যে শিশুটি বইমেলায় গল্পগুচ্ছের মলাটের দিকে আঙুল দেখিয়ে মাকে বলে, 'মা, দেখো- আমার রবীন্দ্রনাথের বই--' রবীন্দ্রনাথ তার। যে ছেলেটি রোজ সন্ধ্যাবেলা হ্যারিকেনের আলোয় 'কিশলয়' খুলে পড়ে- 'আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে--' রবীন্দ্রনাথ তার। সদ্য কথা বলতে শেখা যে দুরন্ত ছেলেটা তার মায়ের গলা জড়িয়ে আধো-আধো বুলিতে বলে, 'আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি --' রবীন্দ্রনাথ তার। 'দিনের আলো নিবে এল সূয্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে চাঁদের লোভে লোভে' -বলতে বলতে যে রাখাল গরু তাড়িয়ে গোয়ালে ফেরে, রবীন্দ্রনাথ তার । যে মেয়েটি স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে লাল পাড় সাদায় সেজে হারমোনিয়ামে সুর তোলে, 'আলো আমার আলো ওগো, আলো ভুবন ভরা-' রবীন্দ্রনাথ তার। যে কিশোরের সূর্যস্নাত মন সূর্যোদয় দেখে বলে ওঠে, 'আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর--' রবীন্দ্রনাথ তার। গ্রামছাড়া রাঙামাটির পথ যে আপনভোলা বাউলকে দেয় গভীর প্রশান্তি, রবিঠাকুর তাঁর। যে পথিকের 'পথ চাওয়াতেই আনন্দ', রবীন্দ্রনাথ তাঁর। যে মানুষটা কাঠের ওপর একটা দাড়িওয়ালা মুখ খোদাই করে শান্তিনিকেতনে খোয়াই-এর হাটে বিক্রি করবে বলে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর। রক্তে রুদ্রবীণার ঝংকার শুনে পুরুষশাসিত সমাজে নিজের অধিকার দাবি করা সেই মহীয়সীর ; রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া খবরের কাগজে রবি ঠাকুরের ছবি দেখে কাগজের টুকরোটা কুড়িয়ে নেওয়া সেই স্কুলছুট ছেলেটার ; সারাদিনের শেষে ক্লান্ত চিত্তে 'দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে' গাইতে থাকা সেই গৃহিণীর। কিন্তু কে এই রবীন্দ্রনাথ? আমাদের সুখে-দুঃখে, প্রাপ্তিতে-বিয়োগান্তে, আবেগে-অনুভূতিতে, অভিমানে-উদাসীনতায় যিনি মনের মণিকোঠায় সদা ধ্রুবতারা-সম নিত্য, তিনিই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আমার, রবীন্দ্রনাথ আপনার, রবীন্দ্রনাথ সবার॥ . **************** . সূচীতে . . .
যদি আমার পাখির মতো থাকত স্বাধীনতা-- যখন খুশি যেতাম ছুঁয়ে ফল-ফুল-লতা-পাতা। যদি আমার পাখির মতো থাকত দুটি ডানা-- ভূমি থেকে যেতাম উড়ে, থাকত না তো মানা। উড়ে উড়ে ঠিক একদিন যেতেম অচিন দেশে-- চাঁদের সাথে হাত মিলিয়ে, মেঘের সাথে ভেসে। সোনার পাহাড়, হীরের গাছ দেখতেম কত-শত ! ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমীরা গল্প শোনাত। শুক-সারি মোর বন্ধু হত, আর পরীরা হত সখী ! এসব হয়তো সত্যি হত, হতেম যদি পাখি। . **************** . সূচীতে . . .
ঝর্না : তুমি এসেছ? এই তোমার কথাই ভাবছিলাম। কখন তুমি আসবে-- তোমার গান শুনব-- কি মিষ্টি গলা তোমার! জানো, তোমার গান শুনব বলে আমি-- আমি রোজ পাহাড়ের উপর থেকে নেমে পাহাড়ের কোলে এসে বসি। শুধু তোমার গান শুনব বলে--
নাইটিংগেল: আমায় বলছ? আমার গান? আমার গান তোমার ভালো লাগে? আর-- আর কি যেন বললে? আমার গান শুনবে বলে তুমি পাহাড়ের কোলে ঝরে পড়ো? আমি তো ভাবতাম তুমি পাষাণ-বক্ষ সিক্ত করতে চাও- থাক ওসব কথা- এবার বেশ বুঝলাম, তুমিই তাহলে আমার গানের সঙ্গে তাল মেলাও।
নাইটিংগেল গান শুরু করল, ঝর্নাও তালে তালে নৃত্য শুরু করল, অমনি পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা ছোট ছোট ফুলেরা রঙিন পাপড়ি মেলে দুলতে লাগল। আর পাহাড় থেকে নাইটিংগেলের গান, ঝর্নার তাল, ফুলেদের আনন্দ প্রজাপতির পাখায় চড়ে উড়ে গিয়ে শান্ত বিস্তীর্ণ উপত্যকায় প্রাণের স্রোত বইয়ে দিল॥ . **************** . সূচীতে . . .
বল না মাগো, তোমার কোলে আসার আগে কোথায় ছিলেম আমি? কোথা হতে ঝুপ করে মা এলেম কোলে নামি? চাঁদের দেশে ছিলেম নাকি চাঁদমামার কোলে? নামিয়েছিলি তোর কোলে, মা, অনেক কথা বলে? ডালিম গাছে ছিলেম কি মা ডালিম ফলের ভিতর? একবারও কি ছুঁয়েছিলি মা, করেছিলি কি আদর? বল, তোর কোলে মা এলেম কোথা হতে? বায়না বুঝি ধরেছিলি আমায় কাছে পেতে? বল, বল, কোথা হতে মোরে পেলি? ছিলেম কি পেয়ারা পাতায়, সুগন্ধের ডালি? কোন দেশে যে ছিলাম আমি, কোন সে অচিনপুরে-- রাঙা ধুলোয় গোধূলি হতো-- মোর ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষুরে। ছিলেম বুঝি রাজপুত্তুর, তুই কি ছিলি রাণী? বল না মা, আমি কি আর অত কথা জানি? আগে সারাটা দিন একা একা কি করতিস মাগো? ভাবতিস, খোকা থাকলে হত কতই না ভালো! বল মা বল, আমের আচার করার সময় ভাবতিস মোর কথা? হত কি মনে, খোকা ছাড়া তোর একলা জীবন বৃথা? . **************** . সূচীতে . . .
যাচ্ছি দিগন্ত ছুঁতে বনানীর রঙে শ্যামলা হতে পুষ্প-পরাগ মাখব গায়ে খেলব মোরা বৃক্ষছায়ে উঠবে বাতাস ভরে ভরে কিশলয়ের তানপুরে- লুটিয়ে ঘাসে, দুলে শাখে ধরব সেথায় মনের মতো গান আড়াল থেকে আফশোসেতে শুনবি তখন লুকিয়ে পেতে কান॥
আয়রে তোরা যাবি তো চল, প্রাণ-চঞ্চল প্রাণোচ্ছল--
আর কোথায় যাবে?
যাচ্ছি দিতে সাগর পাড়ি, মানব না তো জারি জুরি- আনব খুঁজে ঝিনুক, মুক্তো যেখানেই তারা থাকুক সুপ্ত; জোয়ার জলে ভাসব মোরা- বল না রে ভাই, যাবি কি তোরা?
চুপটি থকিস অলস হয়ে, মুখটি কেন বোজা? ভাবছিস, তোর পারবি কিনা? কাজটা নয়কো সোজা? এই সুযোগ আর পাবি নে ভাই হয় যদি হাতছাড়া- একলা আমি যাবই রে ভাই না যদি দিস সাড়া॥ . **************** . সূচীতে . . .