কবি সুশীল মালতীর কবিতা |
অমৃত-আলয় সুশীল মালতী (দক্ষিণেশ্বরে রাসমণির দেবালয় দর্শনে) ( ১ ) দগ্ধ ত্রিতাপতাপী হে সংসারি, এস এ অমৃত-আলয়ে, ( হেথা ) রাজে শান্তি, তৃপ্তি, সুখ, প্রেমানন্দ, ভক্তি ও বৈরাগ্যের ছয়ে | যথা ব্রজধাম শ্যামমূর্ত্তি বুকে, বহিছে যমুনা কলধ্বনি মুখে, ব্রজবাসীগণ আছে মনসুখে, রাধাকৃষ্ণ জয় জয়ে----- ( হেথা ) “ তারিণী” “গঙ্গে” ‘রামকৃষ্ণ প্রভু” উজলিয়া আছে ত্রয়ে | ( ২ ) বিমলা জাহ্নবী তুলিয়া উজান, মধুর বহিয়া যায়, চুম্বিয়া চারু অমৃত-আলয় জলধির পানে ধায় | গোলাপ মল্লিকা করবী টগর, জবা বেলা যূঁই কুসুমের থর, রাজ্ঞী প্রকৃতি সাজায়ে বাসর, বিহ্বল সাধনায়----- বিশ্বরাজন চৌদিকে ভরি, ( যেন ) ধরা দেন আপনায় | ( ৩ ) প্রকৃতির কোলে রতন-প্রদীপ, মন্দির মনোহর, কৌমুদী-প্লাবিত নভো মধ্যভাগে শোভে যথা শশধর ; তট চুম্বিত জাহ্নবীর নীর, চুম্বিত তট মোহন-মন্দির দ্বাদশ মহেশ লিঙ্গশরীর, সারি সারি শোভাকার, অমৃত-আলয় কালিকার বাড়ী, নমি সে দক্ষিণেশ্বর | ( ৪ ) বিস্তৃত প্রাঙ্গণ চারিভিতে ঘেরি, মাঝে রাজে শ্রীমন্দির, মন্দির মাঝারে নীল কাদম্বিনী, মধুরূপ তাপৃরিণীর ; রক্ত উত্পল চরণ কমল, রসনা ওষ্ঠ বান্ধুলির দল, অলঙ্কারে দেবী মধুর উজ্জ্বল, মুকুটে শোভিত শির ; লেখনিরে, তুই নারিবি ফোটাতে, মধুরূপ জননীর | ( ৫ ) প্রস্তর-দেবী রজত পদ্মে রজগিরি সংজ্ঞাহারা ; উরলে নাচিছে ভ্রুকুটিহাসিনী, মুক্তকুন্তলা তারা | নরশিরে শিরে কন্ঠে মালিকা, অসি করে শ্যামা ক্ষুদ্র বালিকা, রসনা চাপিয়া দশনে কালিকা উন্মাদী উল্লাসী পারা, ঊর্দ্ধমুখী শিরা দুভাগে লোলুপা পিয়ার রুধির ধারা | ( ৬ ) কোমল কঠিনা মধুময়ী ভীমা মুরতি কি মনোহর, ত্রিনয়ন-দীপ্তি, দানিতেছে তৃপ্তি, মরি কি মধুরতর ; ( পদে ) মরেনি মহেশ ম়ৃত্যুঞ্জয় তাই, শৈলজে ! পরাণে বড় ব্যাথা পাই, পুনঃ মুখ হেরি সব ভুলে যাই, পদ-শোভা দুঃখকর, ( বুঝি ) মুগ্ধ ধ্যেয়ানে ভোলানাথ মরি. ( ধরি ) চরণ উরস পর | ( ৭ ) প্রাঙ্গন মাঝারে হেথা হোথা মধু অমৃত-আলয় মরি, অনন্ত মাধুরী “শ্রীরাধামাধব”, রাজিছে শ্রীরূপ ধরি | গলে বনমালা তিলক শোভন, নবঘন শ্যাম মুরলীবদন, ত্রিভঙ্গিমঠাম গোপিনীরঞ্জন, আঁকা বাঁকা পদতরী------ হে ভব-নাবিক ! তব সিন্ধুপারে, পদ্ তরী দিও হরি | ( ৮ ) প্রাঙ্গণ -বুকে শান্তিময় গেহে, “রামকৃষ্ণ” প্রাণারাম, দুভাগেতে দুটী সমযোগ্যমণি, “শ্রীরাম” “নরেন্দ্র” “ ঠাম উপাধানে মধু মুগ্ধকরীরূপ, প্রাণারাম প্রভু ধ্যানমগ্ন চুপ, দীনবেশী নাথ ভক্তপ্রাণ ভূপ, জপে ভক্ত মধূনাম | মধুময় নাথ, মধুময় প্রাণে, রাজিলেন মধুনাম | ( ৯ ) ভকত চাতক তৃপ্তিসাধন, “ রামকষ্ণ” প্রামার্ণব, মধুময় স্থানে, মধুময় প্রাণে, মধুময় হোলো সব | ( যবে ) জাহ্নবীর ঘাটে আকুল ক্রন্দন, ( পরে ) মন্দির মাঝারে তারার পূজন, পঞ্চবটী বনে শ্যামার সাধন, মুখে “মা তারিণী” রব, ( তুমি ) প্রেম অবতার, দয়ার্ণব নাথ, গোলকের শ্রীমাধব ! ( ১০ ) মধু পঞ্চবটী শান্তির আলয়, পল্লবে অনিল বয়, মুখরিত কভু বিহগের সুরে, (কভু ) নিঝুম মধুময় | শ্যামল-সুন্দর কি শোভা তরুর, শাখা প্রশাখার মূলেতে প্রচুর , ঢাকিয়া রেখেছে বেদীটি বিভুর, ভাবে ভরি সদা রয় জয় “মা তারিণী” জয় “রামকৃষ্ণ” “রাণী রাসমণি” জয় | ( ১১ ) বিল্বতরু তলে সাধনায় সিদ্ধি, মহাতীর্থ শোভামান, শান্তি পবিত্রতা আবাহন ছায়ে, তোষে তরু তুষি প্রাণ নির্ঝুম ঘোরা রজনীর কোলে, সাধনায় প্রভু মধু মা মা বোনে, বিশ্বজননীর প্রাণ গেল গোলে, মহাতীর্থ দেবোদ্যানে--- মহালীলাস্থল নীরবে গাহিছে, অতীত মধুর গান | ( ১২ ) শৈশব ঊষা, হারায়েছে কবি, বাল্য প্রভাত গিয়েছে, প্রখর মধ্যাহ্ন যৌবন দিবা, গ্রাসিয়া বদন খেয়েছে, প্রবল প্রতাপী ছয়টি কুলোক, আছে দেহে মোর ছটি ছিনে জোঁক, মায়া বাসনায় ঢাকা দুটি চোক, অলসতা মোরে পেয়েছে, মন বীণে মোর চিরতরে বুঝি, বিষাদ রাগিনী গেয়েছে | ( ১৩ ) অলসতা দাও ছোটায়ে আমার, দীপ্তি দাও মোর চোকে, ধৈর্য্যশক্তি দাও হৃদয়ে আমার, খসাই ছয়টি জোঁকে | সহি কত জ্বালা ভস্মীভূত প্রাণ, জ্বলিতেছি নাথ পড়িয়া কুস্থান, এ সংসার-গেহ বিষের সমান, ভেঙ্গেছে হৃদয় শোকে, জ্বোলে পুড়ে নাথ, হোয়েছি উদাস, শ্রীচরণে রাখ মোকে | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |
নারায়ণ সুশীল মালতী ( ১ ) হৃদয় রতন সুন্দর, কোথা হে আমার শোভার আধার, জগত-জীবন ঈশ্বর ! এস প্রেমময়, উন্মুক্ত হৃদয়, পূরাও আমার বাসনা, আজি মধুময় সাঁজে, মরমের মাঝে, জাগিছে আকুল কামনা | ( ২ ) আকুল জীবন, এস নারায়ণ, জুড়াইব পদ-ছায়াতে, তোমাময় ধরা, তব রূপে ভরা. তুমি প্রকাশ ওরূপ আমাতে | অধম বলিয়ে, চরণে দলিয়ে, ফাঁকি দিয়ে মোরে পালাবে ? তব মধু হাসি, কুসুমে প্রকাশি, কোথা তুমি নাথ ! লুকাবে ? ( ৩ ) নভঃপরে শোভে , প্রাণ মন লোভে, সুমধুর বিধুবদন, তব কন্ঠ মরি, তটিনী লহরী, জুড়াইয়ে দেয় শ্রবণ, মধু রূপ রাশি, অরুণে বিকাশি, আলোকিত করে ভুবনে, মৃদু মধু বায়, আদর জানায়, ( তুমি ) নিরদয় হবে কেমনি ? ( ৪ ) ঝুরু ঝুরু ঝুর, মরি কি মধুর, কাঁপায় তরুর পল্লব, তব হৃদিতল, ফুল পরিমল, অনুমানি হৃ-দিবল্লভ | এস হে আমার, হিয়ার মাঝার ( আমি ) জানিনা ভজন পূজন, করণা-নয়নে, হের অভাজনে, এস হৃদে হৃদিরঞ্জন | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |
শ্মশান সুশীল মালতী ( ১ ) জীব ! হওরে চেতন ;----- লীলাশেষে লীন চারু কান্তি মনোহর প্রজ্বলিত কাষ্ঠ-উপাধান চিতাপর, অতীব আত্মীয় যেই, দহিবে অধর, অনিত্য সাজান প’ড়ে রবে খেলাঘর, বিষ্ণুঃবিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! (২) জীব হওরে চেতন ;---- “বল হরিবোল” কি ভীষণ রবে, শুষ্ক রসনায় ডাকে ভীমকন্ঠে সবে, , স্বজনের স্কন্ধে উঠি চলে যাবে যবে, এ শ্মশান-যাত্রা করি ফিরিল কে কবে ? বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ মনঃ নারায়ণ ! ( ৩ ) জীব ! হওরে চেতন ;----- অশ্রু উড়ে হয় হায় বিশুষ্ক নয়ন, উদ্বেলিত নহে হিয়া, স্তম্ভিত কেমন, অথবা অজ্ঞানে ফোটে প্রলাপ কখন, জননীর কোলে যেথা মোরেছে নন্দন | বিষ্ণুঃবিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! ( ৪ ) জীব ! হওরে চেতন ;---- নহে লজ্জাবতী লতা মধু সুষমায়, উন্মাদিনী আত্মহারা অভাগিনী হায়, যবে প্রিয়পতি লয় অনন্ত বিদায়, দৃশ্য কি ভীষণ, ওহো ফোটেনা ভাষায় | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! ( ৫ ) জীব ! হওরে চেতন ;----- অনিত্য এ ভব-ক্ষেত্রে ফসল করম, ফলাও জীবন হালে পবিত্র ধরম্ , আসে যাবে মানবের জীবনের চরম্, পূণ্য কাজ পুঁজী তার ঔষধী পরম্ | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! (৬ ) জীব ! হওরে চেতন ;----- মৃত্যু শুধু অজ্ঞ অন্ধ আঁখির ধারণা, দেহ-ত্যাগে হয় নব দেহ সুরচনা, মানবের পাপ মোহে শুধু আনাগোনা, রসসিন্ধু সে রসিকে রস’না রস’না | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! (৭ ) জীব ! হও রে চেতন ;----- ধরাধরি হ’য়ে যাবে, হবে চেনাচিনি, অন্তর মাঝারে মম বিরাজিত যিনি, জ্ঞানালোকে উদ্ভসিয়া ঊউঠিবেন তিনি, ঐহিক আত্মায় লও পরমাত্মা কিনি | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! ( ৮ ) জীব ! হওরে চেতন ;---- অনিত্য সংসারে ডাক সত্যসনাতন, ডাক’ ভরি কন্ঠ, ডাক মজাইয়ে মন, ডাকেতে উঠিবে টলি তাঁর সিংহাসন, বদন ভরিয়ে বল জয় জনার্দ্দন ! বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! ( ৯ ) জীব ! হওরে চেতন ;----- কুসুমিত লতিকার প্রণয়-বন্ধন, হাসিমাখা মুখে খর রিপুর তাড়ন, তার মাঝে থেকে স্মর ব্রহ্ম সনাতন, গ্রাসিবে দারূণ কাল কি জানি কখন | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! ( ১০ ) জীব ! হওরে চেতন;----- সুকুমার কুমারের স্নেহমাখা টান, মায়ার সে দৃঢ় ফাঁস চাঁদমুখ খান, চুমি মুখ হুঁসিয়ার, কর নাম গান, কি জানি কখন কাল গ্রাসিবে সে প্রাণ | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! ( ১১ ) জীব ! হওরে চেতন ;----- শিক্ষা দীক্ষা গুরু তুমি, হে মহাশ্মশান, একরাশ ভস্ম হবে হেন দেহখান, চিতাবুকে মিশে যাবে ছুটিলে পরাণ, অনিত্য সংসারে সার বিভু গুণগান | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ ! ( ১২ ) জীব ! হওরে চেতন ;------ হরিবোল গোবিন্দ, মাধব হরিবোল, হরিবোল গায়ত্রী জপিয়ে সুধা তোল, হরি হরি বোল মুখে, হরি হরি বোল, হরিবোল সার বোল, আর সব ভোল | বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ নমঃ নারায়ণ | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |
বাসনা সুশীল মালতী ( ১ ) ভৈরবী জাহ্নবী ভাদ্রে ভীষণারূপিণী, উচ্ছ্বসিত রাঙাজল, যেন হাসি খল খল , সন্ সন্ সমীরণে নাচে উন্মাদিনী, আমিও সাজিব গজে, অমনি যোগিনী | ( ২ ) পরিব গেরুয়া বাস, প্রজ্জ্বলিত চিতাকাশ, অকূলে ভাসাব তরী তাহে একাকিনী, চপলা ভ্রূকুটি হাসে আমার যামিনী | ( ৩ ) শঙ্কা না রহিবে বুকে, লজ্জা না রহিবে মুখে, ভীষণে মিশিয়া হব ভীষণা রঙ্গিনী, তরঙ্গে তরীর পর ভীমা উল্লাসিনী | ( ৪ ) ভূকম্পে বসুধা টলে, তীরে তরু বজ্র জ্বলে, তরীবুকে নাচে হিয়া, একাকী কামিনী, উল্লাসে উছলে গঙ্গা দুকূলপ্লাবিনী | (৫ ) উঠিবে তরীর পর, কালান্তক বিষধর, কলেবর জড়াইয়ে গর্জ্জে আমা জিনি, গঙ্গাবক্ষে অমা-রাতে ভুজঙ্গ বন্দিনী | ( ৬ ) প্রচন্ড বহিবে ঝড়, কড় কড় কড় কড়, পড়ে পড়ে অগ্নিময় ভীষণ অশনি, বুকে সর্প, টুপ করে ডুবিয়ে তরণী | ( ৭ ) বোসেছি এ যাত্রা করি, মেলেনি সাধের “তরী”, হরি হরি, এ বাসনা পোরে অভাগিনী, কত দিবা এল গেল কত নিশিথিনী | ( ৮ ) এ মরতে এ ঙূলোকে, কোথা কে তরাবে মোকে, উদ্যোগ করিয়া দিবে , হব আহ্লাদিনী, সবই তব ইচ্ছাধীন কালী কপালিনী | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |
ভবার্ণবে সুশীল মালতী ( ১ ) আকুল বিষাদ ঘূর্ণিপাকে, ডুবলো তারা মনতরী, ত্রিনয়নী তিন চোকে চা, বস্ না এসে কর্ণ ধরি | ( ২ ) পঞ্চ রিপুর মস্ লা দিয়ে, তৈরি করা এ দেহ না, ভাসিয়েছ এ ভবার্ণবে, তরে যাব পেলে ও পা | ( ৩ ) পঞ্চভূতের তরী আমার, মিশ্ বে কবে পঞ্চভূতে, ( তবে ) আসা ভাসা সার হবে কি ? কল্লি কি মা শ্লৈলসুতে | ( ৪ ) ডাগর ভবের সাগর মাগো, খরতর টান তুফানে, লক্ষ্যটা মোর স্থির করা মা, “ধ্রুবতারা” তোমার পানে | ( ৫ ) তরঙ্গময় সাগর বেয়ে, পড়্ বো গিয়ে ক্ষীরোদ হ্রদে, দিবানিশি ভাস্ ব সুখে, তোল্ তারিণি অভয় পদে | ( ৬ ) রাঙ্গা-কমল চরণ তোমার, শম্ভুনাথের উরসরে, দাও তারিণি ! “ রাঙ্গাকমল” আমার মন মধুকরে | ( ৭ ) মনমাতানি, মাতাও মানস, মজাও মজি তোমার প্রেমে, টান দে রাণি ! জ্ঞান-রজ্জুতে, উঠি, যেন যাইনা নেমে | ( ৮ ) অট্টহাসি হেসে এস, ত্রিনয়নী বরাভয়া, জগৎমাতা ব্রহ্মময়ি ! জীবের প্রতি অসীম দয়া | ( ৯ ) লোলরসনা দিগাম্বরী, মুন্ডমালা বিভূষিতা, মহামায়া মা তারিণী, ত্রিজগতের মনোনীতা | ( ১০ ) ভবার্ণবে ভেসে চলি---- মা গো, তুমি তোলো এসে, অবিদ্যার এ অশ্রু মুছি, প্রেমানন্দে উঠি হেসে | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |