কবি সুশীল মালতীর কবিতা
*
উন্মাদী প্রলাপ
সুশীল মালতী
      
.                        ( ১ )

মন !
.       ভাব সাগরেতে তোর শুধু অশ্রু আজ,
.          উচ্ছ্বাসে আজিকে তোর,
.                 শুধু দীর্ঘশ্বাস ঘোর,
.         ছন্দময়ি! লো কবিতে, ধরিবে কি সাজ ?

.                        ( ২ )

.         শান্তি দাও মনময়ি! কাঁদায়ে আমায়,
.           সরল ভাষার সনে,
.                  প্রাণ থুলি কাঁদি ক্ষণে,
,         ভীষণ অব্যক্ত ঝড় থামুক হিয়ায় |

.                        ( ৩ )

.        অমৃত কাননবাসী প্রেমিক রসাল,
.                  “রামকৃষ্ণ”  প্রাণারামে,
.                   হেরিতে সে নিত্যধামে,
,        নিত্য দেহে গেল ভ্রাতা “রাজেন্দ্র”  তমাল |

.                        ( ৪ )

.         ভবার্ণবে  ভাসমান সরস  মরাল,
.                   শৈশবে যৌবনে খেলি,
.                 ধূলা ঝেড়ে খেলা ফেলি,
.         অনন্ত বিদায় হোলো বৈশাখী বিকাল  |

.                        ( ৫ )

.         অন্তিমেতে  “দেব ছবি” * রাখি ভক্ত শিরে,
.                  সোহাগিনী সাধ্বি করে,
.                  রাখি কর প্রেমভরে,
.           অনন্ত নিদ্রায় ভোর হন্ ধীরে ধীরে |

.                        ( ৬ )

.          ফাল্গুনী বসন্ত রাতে বিবাহ খেলায়,
.                     বাসরে বসানু আনি,
.                     রাজেন্দ্র,  প্রমোদরাণী,
.          সুখ-রাতে মেতেছিনু পাপিয়ার প্রায় |

.                        ( ৭ )

.          নিদাঘ বৈশাখী দিবা অবসান প্রায়,
.                     প্রমোদী বিবাদী মরি,
.                     বৈধব্য --- সুবেশ হরি,
.          গলাগলি দুটী বোনে কাঁদি উভরায় |

.                        ( ৮ )

.           রাজেন্দ্রের বামে বালা ছিল রাজরাণী,
.                      হে দেব! কি দোষে ফেলে,
.                      দিল তব তপ্ত তেলে,
.            মধুময়ী এবে পুড়ে বিষাদী রুগিনী  |

.                        ( ৯ )

.           মাধবী ব্রততী এবে হ’য়েছে জঞ্জাল,
.                      মিষ্টি চোখে তেতো জল,
.                      এ অমিয়ে হলাহল,
.           মরীচিকা এ সংসার স্বরূপে মাকাল  |
                   
.                        ( ১০ )

.             সাধ্বী মধুময়ী ভগ্নী সঙ্গিনীটী হায়,
.                      প্রজ্জ্বলিত চিতে পতি,
.                     প্রজ্জ্বলিত চিত্তে সতী,
.             কি ব’লে, কি দিয়ে শান্ত করি সরলায় |

.                        ( ১১ )

.              উথলি এসনা সিন্ধু !  গ্রাসিতে সংসার,
.                     ভীম বলে এস বায়,
.                      উঠ মেঘ নভঃ প্রায়,
.               দাও সৃষ্টি রসাতলে এ সংসার ছার  |

.                        (১২ )

.              ঘুচে যাক মহামায়া এ খেলা তোমার,
.                 আসা যাওয়া হাসা কাঁদা,
.                  সুখ দুঃখ কাল সাদা,
.              কোলাহল হাটখানা হোক্ জলাকার |

.                        ( ১৩)

.             জননীর মর্ম্মভেদী নয়নের নিরে,
.                     মরম দহিয়ে যায়,
.                    মনে যেন হয হায়,
.             থাকিতে নারিবে ভ্রাতা, এল ঐ ফিরে |
                          
.                        (১৪ )

.             বাছনীর তপ্তধার অশান্তি অশেষ,
.                 মর্ম্মে বিঁধে করে সারা,
.                  আহা বালা পিতৃহারা,
.            কতদিন রব আর এ মর্ত্ত্য বিদেশ |

.                        ( ১৫ )

.             শোণিত সম্বন্ধ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার রোদনে,
.                    পাষাণ সে দ্রব হয়
.                   মানবেতে কত সয়,
.             হাহাকার পড়ে গেছে তোমার বিহনে |

.                        ( ১৬ )

.          ঐ যে তোমার আত্মা এসেছে ধরায়,
.                  ঐ যে চৌদিকে ছেয়ে,
.                   এসেছে এ ডাক পেয়ে,
.          ভক্তিভরে নমি ভ্রাত আজিকে তোমায় |

.                        ( ১৭ )

.           বিপদের ঘূর্ণিপাকে বাঁচালে আমায়,
.                   জ্ঞানগর্ভ উপদেশ ;
.                     ঠেকি ধৈর্য্যকূলে এসে,
.           না হলে এ মন তরী ভাসিত কোথায় !

.                        ( ১৮ )

.           পিতা, পুত্র, ভ্রাতা তুমি জানি পরীক্ষায়,
.                      পেয়েছি যে স্নেহরাশি,
.                    হয়নি, হবে না বাসি,
.           জাগিছে, জাগিয়া রবে চির এ হিয়ায় |

.                        ( ১৯ )

.           অবশ্য এসেছে ভ্রাত, এ ঘোর নিশায়,
.                   মনে লয় আছ চেয়ে,
.                   বড় মর্ম্ম ব্যাথা পেয়ে,
.           মুছিনু মুছিগো আঁখি, কাঁদিবনা হায় |

.                        ( ২০ )

.            বল বুদ্ধি হারায়েছি, হারায়ে তোমায়,
.                   হোলে প্রাণে ঘোর কষ্ট,
.                   কারে গো জানাব স্পষ্ট,
.            সংসার দহিল আরো হেন অভাগায় |

.                        (২১ )

.            এ অশ্রু মুছিতে আর নারিব জীবনে,
.                          গিয়াছ আপন ঘরে,
.                       যাব কতদিন পরে,
.            এ প্রবাস হতে ভ্রাত, নিজ নিকেতনে !

.                        ( ২২ )

.            অনশ্বর মধুতরু ভাবুক রসাল |
.                        নশ্বর তমালপতি,
.                   ফলে এ “প্রমোদী” লতি,
.            ভস্মীভূত চিরতরে সংসারী তমাল |
                              
.                        ( ২৩ )

.            বল্লরী  বাঁধিয়া লহ চরণে তোমার,
.                      ও মধুর পদাশ্রয়ে,
.                     শান্তি তৃপ্তি,সুখ, ত্রয়ে,
.            ঘুচাইয়ে দিবে তাঁর বৃথা হাহাকার |

.                        ( ২৪ )

.           এস মোর প্রাণারাম !  হৃদিদ্বার খুলে
.                    পরশি করুণা হাত,
.                   খুলিবে এ হৃদি নাথ,
      মৃত-সঞ্জীবনী সুধা ঢাল হৃদিমূলে  |
                      
.                        ( ২৫ )

.          এস ধর্ম্ম ভাই বোন মিলিয়া সবাই,
.                        “ রামকৃষ্ণ”  “হরি হরি”
.                     তোলো ধ্বনি কন্ঠভরি,
.          আজি প্রভু পদতলে সে রাজেন্দ্র ভাই |

.                     *************************                                                
সূচি    


মিলনসাগর
*
সীতাসতী
সুশীল মালতী
   

.                ( ১ )

প্রকৃতি গোধূলী সাজে মধুরতাময়,
.         বালেন্দু সন্ধ্যার ভালে উজলি উদয়,
ফুটিয়াছে তরুশাখে অশোকের ফুল,
.        সাঁজের সমীর বয় মধুর মৃদুল |

.                ( ২ )

প্রকৃতির কলবরে ধূসর বসন,
.         অধরে কুসুম হাসি নয়নরঞ্জন,
কূজিছে বিহগকুল কল কল স্বরে,
.        ফোটেনি তারকাগুলি এবে নভঃপরে |

.                ( ৩ )

গোলাপ মালতী-বাসে ভ্রমরা আকুল,
.        নাচায় মৃদুল বায়ে কুসুম মুকুল,
মানিনী কুমুদারাণী সরোবর পরে,
.        অধরে অমিয় হাসি মন মুগ্ধ করে |\


.                ( ৪ )

আশোক কানন কোলে বসি অধোমুখে,
.        সোণার কমল আজি কাঁদে মন দুঃখে,
ভাসিছে নলিন আঁখি মলিন বদন,
.         শিথিল কবরী তায় নাহিক যতন |


.                ( ৫ )

করে কুসুমের হার অধোমুখে বসি,
.         গ্রাসিয়াছে যেন রাহু শরতের শশী,
কাঁদিছে কাননে মাতা করে কুলহার,
.         “কোথা রঘুমণি, মালা গাঁথা হোল সার !


.                ( ৬ )

গাঁথিছে রজনী জয়ে নক্ষত্র রতনে,
.             পরারে বিধুরে সতী সোহাগে যতনে,
নভোপরে তারা-হারে রজনীরঞ্জন,
.              নিশির পরাণ-বঁধূ শোভিবে কেমন |


.                ( ৭ )

তুমিও গেঁথেছ রাণি !      কুসুমের হার,
.         দিতে রঘুমণি পায় বাসনা তোমার,
পরাণের  প্রীতি সতি !     নয়নের জল,
.          কুসুমে  কুসুমে  পড়ি করে ঢল ঢল  |

.                ( ৮ )

কোথা বা পরাণ পতি, কোথা তুমি সতী,
.        কাঁদিছ বিষাদে তাই বসি রূপবতী,
ইন্দিরবা, যত তব নয়নাশ্রু গলে,
.        ততই রাক্ষসকুল যায় রসাতলে  |

.                ( ৯ )

নিরখি মলিন লতা বিদরিছে বুক,
.          ভাসিছে নয়ন-নীরে তব পদ্মন-মুখ,
গোলকে রতনাসনে নারায়ণ বামে,
.          যাও সতি, ত্বরা চলি ছাড়ি ধরাধামে |


.                ( ১০ )

ঐ যে কুসুমহার রঘুমণি-পায়,
.             অনিলের সনে ধীরে শূন্যপতে ধায়,
সাধ্বী সতী পতিব্রতা সীতা সতী-সার,
.                ভক্তিভরে নমি কবি লইল বিদায় |


.                     *************************      
.                                                                        
সূচি    


মিলনসাগর
*
উন্মাদিনী
সুশীল মালতী

.                       ( ১ )

.   সখিরে, সে  শ্যামদন ভুলে গেছে রাধিকায়,
মৃদু সমীরণে মিশি,                         মাতায়িছে দশদিশি,
.   সোহাগে মধুরে বাঁশী ডাকেনা কিশোরী  আয়,
আর না ময়ূরী নাচে,                     অলি নাহি মধু যাচে,
.    আকুল লহরী তুলি যমুনা বহিয়া যায়,
নীরবে মলিন মুখে,                সারি শুক মন দুঃখে,
.     নিলাজ কোয়েলা বঁধূ কুহু কুহু কুহু গায় ;
.     কেমনে নিঠুর শ্যাম ভুলে গেল রাধিকায় |



.                      ( ২ )

.   সখিরে, সে শ্যামধন ভুলে গেছে রাধিকায়,
পাপিয়ার পিয়া পিয়া,              মরমে পশিছে গিয়া,
.   আকুল ব্যাকুল হিয়া মনে পড়ে শ্যামরায়,
কলঙ্ক পসরা লয়ে,            মুখে শ্যাম নাম কোরে,
.    শ্যাম-কলঙ্কিনী হয়ে যাব সখি মথুরায়,
দেখিব সে শ্যামধনে,          রত্নময় সিংহাসনে,
.   কুবুজাসুন্দরী বামে শ্যামধন কি শোভায়,
.   সখিরে, নিঠুর শ্যাম ভুলে গেছে রাধিকায় |



.                      ( ৩ )

.   সখিরে, নিঠুর শ্যাম ভুলে গেছে রাধিকায়,
গলে রতনের হার,             বনমালা নাহি আর,
.   শিখিপাখা ত্যেজে সখি, মুকুটে কি শোভা পায়,
নাহি সে মোহন বাঁশী,          গোপিকার প্রেম ফাঁসি,
.   সুমধুর তানে যার লাজ মান ভেসে যায়,
শ্যামকলঙ্কিনী রাধে,              শ্যাম শ্যাম বলি কাঁদে,
.   কলঙ্কে ডরায় সে কি শ্যাম যার হৃদে হায়------
.   কেমনে সে শ্যামধন ভুলে গেল রাধিকায় |



.                        ( ৪ )
    
.    সখিরে সে শ্যামধন ভুলে গেল রাধিকায়,
ষোড়শ গোপিকা সাথে,          হেরিব গোপিকানাথে,
.     গোপিকা বল্লভ বামে হেরিব সে কুবুজায় !
বাঁকার সে বাঁকা আঁখি,          তেমনিই আছে নাকি,
.     মধুর মধুর ভাবে কুবুজার পানে চায়,
বারেক নয়ন ভরি,               হেরিব প্রাণের হরি,
.     ডারিব এ ছার প্রাণ শ্যামের সে রাঙা পায়,
.      কেমনে ভুলেছে কালা পদাশ্রিত রাধিকায় |

.                     *************************      
.                                                                        
সূচি    


মিলনসাগর
*
শৈল দেশে তিন দিন
সুশীল মালতী
                  
.                ( ১ )

