কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই-এর কবিতা
*
রবীন্দ্রনাথ কার
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

যে শিশুটি বইমেলায় গল্পগুচ্ছের মলাটের দিকে আঙুল দেখিয়ে মাকে বলে, 'মা, দেখো-
আমার রবীন্দ্রনাথের বই--'
রবীন্দ্রনাথ তার।
যে ছেলেটি রোজ সন্ধ্যাবেলা হ্যারিকেনের আলোয় 'কিশলয়' খুলে পড়ে-
'আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে--'
রবীন্দ্রনাথ তার।
সদ্য কথা বলতে শেখা যে দুরন্ত ছেলেটা তার মায়ের গলা জড়িয়ে
আধো-আধো বুলিতে বলে,
'আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি --'
রবীন্দ্রনাথ তার।
'দিনের আলো নিবে এল সূয্যি ডোবে ডোবে
আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে চাঁদের লোভে লোভে'
-বলতে বলতে যে রাখাল গরু তাড়িয়ে গোয়ালে ফেরে, রবীন্দ্রনাথ তার ।
যে মেয়েটি স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে লাল পাড় সাদায় সেজে হারমোনিয়ামে সুর তোলে,
'আলো আমার আলো ওগো, আলো ভুবন ভরা-'
রবীন্দ্রনাথ তার।
যে কিশোরের সূর্যস্নাত মন সূর্যোদয় দেখে বলে ওঠে,
'আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর--'
রবীন্দ্রনাথ তার।
গ্রামছাড়া রাঙামাটির পথ যে আপনভোলা বাউলকে দেয় গভীর প্রশান্তি, রবিঠাকুর তাঁর।
যে পথিকের 'পথ চাওয়াতেই আনন্দ', রবীন্দ্রনাথ তাঁর।
যে মানুষটা কাঠের ওপর একটা দাড়িওয়ালা মুখ খোদাই করে
শান্তিনিকেতনে খোয়াই-এর হাটে বিক্রি করবে বলে,
রবীন্দ্রনাথ তাঁর।
রক্তে রুদ্রবীণার ঝংকার শুনে পুরুষশাসিত সমাজে নিজের অধিকার দাবি করা সেই
মহীয়সীর ;
রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া খবরের কাগজে রবি ঠাকুরের ছবি দেখে কাগজের টুকরোটা
কুড়িয়ে নেওয়া সেই স্কুলছুট ছেলেটার ;
সারাদিনের শেষে ক্লান্ত চিত্তে 'দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে' গাইতে থাকা সেই
গৃহিণীর।
কিন্তু কে এই রবীন্দ্রনাথ?
আমাদের সুখে-দুঃখে, প্রাপ্তিতে-বিয়োগান্তে,
আবেগে-অনুভূতিতে, অভিমানে-উদাসীনতায়
যিনি মনের মণিকোঠায় সদা ধ্রুবতারা-সম নিত্য,
তিনিই রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ আমার, রবীন্দ্রনাথ আপনার, রবীন্দ্রনাথ সবার॥

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
শ্রেষ্ঠা আমার দেশ
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

বর্ণে বর্ণে সূর্যের বর্ণালী ;
ধান্যে ধান্যে স্বর্ণের স্বর্ণালি ;
পুষ্পে পুষ্পে সৌরভেতে
নেশাতুর সদা অলি ;
সর্বস্থানে রয়েছে ছড়ায়ে
সোনা রঙের ধূলি।
রূপালী চন্দ্র জ্যোৎস্না রাতে
অতি লাবণ্যময়ী,
আমার দেশের সকলই সেরা,
শ্রেষ্ঠা রূপময়ী॥
নীলাভ ওই গগনেতে
শুভ্র জলদ শোভে,
প্রজাপতি কানন সাজায়
মধুর লোভে লোভে।
পক্ষীসকল ভোরাই গাহে
ঊষার আগমনে,
ধেনুসকল বাসায় ফেরে
গোধূলির ক্ষণে।
তারই শোভায় চক্ষু জুড়ায়,
রূপসী জন্মভূমি-
আমার দেশের সকলই সেরা ,
শ্রেষ্ঠা রূপময়ী॥

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
হতেম যদি পাখি
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

যদি আমার পাখির মতো থাকত স্বাধীনতা--
যখন খুশি যেতাম ছুঁয়ে ফল-ফুল-লতা-পাতা।
যদি আমার পাখির মতো থাকত দুটি ডানা--
ভূমি থেকে যেতাম উড়ে, থাকত না তো মানা।
উড়ে উড়ে ঠিক একদিন যেতেম অচিন দেশে--
চাঁদের সাথে হাত মিলিয়ে, মেঘের সাথে ভেসে।
সোনার পাহাড়, হীরের গাছ দেখতেম কত-শত !
ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমীরা গল্প শোনাত।
শুক-সারি মোর বন্ধু হত, আর পরীরা হত সখী !
এসব হয়তো সত্যি হত, হতেম যদি পাখি।

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দুর্গাপুজো
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

পুজো মানে মাতৃশক্তির আরাধনা-
পুজো মানে হাসি-ঠাট্টা-মজা ;
পুজো মানে স্কুল পালিয়ে কাশের বনে সোজা-
পুজো মানে শপিং, খাওয়া-দাওয়া,
পুজো মানে চারিদিকে খুশি-খুশি হাওয়া ;
পুজো মানে অঞ্জলিবদ্ধ করপুট ;
পুজো মানে স্কুলের শেষে কুমোর-বাড়ি ছুট।
পুজো মানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ঐকতান-
পুজো মানে- ঐ ডেকেছে আহ্লাদের বাণ-
পুজো মানে শিউলি-কাশের মেলা ;
পুজো মানে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ;
পুজো মানে রাগ-দুঃখ-অভিমান ভুলে ঠোঁটের কোনায় হাসি ;
পুজো মানে আনন্দ রাশি-রাশি॥

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ঝর্না ও নাইটিংগেল
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

ঝর্না : তুমি এসেছ? এই তোমার কথাই ভাবছিলাম।
কখন তুমি আসবে-- তোমার গান শুনব--
কি মিষ্টি গলা তোমার!
জানো, তোমার গান শুনব বলে আমি--
আমি রোজ পাহাড়ের উপর থেকে নেমে পাহাড়ের কোলে এসে বসি।
শুধু তোমার গান শুনব বলে--

নাইটিংগেল: আমায় বলছ? আমার গান?
আমার গান তোমার ভালো লাগে?
আর-- আর কি যেন বললে?
আমার গান শুনবে বলে তুমি পাহাড়ের কোলে ঝরে পড়ো?
আমি তো ভাবতাম তুমি পাষাণ-বক্ষ সিক্ত করতে চাও-
থাক ওসব কথা-
এবার বেশ বুঝলাম, তুমিই তাহলে আমার গানের সঙ্গে তাল মেলাও।

নাইটিংগেল গান শুরু করল,
ঝর্নাও তালে তালে নৃত্য শুরু করল,
অমনি পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা ছোট ছোট ফুলেরা রঙিন পাপড়ি মেলে দুলতে লাগল।
আর পাহাড় থেকে নাইটিংগেলের গান, ঝর্নার তাল, ফুলেদের আনন্দ প্রজাপতির পাখায় চড়ে
উড়ে গিয়ে শান্ত বিস্তীর্ণ উপত্যকায় প্রাণের স্রোত বইয়ে দিল॥

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দুর্গা বন্দনা
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

