বিদ্যাসাগরের কবিতা                                           সূচিতে ফেরত    
মিলনসাগরের কবিতার পাতায় বিদ্যাসাগরের কবিতা প্রসঙ্গে বলতে চাই যে বিদ্যাসাগরে একটি মাত্র বাংলা
কবিতা আমাদের হাতে এসেছে। ১৮৭১-৭৩ সালের মধ্যে রচিত “বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না  
এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব”-এর প্রকাশনার পর শুরু হয় পণ্ডিত সমাজের তুমুল আক্রমণ। সেই আক্রমণের উত্তরে
“কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোষ্য” ছদ্মনামে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর “অতি অল্প হইল” প্রকাশিত করেন ১২৮০  
বঙ্গাব্দে (১৮৭৩)। সেই লেখাটি শুরু করেছিলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি কে নিয়ে, বাংলায় একটি কবিতাটি
দিয়ে যা আমরা নীচে কবিতার পাতায় তুলে দিয়েছি।

এছাড়া জানি না বিদ্যাসাগর আরও কোন কবিতা রচনা করেছিলেন কি না। তবুও তাঁর “শকুন্তলা”, “সীতার
বনবাস” প্রভৃতি গ্রন্থের ভাষা, যা মূল গ্রন্থের ভাবানুবাদ মাত্র, এত ছন্দময় ও মধুর যে আমাদের মনে হয়েছে
যে তা কাব্যেরই শামিল।

বিদ্যাসাগরের কথা চিন্তা করলেই কল্পনায় ভেসে ওঠে এক গম্ভীর শাস্ত্রজ্ঞানী পণ্ডিতের মুখ যেখানে কর্তব্য,
আদর্শবাদ আর কর্মযজ্ঞ ছাড়া, প্রেম-ভালবাসার মত জীবনের কোমল ভাবগুলি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত! কিন্তু তাঁর
সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরের যে প্রেমময় ভাবমূর্তী চোখে ভেসে ওঠে তা এক
পরিপূর্ণ  প্রেমিকের!  তাই আমরা তাঁর উপরোক্ত দুটি রচনার যত্সামান্য এখানে তুলে ধরেছি।

বিদ্যাসাগর “শকুন্তলা” গ্রন্থের এই ভূমিকাটি লিখে তাঁর মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন ---

“...যাঁহারা সংস্কৃতে শকুন্তলা পাঠ করিয়াছেন এবং এই উপাখ্যান পাঠ করিবেন চমত্কারিত্ব বিষয়ে এ  
উভয়ের কত অন্তর তাহা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন এবং সংস্কৃতানভিক্ষ পাঠকবর্গের নিকট কালিদাসের  
ও শকুন্তলার এই রূপে পরিচয় দিলাম বলিয়া মনে কত শত বার আমার তিরস্কার করিবেন | বস্তুতঃ  
বাঙ্গলায় এই উপাখ্যান সঙ্কলন করিয়া আমি কালিদাসের ও শকুন্তলার অবমাননা করিয়াছি | আপনাদের  
নিকট আমার এই প্রার্থনা যেন এই শকুন্তলা দেখিয়া কালিদাসের শকুন্তলার উত্কর্ষ পরীক্ষা না করেন |”

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন যে বিদ্যাসাগর এমন একজন মানুষ যাঁর মধ্যে মিলেছে The genius and
wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengali Mother !
 

রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে লিখেছিলেন --- “তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা”।

তাই আমরা তাঁর কয়েকটি লেখার টুকরো কবিতার আকারে এখানে উপস্থাপন করছি। আজ আধুনিক
কবিতার যুগে আশাকরি কেউ এই কাজের আপত্তি করবেন না।

বিদ্যাসাগর বাংলার এমন এক মনীষী ছিলেন যাঁকে নিয়ে অগণিত কবিতা-গীত রচনা করা হয়েছে পরবর্তী
কালের কবি-সাহিত্যিকদের দ্বারা।  
মিলনসাগরে, আমরা সেই রকম কিছু কবিতাও তুলে দিচ্ছি। আমরা
তাঁকে এভাবে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতে পেরে, নিজেদেরকে ধন্য মনে করছি।   



মিলনসাগরে বিদ্যাসাগরকে উত্সর্গ করা কবিতার মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন...        



উত্স :   



মিলনসাগরে বিদ্যাসাগরকে উত্সর্গ করা কবিতার মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন...      
মিলনসাগরে কবি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কবিতার মূল পাতায় যেতে হলে এখানে ক্লিক্ করুন...    


আমাদের যোগাযোগের ঠিকানা :-                                                          উপরে ফেরত   
srimilansengupta@yahoo.co.in      




বিদ্যাসাগরের কবিতার পাতা -
“শকুন্ত
লা” ও “সীতার বনবাস” থেকে অংশবিশেষ সহ এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২৩.৬,২০১১।
“অতি অল্প হইল” থেকে তাঁর বাংলা কবিতা সহ পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ২৮.৭.২০১৯।


বিদ্যাসাগরকে উত্সর্গিত কবিতার পাতা -
পাতাটির প্রথম প্রকাশ - ৬.৯.২০১৪।
পরিবর্ধিত সংস্করণ - ২৮.৭.২০১৯।


.
*
*
*
*
*
*
*
*
*
*
*
*
*
সংক্ষিপ্ত জীবনী  
ছাত্র জীবন   
শিক্ষা সংস্কার   
জন শিক্ষা   
নারী শিক্ষা   
বিধবা বিবাহ   
বহুবিবাহ রোধ   
মাতৃভক্তি   
আনুয়িটি ফাণ্ড    
দয়ার সাগর   
রামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগর   
শেষ জীবন   
পাঠ্যপুস্তক রচনা   
সাহিত্য রচনা   
বিদ্যাসাগরের কবিতা     
উত্স    
এ হেন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র। ছোটবেলায় তাঁর শখের খেলা ছিল কপাটি (কাবাডি)  আর  
লাঠি। স্বাস্থ্য তেমন ভাল না হলেও ছিলেন ভীষণ একগুঁয়ে। কিন্তু পড়াশুনায় তার অগাধ মনোযোগ ছিল।  
পাঠাশালার পণ্ডিতরা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় বাবার সাথে কলকাতায় আসার পথে রাস্তার
মাইলস্টোন দেখে দেখে ইংরেজির
1 থেকে 10 অঙ্ক শিখে ফেলেছিলেন। পড়াশুনার দিকে ঝোঁক দেখে, তাঁকে
পড়াশুনা করানোটাই তাঁর পরিবার সমীচীন মনে করেছিলেন।
সাহিত্য রচনা                                                          সূচিতে ফেরত
তাঁর প্রথম গ্রন্থ “বেতালপঞ্চবিংশতি” (১৮৪৭) হিন্দী থেকে অনুবাদ। “শকুন্তলা” (১৮৫৪) সংস্কৃতে কালিদাসের
অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ ও "সীতার বনবাস" (১৮৬০) সংস্কৃতে ভবভূতির উত্তররামচরিত অবলম্বনে রচিত।
দুটিই আক্ষরিক অনুবাদ নয়। তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় রচনার মধ্যে আছে "ভ্রান্তিবিলাস"(১৮৬৯) শেক্সপীয়রের
নাটক
The Comedy of Errors এর সাবলীল গদ্য আখ্যানে রূপান্তর।

তাঁর মৌলিক রচনার মধ্যে রয়েছে “সংস্কত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব” (১৮৫৩) যা  
ভারতীয় ভাষায় সাহিত্যের ইতিহাস রচনার সর্বপ্রথম চেষ্টা। “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা  
এতদ্বিষয়ক বিচার” (১ম পুস্তক-জানুয়ারী ১৮৫৫, ২য় পুস্তক-অক্টোবর ১৮৫৫, পরে আরও দুইবার এই বইটি
প্রকাশিত হয়)। “বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার” (১ম পুস্তক-১৮৭১, ২য় পুস্তক -  
১৮৭৩)। এই দুটি রচনাই তাঁর মণীষা, হৃদয়বত্তা ও যুক্তিবিন্যাস ক্ষমতার উত্কৃষ্ট নিদর্শন।

তাঁর অন্য রচনার মধ্যে অসমাপ্ত আত্মচরিত এবং “প্রভাবতী সম্ভাষণ” (১৮৯২) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এটি  
বিদ্যাসাগরের এক অতি প্রিয় বালিকার মৃত্যুতে রচিত শোক-প্রবন্ধ।
পাঠ্যপুস্তক রচনা                                                     সূচিতে ফেরত    
প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা শেখাবার পথ দেখালেন, ভারতবর্ষের জনশিক্ষার দিশারী বিদ্যাসাগর, একদিন
পালকীতে যেতে যেতে “বর্ণপরিচয়” (১৮৫৫) রচনার মধ্য দিয়ে। দেড়শো বছরেরও বেশী সময় ধরে আপামর
বাঙালীকে তার মাতৃভাষার সাথে এই বইটিই প্রথম পরশ জুগিয়ে চলেছে! রবীন্দ্রনাথও (জন্ম ১৮৬১) হয়তো
“বর্ণপরিচয়” দিয়েই বাংলা শিক্ষা শুরু করেছিলেন! (সঠিক জানা নেই, কেউ সঠিক তথ্য জানালে এখানে তা,
লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রকাশিত করা হবে)। এছাড়াও বিদ্যাসাগর ছোটোদের জন্য লিখেছিলেন
"আখ্যান মঞ্জরী" (১৮৪৯), "বোধোদয়" (১৮৫১), "ঋজুপাঠ" (১৮৫১-৫৩), "কথামালা" (১৮৫৬),  "চরিতাবলী"
(১৮৫৬) প্রভৃতি।
শেষ জীবন                                                                                সূচিতে ফেরত    
তাঁর শেষ কাজ ছিল মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট কে গড়ে তোলা, যা এখন বিদ্যাসাগর কলেজ হিসেবে   
পরিচিত। তাঁর যা কিছু সম্বল ছিল সব তিনি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁর নানা কাজে
যারা সহায় হয়ে এসেছিলেন তারা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। যাদের জন্য ঋণে জর্জরিত হয়ে  
পড়েছিলেন তাদের অনেকেই তাকে পরিহার করেছিলেন। দুঃখে, অভিমানে তিনি নিজেকে গুটিয়ে  
নিয়েছিলেন নাগরিক জীবন থেকে। পারিবারিক জীবনেও দেখা দিয়েছিল অশান্তি। তাই তিনি শেষ বয়সে
চলে গিয়েছিলেন অধুনা ঝাঢ়খণ্ড রাজ্যের, জামতারা জেলার, কর্মাটাড় গ্রামে, সাঁওতালদের মাঝে। অভিমানে
তিনি বলে গেছেন “তোমাদের মতো ভদ্রবেশী আর্যসন্তানদের চাইতে আমার অসভ্য সাঁওতাল ভালো লোক”।
ভদ্রবেশীদের অকৃতজ্ঞতার আঘাতেই হয়তো বলেছিলেন “লোকটা আমার নিন্দে করছে? কেন? তার তো
কোনো উপকার করিনি আমি!” তাঁরই স্মৃতিতে, কর্মাটাড়ের কাছের রেল স্টেশনটির নামকরণ করা হয়েছে
"বিদ্যাসাগর"!

তাঁর তিরোধানের পর
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন
সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।” বিদ্যাসাগর ছিলেন
বাংলাদেশের সেই মানুষ। এ বিষয়ে পড়ুন  রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর স্মরণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ প্রবাসী পত্রিকা . . .
এখানে ক্লিক করে . . .
রামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগর                                                             সূচিতে ফেরত   
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বিদ্যাসাগরের থেকে প্রায় ১৬-১৭ বছরের ছোটো ছিলেন। বিদ্যাসাগরের
পাণ্ডিত্য  ও দয়ার কথা ভক্তদের মুখে শুনে তিনি তাঁর সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতর রচয়িতা শ্রীম বা মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর কাছে (তিনি মাস্টারি করতেন বলে ঠাকুর
রামকৃষ্ণ তাঁকে ডাকতেন  মাস্টার বলে)। শ্রীম বিদ্যাসাগরেরই প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলে পড়াতেন। সেই সূত্রে
শ্রীম-র সাথে বিদ্যাসাগরে পরিচয় ছিল। বিদ্যাসাগরকে রামকৃষ্ণের সাক্ষাতের ইচ্ছার কথা জানাতেই তিনি
রাজি হয়ে যান। শুধু  জিজ্ঞেস করেছিলেন “তিনি কি রকম পরমহংস?” আর “তিনি কি গেরুয়া কাপড় পড়ে
থাকেন?”!   

সেই মতো, ৫ আগস্ট ১৮৮২ তারিখে ঠাকুর রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগরের বাড়ীতে এসে দেখা করে যান। সেই  
সাক্ষাত্কারটি লিপিবদ্ধ করেছিলেন শ্রীম।

এই ঐতিহাসিক সাক্ষাত্কারটি থেকে আমরা বিদ্যাসাগরে মার্জিত রুচি ও শিষ্টাচারের পরিচয় পাই। জানতে
পাই যে তাঁর টেবিলে যে সব চিঠিপত্র রাখা থাকতো, তাতে থাকতো বহু মানুষের সাহায্যের জন্য প্রার্থনা।
কারো স্কুলের ফি দিতে পারছেন না তো কারো বই কেনার পয়সা নেই বা কারও সংসার খরচ নেই বা কেউ
বিলাত থেকে কিছু অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করেছেন।

বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন “ঈশ্বর বিদ্যাসাগর যেরূপ কাজ করছে সে খুব ভাল। দয়া খুব  
ভাল। দয়া আর মায়া অনেক তফাত। দয়া ভাল, মায়া ভাল নয়। মায়া আত্মীয়ের উপর ভালবাসা---স্ত্রী, পুত্র,
ভাই, ভগিনী, ভাইপো, ভাগনে, বাপ, মা এদেরই উপর। দয়া সর্বভূতে সমান ভালবাসা”।
দয়ার সাগর                                                                            সূচিতে ফেরত   
বিদ্যাসাগর সারা জীবন মানুষের কথা ভেবেছিলেন। তাঁর কাছে নিয়মিত অগুণতি মানুষের সাহায্য প্রার্থনা
জানানো চিঠি আসতো। তিনিও যথা সাধ্য সাহায্য করতেন। শ্রীম রচিত রামকৃষ্ণ কথামৃতে রামকৃষ্ণ
পরমহংসের সঙ্গে বিদ্যাসাগরে সাক্ষাত্কারের বর্ণনায় সেই কথা রয়েছে। তাই তিনি সমকালীন
মানুষের কাছে “দয়ার সাগর” নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

১৮৬৫-৬৬ এর মন্বন্তরের সময় বিদ্যাসাগর কোমর বেঁধে সেবার কাজে লেগে পড়েছিলেন। সম্পূর্ণ নিজের
খরচে খুলেছিলেন অন্নসত্র। চার-পাঁচ মাস ধরে ১২ জন ঠাকুর দিন রাত রান্না করেছে। সেখানে নিজের হাতে
শরণার্থীদের মাথার রুক্ষ চুলে তেল মাখিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে ঘর নেই বলে কি ঘরের স্নেহ-যত্ন পাবে না
এই হতভাগারা!?

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্যারিসে থাকাকালীন অর্থাভাবে প্রায় জেলে যেতে বসেছিলেন। ভরসা  
করেছিলেন বিদ্যাসাগরের সাহায্যের। আশাহত হননি। বিদ্যাসাগর তখন কপর্দকশূণ্য হয়ে গিয়েছিলেন বলে
ধার করে টাকা পাঠিয়েছিলেন মাইকেলকে। মাইকেল বলেছিলেন যে বিদ্যাসাগর এমন একজন মানুষ যাঁর  
মধ্যে মিলেছে
The genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a
Bengali Mother
!  
মাতৃভক্তি                                                                                সূচিতে ফেরত  
তাঁর মাতৃভক্তি কিংবদন্তী সমান। জনশ্রুতিতে আছে যে একবার তাঁর মা ভগবতী দেবী বলেছিলেন যে ঈশ্বর
যদি তাঁর ভাইয়ের বিয়ে তে উপস্থিত না থাকেন তবে তাঁর খুব মন খারাপ করবে। ছুটি না পেয়ে শেষে  
চাকরীতে ইস্তফা দেবার ভয় দেখিয়ে ছুটি মঞ্জুর হল। কিন্তু পথে পড়লো ভরা বর্ষার দামোদর নদ। কোনো
নৌকা পারাপার করতে রাজি হলো না। তিনি থেমে যান নি, মায়ের ডাকে সোজা সেই রাত্রেই  দামাল  
দামোদর সাঁতরে পার হয়ে বীরসিংহে পৌঁছে মাকে বললেন “মা, এসেছি!”

একবার মা জানালেন যে গাঁয়ের লোকে শীতে কষ্ট পায় বলে তিনিও লেপ ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ  
করছেন! বিদ্যাসাগর মার কাছে জানতে চান কটি লেপ হলে গাঁয়ের সবার একটি করে লেপ হবে! কিছুদিনের
মধ্যেই ততগুলি লেপ তাঁর গাঁয়ে পৌঁছে গিয়েছিল!

বিদ্যাসাগর তাঁর মায়ের ডাকে সত্যিই দামোদর নদী পার হয়েছিলেন কি না তা নিয়ে আধুনিক যুগের অনেক
বিশিষ্ট শিক্ষিত বঙ্গপুঙ্গবদের রাতের ঘুম হচ্ছিল না! বিদ্যাসাগরের নিকট আত্মীয়দের স্মৃতি ও লেখা থেকে
রিসার্চ করে এবং বিদ্যাসাগরেরই কঠোর পরিশ্রমের ফসল হিসেবে যে অপেক্ষাকৃত মানবিক ও  শিক্ষিত
বাঙালী সমাজ গড়ে উঠেছে, সেই সমাজেরই ছত্রছায়ায় লালিত ও শিক্ষিত হয়ে, ওই মহান সত্যবাদী যুধিষ্ঠির
বঙ্গপুঙ্গবরা জানিয়েছেন যে, না বিদ্যাসাগরের সেই নদী পার হওয়ার কাহিনীটি মিথ্যা। তিনি সেই কাজটি
আদৌ করেন নি। বিদ্যাসগরের মত মানুষের মাতৃভক্তির এই কাহিনীটি যদি তেমনই চলতে থাকতো তাতে
কি ক্ষতি ছিল ? আমাদের প্রশ্ন এই যে, চারপাশে ভুরি ভুরি কদর্য মিথ্যার জাল যেখানে আমাদের  সমাজের
সর্বত্র বেষ্টন করে রয়েছে, সেগুলোকে তো প্রকাশের আলোয় আনার কোন চেষ্টাই দেখা যায়না, সেখানে এমন
সুন্দর একটি গল্পকে ধূলিসাৎ করার কি দরকার ছিল ? বিদ্যাসাগর তো এর চেয়ে বহু বহু গুণ কঠিন কাজ
সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছে যে যারা এই কাজটি করেছেন তারা তাদের এবং সমাজের
সময়, অর্থ ও শ্রমের অপচয় করেছেন। অভদ্র ভাবে বলছি যে তারা আসলে সময়, অর্থ ও শ্রমের পিণ্ডি
চটকেছেন
।” – মিলন সেনগুপ্ত
বহুবিবাহ-রোধ                                                                         সূচিতে ফেরত
তখন আরো একটি কুপ্রথায় বাংলা ছেয়ে গিয়েছিল। কৌলীন্য-প্রথা। এর ফলে বহুবিবাহের ছড়াছড়ি ছিল।  
পঞ্চান্ন বছরের কারোর বিয়ের সংখ্যা আশি! আঠারো বছরের ছেলের বিয়ে একুশটি! ৩৫ বছরের ছেলের
বিয়ে চল্লিশটি! কিংবা বারো বছরের ছেলের পাঁচ বৌ। কূলীন ব্রাহ্মণরা অনেক সময় খাতায় লিখে রাখতো
তাদের বিবাহিত স্ত্রীদের বাপের বাড়ীর ঠিকানা! অনেকের জীবিকাই ছিল এক শ্বশুরবাড়ী থেকে আরেক  
শ্বশুর বাড়ী গিয়ে কিছু দিন কাটিয়ে তাদের ধন্য করে আবার আরেক শ্বশুরবাড়ীকে ধন্য করতে যাওয়া!  
বউরা বাপের বাড়ীতেই থাকতো! বিদ্যাসাগর গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।

১৮৫৫ সালে আর ১৮৬৬ সালে এই প্রথা বন্ধ করার জন্য আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেন বিদ্যাসাগর। দুবারই
আন্দোলন হলেও তা বিফল হয়ে যায়। কিছুদিন পর প্রকাশিত হলো “বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না
এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব” (১৮৭১ -৭৩)। আরো একবার শোরগোল উঠেছিল পণ্ডিত সমাজে। সেই পণ্ডিত সমাজের
উত্তরে “কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য” ছদ্মনামে বিদ্রুপভরা দুটি বই লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর “অতি অল্প হইল”
(১৮৭৩), “আবার অতি অল্প হইল” (১৮৭৩)।
বিধবা বিবাহ                                                                            সূচিতে ফেরত   
১৮২৯ সালে, লর্ড উইলিয়াম বেনটিঙ্ক এর শাসনকালে, রাজা রামমোহন রায়ের দ্বারা আনীত সতীদাহ প্রথা  
বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়। এই প্রথা লুপ্ত হলে বহু নারী ভয়ঙ্কর যাতনাময় মৃত্যুর থেকে অব্যাহুতি  
পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সমাজে তাঁদের যে ভাবে বেঁচে থাকতে হোতো, তা তিল তিল করে মরা ভিন্ন অন্য
কিছু ছিল না।  

বিদ্যাসাগরের মাত্র ১৪ বছর বয়সে, তাঁর এক বাল্যসঙ্গিনী বিধবা হয়েছিলেন। একদিন তাঁদের বাড়ীতে গিয়ে
বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন যে সেই মেয়েটি সারাদিন অভুক্ত, কারণ সেদিনটা নাকি ছিল একাদশী! সেদিন তাঁর
মনে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা তাঁর সারাজীবনে নেভে নি।

শুধু যুক্তি নয় তিনি এক্ষেত্রেও শাস্ত্র দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে হিন্দু ধর্মে বিধবা বিবাহ ষোলো আনা শাস্ত্র  
সম্মত! বিভিন্ন সময়ে বিধবা বিবাহের সপক্ষে প্রবন্ধ প্রকাশিত করে জনমত গঠন করেছিলেন।| ১৯৫৫ সালে
প্রকাশিত করেছিলেন “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব”। গভর্নর জেনারেলের
কাছে বিধবা বিবাহ  আইন  প্রণয়নের জন্য দরবার করেছিলেন আধুনিক কালের সাক্ষর অভিযানের মধ্য
দিয়ে। বিরোধীদের থেকে অনেক বেশী সাক্ষর তিনি যোগাড় করেছিলেন।  

অবস্থা এমন পর্যায় চলে গিয়েছিল যে পরিবেশ হিংসাত্মক হয়ে উঠছিল। সেই আশঙ্কা করে বাবা ঠাকুরদাস
বন্দ্যোপাধ্যায়, গ্রাম থেকে, পুত্রের সুরক্ষার জন্য লেঠেল দেহরক্ষী পাঠিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২৬ জুলাই  
১৮৫৬ তারিখে, লর্ড ক্যানিং এর শাসনকালে, বিধবা বিবাহ আইন পাশ করিয়ে নেওয়া হয়।

জাতীয় উত্সবের মতো বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। পাত্রের নাম শ্রীশচন্দ্র  
বিদ্যারত্ন এবং পাত্রী কালীমতী দেবী। সরকারী প্রহরায় বরযাত্রী আসে বিবাহমণ্ডপে। কাগজে কাগজে,  
পণ্ডিতদের সভায়, মেয়েমহলে,
দাশুরায়ের পাঁচালীতে, এমন কি চাষীর ধানক্ষেতে একটাই আলোচনা। পথে
পথে ছড়া কাটা চলেছে ---

“বেঁচে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে,
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবার হবে বিয়ে”  

শান্তিপুরের তাঁতিরা কাপড়ে লিখেছে “বেঁচে থাকুক বিদ্যাসাগর”! মেয়েরা সেই মন্ত্র লেখা শাড়ী পড়েছেন।

১৮৭০ সালে বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণচন্দ্র এক বাল্যবিধবাকে বিবাহ করেন। পুত্রের অনুমতি চাওয়া  
পত্রের উত্তরে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন “বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সত্কর্ম। এ জন্মে যে
ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনো সত্কর্ম করিতে পারিবো, তাহার সম্ভাবনা নাই।”

সত্যই কি বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের আন্দোলন এবং আইন প্রণয়ন, সর্বাত্মকভাবে সফল হয়েছিল?  
বর্ণহিন্দু বাঙালীরা কি তা মন থেকে মেনে নিতে পেরেছিলেন? এ বিষয়ে
ডঃ শর্মিষ্ঠা সেন তাঁর "বাংলা  
সাহিত্যে বিধবা চিত্রণ" গ্রন্থে লিখেছেন ---

" ...প্রথমটিকে (সতীদাহ রোধক আইন) যদি বা পরিশীলিত শিক্ষিত সম্প্রদায় Barbaric act বলে ছেড়ে দিয়েও
থাকেন খানিকটা, দ্বিতীয় আইনটিকে (বিধবা বিবাহ আইন) কিছুতেই হিন্দু সমাজ তাঁদের চিরাভ্যস্ত  
সমাজকাঠামো এবং হিন্দু নারীর সতীত্বআদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছিলেন না | তাই বিদ্যাসাগরের  
নায়কত্বে যে আন্দোলন, সেখানে নারীর ব্যভিচারের ভয়ই বিধবাবিবাহের একমাত্র কারণ আর তা নিয়ে হিন্দু
বাঙালী সমাজ তোলপাড় হয়েছে | সাময়িক উত্তেজনার বশে সংস্কারকরা বিধবা নারীর যে পুনর্বিবাহের  
আদর্শ সেদিন গড়ে তুলতে চাইছিলেন, সেই আদর্শ সেদিন বৃহত্তর হিন্দুসমাজের সাধারণ জীবনের সমস্যার
সঙ্গে মিশ খায়নি | নারীর সতীত্বের ধারণাতেই যে সমাজের পত্তন, নারীর সতীত্বই যে সমাজের প্রতি ঘরের
সাধারণ শিক্ষা, সেখানে বিদ্যাসাগরের কথিত বিধবা নারীর "দুর্জ্জয় রিপুবর্গের" প্রাবাল্যের ধারণা ব্যর্থ হতে
বাধ্য | তাই দেখা যাবে, সাহিত্যে-নাটকে কিংবা উপন্যাসে, যেখানেই এই দুর্জ্জয় রিপু-বশিভূত নারীর কথা  
বলা হয়েছে, খুব শ্রদ্ধাভরে বলা হয় নি | ...

.... ইয়ং বেঙ্গলের প্রচেষ্টা আর বিদ্যাসাগরের যুগান্তকারী মন্তব্য - (যে, "বিধবা হইলেই নারীর দেহ পাষাণময়
হইয়া যায়'না") মৌচাকে ঢিল মারার মত বাংলা সাহিত্যের জগতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ঠিকই, যার  
অভিঘাতে বাঙালী পুরুষতন্ত্র তাঁদের এতদিনকার লালিত নারীর সতীত্ব ও পাতিব্রত্যের ধারণাকে আরেকবার
ভেঙে-চুরে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের কাঙ্খিত মধ্যযুগীয় আদর্শের কোনও ব্যত্যয়
সেখানে ঘটেনি |"
নারীশিক্ষা                                                                                  সূচিতে ফেরত   
বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন মেয়েদের শিক্ষা দেবার কথাও। তখনকার সমাজ ব্যবস্থা মেয়েদের করে রেখেছিল
পর্দানশীন। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর পদ্ধতিতে  কোনো জোর জবরদস্তির
জায়গা ছিল না। যাদের কাছে শাস্ত্রই ছিল সর্বস্য তাঁদের তিনি শাস্ত্রের ভেতর থেকেই যুক্তি-তর্ক দিয়ে  
বোঝাবার চেষ্টা করতেন। খুঁজে বার করলেন শাস্ত্র বচন ---

“কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ”
অর্থাৎ কন্যাকেও অতিযত্নের সঙ্গে পালন করতে হবে, শিক্ষা দিতে হবে

১৮৪৮ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের, ট্রিনিটি কলেজের স্নাতক জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন,
যিনি বেথুন সাহেব নামেই ভারতবর্ষে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন  
গভর্নর জেনারেলের কাউনসিলের ল মেম্বার। এর সাথে সাথে তিনি কাউনসিল অফ এডুকেশনের সভাপতিও
ছিলেন।
পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামগোপাল ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জী প্রভৃতি আধুনিক মনষ্ক
মনীষীদের সাহায্যে, ৭ মে ১৮৪৯ এ বেথুন সাহেব, মেয়েদের জন্য একটি স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলটির
জন্য কলকাতার মির্জাপুরে জমি দান করেছিলেন রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জী। ভারতবর্ষে এটিই মেয়েদের জন্য
প্রথম স্কুল। এই স্কুলের সম্পাদক হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১২ অগাস্ট ১৮৫১ তারিখে বেথুন সাহেব
পরলোকে গমন করেন।

১৮৫৭ সালে বিদ্যাসগর বর্ধমান জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি মেয়েদের স্কুল। ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে
তিনি নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠা করলেন ৩৫টি স্কুল। ছাত্রী সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এই স্কুলগুলি বিদ্যাসাগর
নিজের খরচেই শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার থেকে সাহায্যের আশ্বাস পেলেও তা পাওয়া যায় নি।  
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ (ইংরেজদের ভাষায়) শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই সময়েই। ইতিহাসের পাতায়
চোখ রাখলেই বোঝা যায় যে সেই সময় ইংরেজরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াইতে ব্যস্ত হয়ে   
পড়েছিলেন। হয়তো তাই তাঁরা বিদ্যাসাগরের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সাহায্য করেন নি।
জনশিক্ষা                                                                                  সূচিতে ফেরত   
বিদ্যাসাগর কেবল সংস্কৃত কলেজের কথাই ভাবেন নি। তিনি ভেবেছিলেন সারা দেশের কথা। তিনি   
বুঝেছিলেন যে সারা দেশে ইস্কুল না খুলে এই জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব নয়। তিনি গ্রাম গ্রামে ঘুরে
১৮৫৫ সালের অগাস্ট মাস থেকে ১৮৫৬ সালের জানুয়ারী মাসের মধ্যে নিজেই স্থাপন করলেন ২০টি মডেল
স্কুল, বিভিন্ন গ্রামে। এই সব স্কুলে যাঁরা পড়াবেন তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য সংস্কৃত কলেজের ভবনেই তৈরি   
হলো একটি নর্ম্যাল স্কুল। অক্ষয়কুমার দত্ত হলেন তার প্রধান শিক্ষক।
শিক্ষা-সংস্কার                                                                             সূচিতে ফেরত   
শুরু হল তাঁর কর্মজীবন। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি যোগ দিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে এবং হয়ে
উঠলেন হেড পণ্ডিত। ১৮৪৬ সালে তিনি এসে যোগ দিলেন সংস্কৃত কলেজে। তাঁর অধ্যক্ষতায় সংস্কৃত  
কলেজের আমূল সংস্কার লক্ষ্য করা গেল। তিনি মনে করতেন যে, যে মানুষ পণ্ডিত হবেন তিনি যেন  
কুসংস্কার মুক্ত হন। তাই পণ্ডিতদের সিলেবাসে, প্রাচীন শাস্ত্রের বেদান্ত বা সাংখ্যের সাথে লজিক আর
ইংরেজী পড়াবারও ব্যবস্থা করলেন। বদল শুধু সিলেবাসেই নয়, তাঁর সমাজ সংস্কারের কাজও সেখান  
থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তিনিই প্রথম সংস্কৃত কলেজে অব্রাহ্মণদের পড়বার অধিকার দিলেন।  
প্রাচীনপন্থীরা ধর্মলোপ, জাতিলোপের কথা তুলে তুমুল শোরগোল তুলেছিলেন! তখন বিদ্যাসগর যুক্তি দিয়েই
বলেছিলেন যে তাই যদি হবে তাহলে অব্রাহ্মণ রাজা রাধাকান্ত দেব কেন সংস্কৃত পড়ছেন!? টাকার লোভে
ম্লেচ্ছ সাহেবদেরই বা পণ্ডিতরা কেন সংস্কৃত শেখাচ্ছেন!? এই যুক্তির কাছে বলাবাহুল্য আর কোনো বাধা
টেকে নি।

বিদ্যাসাগর মনে করতেন যে শেখানোর পদ্ধতি সহজ হওয়া উচিত। তাই রচনা করলেন সংস্কৃত ব্যাকরণের
“উপক্রমণিকা” (১৮৫১), আর একেই একটু বিষদ করে লিখলেন “ব্যাকরণকৌমুদী” (১৮৫৩ - ৬২)। শোনা যায়
যে এর ফলে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্র ছ-মাসের মধ্যেই সংস্কৃত শিখে ফেলতে পেরেছিলেন।
ছাত্রজীবন                                                                                  সূচিতে ফেরত   
সেই মতো ১৮২৮ সালে তাঁকে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হল।  কলকাতায়  থাকতে   
হতো তাঁর বাবার মনিবের বাড়ীতে। কখনো ভাত জুটতো কখনো জুটতো না। বেশীর ভাগ দিনই শুধু    
শুকনো ভাত। পরনে সেই চরকা কাটা সুতোয় বোনা মোটা কাপড়। মেধার জন্য বৃত্তি পেতেন।  তখন   
থেকেই দয়ালু মনের ঈশ্বর, সেই টাকা থেকেও তাঁর গরীব সহপাঠী বন্ধুদের জন্য খরচ করতেন। তখন তাঁর
মেজ ভাই দীনবন্ধুও কলকাতায় তাঁদের সাথেই থাকতেন। সবার জন্য ঈশ্বর বাজার করতেন, রাঁধতেন এবং
বাসন মাজতেন! বাটনা বেটে বেটে হাতের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। রাতেই পড়ার সময় পেতেন।
প্রদীপ জ্বালিয়ে অথবা রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়তেন। তখন কলকাতার পথে পথে গ্যাসবাতি  
বসানো হয়ে গেছে।

১৮৪১ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করে বেরোলেন। তিনি ব্যকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত,   
স্মৃতি, ন্যায় এবং জ্যোতিষে বিশারদ, সর্বশাস্ত্র পারঙ্গম বলে সংস্কৃত কলেজ থেকেই তাঁকে বিদ্যাসাগর  
উপাধি দেওয়া হয়েছিল।   
অ্যান্যুয়িটি ফান্ড  
মেয়েদের অসহায়তার কথা ভেবে এই কাজটি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি ১৮৭২ সালে  প্রতিষ্ঠা  
করেছিলেন “হিন্দু ফ্যামিলি অ্যান্যুয়িটি ফান্ড”। সাধারণ গৃহস্থের মৃত্যুর পর অনেক সময়েই তাদের পরিবার
নিরুপায় নিঃসম্বল হয়ে পড়ে। তারই প্রতিকারের জন্য এই ব্যবস্থা করেছিলেন।
*
*
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর - উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ  
(Bengal  Renaissance) এর একজন কাণ্ডারী। বাংলার মাটিতে শেষ
পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে, যদি কেউ কখনও কোনো সফল আন্দোলন বা
বিপ্লব  করে থাকেন তবে তাঁর নাম অবশ্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার,  অবিভক্ত মেদিনীপুর  
জেলার,  (অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল  মহকুমার)  
বীরসিংহ গ্রামে (সেই সময়ে নাকি  বীরসিংহ গ্রামটি হুগলী জেলার
অন্তর্গত ছিল)। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার  নাম
ভগবতী দেবী।

ঠাকুরদাস অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে জীবন শুরু করেন। গ্রামে চরকায়
সুতো কেটে দিন চালাতেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কলকাতায় আসেন
জীবিকার উদ্দেশে। শেখেন ইংরেজি এবং কর্মজীবন শুরু করেন মাত্র
২টাকা মাইনের চাকরি দিয়ে যা ২৩ বছর বয়সে তাঁর বিবাহের  
সময় বেড়ে হয়েছিল ৬টাকা।