অস্ত যায় দিনমণি রক্তিম ছটায়,
.        চিকিমিকি ভাতিটুকু পল্লবে শোভন ;
ধূসর-বসনা সন্ধ্যা আসে পায় পায়,
.        সমুন্নত নত শৃঙ্গে নাচে ধেনুগণ |

.                ( ২ )

একটানা ঝর ঝরে সলিল পতন,
.        শ্যামের সুঠাম তরু নিস্তব্ধ নিচল ;
প্রকৃতি সুন্দরী যেন ধ্যানস্থ মগন,
.        ব্যাকুল সে স্মৃতি তুলি মরমের তল |


.                ( ৩ )

( ফিরি গৃহে )
সন্ধ্যাদীপে আলোকিত শোভিত মধুর,
.        পুরজন সুশোভিত আনন্দ আলয় ;
কোথা সে বিগত দিন প্রবাস সুদূর,
.        আজি কেন সে দিন গো এত মনে হয় |


.                ( ৪ )

( আর একদিন )
খর সূর্য্য জ্বলিতেছে মস্তক উপর,
.        নিজন বিজন দেশ নিস্তব্ধ মধুর ;
অদূরে উন্নত শির ধবল শেখর,
.        কি রাগিনী বাজে হৃদে তোলে কিবা সুর |


.                ( ৫ )

দূরে ছিল কুটিলতা মাখা এ সংসার,
.        শত বাধা টুটে ছিল বন্য জীব সম ;
সবুজ চাক্ষেত্রে নব শোভা চারি ধার,
.        স্বপন না সত্য, আজ ভ্রম হয় মম |

.                ( ৬ )

(টাইগার হিলে আর একদিন)
তৃষায় পূরিত দিবা মধ্যাহ্ন মধুর,
.        বিজন অরণ্য ঠাঁই, চরে মেষপাল ;
সঙ্গিগণ অগ্রগামী ছিল বহু দূর,
.        বন ফুল মিষ্ট হাসে কি সন্ধ্যা সকাল |
                   ( ৭ )

প্রকৃতির মধু হাসি নিজন কাননে,
.        বিমুগ্ধ মানস মন উধাও কেমন ;
আজ গৃহ-দুর্গে বসি পড়ে তাহা মনে,
.        বিশ্বরাজ !  ধরা তব মধুর মোহন |

.              *************************      
.                                                                        
সূচি    


মিলনসাগর
*
দুষ্ট বিজু
সুশীল মালতী

.                        ( ১ )

দুষ্টুমিতে সরেস বড়, নিত্তি জ্বালায় বিজু বাবু,
.           পড়তে গেলে কান্না আসে,
.           বই হারাবে মাসে মাসে,
এমন রোগের ওষুধ শুধু গরম গরম চাবুক-সাবু  |


.                        ( ২ )

বরণটী তার গিব্য কাল, গোল মুখেতে ছোট্ট চোক,
.             ধূলায় ধূসর পায়ে কাদা,
.             অনিয়মে রোগকে সাধা,
এমন ছেলের নিন্দে করে, জগৎ জুড়ে সর্ব্ব লোক |

.                        ( ৩ )

পোড়তে বসে পোড়তে পারে, বোঝায় ও তার দিব্য মাথা
          বই হাতে মন ঘুড়ির পরে,
           প্রাণটা শুধু নৃত্য করে,
লিখতে বোসে আন্ মনেতে, শতেক ভুলে ভরায় খাতা |

.                        ( ৪ )

এমন ছেলের আদর কোথা , সবাই করে আনাদর,
            বড় হয়ে কাঙ্গাল হবে,
            পথের ধারে পড়ে রবে,
মূর্খ বোলে ঘৃণা ভরে কেউ চাবে না মুখের পর |

.                        ( ৫ )

কৃপাময়ী ভারতি মা, নমি তোমার চরণ দুটি,
.                বিজুর মত ছেলের তরে,
.                কবি কেঁদে মানত করে,
পড়ার উপর মনটা পড়ুক, অলসতা যাউক ছুটি |

.                 *************************      
.                                                                        
সূচি    


মিলনসাগর
*
অমৃত-আলয়
সুশীল মালতী
(দক্ষিণেশ্বরে রাসমণির দেবালয় দর্শনে)

( ১ )

দগ্ধ ত্রিতাপতাপী  হে সংসারি,
এস এ অমৃত-আলয়ে,
( হেথা ) রাজে শান্তি, তৃপ্তি, সুখ, প্রেমানন্দ,
ভক্তি ও বৈরাগ্যের ছয়ে |
যথা ব্রজধাম শ্যামমূর্ত্তি বুকে,
বহিছে যমুনা কলধ্বনি মুখে,
ব্রজবাসীগণ আছে মনসুখে,
রাধাকৃষ্ণ জয় জয়ে-----
( হেথা ) “ তারিণী” “গঙ্গে”  ‘রামকৃষ্ণ প্রভু”
উজলিয়া আছে ত্রয়ে |

( ২ )
বিমলা জাহ্নবী তুলিয়া উজান,
মধুর  বহিয়া  যায়,
            চুম্বিয়া চারু অমৃত-আলয়
জলধির পানে ধায় |
গোলাপ মল্লিকা করবী টগর,
জবা বেলা যূঁই কুসুমের থর,
রাজ্ঞী প্রকৃতি সাজায়ে বাসর,
বিহ্বল সাধনায়-----
বিশ্বরাজন চৌদিকে  ভরি,
                     ( যেন ) ধরা দেন আপনায় |

( ৩ )

প্রকৃতির কোলে রতন-প্রদীপ,
মন্দির মনোহর,
কৌমুদী-প্লাবিত নভো মধ্যভাগে
শোভে যথা শশধর ;
          তট চুম্বিত জাহ্নবীর নীর,
          চুম্বিত তট মোহন-মন্দির
          দ্বাদশ মহেশ লিঙ্গশরীর,
               সারি সারি শোভাকার,
অমৃত-আলয় কালিকার বাড়ী,
                      নমি সে দক্ষিণেশ্বর |


( ৪ )

বিস্তৃত প্রাঙ্গণ চারিভিতে ঘেরি,
          মাঝে রাজে শ্রীমন্দির,
মন্দির মাঝারে নীল কাদম্বিনী,
               মধুরূপ তাপৃরিণীর ;
           রক্ত উত্পল চরণ কমল,
           রসনা ওষ্ঠ বান্ধুলির দল,
অলঙ্কারে দেবী মধুর উজ্জ্বল,
          মুকুটে শোভিত শির ;
লেখনিরে, তুই নারিবি ফোটাতে,
                   মধুরূপ জননীর |

( ৫ )

প্রস্তর-দেবী রজত পদ্মে
                    রজগিরি সংজ্ঞাহারা ;
উরলে নাচিছে ভ্রুকুটিহাসিনী,
                                       মুক্তকুন্তলা তারা |
নরশিরে শিরে কন্ঠে মালিকা,
অসি করে শ্যামা ক্ষুদ্র বালিকা,
রসনা চাপিয়া দশনে কালিকা
                        উন্মাদী উল্লাসী পারা,
ঊর্দ্ধমুখী শিরা দুভাগে লোলুপা
                       পিয়ার রুধির ধারা |


( ৬ )

কোমল কঠিনা মধুময়ী ভীমা
           মুরতি কি মনোহর,
ত্রিনয়ন-দীপ্তি, দানিতেছে তৃপ্তি,
                   মরি কি মধুরতর ;
( পদে ) মরেনি মহেশ ম়ৃত্যুঞ্জয় তাই,
           শৈলজে !  পরাণে বড় ব্যাথা পাই,
      পুনঃ মুখ হেরি সব ভুলে যাই,
                  পদ-শোভা দুঃখকর,
( বুঝি ) মুগ্ধ ধ্যেয়ানে ভোলানাথ মরি.
                                  ( ধরি ) চরণ উরস পর |


( ৭ )

প্রাঙ্গন মাঝারে হেথা হোথা মধু
         অমৃত-আলয় মরি,
অনন্ত  মাধুরী “শ্রীরাধামাধব”,
                      রাজিছে শ্রীরূপ ধরি |
গলে বনমালা তিলক শোভন,
           নবঘন শ্যাম মুরলীবদন,
ত্রিভঙ্গিমঠাম গোপিনীরঞ্জন,
                       আঁকা বাঁকা পদতরী------
 হে ভব-নাবিক !  তব সিন্ধুপারে,
                                 পদ্ তরী দিও হরি |


( ৮ )

প্রাঙ্গণ -বুকে শান্তিময় গেহে,
                 “রামকৃষ্ণ” প্রাণারাম,
দুভাগেতে দুটী সমযোগ্যমণি,
               “শ্রীরাম”  “নরেন্দ্র” “ ঠাম
            উপাধানে মধু মুগ্ধকরীরূপ,
প্রাণারাম প্রভু ধ্যানমগ্ন চুপ,
দীনবেশী নাথ ভক্তপ্রাণ ভূপ,
                               জপে ভক্ত মধূনাম |
            মধুময় নাথ, মধুময় প্রাণে,
                             রাজিলেন মধুনাম |


( ৯ )

ভকত চাতক তৃপ্তিসাধন,
                    “ রামকষ্ণ” প্রামার্ণব,
মধুময় স্থানে, মধুময় প্রাণে,
                                      মধুময় হোলো সব |
( যবে )  জাহ্নবীর ঘাটে আকুল ক্রন্দন,
( পরে )  মন্দির মাঝারে তারার পূজন,
     পঞ্চবটী বনে শ্যামার সাধন,
                                       মুখে “মা তারিণী”  রব,
( তুমি )  প্রেম অবতার, দয়ার্ণব নাথ,
                                              গোলকের শ্রীমাধব !


( ১০ )

মধু পঞ্চবটী শান্তির আলয়,
          পল্লবে অনিল বয়,
মুখরিত কভু বিহগের সুরে,
                          (কভু ) নিঝুম মধুময় |
শ্যামল-সুন্দর কি শোভা তরুর,
           শাখা প্রশাখার মূলেতে প্রচুর ,
ঢাকিয়া রেখেছে বেদীটি বিভুর,
           ভাবে ভরি সদা রয়
 জয় “মা তারিণী”  জয় “রামকৃষ্ণ”
“রাণী রাসমণি” জয় |

( ১১ )

বিল্বতরু তলে সাধনায় সিদ্ধি,
           মহাতীর্থ শোভামান,
শান্তি পবিত্রতা আবাহন ছায়ে,
             তোষে তরু তুষি প্রাণ
নির্ঝুম ঘোরা রজনীর কোলে,
সাধনায় প্রভু মধু মা মা বোনে,
বিশ্বজননীর প্রাণ গেল গোলে,
                   মহাতীর্থ দেবোদ্যানে---
মহালীলাস্থল নীরবে গাহিছে,
                          অতীত মধুর গান |


( ১২ )

শৈশব ঊষা, হারায়েছে কবি,
                  বাল্য প্রভাত গিয়েছে,
প্রখর মধ্যাহ্ন যৌবন দিবা,
                   গ্রাসিয়া বদন খেয়েছে,
প্রবল প্রতাপী ছয়টি কুলোক,
    আছে দেহে মোর ছটি ছিনে জোঁক,
মায়া বাসনায় ঢাকা দুটি চোক,
                     অলসতা মোরে পেয়েছে,
মন বীণে মোর চিরতরে বুঝি,
                                বিষাদ রাগিনী গেয়েছে |



( ১৩ )

অলসতা দাও ছোটায়ে আমার,
           দীপ্তি দাও মোর চোকে,
ধৈর্য্যশক্তি দাও হৃদয়ে আমার,
                খসাই ছয়টি জোঁকে |
সহি কত জ্বালা ভস্মীভূত প্রাণ,
জ্বলিতেছি নাথ পড়িয়া কুস্থান,
           এ সংসার-গেহ বিষের সমান,
                   ভেঙ্গেছে হৃদয় শোকে,
জ্বোলে পুড়ে নাথ, হোয়েছি উদাস,
                        শ্রীচরণে রাখ মোকে  |

.                 *************************      
.                                                                                            
সূচি    


মিলনসাগর
*
নারায়ণ
সুশীল মালতী

( ১ )

হৃদয় রতন সুন্দর,
কোথা হে আমার                শোভার আধার,
জগত-জীবন ঈশ্বর !
এস  প্রেমময়,                       উন্মুক্ত হৃদয়,
পূরাও আমার বাসনা,
আজি  মধুময় সাঁজে,             মরমের মাঝে,
জাগিছে আকুল কামনা |



( ২ )

আকুল জীবন,                         এস নারায়ণ,
জুড়াইব পদ-ছায়াতে,
তোমাময় ধরা,                       তব রূপে ভরা.
   তুমি প্রকাশ ওরূপ আমাতে |
অধম বলিয়ে,                        চরণে দলিয়ে,
 ফাঁকি দিয়ে মোরে পালাবে ?
তব মধু হাসি,                       কুসুমে প্রকাশি,
কোথা তুমি নাথ !   লুকাবে  ?


( ৩ )

নভঃপরে শোভে ,                প্রাণ মন লোভে,
সুমধুর   বিধুবদন,
তব কন্ঠ মরি,                         তটিনী লহরী,
জুড়াইয়ে দেয় শ্রবণ,
মধু রূপ রাশি,                     অরুণে বিকাশি,
আলোকিত করে ভুবনে,
মৃদু মধু বায়,                       আদর জানায়,
( তুমি  ) নিরদয় হবে কেমনি ?

( ৪ )

ঝুরু ঝুরু ঝুর,                       মরি কি মধুর,
কাঁপায় তরুর পল্লব,
তব হৃদিতল,                          ফুল পরিমল,
অনুমানি হৃ-দিবল্লভ |
এস হে আমার,                      হিয়ার মাঝার
 ( আমি ) জানিনা ভজন পূজন,
করণা-নয়নে,                         হের অভাজনে,
এস হৃদে হৃদিরঞ্জন |

.                 *************************      
.                                                                                            
সূচি    


মিলনসাগর
*
শ্মশান
সুশীল মালতী

( ১ )

জীব ! হওরে চেতন ;-----
লীলাশেষে লীন চারু কান্তি মনোহর
প্রজ্বলিত কাষ্ঠ-উপাধান চিতাপর,
অতীব আত্মীয় যেই, দহিবে অধর,
অনিত্য সাজান প’ড়ে রবে খেলাঘর,
বিষ্ণুঃবিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !

(২)

জীব হওরে চেতন ;----
“বল হরিবোল”  কি ভীষণ রবে,
শুষ্ক রসনায় ডাকে ভীমকন্ঠে সবে,
, স্বজনের স্কন্ধে উঠি চলে যাবে যবে,
এ শ্মশান-যাত্রা করি ফিরিল কে কবে ?
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ মনঃ নারায়ণ !

( ৩ )

জীব !  হওরে চেতন ;-----
অশ্রু উড়ে হয় হায় বিশুষ্ক নয়ন,
উদ্বেলিত নহে হিয়া, স্তম্ভিত কেমন,
অথবা অজ্ঞানে ফোটে প্রলাপ কখন,
জননীর কোলে যেথা মোরেছে নন্দন |
বিষ্ণুঃবিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !

( ৪ )
জীব !   হওরে চেতন ;----
নহে লজ্জাবতী লতা মধু সুষমায়,
উন্মাদিনী আত্মহারা অভাগিনী হায়,
যবে প্রিয়পতি লয় অনন্ত বিদায়,
দৃশ্য কি ভীষণ, ওহো ফোটেনা ভাষায় |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !



( ৫ )

জীব !   হওরে চেতন ;-----
অনিত্য এ ভব-ক্ষেত্রে ফসল করম,
ফলাও জীবন হালে পবিত্র ধরম্ ,
আসে যাবে মানবের জীবনের চরম্,
পূণ্য কাজ পুঁজী তার ঔষধী পরম্ |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ  !


(৬ )

জীব !    হওরে চেতন ;-----
মৃত্যু শুধু অজ্ঞ অন্ধ আঁখির ধারণা,
দেহ-ত্যাগে হয় নব দেহ সুরচনা,
মানবের পাপ মোহে শুধু আনাগোনা,
রসসিন্ধু সে রসিকে রস’না রস’না |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !



(৭ )

জীব !   হও রে চেতন ;-----
ধরাধরি হ’য়ে যাবে,  হবে চেনাচিনি,
অন্তর মাঝারে মম বিরাজিত যিনি,
জ্ঞানালোকে উদ্ভসিয়া ঊউঠিবেন তিনি,
ঐহিক আত্মায় লও পরমাত্মা কিনি |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !

( ৮ )
জীব !  হওরে চেতন ;----
অনিত্য সংসারে ডাক সত্যসনাতন,
ডাক’ ভরি কন্ঠ, ডাক মজাইয়ে মন,
      ডাকেতে উঠিবে টলি তাঁর সিংহাসন,
বদন ভরিয়ে বল জয় জনার্দ্দন !
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !


( ৯ )

জীব  !    হওরে চেতন ;-----
কুসুমিত লতিকার প্রণয়-বন্ধন,
হাসিমাখা মুখে খর রিপুর তাড়ন,
তার মাঝে থেকে স্মর ব্রহ্ম সনাতন,
গ্রাসিবে দারূণ কাল কি জানি কখন |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !


( ১০ )

জীব !   হওরে চেতন;-----
সুকুমার কুমারের স্নেহমাখা টান,
মায়ার সে দৃঢ় ফাঁস চাঁদমুখ খান,
চুমি মুখ হুঁসিয়ার, কর নাম গান,
কি জানি কখন কাল গ্রাসিবে সে প্রাণ |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !


( ১১ )

জীব !     হওরে চেতন ;-----
শিক্ষা দীক্ষা গুরু তুমি, হে মহাশ্মশান,
একরাশ ভস্ম হবে হেন দেহখান,
চিতাবুকে মিশে যাবে ছুটিলে পরাণ,
অনিত্য সংসারে সার বিভু গুণগান |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ !

( ১২ )

জীব !   হওরে চেতন ;------
হরিবোল গোবিন্দ, মাধব হরিবোল,
হরিবোল গায়ত্রী জপিয়ে সুধা তোল,
হরি হরি বোল মুখে, হরি হরি বোল,
হরিবোল সার বোল, আর সব ভোল |
বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ |

.      *************************      
.                                                                                            
সূচি    


মিলনসাগর
*
বাসনা
সুশীল মালতী

( ১ )

ভৈরবী জাহ্নবী ভাদ্রে ভীষণারূপিণী,
উচ্ছ্বসিত রাঙাজল,
যেন হাসি খল খল ,
সন্ সন্ সমীরণে নাচে উন্মাদিনী,
আমিও সাজিব গজে, অমনি যোগিনী |


( ২ )

পরিব গেরুয়া বাস,
প্রজ্জ্বলিত চিতাকাশ,
অকূলে ভাসাব তরী তাহে একাকিনী,
চপলা ভ্রূকুটি হাসে আমার যামিনী |


( ৩ )

শঙ্কা না রহিবে বুকে,
লজ্জা না রহিবে মুখে,
ভীষণে মিশিয়া হব ভীষণা রঙ্গিনী,
তরঙ্গে তরীর পর ভীমা উল্লাসিনী |


( ৪ )

ভূকম্পে বসুধা টলে,
তীরে তরু বজ্র জ্বলে,
তরীবুকে নাচে হিয়া, একাকী কামিনী,
উল্লাসে উছলে গঙ্গা দুকূলপ্লাবিনী |


(৫ )

উঠিবে তরীর পর,
কালান্তক বিষধর,
কলেবর জড়াইয়ে গর্জ্জে আমা জিনি,
গঙ্গাবক্ষে অমা-রাতে ভুজঙ্গ বন্দিনী |


( ৬ )

প্রচন্ড বহিবে ঝড়,
কড় কড় কড় কড়,
পড়ে পড়ে অগ্নিময় ভীষণ অশনি,
বুকে সর্প, টুপ করে ডুবিয়ে তরণী |


( ৭ )

বোসেছি এ যাত্রা করি,
মেলেনি সাধের “তরী”,
হরি হরি, এ বাসনা পোরে অভাগিনী,
কত দিবা এল গেল কত নিশিথিনী |


( ৮ )

এ মরতে এ ঙূলোকে,
কোথা কে তরাবে মোকে,
উদ্যোগ করিয়া দিবে , হব আহ্লাদিনী,
সবই তব ইচ্ছাধীন কালী কপালিনী |


.      *************************      
.                                                                                            
সূচি    


মিলনসাগর
*
ভবার্ণবে
সুশীল মালতী

( ১ )

আকুল বিষাদ ঘূর্ণিপাকে,
ডুবলো তারা মনতরী,
ত্রিনয়নী তিন চোকে চা,
বস্ না এসে কর্ণ ধরি |


( ২ )

পঞ্চ রিপুর মস্ লা দিয়ে,
তৈরি করা এ দেহ না,
ভাসিয়েছ এ ভবার্ণবে,
তরে যাব পেলে ও পা |

( ৩ )

পঞ্চভূতের তরী আমার,
মিশ্ বে কবে পঞ্চভূতে,
( তবে )  আসা ভাসা সার হবে কি ?
কল্লি কি মা শ্লৈলসুতে |


( ৪ )

ডাগর ভবের সাগর মাগো,
খরতর টান তুফানে,
লক্ষ্যটা মোর স্থির করা মা,
“ধ্রুবতারা”  তোমার পানে |


( ৫ )

তরঙ্গময় সাগর বেয়ে,
পড়্ বো গিয়ে ক্ষীরোদ হ্রদে,
দিবানিশি ভাস্ ব সুখে,
তোল্ তারিণি অভয় পদে |


( ৬ )

রাঙ্গা-কমল চরণ তোমার,
শম্ভুনাথের উরসরে,
দাও তারিণি !  “ রাঙ্গাকমল”
আমার মন মধুকরে |


( ৭ )

মনমাতানি,   মাতাও মানস,
মজাও মজি তোমার প্রেমে,
টান দে রাণি !    জ্ঞান-রজ্জুতে,
উঠি, যেন যাইনা নেমে |


( ৮ )

অট্টহাসি হেসে এস,
ত্রিনয়নী বরাভয়া,
জগৎমাতা ব্রহ্মময়ি !
জীবের প্রতি অসীম দয়া |


( ৯ )

লোলরসনা দিগাম্বরী,
মুন্ডমালা বিভূষিতা,
মহামায়া মা তারিণী,
ত্রিজগতের মনোনীতা |


( ১০ )

ভবার্ণবে ভেসে চলি----
মা গো, তুমি তোলো এসে,
অবিদ্যার এ অশ্রু মুছি,
প্রেমানন্দে উঠি হেসে |

.      *************************      
.                                                                                            
সূচি    


মিলনসাগর