কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্রর কবিতা
*
আনমনা
কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র
১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ
ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

মাধবী লতিকা ঝুলিয়া পড়েছে আমলকি ডাল হোতে
খসে মাঝে মাঝে এক একটি ফুল কুমারের@ ক্ষীণ স্রোতে
মৃদু ঢেউয়ে ঢেউয়ে কোথা ভেসে যায় অজানা দেশের দিকে
আনমনে তুমি কি দেখিছ হেথা চাহিয়া নির্নিমিখে।

এখানে ওখানে এলোমেলো ঘন সবুজ সুপারি সারি
কুমারের বুকে দুলিছে বাতাসে কাঁপিতেছে ছায়া তারি
আঁধার নামিয়া আসে ধীরে ধীরে ওপারের বেণু-বনে
চাহিয়া চাহিয়া এ সবের দিকে বলো কি ভাবিছ মনে।

কবরী ভাঙ্গিয়া ঘন কেশরাশি পড়িয়াছে খুলে খুলে
শিথিল আঁচল অবশ আবেশে লুটায় চরণমুলে
উন্মনা মন ভেসে গেল কোথা, অয়ি ধ্যান নিমগনা
চকিত পরশে তনু তো তোমার শিহরিয়া উঠিল না।

এ বিকাল বেলা বলো কি একেলা চলি আনমনে আজি
আপন খেয়ালে ভরিয়া ভরিয়া তুলিছে স্মৃতির সাজি
পিছনের পথে পড়িয়া রয়েছে শুষ্ক যে ফুলগুলি
আজি পুনরায় তাদের কি তুমি যতনে নিতেছ তুলি?

ফিরিয়া গিয়াছ কৈশোরে বুঝি কিংবা বাল্যকালে
সখা সখী সব ঘিরিয়া ঘিরিয়া বেঁধেছে প্রীতির জালে,
চিত্ত তোমার মত্ত বুঝি বা সেই মধুময় পুরে
খুসিতে ভরিয়া উঠিছে হৃদয়, পুরান সে কোন্ সুরে।

সেখানে তোমার খেলা ঘরে আজো চরণচিহ্ন আঁকা।
এখনো বাতাসে বাতাসে তোমার চুলের গন্ধ মাখা
উছল পুলকে উঠেছে মাতিয়া যত পুতুলের দল
ওঠে ক্ষণে ক্ষণে বিভল কণ্ঠে আনন্দ কোলাহল।

আমি বহু দূরে রয়েছি দাঁড়ায়ে শুভলগনের তরে
মধুর স্মৃতির খেলাঘর হোতে কখন আসিবে ঘরে
অতীত হইতে কখন বলগো ফিরিবে বর্ত্তমানে
অতল গভীর শান্ত নয়নে চাহিবে আমার পানে।

কানে কানে মোর কখন গাহিবে ধীরে গুন্ গুন্ সুরে
নিয়ে যাবে মোরে কখন কল্প সুদূর স্বপ্নপুরে।
আমার বক্ষে তনুখানি তব কাঁপিবে ছায়ার মত
অধরে অধরে মিলিয়া আসিবে নয়নে নয়ন নত।

@ - কুমারের - কুমার নদীর। কবির গ্রাম সগরদি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া “কুমার”
নদী।

.              ****************                
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ভাষা
কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র
১৯৩৮-৪০ সালে কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণুপদ
ভট্টাচার্য্যের মিলিত প্রচেষ্টা “জোনাকি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

হে আমার ভাষা
অসম্পূর্ণ এখনো প্রত্যাশা
তৃপ্তিহীন রহিল এখনো
কেনো
কেনো তুমি হোতে নাহি পারো
আরো তীক্ষ্ণ, আরো দীপ্ত, তীব্রতর আরো,
তোমার শাপিত দীপ্তি বিদ্যুতের মতো
কেনো চক্ষু করে না আহত?

বলো বলো কবে
স্পর্শে তব তীব্রতম তড়িতের সঞ্চালন হবে
কবে তব বৈদ্যুতিক তীক্ষ্ণদৃষ্টি আসি
অন্তরের অন্ধতম কক্ষগুলি তুলিবে উদ্ভাসি’।
কবে তব কলহাস্য ধারা
দীর্ণ করি বাহিরিবে অবরুদ্ধ পর্ব্বতের কারা
তীক্ষ্ণ স্রোতে ভেসে যাবে যার
গভীর নৈরাশ্য যত ঊর্দ্ধোত্থিত কর্ণভেদী যত হাহাকার।
বাসনার জ্বালাময় আশ্লেষের আকর্ষণে কবে
রোমকূপে রোমকূপে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ যত প্রজ্জ্বলিত হবে।
মাধূর্য্যের তীব্রতায় পরিপূর্ণ কিংবা কালকূটে
তোমার চুন্বন-রস আজো নহে উৎসারিত তব রক্ত ওষ্ঠাধারপুটে।
গুপ্ত সেই রস নির্ঝরিণী
কবে হবে উদ্বেলিত আজো যাহা উৎসমূলে অন্তরচারিণী?
রুদ্রনৃত্যে উন্মত্ত প্লাবনে
ছুটিয়া চলিবে কবে অতলগর্ভ প্রশান্তির সমুদ্রের পানে।

.              ****************                
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর