( ৯ )
আসিবে শরৎ শ্যামল বসনে,
উজলি উঠিবে শশাঙ্ক গগনে,
নিরব নিশীথে নিরজনে বসি,
শরতের চাঁদে হেরিব,
ধীরে ধীরে মম হৃদয়ের চাঁদে
হৃদয়ে উদয় করিব |



( ১০ )
আসিবে হেমন্ত শীতলতা শিরে,
শিহরি উঠিব হেমন্ত সমীরে,
হেমন্ত ঊষায় বিমল শিশিরে
নলিনী কি রূপ ধরিবে,
নিরখিব বসি কেমনে তপন
নীহার-মালিকা হরিবে |

( ১১ )
বিষন্নতা ল’য়ে হিম ঋতু এসে,
সাজাবে কানন বিধবার বেশে,
যাবে শোভা-ছটা শুকয়িবে লতা,
ঢাকা না রহিবে কুটীরে,
আমিও তখন বসিব ধ্যেয়ানে
মুদিয়া নয়ন দুটারে |

( ১২ )
আসিবে বসন্ত মলয় পবন,
মুঞ্জরিবে বনে তরুলতাগণ,
কুটীরেতে নব কচি কচি লতা,
সোনালী ছটায় ঢাকিবে,
কোকিল কূজনে মধুপ গুঞ্জনে,
সুপ্ত হৃদি মোর জাগিবে |


( ১৩ )
থাকিব কাননে স্বাধীনতা লোয়ে,
শান্তি প্রীতি রবে সহচরী হোয়ে,
মিটাবে পিপাসা নদীর সলিল,
নিবারিবে ক্ষুধা তরুর ফল,
অঙ্গ ঢাকিবার আছেত কাননে,
কচি কচি চারু গাছের বাকল |



( ১৪ )
ফণীনীর বেশে তটিনীর তীরে,
বিষাদের গান গাব ঘুরে ফিরে,
মধুর বিমল শারদ ঊষায়,
শেষের সেদিন আসিবে,
রূপবতী ঊষা ছড়াইয়ে রূপ,
কুসুমের মুখে হাসিবে |

( ১৫ )
নদীর সৈকতে মিলি বনবালা,
অন্তর্জ্জলী  করি ঘুচায়িবে জ্বালা,
বিভুগুণ গান গাহিতে গাহিতে
তটিনী সাগরে ধায়,
বিভু ধ্যানে আমি মুদিয়া নয়ন
মিশিব অনন্ত গায়  |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
বিকল বীণা
সুশীল মালতী

( ১ )

ভাবের হাটে আছি বসে,
সম্বল মোর ভাঙ্গা বীণ্,
গেছে বীণা ভেঙ্গে-চুরে,
বাজেনা বেহাগী সুরে,
( এখন ) গাইছে মন-বিকল-বীণা
‘কাটাও হরি আমার দিন’ |


( ২ )

দুদিনে সে নূতন বীণা,
ভেঙ্গে গেল আঘাত খেয়ে,
জোড়া দেওয়া যায়না তারে,
তার ছিঁড়েছে একেবারে,
নিশি দিবা আকূল হোয়ে
উঠছে শুধু হা-হা গেয়ে |


( ৩ )

ভবের হাটে এসে এবার,
ব্যস্ত বড় চোলে যেতে
কুহকিনী আশারাণী,
বল্লেনাকো মিষ্ট-বাণী,
( ও তাই ) উদাস প্রাণে বোসে বোসে
কেঁদেই মরি দিনে রেতে |


( ৪ )

আমার মন-বীণা যদি
অলসতা তেজ্য করে,
ডাকে বিভু দয়াল হরি,
অহর্নিশি ব্রহ্মে স্মরি,
তবেই শেষের সেদিনটীতে
যাব চলে আপন ঘরে  |


( ৫ )

ডাক্ লে বীণে ডাক্ তে পারে,
ডাক্ বোনাকো এমনিকুড়ে,
ডাকার মত ডাকলে তাঁরে,
চোলে যাব ভব পারে,
এমন কোরে হতাশ বুকে
থাক্ বনাকো পোড়ে দূরে  |



( ৬ )

মন-বীণা মোহন সুরে------
ধর প্রভু দয়াল হরি,
জুড়িয়ে যাবে সকল জ্বালা,
সাঙ্গ হবে ভবের পালা,
আনন্দেতে উঠবি মেতে
পাবিরে তাঁর চরণতরী |


( ৭ )

এমন অলস অজ্ঞ বীণে,
ভাঙ্গবে তবু ডাক্ তে নারে,
পাগল হোয়ে ডেকে উঠুক,
অজ্ঞানতার আঁধার ছুটুক,
জ্ঞানের আলো জ্বোলে উঠুক,
এ অন্ধকার হৃদ-মাঝারে |