জয় জয় হে মাতা দেবী ত্রিনয়নী।
দুঃখহারিণী মাতা তুমি কপলিনী॥
জয়ন্তী তুমি মাতা, শান্তিদায়িনী।
রিপু বিনশিনী তুমি অসুরমর্দিনী॥
তব জ্যোতিতে হয় মাতা জগৎ আলোকিত।
কানন হয় গো মাতা পুষ্প শোভিত॥
কালী তুমি, নও কালো--
কালো তব রূপ-- সে যে জগতের কালিতে।
আবির্ভূতা হও দেবী যত কালো দূরিতে॥
সর্বভূতে অধিষ্ঠাত্রী তুমি শক্তিস্বরূপিনী।
পুস্তকে আছ মাগো বিদ্যাদায়িনী॥
মঙ্গলা তুমি মাতা, করো জগতের কল্যাণ।
সনাতনী তুমি মাতা, অজ্ঞানে দেহ জ্ঞান॥
জড়জনে দেহ প্রাণ, অন্ধরে আলো।
তব স্পর্শে, হে মাতা, দূর হোক কালো॥।
শান্তি রূপে আছ তুমি সকলের অন্তরে।
শ্যামলিমা তোমার দান ধূসর প্রান্তরে॥
সাহস দেহ মা গো, অভয়দাত্রী।
সুখদা, বরদা, তুমি মাতা ধাত্রী॥
বসুধা রূপে আছ এই বসুন্ধরায়।
মৃত্তিকা রূপে তুমি সবার আশ্রয়॥
দুর্গা রূপে তুমি মাগো দুর্গতিনাশিনী।
তুমি আছ সর্বস্থানে দশপ্রহরণধারিনী॥
মহিষাসুরমর্দিনী রূপে তব অকাল বোধন।
বাসন্তী রূপে বসন্তে তব আগমন॥
ভৈরবী তোমার নাম, তুমি ধুম্রবতী।
বগলমুখী তুমি মাগো, তুমি মাতা সতী॥
ভদ্রকালী রূপে তোমায় নিত্য পূজা করি।
শান্তি দেহ গো মাতা সব অশান্তি হরি॥
পার্বতী তুমি মাতা গিরিরাজকন্যা।
অপর্ণা তুমি মাতা, তুমি অনন্যা॥
বুদ্ধিরূপে তুমি আছ, আছ শক্তি রূপে।
নিত্য তোমারে পূজি পুষ্প-অর্ঘ্য-ধূপে॥
মহালক্ষ্মী রূপে আছ ধান্যের ক্ষেতে।
তোমায় স্মরি মাগো সিংহাসন পেতে॥
শ্রী রূপে ঐশ্বর্যে সদা বিরাজ তুমি।
পতিতপাবনী তুমি সবার জননী॥
হিমালয়নন্দিনী দেবী মহামায়া।
তব নাম স্মরণে শুদ্ধ হয় হিয়া॥
কন্যা রূপে তুমি আছ প্রতি ঘরে ঘরে।
তোমার কুমারী রূপ দেখে মন ভরে॥
বিদ্যরুপে তোমার প্রকাশ জানি হে জননী।
মাতৃরূপে সদা তুমি বিরাজমান জানি॥
দয়া রূপে মনের মাঝারে, আছ ক্ষমা রূপে।
জ্ঞানদায়িনী আছ হে সরস্বতী রূপে॥
সৃষ্টি রূপে তুমি মাগো সদাই বিরাজমান।
সুখ- শান্তি- সমৃদ্ধি নিত্য করো দান॥
আছ সবার হৃদয়ে, মাগো, তুমি দয়াময়ী।
অম্বিকা, চন্ডী তুমি, তুমি শক্তিময়ী॥
সর্বভূতে তুমি মাগো বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা।
প্রণাম চরণে তব শক্তিরূপিণী মাতা॥

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বসন্ত
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

বসন্তে এই ফুলের সাজে সেজেছে আজি প্রকৃতি,
গুলাল মেখে পাখায় পাখায় উড়ছে প্রজাপতি।
লেগেছে দোল পাতায় পাতায়,
কূজিছে কোকিল শাখায় শাখায়,
পলাশ ফুলের আগুন মেখে
ফাগুনরানী এলেন সুখে,
বসন্ত আজ সঙ্গে এল - তাঁহার খেলার সাথী।
কোথা রে সবাই-- আয় রে আয়--
লেগেছে যে দোল বনে বনে হায় !
জ্বালিয়ে দিয়ে খুশির চিরাগ,
রাঙা আবির, ফুলের পরাগ
আদুল গায়ে মাখতে আয়।
ফাল্গুনে আজ বসন্তের রঙের খেলা দেখতে আয়।

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
খোকার প্রশ্ন
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

বল না মাগো, তোমার কোলে আসার আগে কোথায় ছিলেম আমি?
কোথা হতে ঝুপ করে মা এলেম কোলে নামি?
চাঁদের দেশে ছিলেম নাকি চাঁদমামার কোলে?
নামিয়েছিলি তোর কোলে, মা, অনেক কথা বলে?
ডালিম গাছে ছিলেম কি মা ডালিম ফলের ভিতর?
একবারও কি ছুঁয়েছিলি মা, করেছিলি কি আদর?
বল, তোর কোলে মা এলেম কোথা হতে?
বায়না বুঝি ধরেছিলি আমায় কাছে পেতে?
বল, বল, কোথা হতে মোরে পেলি?
ছিলেম কি পেয়ারা পাতায়, সুগন্ধের ডালি?
কোন দেশে যে ছিলাম আমি, কোন সে অচিনপুরে--
রাঙা ধুলোয় গোধূলি হতো-- মোর ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষুরে।
ছিলেম বুঝি রাজপুত্তুর, তুই কি ছিলি রাণী?
বল না মা, আমি কি আর অত কথা জানি?
আগে সারাটা দিন একা একা কি করতিস মাগো?
ভাবতিস, খোকা থাকলে হত কতই না ভালো!
বল মা বল, আমের আচার করার সময় ভাবতিস মোর কথা?
হত কি মনে, খোকা ছাড়া তোর একলা জীবন বৃথা?

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
আহ্বান
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

আয়রে তোরা যাবি তো চল,
প্রাণ-চঞ্চল প্রাণোচ্ছল--

যাবে কোথায়?

যাচ্ছি দিগন্ত ছুঁতে
বনানীর রঙে শ্যামলা হতে
পুষ্প-পরাগ মাখব গায়ে
খেলব মোরা বৃক্ষছায়ে
উঠবে বাতাস ভরে ভরে
কিশলয়ের তানপুরে-
লুটিয়ে ঘাসে, দুলে শাখে
ধরব সেথায় মনের মতো গান
আড়াল থেকে আফশোসেতে
শুনবি তখন লুকিয়ে পেতে কান॥

আয়রে তোরা যাবি তো চল,
প্রাণ-চঞ্চল প্রাণোচ্ছল--

আর কোথায় যাবে?

যাচ্ছি দিতে সাগর পাড়ি,
মানব না তো জারি জুরি-
আনব খুঁজে ঝিনুক, মুক্তো
যেখানেই তারা থাকুক সুপ্ত;
জোয়ার জলে ভাসব মোরা-
বল না রে ভাই, যাবি কি তোরা?

চুপটি থকিস অলস হয়ে,
মুখটি কেন বোজা?
ভাবছিস, তোর পারবি কিনা?
কাজটা নয়কো সোজা?
এই সুযোগ আর পাবি নে ভাই
হয় যদি হাতছাড়া-
একলা আমি যাবই রে ভাই
না যদি দিস সাড়া॥

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নববর্ষ
কবি অলিপ্রিয়া সাঁবুই

নব বরষে আলোর পরশে, নব উল্লাসে নব হরষে
ভরিয়া উঠিছে প্রাণ-
এসো আজ তবে, এক হই সবে
ভুলিয়া সকল মান।
যার যাহা দুঃখ-ক্লেশ, করে দাও সব শেষ,
মনের কালোর মহামারীকে করো বিতাড়ন।
আজিকার দিনে বিশ্বভুবন, সূর্যস্নাতা ফুলের মতন-
আনন্দধারায় করিয়া স্নান, নব নব সুরে বাঁধে নব গান,
সাথে রাখে ভরসা।
নব গন্ধে নব ছন্দে মর্ত্যভূমির প্রতি রন্ধ্রে
জাগে নব আশা।
নব গীতি, নব প্রীতি, নব তৃপ্তি, নব দীপ্তি
বিকশিত হল আজি-
নববর্ষ এসেছে আজিকে
নব আনন্দে সাজি।

.              ****************                          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর