কবি তারাপদ লাহিড়ী – “কুক্কুট ভট্ট” ছদ্মনামে
রম্যরচনা ও ছড়া লিখতেন। বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী
এবং Revolutionary Socialist Party বা R.S.P. দলের
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, এই কবি তারাপদ লাহিড়ী জন্মগ্রহণ
করেন অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ
মহকুমার বেলেকাঁদি গ্রামে। পিতা সীতানাথ লাহিড়ী
এবং মাতা অন্নপূর্ণা দেবী।
কবির শিক্ষা ও কর্মজীবন - পাতার উপরে . . .
কবি তারাপদ লাহিড়ী প্রথমে গ্রামের ইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন
সরকারি উচ্চ পদস্থ আধিকারিক। তিনি ভাইয়ের জন্য ফরিদপুর শহরের স্কুলে ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনার
বন্দোবস্ত করেন। তিনি যখন ম্যাট্রিকুলেশন দিচ্ছেন তখনই ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ দ্বারা মন্টেগু-চেমস্ফোর্ড
শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ঘোষণা করা হয়। এর বিরুদ্ধে গান্ধিজীর ডাকে অসগযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে যায়।
কবি ততদিনে ম্যাট্রিকুলেশনের ৬টি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছেন। সপ্তম এবং শেষ পরীক্ষাটি বাকি ছিল। সেই
পরীক্ষাটি না দিয়ে স্থির করলেন যে আর কোনও সরকারি বা সরকার অনুমোদিত স্কুলে পড়বেন না। তিনি
সর্বান্তঃকরণে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েঠিলেন। ১৯২২ সালে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর
তারাপদবাবু কিছুদিন ঢাকা জাতীয় মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। প্রেসিডেন্সি জেলের কারাবাসের সময়ে
তিনি I.A. পরীক্ষা দেন। তখন একটা নিয়ম ছিল I.A. করার পর ২ বছরের মধ্যে B.A. পরীক্ষা দেওয়া যাবে
না। তিনি এই অন্তর্বর্তী সময়ে মোক্তারি পাশ করেন। ১৯৩৮ সালে জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ফরিদপুর
শহরে ওকালতি প্র্যাকটিস করা শুরু করলেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফৌজদারি মামলায় সর্বাগ্রগণ্য
আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এই সময়ে তিনি ফরিদপুর জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক ছিলেন।
কবির স্বাধীনতা সংগ্রামে কারাবরণ ও RSP দলগঠন - পাতার উপরে . . .
স্বাধীনতা সংগ্রামে কবি বহুবার কারাবরণ করেছিলেন। ১৯২১ সালে গান্ধিজীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের
সময়ে ঢাকার করোনেশন পার্কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২২ সালের মে মাসে
তিনি কারামুক্ত হন।
১৯২৮-এ গঠন করা সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে গান্ধীজির ডাকে দেশজুড়ে হরতাল পালিত হলো। সর্বত্র
সাইমন কমিশনকে বয়কট করা হলো। এই আন্দোলনের রেশ ধরেই ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আইন অমান্য
আন্দোলনের ডাকে সারা দিয়ে, অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা সহ, হাজার হাজার মানুষ এই আন্দোলনে যোগ
দেন। তারাপদ লাহিড়ীকে ১৯৩০ এর শুরুর দিকেই পুনর্বার গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো
হয়। সেই সময়ে আলিপুর জেলে তাঁর সহ-বন্দীদের মধ্যে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত,
সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, চারুচন্দ্র ভাণ্ডারি, আনান্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার,
ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, কিরণ শঙ্কর রায়, ডঃ প্রতাপচন্দ্র গুহ রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এবং আরো অনেকে। ১৯৩১
সালের মার্চ মাসে গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে তিনি সেবার জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩২ সালের শুরুতেই তারাপদ লাহিড়ীকে আবার গ্রেফতার করা হল। এবারে তাঁকে পাঠানো হল হিজলি
অ্যাডিশনাল স্পেশাল জেলখানায়। এই জেলটি ছিল খড়্গপুর শহর থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরে এক নির্জন
স্থানে। এখানে তখন ছিলেন অজয় মুখার্জী, প্রফুল্ল ঘোষ, হরিপদ চ্যাটার্জী, প্রফুল্ল সেন, সতীশ সামন্ত ও আরো
অনেক ছিলেন। এবার তাঁকে ১৯৩৩ সালের শেষ দিকে হিজলি জেল থেকে ছাড়া হয়। বাইরে এসে তিনি
আনন্দবাজার পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুরেশচন্দ্র মজুমদারের সাথে দেখা করলেন এবং হিজলি জেলে
বন্দী নির্যাতনের বিশদ বিবরণ দিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রতিবাদী নিবন্ধ প্রকাশিত হল। প্রখ্যাত
সাংবাদিক তথা সম্পাদক রামানন্দ চট্যোপাধ্যায়ের "Modern Review" পত্রিকাতেও এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র
প্রতিবাদ জানানো হল। এরপর জেল কোড থেকে “জেল সুপারকে দেখলে হাত তুলে সেলাম জানাবার নিয়ম”
উঠে গেল।
১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে তারাপদ লাহিড়ী চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পুনর্বার কারান্তরালে
নিক্ষিপ্ত হলেন। তিনি প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ’৩৮-এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন।
১৯৪০ সালের ১৯শে মার্চ বিহারের রামগড়ে এক ঐতিহাসিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিল নতুন
রাজনৈতিক দল Revolutionary Socialist Party বা R.S.P. । তারাপদ লাহিড়ী এই R.S.P. দলের অন্যতম
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
১৯৪২-এ গান্ধিজী তথা কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিলে R.S.P. দল এই আন্দোলনে যোগদান
করেন। কবি এবারও ১৯৪২ থেকে ’৪৬ রাজসাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন।
কারাবাসের কালে কবি তারাপদ লাহিড়ীর চরকায় সূতা কাটা - পাতার উপরে . . .
তিনি ১৯৪২ থেকে ’৪৬ সালে রাজসাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবাসের সময়ে তারাপদ লাহিড়ী স্থির
করেছিলেন যে সংকীর্ণ দলাদলির মধ্যে না গিয়ে সময়টা চরকায় সুতো কাটবেন। তিনি জেল থেকে তাঁর
সহধর্মিণীকে লিখে পাঠালেন একটা চরকা পাঠানোর জন্য। ’৪৬ সালে মুক্তির পর তিনি সেই চরকায় কাটা
সুতো দিয়ে দু’টো শাড়ি তৈরি করিয়ে স্ত্রী-কে উপহার দিয়েছিলেন।
কবির সাহিত্যসাধনা ও প্রকাশিত গ্রন্থাবলি - পাতার উপরে . . .
সংস্কৃত সাহিত্য থেকে শুরু ক’রে বাংলা সাহিত্যে অনায়াস বিচরণ ছিল। ১৯২৩ সালে তিনি বেনারসে বঙ্গীয়
সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক হরিহর শাস্ত্রীর কাছে বেদান্ত দর্শন পড়তে যান। তাঁরই উৎসাহে তারাপদ
লাহিড়ী, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কার্যালয়ে যাতায়াত শুরু করেন। গ্রামীণ সমাজে অনেক অমূল্য কবিতা,
গান, নাটক রচিত হয় যেগুলির সৃষ্টিকর্তার নাম জানা যায় না। তারাপদ লাহিড়ী এইসব নামপরিচয়হীন কবি
ও লেখকদের নিয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
কবি তারাপদ লাহিড়ীর প্রকাশিত স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজনৈতিক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে . . .
“জমিদারি দখল বিলের গলদ”, “মার্ক্সীয় দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা”, “মার্ক্সীয় অর্থনীতি”, “ভারতীয়
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি”, “ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নানা বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্র
মোকদ্দমার ইতিহাস”, “স্বদেশ প্রসঙ্গে” (প্রবন্ধ সংকলন), “মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু”, “Freedom Struggle and
Anushilan Samiti Vol-I” (In part), “Freedom Struggle and Anushilan Samiti Vol-II” প্রভৃতি।
তাঁর প্রকাশিত সাহিত্যমূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে . . .
“কালিদাসের মেঘদূত”-এর বাংলা অনুবাদ, “রবীন্দ্র ভাবনা”, “কালকেতু ফুল্লরা”, “উপনিষদ বিপ্লব” প্রভৃতি।
কবি তারাপদ লাহিড়ীর কবিতা - পাতার উপরে . . .
তাঁর কবিতা আমরা পেয়েছি মূলত কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বারা সম্পাদিত, ১৯৮০ সালে প্রকাশিত,
কাব্যসংকলন “ব্রাত্য পদাবলী” থেকে। বইয়ের ভূমিকায় সম্পাদক জানাচ্ছেন যে সে যাবৎ কবি তারাপদ
লাহিড়ীর কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় নি। তিনি তখন ছড়া ও কবিতা লিখছিলেন “কুক্কুট ভট্ট” ছদ্মনামে।
কবিতা ছাড়াও তিনি গদ্য এবং তাত্ত্বিক সাহিত্য রচনা করে গিয়েছেন। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত, কবি সুব্রত
রুদ্র সম্পাদিত “গণসংগীত সংগ্রহ” সংকলনে কবি তারাপদ লাহিড়ীর একটি গণসঙ্গীত রয়েছে। এ ছাড়া একটি
কবিতা আমাদের পাঠিয়েছেন কবি সোমনাথ গুহ।
***************************************
আমরা কৃতজ্ঞ কবিপুত্র উৎপলাভ লাহিড়ীর কাছে যাঁর লেখা "মহাজীবন" নামক কবি জীবনীটি এখানে সম্পূর্ণ
তুলে দিয়েছি এবং এই তথ্য থেকেই আমরা কবির কবি-পরিচিতিটি সঠিকভাবে লিখতে পেরেছি।
তাঁর ইমেল - utpalavalahiri@yahoo.in
আমরা কৃতজ্ঞ কবি সোমনাথ গুহর কাছেও, যিনি এই লেখাটি এবং কবির ১টি ছড়া আমাদের পাঠিয়েছেন।
তাঁর ইমেল - somenath.guha26@gmail.com
মিলনসাগরে আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।
*************************************** এই পাতার উপরে . . .