মূক কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র এটিই কবির ছাপামাধ্যমে প্রথম প্রকাশিত রচনা। বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার, শ্রাবণ, ১৩৪৩ সংখ্যায় (জুলাই ১৯৩৬) প্রকাশিত কবিতা।
তোমাকে বাসি ভালো এ কথা ক্ষণে ক্ষণে বলিব তোমা ভাবি সদাই মনে মনে। বলিতে যবে চাই কথা না খুঁজে পাই হতাশ হয়ে ফিরি আপন গৃহকোণে।
নীরব ব্যাকুলতা দেখো না চোখ তুলি তুমি যে চাও শুধু সাজানো কথাগুলি, কথার মালা গেঁথে পারিনে নিয়ে যেতে তাই তো আসি ফিরে আবার যাই ভুলি।
সবে যে আসে নিয়ে কথার সাজি ভরি চরণ ডালি দেয় রজনী-দিন ধরি অধরে ক্ষরে শুধু কপট কথা-মধু ওদের ব্যবহারে আপনি লাজে মরি।
কেবল আসি যাই না জানি কোন কাজে আমার মনোবীণা তোমার সুরে বাজে শুধু কি ভালোবাসা পাবে না কভু ভাষা গুমরি মরি যাবে আপন হৃদিমাঝে?
সঙ্গ কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত “পরিচয়” পত্রিকার, কার্ত্তিক, ১৩৪৩ সংখ্যায় (অক্টোবর ১৯৩৬) প্রকাশিত কবিতা।
ভালো লাগে তোমার একা থাকতে? ভালো লাগে? আমার লাগে না কিন্তু। সব সময় নয় অন্ততঃ। ধরো কোনো গ্রীষ্মের দুপুর--- গরমে দম বন্ধ হোয়ে আসে, এমনি এক দুপুর। তোমার টেবিলের ওপর রয়েছে--- অসংখ্য লোভনীয় গল্পের বই, নানাদেশের নানারঙের চোখ-ভোলানো মাসিক পত্র--- এবং আরও অনেক রকমের অনেক কিছু--- যা তোমার মনকে আকৃষ্ট করে অন্য সময়, কিন্ত এখন? এই গরম, গা ঝলসানো দুপুরে তোমার সে সব ছুঁতে ইচ্ছা করে কি? কী কোরবে তুমি?
চিলা কোঠায় গিয়ে শীতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়তে পার অবশ্য ফ্যান খুলে দিয়ে। কিন্তু অস্বস্তি আরও বাড়বে তাতে। খানিক পরে তুমি বাধ্য হবে উঠে আসতে। না যাচ্ছে শোওয়া, না বলা, না দাঁড়ানো, অস্তিত্বই হোয়ে উঠছে অসহনীয়। কী কোরবে ভেবে পাচ্ছো না, কোরছোও না কিছু ছটফট করা ছাড়া। এমনি এর দুঃসহ দীর্ঘ গ্রীষ্মের দুপুর কী কোরে কাটে বলো তো? এই সময় তুমি কি সঙ্গ কামনা করো না সঙ্গ কামনা করো না এমন একজনের--- যার সঙ্গে যা'তা নিয়ে গল্প কোরতে পারো যার সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার কোরলে সে ক্ষুণ্ণ হবে না, এবং সে যদি করে, তুমিও না? হাসি আর গল্পে, অজস্র লঘুতায় সুদীর্ঘ আর সুতপ্ত দুপুর কখন যাবে কেটে তুমি টেরও পাবে না। ভাবতে পারো : কী আরাম, মরুভূমিতে থেকেও তুমি কোনো কষ্ট পেলেনা, কারণ তুমি ওয়েসিসে ছিলে॥
কিংবা কোনো বর্ষণ-মুখর বিকেলই ধরো বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, কখনো খামবে সে ভরসা হোচ্ছে না, বাইরে যাওয়া যায় না, ঘরে থাকা দুঃসহতর, সব গেছে ভিজে। ভিঝে মাটির ভ্যাপসা গন্ধ আসছে তোমার নাকে তোমার মনও কি ভিজে যায়নি স্যাঁৎসেতে হোয়ে?
এমন সময় তুমি যদি পাও তেমন একজনকে--- যে বেশ ঝরঝরে রয়েছে মনে আর পোষাকে। সূর্য্যালোকের মতোই উষ্ণ আর উজ্জ্বল যার কথা আর হাসি যে ঔজ্জ্বল্যে তোমার ঘর আলোকিত হোয়েছে আলোকিত হোয়েছে তোমার মন, কী আরাম ভাবতে পারো?
ধরো কোনো ম্লান, বিষণ্ণ সন্ধ্যা! তুমি রুগ্ন, ভয়ানক রুগ্ন, ভালো-না-লাগা রোগে। তোমার মুখ দিয়ে চীৎকার বেরুচ্ছে না, এতো অসহ্যতর তোমার যন্ত্রণা, চুপ কোরে বোসে আছো। রোগ চিনেছো ওষুধ পাচ্ছো না খুঁজে। একস্পেরিমেন্ট করার মতো না আছে ইচ্ছা, না উৎসাহ। সেই মুহূর্তে তুমি কি কামনা করোনা তার সঙ্গ যাকে তোমার ভালে লাগে, সিম্পলি ভালো লাগে? তোমাকেও ভালো লাগে যার? যার খুসির ঢেউয়ে মনের ম্লানিমা যাবে ভেসে, ভেসে যাবে ভালো-না-লাগা। যার চোখের বৈদ্যুতিক আলোয় ঘুচবে সন্ধ্যার অন্ধকার, ঘুচবে মনের অন্ধকার। সুস্থ, স্বাভাবিক আর তৃপ্ত মনে তুমি বোলবে : কী আরাম!
প্রেমের অমিয় স্পর্শ---মধু শিহরণ বিদ্বেষ ঈর্ষ্যার বিষে ক্লিষ্ট তনুমন সরল বিশ্বাস আর সন্দেহ সংশয় অন্তরের প্রীতি বাণী---ক্রুর অভিনয় তৃপ্তিহীন বাসনার সুদুঃসহ জ্বালা রচিত কণ্টকপুষ্পে মুহূর্ত্তের মালা।
সীমাহীন রিক্ততার বিপুল বেদনা আশার আশ্বাস কভু কল্পনায় বোনা উন্মত্ত রক্তের নৃত্য কভু বক্ষমাঝে প্রশান্ত সুষুপ্তি চোখে কভু বা বিরাজে অসির ঝঞ্চনা আর ভীরু পলায়নে কী বিচিত্র পরিচয় জীবনের সনে।
শক্তির ঐশ্বর্য্য মোরে কত ঘিরে থাকে দুর্ব্বল দীনতা কভু পঙ্গু ক'রে রাখে কখনো ছুটিয়া চলি কখনো বা থামি দুর্গম বন্ধুর পথ উঠি আর নামি। মুহূর্তে মুহূর্তে মোর কী বিচিত্র রূপ বুঝিতে পারি না আমি নিজের স্বরূপ।
কানে কানে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
গুঞ্জরিত যে সুর আমার . তোমার কানে কানে রাগিণী তার না-ই রহিল . না-ই রহিল মানে।
অর্থ কি সুর চাই কি মোরা . চাই যে কানাকানি কানের কাছে সঙ্গোপনে . অধর যখন আনি।
তাই তো প্রিয়া হৃদয় তোমার . ভাসবে গানে গানে যা-ই কিছু না গুঞ্জরি গো . তোমার কানে কানে।
প্রিয়া প্রশস্তি কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
স্মরণ কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
নিশীথ নিঝুম যামিনী যখনো বিভোরে ঘুমোয় তোমার ভেঙেছে ঘুম। বলো তো তেমন ক্ষণে কোন্ কথা পড়ে মনে? খোলা জানালায় চাহিয়া অন্ধকারে কার কথা বলো মনে পড়ে বারে বারে?
যখন বাতাসে হাসনাহানার গন্ধ ভাসিয়া আসে ঘুমে শিথিলিত কবরী খুলিয়া পড়ে যেন কার মৃদু কোমল পরশ ভরে অঙ্গ তখন কোন্ কথা বলো স্মরি' কেবলি তোমার কাঁপে থর থর করি।
মেলিয়া হাজার তারা বিভোর আকাশ তোমাকে যখন দেখিছে পলক হারা, দেখার ভঙ্গী তার দেখে’ তব বলো কার কথা মনে পড়ে শুধু বারবার।
বিকাল কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
দুপুরের সাদা রোদ ক্রমে ক্রমে লাল হোয়ে আসে হেলিয়া পড়িল সুর্য্য ক্লান্ত দেহে পশ্চিম আকাশে, তোমার মধ্যাহ্ন নিদ্রা ভাঙো, হোলো জাগিবার কাল চোথ মেলে দেখো চেয়ে আসিয়াছে রঙীন বিকাল।
অনেক ঘুমালে তুমি বহু লেখা হোয়ে গেলো মোর এতক্ষণ দুই ভিন্ন স্বপ্ন-লোকে ছিলাম বিভোর, ওঠো, ওঠো, এখন যে হোয়ে এলো মিলিবার কাল পরিয়া রঙীন শাড়ী চেয়ে দেখো এলো যে বিকাল।
আকাশের নীল বুকে সে রঙের দাগ লেগে গেলো নানান রঙের ছিটা এখানে ওখানে এলোমেলো পড়িয়াছে আয়নায় সে রঙের কিছু উড়ে এসে তোমার অধরে, গালে, নয়নে, কপোলে, এলোকেশে।
বাতাসে উড়িছে চুল এলোমেলো শিথিল অঞ্চল বিকালের রঙে তারো চিত্ত আজি হোয়েছে চঞ্চল, অন্ধকারে একা একা তুমি শুধু ঘুমাবে কি ছবি বিচিত্র রঙের জাল বুনিয়া চলেছে যবে রবি?
কী লোভে এখনো তুমি বুজিয়া রয়েছ দুই চোখ তবে কি রঙীন আরো এরো চেয়ে তব স্বপ্ন-লোক রঙীন বিকালে বসি কোনো কবি বোনে কি সেখানে রঙীন কথার জাল গুন্ গুন্ করি’ তব কানে?
তাই বলো এ তো নয় পৃথিবীর বিকালের রঙ্ সুমধুর অনুরাগে আরক্তিম হোয়েছে বরং তোমর ও মুখখানি ; মৃদু মৃদু শিহরিত বুক গোপন স্বপন পুরে পেয়ে বলো কার স্পর্শ সুখ?
বরষা কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
বাহিরে বরষা ঝরে ডাকছো মোরে এখন ওখানে যাবো কেমন কোরে তুমিই এখানে চলে এসোনা নিজে আমার এ ঘরে এসো বৃষ্টি ভিজে।
ভিজলে তোমাকে বেশ দেখাবে ভালো ভিজবে তোমার দুটি নয়ন কালো মুক্ত কবরী হোতে ঝরবে বারি ভিজলে তোমাকে ভালো দেখাবে ভারি।
তোমার নয়ন হোতে কাজল যাবে বৃষ্টি কপোল হোতে রঙ্ মোছাবে সিক্ত বসন গায়ে লেপটে’ রবে ভিজলে ভালোই তুমি দেখতে হবে।
আমার ঘরের মাঝে বৃষ্টি হবে অঙ্গে তোমার জল ঝরবে যবে গভীর কৃষ্ণ তব কেশের রাশি সজল মেঘের মতো রহিবে ভাসি’।
আমার শ্রবণ ভরে বৃষ্টি হবে কণ্ঠে তোমার সুর ঝরবে যবে মধুর কণ্ঠ হোতে সুরের ধারা ঝরবে বাদল সম আপন হারা।
আমার চোখের ’পরে বৃষ্টি হবে ঝরবে তোমার সুধা দৃষ্টি যবে কাজল মেঘের দু’টি তারকা তলে কভু বা বাদল কভু বিজলী ঝলে।
আমার অধর ’পরে বৃষ্টি হবে অধরে তোমার চুমো ঝরবে যবে নয়ন অধর আর কপোল চুমি’ আনবে অঙ্গে মম বরষা তুমি।
প্রশ্ন কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
লিখিতে লিখিতে মোর যাহা কিছু রয়ে যায় বাকি অলখিত সে রচনা পড়ে নাকি তব দু’টি আঁখি? আপনার মনে মনে শোনো না কি মোর মৌন ভাষা ছন্দের বাঁধনে বাঁধা নাহি পড়ে যে বেদনা আশা, তোমার মনের কোণে তারাও কি ধরা দেয় নাকি, তব আঙিনায় নেমে আসে নাকি উড়ে যাওয়া পাখী?
হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ছুঁতে ছুঁতে আমার যে কথা বলিব বলিয়া বলা হয়নাকো যে সব বারতা, যাহারা পড়েছে ঢাকা বিস্মৃতির ঘন কুয়াশায় সন্ধ্যায় তোমার মনে ফেরে নাকি আপন বাসায়? ভীরু যারা ওঠে নাই আজো আর যাহাদের পাখা তোমার নিভৃত নীড়ে তারাও কি রহে নাই ঢাকা? মোর অকথিত বাণী যত মোর রাগিনী অগীত তোমার বীণার তারে বলো তারা হয় কি ঝঙ্কৃত?