ঘুম ভাঙ্গা এক রাত শান্ত কুকুরের পাল জরত্গ্রব ভাবনা ঘুমোনো জাগার মাঝখান দুই আমার স্থিরতা , না ফুরোনো সামনের রাজ পথ চলেছে না-ভাঙ্গা এক জীবন গ্রন্থী |
আমি কি থেমেছি কোথাও, ভাঙ্গা আয়নায় আমি আমি আমি ছেঁড়া ইতিহাসের পাতা প্রবাহমান ঘটনার স্রোত লাটাইয়ের অফুরান সুতো আকাশ ছোয়া ঘুড়ির স্পর্ধা | সুখ দুঃখ স্বপ্ন একাকার জীবন জীবনের মাঝে ছোঁয়া | খুঁজে ফেরা সপ্তলোকের ঠিকানা, শান্ত,শুদ্ধ অজর অমর আমি মৃত,আমি জীবিত |
যেমন একটি গ্রাম হয়--সারি সারি সাজানো ঘর ক'বিঘা জমি নিয়ে পড়ে ছিল ওরা | ছায়াঘন শান্ত নীড়,বংশপরমপরায় জীবন চলেছিল জীবনের মত | একদিন এলো অভিশপ্ত সময়--রাজনীতির খেপা ঝড়ে ক্ষিপ্ত হলো পাগলের দল | একান্ত যে ঘর ছিল,নিগরানো বুকের রক্তে বাঁধা ঘর, বিদ্ধস্ত হলো ,পায়ের তলে মাড়িয়ে গেল অসংখ্যা রাত্রির ছায়া | অরাজক সাম্রাজ্যে--শীথিল স্বাধীনতার স্বৈরাচারিতা ধ্বংশের পায়ে পায়ে নিয়ে এলো বিভত্সতা, অন্তিম অস্শীলতাকেও লজ্জা দিযে গেল সীতা সতী সাবিত্রীর দেহ নিয়ে খেলেছে ছিনিমিনি বর্বর খেলা, লিপ্সিত রাত্রি তাই কুঁড়ে কুঁড়ে কাঁদে ছিল | রচেছে অলিখিত ইতিহাস,নিজেরই কুল ভাঙ্গা তামাশায় মেতে উঠে ছিল সর্বনাশা কীর্তিনাশা | রাস্তায় সারি সারি মৃত দেহ,অপরিচিত মৃতের মিছিল-- গলা পচা মাটির শেষ যাত্রার লিপটে থাকা ছেটানো সিন্দুরে | রক্তে ডাকে বান | বাঁচার তাগিতে ছুটে গেল ওরা ধুলায় লুটানো থাকে নিজেরই শরীর ছেঁড়া রক্ত স্নেহ,প্রেম, প্রীতির মৃত্যুর ইতিহাস বারবার লাজে ঢেকেছে নত মুখ-- কলুষিত হোয়েছে জীবন | ঘাম ভাঙ্গা সেই ফসলের খেত ধরে, লালীম উষরতা বেয়ে নদী নেমেছিল ঢালে আমাদের কাছে সে ছিল অভিশপ্ত বাংলা |
(২) . দন্ডক বন
নিস্ব সন্তানেরা উঠে আসে পশ্চিমের শিবিরে | মন্বনতরের নিস্বহায় লোকেদের মাথা পায় এক ছত্র ছায়া-- ফেলে আসার যন্ত্রনা,মাথা গোঁজার তাগিতে হলো তারা আরন্যর পুনর্বাসী. সরকারী ছত্র হলো দন্ডক অরন্য ঝাপরানো বনের আনাচে কানাচে ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকারে গড়ে ওঠে সে অস্বিকৃতের গ্রাম | তুলকালাম চলে জীবন সংঘর্ষ-- ভাঙ্গা মন জুড়তে হবে যে আবার অলক্ষ্যে রক্ত ঝরা মন ও দেহ দুঃস্বপ্নের চাপ চাপ কালো রুধির ছিন্ন স্বত্তার ভয়ঙ্কর স্বপ্ন ভূমির উপর আবার চলে নাঙল, চলে কাঙালের কঠোর সংগ্রাম অনুর্বর জমির পিঞ্জরে চলে নিস্ফল মেহনতি লোহার ঝনঝনি ঝড়ে যাওয়া ধানের পৃষ্ঠে-- একদিন পরিশ্রম ফুটে ওঠে মাঠে মাঠে অরণ্যের অন্ধকার চিরে ভোরের ঝকমকি রুপোর আলোয় আবার সোনালী ধানের খেত দোলালো হাওয়া বিচ্যুরিত জীবনের আলোকে অরণ্যের আশ্রয় তবু ভালো লাগে হিংস্র মানুষের বর্বরতা থেকে অনেক সরল এই গাছেদের সখ্যতা স্বপ্নীল নীল আকাশ মাথা তুলে উঁকি মারে নতুন অতিথীদের জানায় স্বাগত | ছোট নদী ,ঝর্ণা,পাহাড় ও দ্বীপ পরিচয় নিয়ে আসে ছুটে ছন্ন ছাড়া মানুষেরা মথা গোঁজে মাটি বাঁধা ঘরে বিছায় গোবরে প্রলেপ মাখা উঠোন ঘরের নতুন বৌ,ঘোমটার নিছে আবার হাসতে শেখে মেঘ ভাঙ্গা গানে আবার বৃষ্টি নাবে খরা ফাটা পাথরে বনে মাটির ফসল, ভেসে আসে প্রবাসী পাখীর দল জন্মের মৃত্তিকায় বাঁচার তাগিদে হতাশ জীবনে আবার নামে সবুজ বৃষ্টি-- ঝিলিমিলি হলুদ বসন্তে নামে জ্যোতস্নার সমুদ্রে ভাসা গোটা এক চাঁদ | জাগরিত দন্ডকবন প্রকৃতির কোলে বাঁধে ধুসর গোধুলি রং গোচারণ রাখালের হাতে বাজে বাঁশি-- কোনো ছোট্ট রাধিকা খুঁজে পাবে বনবাসী কৃষ্ণকে |
দেখো সেই গ্রামটিকে মনের আঙ্গিনা বেয়ে অনেক দূর তো এলে, একবার ফিরে দেখো সেই গ্রামটিকে-- দীঘির ঘাটলায় সে মেয়েটা সাজিয়ে নিয়েছে এঁট বাসনের পাঁজা, সেই ধীর পায়ে পা পা চলে যাওয়া ছেলেটা বার বার ঘুরে দেখে মেয়েটার দিকে-- মেয়েটা মুখ টিপে হাসে | পান খেয়ে ঠোঁট রাঙ্গা নতুন বৌ তোমার হাতে দেয় সাজা পান, রাঙ্গা মুখের ইশত খোলা দাঁতের হাসিতে ভালোলাগা ভরা ছিল |
হলুদ ধান খেত হাওয়ার হুল্লোরে মাতে, মাঠের আল বেয়ে সহস্র পথ মিশে গেছে গ্রাম গঞ্জ সহরে, সোনালী সর্ষে ফুলের বাগানে সকালের সূর্য নাবে, মাচানে লমলমে লতানো ডগায় ঝোলে লাউ কুমড়োর সারি, হাঁসেরা সাঁতার কাটে নদী পুকুরের স্বচ্ছ জল কেটে, লেংটো ছেলেরা ঝাপায় নদীতে, সকালের জাল বাঁধে রুপালি মাছ, নেড়া বেল তলার মাঠে খেলা করে ছেলেদের দল, পাশে পটে আজও আছে জরা জীর্ণ সে মন্দির, সন্ধ্যের গোধুলি ধুলোয় ধুলো মাখা রাখালের দল, ছাগ ও গাভী চড়িয়ে ফেরে ঘর | কাঁথায় জড়িয়ে শরীর নাতি নাতনি শোনে দিদিমার গল্প |
কখনো দমকা হাওয়া ঘরের খুঁটি নাড়ে. কালবৈশাখীর ঝড়ে ওড়ে চাল, চৈত্রের খরায় মাটি ফাটে-- আবার বর্ষা আসে,মাটির গন্ধে মাখে আম্রমুকুল. দুমুঠো খেয়ে তাও স্বপ্ন দেখে গরীব, নাক টেনে নেয় খোলা বাতাসের সজীবতা. রাতের অশরীরী নাচে অন্ধকার বাঁশ বনে ভয়ের রোমাঞ্চে আবার নতুন ভোর জাগে |
খেলা করে শিশুরা, সে ছেলেটা পা টিপে পার হয় পুকুরের ধার, সে মেয়ে,বৌ এক পাঁজা বাসনের মাঝে পান খাওয়া লাল মুখ-- মায়া ভরা গ্রামের কথা খুব মনে পড়ে.
আজকাল কিছুই লাগে না আমার বিছানায় কুঁকিয়ে ওঠা বৌয়ের যন্ত্রনার শরীর ছেড়ে রেখে পয়সা গুনি ঝন ঝনাত | সানাই ছুরি, কারণ আগামী কুরুক্ষেত্রের অংশীদার আমিও, নিজেকে তৈরী করতে বুক বাঁধি পাথরে-- আমাদের বাঁচতে হলে প্রয়োজন হবে অনেক সংহার II
আমায় ভাবতে দাও নি, তাই ভাবতে পারিনি | আমায় চিনতে দাও নি, তাই ভলো মন্দ চিনতে পারিনি. আমায় পেট ভরে খেতে দাও নি, তাই এ অপুষ্ট শরীর আমাদের ! আমাদের করেছ অত্যাচার, তাই অত্যাচারে হয়েছি জর্জরিত |
কিন্তু সব কিছুরই তো একটা সীমা আছে, তার বাইরেই ঘটে বিস্ফোট. যখন বাঁচা না বাঁচা এক হোয়ে যায়, তখন বাঁচার জন্য যে শেষ কামড় দেব জানি তা তোমরা সহ্য করতে পারবে না. সে সম্মিলিত সহ্যআতীত ফেটে পড়ার জন্য আগামী দিনের অপেক্ষায় দিন গুনছি আমরা II
. ****************** (রচনা কাল ও স্থান :২১.০৭.১৯৯১ ,জবলপুর.)
এখন অস্থিরতা কম. এখন নিশ্চিন্ত সন্ধ্যায় রান্নার ছ্যাঁত শব্দের প্রখরতা, তুলট শরীরের অবসাদ প্রতিদিন অমাবশ্যা রাতে ম্যাজ ম্যাজ হাঁটুর ব্যথাটা অনুভব করতে পারি | স্পস্ট জন্ম ও বৃদ্ধির নিয়মটা চোখে পড়ে. কখনো আমি ভালো আছি, একাকার আমি, সুখের মাঠটা আকাশের বয়সটা,পৃথিবীর আয়ুটা ধরতে পারি, হঠাত সরে যাওয়া বিপর্যয় শুন্যে পাকা ধান,ফসলের খেত,জলদ পুকুর তীর পলাতক ঘন্টার শিকল আর আমি অতীত পাখীর মত সরে আসি পশ্চাত, ছায়া কাঠি ছেড়ে নদী বন ও পর্বতের উত্তর চূড়া ছেড়ে নীলাঞ্জনার তীর,ছায়া বট ও পাকুর কন্দের পার-- যেখানে নীল ছায়া,বিকেল কুয়াশা একাকার তোমাদের হাত পা মুখ ভাঁজ করা পুরনো ইতিহাস সিন্ধুর স্রোতে ...ভেসে ভেসে... থেমেছে সেই গ্রন্থী ও মালায় দ্বীপ | সবুজ মাটির শরীরে আমার ইচ্ছার আবিষ্কার কখনো শেষ হবে না II
সিঁদুর কুঠরি থেকে গভীর রাতে তন্দ্রা জড়ানো কন্ঠে মাতালের গলা শুনে ভয়ে কাঠ হওয়া বৌটা সকালের ধুপদুস্তর দেহ দেখে আশ্বস্ত হয়, মনে হয় পরখ করে সে দেখে সেই তেলতেলে শরীরের শুদ্ধতা | আছে সব সান্ত্বনার-- সাজের কৌটো খুলে ছোট্ট আয়নাতে করে পরখ, আছে সব ঠিক ঠাক | অন্তত ওই আয়না কুঠরিতে বাঁধা আছে একজন-- যে জীবনের হাসি কান্নার চিরসাথী হোয়ে থাকবে |
মাঝে মাঝে প্রচন্ড ধিক্কারে যখন জ্বলে ওঠে ওর মাথা বুক পিঠ, প্রত্যুষের চিকচিকে মেলে ধরা রোদে সিঁদুর কুঠরি থেকে বলে ওঠে -- ঠিক,সব ঠিক ঠিক ঠিক II
নিজেকে খুঁজি শরীর নামক খোলশটায় কেমন চুপি সারে বসে থাকি, আশ্চর্য় লাগে খুব, আয়নায় শতবার নিজের দেখা মুখটাকেই অপরিচিত মনে হয | হাজার ছবির মাঝ থেকে নিজেকে খুঁজে পাবই, জোর করে বলতে পারি কোই! নিজেকে নিজের খুঁজে না পাবার দৈনতা মনকে বড় বেশী পীড়া দেয় II
দুরে দেখি সবুজ একখন্ড ঘাসের চপলা, ভাবি মাথার নিচে আছে কমল বালিশের ভাবনা. সত্য গিয়ে টিকে থাকে কাঁচা সবুজ ঘাসের আঁটিতে | মায়ের কোমল হৃদয়ে ঠেকে ভাঁজ করা পবিত্রতার শেষ চিহ্ন | লুপ্ত প্রায় দাহ্য পদার্থে অক্লেশে জ্বলে যায় ইঁট পাথর চুনা অবশিস্ট খুঁজে পাই কুন্ডলিত শুদ্ধ্ সোনার কণা | অবশেষ বুকে রাখা নেশাসক্ত সাপের ছোবলে সত্যের কবলে দুমড়ে যায় পরিশিষ্ট শক্তমন |
চমা খুলে রেখে ছুঁয়ে দেখ...সেই দেহ... পাহারায় রাখা সেই নৈবদ্য অনেক ঝর জল সয়ে এখনো পবিত্র আছে. মনে পাবে ভিজে মাটির আঘ্রাণ, চুলে পাবে যুইয়ের সুবাস, দশটা ছুঁলে এক কণা মূল্য বান মণি খুঁজে পাবে তুমি | চৈত্রের ঘাসে শিশিরের মলিনতা যাবে ঝরে | প্রকৃতি তে স্পস্ট হবে অবশেষ শারীরিক পুষ্টতা. খোলশের নীচে আছে সার সত্তা যে বীজ-- যে স্পষ্টত জেগে আছে সময়ের দীর্ঘ প্রতীক্ষায়, প্রসস্ত সুযোগে সে ধরবে তুলি, তাঁরা ঠিক সজীবতায় টেনে তুলবে-- মরা গাছ,পশুপাখী, পাংশু বিবর্ণ-প্রাণ শরীর II
নিজের বানানো ঘরে বসে থাকি দৃড় অঙ্গীকারে | জীবনের চরম সত্য নিয়ে গুনে চলি প্রতি পায়ের পতন | রোম ছিদ্রের প্রতিটি মানসিক শিকড়ে সাপটে ধরি মাটির চৈতন্য, জীবনের পৃষ্ঠা থেকে স্বপ্নকে ঠেলে ফেলি দুরে |
তবু ভ্রস্ট হয় লক্ষ্যভেদ, অব্যর্থ বিশ্বাসে নামে ভ্রমিত চোরা ধ্বস, জমাট জ্যোত্স্নায় শুয়ে থাকে স্বপ্নের মায়াবী ঘর |
. ********************
রচনা কাল : ০৩.০৮ .১৯৯১ স্থান: জবলপুর (মধ্য প্রদেশ)
ঝাল মুড়ির ঠোঙ্গা হাতে বিশ্রামের পথে ধীরে ধীরে হেঁটে যাই রাজ পথে চেনে না কেউ কাউকে উঁচানো গ্রিলের গেটে লাগা থাকে তীর ফলা নক্ষত্রের সৌন্দর্য একান্ত আপন আমার শামুকের গতি নিয়ে সভ্যতার জয় ধ্বজা অনামির হুল্লোরে জয়গান গায় দীঘিতে ঘুমিয়ে থাকার চোখ নিয়ে জেগ না যেন-- সময় হয়নি এখনো | তার চে গেগে থাকো তুমি জানালার বাইরে না এসে আকাশের তারা গনো, নতুবা আবার তোমায় নাবতে হবে সমুদ্র সুসে নেবে বালি চরাচর
কালো ছায়া দিগন্ত ঘিরে ছিল সে দিন তোমার গালের তিল সৌন্দযকে ভাবিয়ে তুলে ছিল, রুপোর কৌটো থেকে ছিঁটকে পড়েছিলো সিঁদুরের ছেঁটা | লোপাট ঘর পড়ে ছিল খালি, কেউ ছিল তাই ভেবে অযথা কেন লিখছ তুমি ! কেউ না থাকতে পারার ভাবনা মন নাড়ায় না তোমায়? চাল নেই,ধান খোসা পড়ে আছে তাই, তুমি বলবে কেউ ছিল তাই তো শুন্য ঘর,কিম্বা সযত্ন আবরণে ধরে রাখা অমৃত তুমি আমি যে কেউ গলায় ঢেলে নেব, পৃথিবী ব্যাপে অন্ধকার এলে তোমার ছায়া কোথাও পড়বে না |