( ৮ )

মন-বীণায় মন-মাতান,
উঠুক বিভুর মধুর সুনাম,
চিনুক প্রভু কৃপানিধি,
বলুক্ দয়াল জুড়াও হৃদি,
আনন্দেতে চিন্ তে থাকুক্
প্রেমময়ের প্রেমের সে ধাম |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
শ্রীকৃষ্ণ
সুশীল মালতী

( ১ )

হৃদয়ে রতন মনমত ধন,
শ্যাম গুণমণি মোর,
যাঁহার মধুর মোহন মুরতি,
হৃদে রাখি থাকি ভোর |
আঁকা বাঁকা ঠাম, ত্রিভঙ্গিমশ্যাম,
প্রাণে প্রাণে ভালবাসি,
নিশিদিন মম হৃদয় মাঝারে
প্রকাশ ও রূপরাশি |


( ২ )


তিলক শোভিত, চন্দন চর্চ্চিত,
গলে বনমালা দোলে,
রাঙ্গাপদে শোভে মোহন নূপুর,
বিভোর করিয়া তোলে |
মরি মরি মরি, হরি  !  প্রাণ হরি,
মরেছ পাগল প্রায়,
আমি পড়েছি লুটিয়ে, সকল ভুলিয়ে,
তব রাঙ্গা দুটি পায় |


( ৩ )

মরি কি মোহন বিনোদ চূড়াটি,
বামে হেলে ঐ রয়,
শ্যাম শ্যাম মোর হৃদয় রতন,
অপরূপ প্রেমময়  |
মোহন-মুরলী মনোহর করে,
অতীব সুশোভা পায়,
মধুর অধর পরশে মধুর-----
বাজিয়া উঠিছে তায়  ||


( ৪ )

অবোধ অধমা দাসীরে শ্রীহরি,
রাখিও চরণোপরি,
( আমি ) সকলি দিয়েছি প্রাণ-মন নাথ,
কমল চরণে ধরি  |
( আমি ) আপনা ভুলিয়ে নিরখি ও রূপ,
সুধারসে ডুবে থাকি |
নাহিক তুলনা, অতুলান শ্যাম
তোমারে হৃদয়ে রাখি |


( ৫ )

( হেন ) পরাণ মাতান মধুর মূরতি,
কোথাও দেখিনি আর,
ত্রিদিব মাঝারে রমণীয় রূপ,
এ হেন আছে কি কার ?
মরমের ধন লুকায়ে মরমে,
খুলিতে নারি যে আঁখি ,
কোথা পালায়িবে হৃদয়-রতন
হৃদয়ে পূরিয়া রাখি |


( ৬ )

তোমাকে বাঁধিব ভকতির ডোরে,
তুমি হে শিখায়ে দাও,
অধম পাতকী, তুমি গুণময়,
পবিত্র করিয়া নাও |
( আমি ) শুধু রূপে ভোর, লইয়া তোমারে,
জানিনা পূজিতে হরি,
শিখায়িয়ে দাও,  তুমি দয়াময়,
পূজন মানস করি |


( ৭ )

অধমার সাধ হোয়ে একমনা,
তোমা লোয়ে থাকি ভোর,
সুধামাখা নাম, সুধাসিন্ধু তুমি,
জুড়াও হৃদয় মোর |
নিতি নব জ্বালা, লোয়ে ঝালাপালা,
অবসাদে ভরা বুক,
তিলকের তরে,   সংসার ভিতরে,
নাহি সুখ একটুকু  |




( ৮ )

ব্যাকুল পরাণে চাহি তব পানে,
আঁখিনীরে সদা ভাসি,
মিটাও কামনা, পূরাও বাসনা,
শ্যাম হে হৃদয়ে আসি |
কমল চরণে মন-মধুকর
গুঞ্জিবে দিবস নিশি |
( আমি ) আপনা ভুলিয়ে, তোমাময় হয়ে,
থাকিব তোমাতে মিশি |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
সংসার
সুশীল মালতী

( ১ )

সংসার কাজল গেহ,
ছয়-রিপু ভরা দেহ,
মায়া মোহ ফাঁস হোতে সদা সাবধান
আপনা বাঁধিয়া চল,
সুধাসিন্ধু নামে গল,
পূর্ণ মনস্কাম যবে ছুটিবে পরাণ !


( ২ )

সংসার মায়ার ছায়,
ঢাকিলে দু আঁখি হায়,
গলায় লাগিবে দৃঢ় নাগপাশ টান,
কাঁদিবে শেষের দিনে
আপন সম্বল বিনে,
প্রভাতী জীবন এত


( ৩ )

যবে জাহ্নবীর তীরে,
বাহিরাবে প্রাণ ধীরে,
সুধাবেন মহাজন প্রভু ভগবান,---
ভবের বাজারে গিয়ে
দেখি কি এসেছ নিয়ে ?
কি দিবে প্রভুর পায়, দিন আগুয়ান


( ৪ )

কিনিয়াছি রাশ রাশ,
হা হুতাশ দীর্ঘশ্বাস,
বিয়োগ বেদনা মোহ বিষাদের গান |
প্রদোষে প্রভাত শুধু,
জ্বলিছে এ হিয়া ধূ ধূ,
ক্ষীপ্ত বীণা তোলে শুধু বিষাদেরি তান


( ৫ )

মহা মায়া-যোরে মোর,
প্রাণ মন আছে ভোর,
সংসার কুহকে ঢাকা মম দু নয়ান,
শৈশব গিয়াছে চলি,
যৌবন এ মন অলি,
আনন্দের খনি পদ পেলেনা সন্ধান |


( ৬ )

সংসার মাঝারে রোয়ে,
বৃথা দিন যায় বোয়ে,
কি হবে যে দিন হবে সৈকত শয়ান |
দাও মোরে দিব্যজ্ঞান,
প্রাণাধার ভগবান,
এসেছি চরণে নাথ, করুণানিধান |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
বেদব্যাস
সুশীল মালতী

( ১ )

খর-স্রোতা দুকূল-প্লাবিনী সরস্বতী----
অনিল লহরে নিশি,
নাচিছে দিবস মিশি,
কুলুতানে মধু গায় নদী পুণ্যবতী !


( ২ )

তরু’পরি গাহে পিক পাপিয়া বুলবুল----
কাকলী বর্ষিত স্থান,
জুড়ায় তাপিত প্রাণ,
কুসুম সৌরভে করে মানস আকুল  |


( ৩ )

তট’পরি ক্ষুণ্ণমনে বসি ঋষি ব্যাস,
মহর্ষি উধাও মন,
হারা যেন কি রতন,
কি যেন নাহিক চিত্তে কিসের প্রয়াস !


( ৪ )

জ্ঞানের ভান্ডার কবি বেদব্যাস যিনি,
রাশি রাশি গ্রন্থ যাঁর,
হিয়া ভারাক্রান্ত তাঁর,
উধাও মানসে কেন শান্তিহারা তিনি !


( ৫ )

ভক্তাধীন ভগবান কৃপাসিন্ধু হরি-----
মন পেয়ে সে সন্ধান,
উঠিল কাঁদিয়া প্রাণ,
মহর্ষির সুপ্রভাত অশান্তি শর্ব্বরী |


( ৬ )

ডাকিলেন ভগবান দেবর্ষি নারদে----
হে নারদ, মর্ত্তে যাও,
মহর্ষিরে দেখা দাও,
সন্তপ্ত মহর্ষি বসি সরস্বতী নদে |


( ৭ )

সদানন্দ প্রেমময় দেবর্ষি চলিল,
বীণায় মধুর তানে,
বিভুর কীর্ত্তন গানে,
নয়ন গলিল, আহা মরম মোহিল

( ৮ )

জ্ঞান অবতার, কবি কূলের ভূষণ,
বসি যথা বেদব্যাস,
উধাও মরমাকাশ,
দেবর্ষি নারদ আসি দেন দরশন ||


( ৯ )

জ্ঞান গৌরবের মূর্ত্তি ঋষি বেদব্যাস,
পাশে প্রেম-ভক্তি স্ফূর্ত্তি ,
দেবর্ষি নারদ মূর্ত্তি,
দেবর্ষি মহর্ষি পাশে, কি শোভা বিকাশ !


( ১০ )

কহিলেন  ব্রহ্মাপুত্র দেবর্ষি মহান্ ,----
মহর্ষে !  কি হেতু ক্ষুণ্ণ,
কেন চিত্ত শান্তি শূন্য,
অধীর কেন গো তব তত্ত্বজ্ঞ পরাণ ?


( ১১ )

কি কারণ ক্ষুণ্ণ মন তব তপোধন,
অসার সংসারে সার,
পরারাধ্য প্রাণাধার,
লেখনী কি করিয়াছে সে গুণ কীর্ত্তন ?


( ১২ )

কহিলেন দেবর্ষিরে তখন----
লভিয়াছে জ্ঞানধন,
এবে প্রেম আকিঞ্চন,
হৃদয়-মন্দিরে চাহি পূজিতে চরণ |


( ১৩ )

মধুভাষী নারদের অমিয় বচন,
কঁহিলেন -----তপোধন,
সবি দেখি আয়োজন,
একটাই বাকী কেন রেখেছ এখন  ?:


( ১৪ )

এস আজি সে দক্ষিণা কর সমাপন,
নৈবেদ্য সাজায়ে রাখি,
দক্ষিণাই দেথি বাকী,
মনফুলে সে দক্ষিণা করনা অর্পণ |


( ১৫ )

মহর্ষির প্রেম-আঁখি ফুটিল তখন,
দেবর্ষি দিলেন দীক্ষা,
মহর্ষির মহা শিক্ষা,
জ্ঞানে প্রেমে সম্মিলন, অতি সুশোভন |


( ১৬ )

এই ফলে সুধাময় সুগ্রন্থ সূজন-----
লেখনীর মধুবৃষ্টি,
শ্রীমদ্ ভাগবৎ-সৃষ্টি,
সংসারী জীবের প্রাণে অমিয় সিঞ্চন |


( ১৭ )

প্রণারাম বিনা কোথা, প্রাণের আরাম !
মোহ-অন্ধ জীব সব,
চিত্তে হাহাকার রব,
আসা যাওয়া জন্ম মৃত্যু নাহিক বিশ্রাম |


( ১৮ )

সচ্চিদানন্দের নামে হ’  মন মগন,
লেখনি !   পবিত্র মুখে,
ফোটাও পরম সুখে,
পাতকী-তারণ বিভু ব্রহ্ম সনাতন |


( ১৯ )

এই যেন হয় নাথ প্রভু ভগবান !
বারেকের তরে হায়,
ফোটে যেন রসনায়,
“জয় ভগবান”  বলি ছোটে গো পরাণ |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
শ্মশানবাসিনী
সুশীল মালতী

( ১ )

শ্মশান-হৃদয়ে শ্মশানবাসিনী
আয় মা নাচিয়ে আয়,
মধুর নূপুর মধুর মধুর
বাজুক রাতুল পায়  |


( ২ )

( হৃদি )  কুসুম কাননে সুখ সহচরী
বিরাজিত যবে মোর,
( তবে ) কাতরে কাঁদিয়ে, আয় মা বলিয়ে,
করিনি সাধনা তোর  |


( ৩ )

লোয়ে খেলা ধূলা শিশুকালে সুখে
কেটেছে সময় মোর,
কিশোর উন্মেষে, অলসে হরষে,
আছিনু নেশায় ভোর  |


( ৪ )

মায়াজালে ভুলি মোহ মদিরায়
অঘোরে ঘুমায়ে বই,
বারেক ভাবিনি, তোমারে ভবানি  !
মা বোলে ডাকিনি---- কই !


( ৫ )

একে একে দোঁহে লোয়েছে বিদায়,
চির তরে হোলো নাশ,
গেছে সুখ-সাধ, সকলি বিষাদ,
নাহি হৃদে কোন আশ |


( ৬ )

বাসনা পুড়েছে আছে ভষ্মরাশি,
জ্বলে চিতা কালানলে,
আহা উহুঃ খর তপ্ত হৃদি জ্বালা,
দীরীঘ শ্বাসেতে চলে |


( ৭ )

হৃদয় কানন শ্মশান ভীষণ
আঁধার আঁধার ঘোর,
আয় মা জননী, ত্রিলোকতারিণি,
এ হৃদি শ্মশানে মোর  |


( ৮ )

গেছে যা জননি, চাহিনাক আর
আয় মা নাচিয়ে আয়,
(  আমি ) দিব পুষ্পাঞ্জলি,  প্রাণ-ফুল লোয়ে
অভয়ে !    অভয় পায়  |


( ৯ )

তুমি কুসুমেষু, লোয়ে ফুলশর
ঘুমাও মলিন বেশে,
বিবেক বৈরাগ্য, শান্ত মূরতিতে
চিত্ত শুদ্ধি কর এসে |


( ১০ )

প্রেতিনী যোগিনী ডাক মা তোমা
নাচ মা ভীষণ বেশে,
সুধাপানে ঢুলু নয়নের তারা
অসি করে এলোকেশে  |


( ১১ )

বিলোল রসনা, তারা বিবসনা,
মুন্ডমালা বিভূষিতা,
সে রূপ নিরখি, নাচিবে পরাণ
হবনা শঙ্করী,ভীতা |


( ১২ )

মিছার কি ছার, ফাঁকি এ সংসার,
সার মা চরণ দুটী,
কালিন্দি-সলিলে,  রাঙা  শতদল
উঠেছে যেন মা ফুটি |


( ১৩ )

নীরদ-বরণ, তারা ত্রিনয়নী
মধুর অট্ট হেসে,
শ্মশানবাসিনী, নৃমুন্ডমালিনী,
দাঁড়া না হৃদয়ে এসে |


( ১৪ )

আর মা ডরিনা, ও রূপেতে তোর
আয় মা নাচিয়ে আয়,
মধুর নূপুর মধুর মধুর
বাজুক রাতুল পায় |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
রাধিকা
সুশীল মালতী

মধুর বাসন্তী নিশি, মৃদুল মলয় বায়,
শোভিছে বিমল চাঁদ, সুনীল গগন গায় |
পাপিয়ার পিয়া রবে, পরাণ আকুল সই,
চাঁদিনী রজনী আজি, মোর শ্যামাচাঁদ কই  !
আর কি সজনি আমি, ফিরে পাব শ্যামাচাঁদে,
যাঁহার বিরহে মোর সতত পরাণ কাঁদে |
আর কি আসিবে ফিরে পরাণ বঁধুয়া মোর,
আশায় আশায় কত যামিনী হইল ভোর |
কত ফুলমালা গাঁথি, পরাতে বঁধুর গলে,
পোহালে যামিনী সই, ভাসাই যমুনা জলে |
কত সাধ আশা সখি, মরমে লুকায়ে রাখি,
নিশি শেষে অবসাদ, ভাসে মোর দুটি আঁখি |
এত প্রেম ভালবাসা, ভুলে গেছে সে নিঠুর,
বারেক সুধাই সাধ, গিয়ে সে মথুরাপুর |
এ মধু যামিনী কালে মরমে কত যে জাগে,
শ্যামের বিরহে মোর, কিছুত না ভাল লাগে |
তমালে কোয়েলা বঁধু, আজি আর কেন গাও,
নাহি মম প্রাণবঁধু, আজি তুমি ফিরে যাও |
কত স্মৃতি জাগিতেছে, পিকরে ও কুহু গানে,
আঁকুলি ব্যাকুলি রাধা তোমার পঞ্চম তানে |
হরষে অমিয় মাখা তোর ডাক কুহু কুহু,
বিষাদে আকুল হিয়া, গাহে মোর উহুঃ উহুঃ |
ফিরে যাও পিকবর, নাহি মোর শ্যামচাঁদ,
শ্যাম গেছে মথুরায়,  সুখ সাধ অবসাদ |
ফাঁকি দিয়ে পালায়েছে আমার সে মন-চোর |
শ্যাম-সোহাগিনী রাধা সহিছে যাতনা ঘোর ||
তাই----খুলেছে কবরী আজ আঁখিতে অঞ্জন নাই,
অধরে তাম্বুলরাগ আজিরে নাহিক তাই  |
চিকণ বসন মোর নাহিরে মুকুতা হার,
শোভা ছটা সুখ সাধ গিয়েছে সনেতে তার |
পুন যদি শ্যাম মোর আসে এ গোকুলে ফিরে,
আবার আসিও তুমি, দিলাম মাথার কিরে |
আঁধার গোকুলে রাধা, শ্যামের বিরহ রয়,
তোমার ও মধুরব, আজি শোভনীয় নয়  |
যথা মম শ্যাম নিধি, যাও তুমি তাঁর পাশে,
বলিও রাধিকা আছে তোমারি মিলন আশে |
কুলবালা কুলবধূ জানিনা মথুরা-ধাম,
চুরি কোরে মন প্রাণ, মজায়ে গিয়েছে শ্যাম |
সম্বল নয়ন নীর,  বুকে হা-হুতাশ জ্বালা,
শ্যাম মোর বুকে আঁকা, শ্যাম নাম জপমালা  |
সে মধু স্মৃতির ছটা জড়ায়ে মরমে মোর,
কভু বা কাঁদায় মোরে,  শ্যাম মম বুকে রয়,
মিছে কাঁদি শ্যাম, শ্যাম, সেত আমা ছাড়া নয় |
ইষ্টদেব হৃদিদেব, পতি বিশ্বপতি হায়,
দুই  এক, একে দুই, আঁখি মুদি হেরি যায় |
নিঠুর নহেত শ্যাম,   নীরবে বুকেতে আছে,
এ মধু যামিনী সই, নয়ন মুদিয়ে রই,
হৃদয় রতন লয়ে,  হরষে মগন হই  |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
অনন্ত-শয্যা
সুশীল মালতী

( ১ )

মধুর মাধুরী ঝলসে মধুর,
বহিছে মলয় নাচিয়া,
উছলি উঠিছে ক্ষীরোদের নীর,
লহরে লহরে ভাঙ্গিয়া  |


( ২ )

সাগর মাঝারে অহি-উপাধানে,
নিখিল-কারণ শ্রীহরি,
শ্রীচরণতল সেবিছে কমলা
ফুল্ল কুসুম আমরি !


(৩ )

নাভিপদ্মে ফুটি পদ্মযোনি ব্রহ্মা,
মধ্যাহ্ন অরুণ-ভাতি,
অনন্ত মাধুরী লভিয়া সাগর,
হরষে উছলে মাতি |


( ৪ )

নীলাকাশ ধরি চন্দ্রাতপ মরি
শোভে তারা ভানু শশী,
সোণার কমল অতুলনা লক্ষ্মী
পাদপদ্ম সেবে বসি  |


( ৫ )

নীল তনুখানি চতুর্ভূজ বিষ্ণু
লীলামৃত ঝরে রূপে,
বিভোর হইয়া নেহারে ভুজঙ্গ
অনিমিষে রহে চুপে |


( ৬ )

শঙ্খ চক্র গদা কমল করেতে
কৌস্তুভ উরসে শোভে,
রক্ত কোকনদ দুর্ল্লভ চরণ
মুনি-মন ধায় লোভে |


( ৭ )

সুশান্তি মলয় ধীরে নেচে চলে
চৌদিকে আনন্দ ভরি,
বিমল প্রেমেতে মাখান প্রকৃতি
স্নিগ্ধ-কম  কোল মরি !


( ৮ )

প্লাবিত জোছনা চির মধুময়ী
পূর্ণমাসী লক্ষ্ণীসতী,
অতুলন তাহা, অপরূপ রূপ
মধুর মোহন জ্যোতি |


( ৯ )

ক্ষীরোদের মাঝে “লক্ষ্ণী-নারায়ণ”
ভূলোকে ধুলায় পাপী,
অজ্ঞান তিমিরে অন্ধ দুনয়ন,
মরম বেদনে যাপি !


( ১০ )

লীলাময় নাথ  !   নিখিল-কারণ
লীলাভূমি ধরাখানি,
খেলেন লইয়া মানব পুতুল
কোথা হোতে সব আনি |


( ১১ )

খেলিতে খেলিতে বিভোর মানব
পাতে গো সাধের ঘর,
ফুরাইলে ছুটি, মুদি আঁখি দুটি
শয়ন চিতার পর  |


( ১২ )

ডাকিলে নাথেরে, লন কোলে তুলে
পরীক্ষা এ সুখ দুঃখ,
আঁধার পুরাণে, লুটালে চরণে
দেন হৃদে জ্যোতি-টুক |


( ১৩ )

অজ্ঞানতা পাপ টুটিয়া ফুটিবে
মধুর হরষ হাসি,
( আমি )  তাই ডাকি নাথ, অধমতারণ !
সেই লোভে ছুটে আসি  |


( ১৪ )

কোথা হে হৃদয়রতন মোহন
সুন্দর মন শ্যাম !
কোথা সে মধুর উল্লাস-পূরিত
শোক-তাপ-হারী ধাম |


( ১৫ )

চাহি মুখপানে, কেঁদে ডাকি নাথ
এস হে ফোটাও আঁখি,
ভব-কষ্ট পরে কসিতেছ এত
এখনও কসার বাকী ?


( ১৬ )

তোমা পেলে রব নীরবে মজিয়ে,
তুলিবনা হাহাকার,
( আমি ) পেতেছি হৃদয়, এস প্রেমময়,
নাশ এ রোদন ভার  |


( ১৭ )

কথিত পঠিত শুনিতেছি নাথ !
হেরিব না, কি গো নয়নে ?
নমঃ নমঃ দেব “লক্ষ্ণী-নারায়ণ”
ক্ষীরোদে অনন্ত-শয়নে |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
শকুন্তলা
সুশীল মালতী

( ১ )

মধুর সুষমা ভরা হিরণ্য কানন
           তরুশাখে বিহগেরা সুমধুর গায়,
ফুলদল পরকাশি মধুর আনন
বিতরে সুবাসরাশি মৃদু মলয়ায়  |
                   
( ২ )


বসন্ত বিরাজে সদা প্রকৃতির সনে
কুহুরবে মুখরিত মধুপ গুঞ্জন,
কুসুমিত তরুরাজি খর সমীরণে,
ঝরে ঝরে ফুলদল করে বরিষণ |


(৩ )

কাননে কুটীর মাঝে কে তুমি রূপসি ?
মরিয়াছ এলোকেশে কুসুম রতন,
বন মাঝে মনোরমা নবীনা তাপসী  !
কম কলেবরে শোভে বাকল-বসন |


( ৪ )

প্রকৃতির সনে নিতি ধরি নব বেশ,
প্রফুল্ল কুসুমাননে সুমধুর হাসি,
কোমল সরল প্রাণে নাহি দুঃখ লেশ,
মুনি-মন হরে হেরি মধু রূপ রাশি |


( ৫ )

মধুর মোহিনী ছবি বিজন কাননে,
কে তুমি সরলা-বালা কুটীর-বাসিনী,
নিবিড় বিজনে বালা কুরঙ্গিনী সনে
ভ্রমিছ আমোদ ভরে বন-বিহারিণী |


( ৬ )

বাঁধি বন-বল্লরীরে তমালের পরে
কোমল কোকিল-কন্ঠে উলুধ্বনি দিয়ে,
নাচিছ ময়ুরী সাথে নব সুখ ভরে-----
লতিকা সখীর সাথে তমালের বিয়ে |


( ৭ )

মধুর ঊষায় নিতি বিহগের সনে
সরল তরল প্রাণে গাও মধু গীতি,
নিরখি কুসুম হাসি,  হাস সুখ-মনে
বনজ কুসুমে ভূষা কর নিতি নিতি  |


( ৮ )

নবফুলে বাজু বালা , কলিকার দুল,
উরসে দুলিছে নব গোলাপের হার,
পরিমলে দশদিক করিয়া আকুল,
মুকুতা কাঞ্চন হীরা তুলনাটয় ছার |


( ৯ )

সরলা সুন্দরী সতী বিপিনবাসিনী
পশু পাখিগণে স্নেহে করিছ পালন,
        বনমাঝে বনদেবী নব তপস্বিনী,
বিধির স্নেহের নিধি লুকানো রতন  |


( ১০ )

বিভোর অথিতি হেরি মধুর মুরতি,
তুষিলে অতিথি সতি,  শীতল সলিলে,
‘কে তুমি ?’ কহিল পান্থ ‘কহ রূপবতি !’
“শকুন্তলা” মুনিকন্যা মধুর কহিলে |


( ১১ )

অপ্সরা-তনয়া, জন্ম নিকুঞ্জ-কাননে
মুকুলে তাজিয়া মাতা গেল দেবদেশে,
বসুধারে প্রদানিল এ হেন রতনে,
নন্দনবাসিনী বামা ধরাপরে এসে |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
বাজার
সুশীল মালতী

( ১ )

বিষম প্যাঁচের বাজারখানা
চারিধারে ঘেরা জাল,
বুঝতে গেলে গুলিয়ে যাবে,
তবুও না তত্ত্ব পাবে,
ঠোক্করেতে আঘাৎ খাবে,
দেখছি এ দিন বিষম কাল  |


( ২ )

এ বাজারে মানব যাত্রী
তারা নিতি যাচ্ছে আসে,
প্রায় দেখা যায় কলাই করা,
মিষ্টভাষা চিত্তহরা,
কাছে এসে সেইত ত্বরা
জড়িয়ে দেবে বিষম ফাঁসে |


( ৩ )

ঐ যে দেখ বিষে গড়া
গোলমেলে ঢং গোলাকারা,
মিষ্টতা-হীন নামটা “টাকা”
কোমল নয়ত শক্ত চাকা.
ওতেই আছে সবগো ঢাকা,
গুণ বুঝেছে নাড়ে যারা |


( ৪ )

প্রভু দেছেন পাঠায়ে মোরে,
তাই এসেছি  এ বাজারে,
কুক্ষণেতে যাত্রা আমার,
লাভে শূন্য হোলোগো হার,
শূন্য হাতে এ হাহাকার,
বল্ বো কি হায় গিয়ে তাঁরে |


( ৬ )

মায়া মোহের দৃঢ় বাঁধন,
অলস হৃদয় ভালবাসে,
মায়ার পুতুল “ফলটী” * আমার,
মায়ার খনি বদনটি তার,
ক্ষণেক ছেড়ে চিত্ত বিকার,
দৃঢ়-বাঁধা  এ নাগ পাশে |

* লেখিকার একমাত্র পুত্র-- বিজনকুমার

( ৭ )

জগত্গুরু ! প্রেমের আধার !
পড়্ লে তোমার এমনি ফাঁসে------
চরণে প্রাণ থাক্ তো বিঁধে,
পথটা পেতাম মধুর সিধে,
জ্ঞানের আলো জ্বলতো হৃদে
বাজার করে যেতাম পাশে |


( ৮ )

মিল্ লনাত সরল  স্বজন,
মর্ম্মে দেখি আঁটা খিল,
সাত নকলে আসল খাস্তা,
পাইনা সঠিক সোজা রাস্তা,
গুলিয়ে মরি নাই ব্যবস্থা,
মনের শান্তি নাইকো তিল |


( ৯ )

ভবের বাজার সকল অসার,
বুঝেছি সার দয়াল হরি---
এখন ওহে কৃপানিধি,
সোজা কর বিকল হৃদি,
ডাকলে আসো এইত বিধি,
এসহে নাথ কৃপা করি |


( ১০ )

আসা যাওয়া সার হবে কি ?
এ অভিযোগ কর্ বো তোমায়------
তেমন কোরে সাজিয়ে দিলে,
এমন করে ভেঙ্গে নিলে,
জীবন-বাঁধন হচ্ছে ঢিলে,
( ওগো )  এগিয়ে আসে যাবার সময় |


( ১১ )

ভবের হাটে ভাঙ্গা প্রাণে
আশা শুধু রাতুল চরণ-----
সার বুঝেছি ----অনিত্য সব,
বাজায়ে এ ঘোর কলরব,
চাইনা বিষের বিষয় বিভব,
তোমাতে ধায় পাগল এ মন |


( ১২ )

কোথা হে নাথ !  আনন্দময় !
প্রাণ মেতে যায় নাম রসেতে,
গুপ্ত কত অমৃত রয়,
ভান্ডার সে চরণদ্বয়,
চিত্ত চকোর আকুল যে হয়,
( আমি ) পাগল হলাম তোমায় পেতে |


( ১৩ )

বাজার দেখে ডরিয়ে মলেম,
অজ্ঞ আমি অন্ধকারে,
মহৎ জ্ঞানী দক্ষ যাঁরা,
মোক্ষ-ফলটী লভেন তাঁরা,
অজ্ঞ আমি হলেম সারা,
তোমা বিনা জানাই কারে |


( ১৪ )

( আমি ) এ বাজারে আসল ফাঁকী-----
বুঝ্ বনাকো অত শত,
দীনা হীনা অণুকণা,
চক্ষু দুটো বড্ড নোনা,
ঠেক্ লে পদে হবে সোণা,
প্রাণে আশা জাগ্ ছে কত |


( ১৫ )

বাজার পথে তুমিই সহায়
দীন-ভরসা অধমতারণ !
রেখে হে নাথ পদে তোমার.,
বাজার ব্যাসাৎ ঘুচাও আমার,
রাখ মার দিলাম এ ভার,
তুমিই আমার হৃদয়রতন |

.                                               *************************                                     
সূচি    


মিলনসাগর
*
বৃন্দাবন
সুশীল মালতী

( ১ )


বিরহ বিধুর
সুষমা বিহীন
                              বিষাদিনী ব্রজপুর |
ফোটেনা অধরে
ফুলকুল হাসি,
                                 নাহি সে বাঁশরী সুর |


( ২ )

মরম উচ্ছ্বাস
যমুনা উজান,
                              নাহি সে মৃদুল তান |
বিহগের স্বরে
নিতি নব নব
                              নাহি সে মধুর গান |



( ৩ )


নবীন  পল্লবে
কলেবর আভা,
                           বিকাশে না নব ছটা |
চাঁদিনী নিশীথে
জোছনা বসনে
                          নাহি সে মাধুরী ঘটা |


( ৪ )

ধেনু পালে নাই
চপল চলন,
                          সমীরে মধুর ভাষ |
শ্যামধন হারা
বৃন্দাবন ধাম
                            বিষাদিনী বার মাস |


( ৫ )
( যবে )      সে শ্যাম-তমালে
রাধিকা লতিকা
                              বেড়িত মধুর হেসে |
বিটপীর সারি,
যোড়শ গোপিকা,
                                 ঘেরিত মধুর বেশে  |

( ৬ )

সুষমায় ভরি
সোণার গোকুল,
                                প্রমোদে উঠিত ভাসি |
মুরলীর স্বরে,
ব্রজ ঘরে ঘরে,
                              ঢালিত সুধার রাশি |

( ৭ )

( যবে ) নবীন নধর
নীল তনুখানি,
                         চন্দন চর্চ্চিত ভাল |
শ্যমলী ধবলী
ধেনুগণ পাছে,
                            ধেয়ে যেত শ্রীগোপাল |
                  
                      ( ৮ )

রুণু  রুণু  রুণু
ঝুমুর  ঝুমুর,
                                    বাজিত নূপুর পায় |        

বেণু করে শ্যাম,
ত্রিভঙ্গিম  ঠাম,
                                     নাচিয়ে নাচিয়ে যায় |


( ৯ )

শ্রীদাম,  সুদাম,
সাথীদের  সনে----
                         কদম্বের তলে খেলা |
গোপিকার ননী
গোপনে হরণ,
                       মধুর শৈশব বেলা |


( ১০ )

অতীত স্মৃতিটী
মাখিয়া হিয়ায়
                      ধরিয়া বিষাদ সাঁজ |
লীলাভূমি ব্রজ,
লীলাময় হারা,
                             পড়িয়া রোয়েছে আজ |


( ১১ )

গোকুল-রতন,
গোলকে  প্রকাশ,
                        শূন্য করি ব্রজধাম |
দেখিবার সাধ,
হয় যদি ভাই,
                             পরাণ-মাতান শ্যাম |


( ১২ )
         সবে মিলি জুলি,
মায়া মোহ ভুলি,
                           সাধনা করিবি আয়  |
করুণা-আধার,
শ্যাম প্রাণময়,
                              রাখিবে রাতুল পায় |


( ১৩ )
                  
চির  শান্তিময়
সে দুটী  চরণ,
                          পরশে হইবে সোণা |
সে চরণতরী
পেয়ে গেল তরি,
                          পাতকী কতই  জনা |

.                                               *************************                                     
সূচি    






মিলনসাগর