কবি তপন গাঙ্গুলীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
কবি তপন গাঙ্গুলীর পরিচিতির পাতায় . . .
অকালবোধন
কবি তপন গাঙ্গুলী

হয়তো প্রাত্যহিকতা, গার্হস্থ্য-প্রীতি
সান্নিধ্য-তাড়ণা ও সৃজন প্রক্রিয়ায়
ঘুম ও জাগরণের অংশীদারিত্ব নিয়েছেন তিনি...

কালো মেঘের কন্যারা সব মাথার উপর ঘুরে বেড়ায়
হঠাৎ রেগে ভীষণ বেগে দৌড়ে আসে সর্বনাশী
অঝোর কান্না মেখে এ-কুল ও-কুল দু-কূল ভাসায়
ভাসছে সাগর সমুদ্র নদ স্থলতরঙ্গে জলরাশি...

এমন সময় যে যার মতো করে গড়ে তুলুক নতুন ঘর
এদেশের জল, মাটি, রোদে --
প্রতিবাদে রাষ্ট্র ভেঙে দিয়ে যায়
নিয়তি-জর্জর স্বভাবের জীর্ণ বুনিয়াদ --

নিঃশ্বাসে জমে যাচ্ছে বুকের কঠিন বরফ
নারীর রত্ন লুটে নিতে উন্মত্ত নেকড়েরা
আশ্বিনের ঝড়ের মতো জুয়ায় মাতাল
নিঃশব্দ গান্ডীব কেঁপে ওঠে হাতে
নিরুপায় পেশী আলগা হয়ে গেছে।
তুষারজমা বুকের হাপর থেকে
একটুকরো আগুন পাশুপত পড়ে আছে

কে তাকে জুড়বে প্রতিজ্ঞার জ্যা-তে ---









*
দ্রোহ
কবি তপন গাঙ্গুলী

হৃদয়ের উষ্ণতাকে ঘিরে রেখো
ন ইলে প্রেম প্রেম খেলা অর্থহীন।
এক বুক শুন্য হৃদয়ে
পলিমাটি সরে গেলে
পুতুল গড়বে কি নিয়ে
সে তো শুধু ধ্বংসের বান ডেকে যাবে।

চৌরাস্তার মোড়ে থেকে
জনপ্লাবনের আশায় বুক বেঁধে
অনন্তকালের যাত্রী আমি,শুধু প্রেম চেয়ে।
যক্ষের আগল ভেঙ্গে কখনও বিস্মৃতিবোধে
ভাঙা বুকের পাঁজরের নাচে
সম্বিত ফিরে পাই,দ্রোহের আগুনে।









*
মহাকালের পদাবলী
কবি তপন গাঙ্গুলী

প্রতিবাদের পদ্য লেখা বেশ সহজ
রক্ত দোয়াতে ডুবিয়ে
যন্ত্রণার আঁচড় কেটে
তরতর করে
লিখে ফেলা যায়
সেসব পদাবলী...

কিন্তু যার ছেঁড়া জামাটিকে
লোকে মহাকাল বলে জানে
যার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে নেয়
শহরের বেশ্যা মায়েরা
যার ভেতর থেকে রাজবেশ পরে
মদের বোতল হাতে বেরিয়ে আসে
শহুরে বাবু বিবির দল।
আচমকাই সে বলে ওঠে --
আচ্ছা প্রতিবাদের সভাঘরটা
কোথায় বলতে পারেন?

বিশ্বাসের সেই জমিতে দাঁড়িয়ে
অনুভবে আসে পদ্যের উষ্ণতা।
বন্দুকের নল শেষ কথা বলে না ;
শেষ কথা বলে জাগ্রত বিবেক।










*
মৌনতা
কবি তপন গাঙ্গুলী

মৌনতায় তুমি বারবার আসো চিৎকার !
চিৎকারে চিৎকারে নতমুখ গরুর ঘাড়ে কিষানের লাঙল
গড়িয়ে গেলে ধানের ক্ষেত
সময়ের তোরন পেরিয়ে স্বপ্নের স্টেশনে থেমে যায়
রাতভাঙা পলাতক ট্রেন।
শালবনি ! আহা অস্টাপোভা !
স্বপ্নের গন্তব্য স্টেশন !
সকালের সাদা চাদরে সাজানো পডিয়াম
পলাতক রাজাধীরাজ ধীর গলায় বল্লেন,
আমি ভালোবাসি মানুষ !
ঈশ্বরের উদ্ভাস মানুষ !

একটি শিশু ছুটে যায় ভীড় ঠেলে আসন্ন রক্তপাতের দিকে !

চেন টানে তেভাগা,
চেন টানে নক্সালবাড়ি
চেন টানে ইলা মিত্র
চেন টানে কানসাট
মাতারীর গালে রুজ, ঠোটে লাল কানসাটের লিপস্টিক !

রাস্ট্র কেন চিরকাল কৃষকের রক্তভূক জারশেভিক !








*
দ্রোহকাল
কবি তপন গাঙ্গুলী

কোথাও একটা শুরু আছে নিশ্চয়
চুপচাপ বসে আছি তার ই অপেক্ষায়
রাজনীতি অর্থনীতিতে লোপাট দেশকাল
হরিমটরের অপলক অনিবার্য উপস্থিতি।

কেন এই ছায়ামুখ রহস্যের উপস্থাপনা
ভোটবাজিতে গোল্লায় গেছে দেশটা
দমবন্ধ হয়ে আসছে অশালীন ধোঁয়ায়
ভরা জোয়ারের দ্যোতনায় নোনাজল শূন্যতা।

কখনও সে নাভিমূল আঁধারে অমলিন একা
ক্ষেতভূমি ভিজে লাল হয়ে গেছে উপদ্রপে।
অর্থ অনর্থের মাঝে পরা অপরা ধারায়
ঘাড় কাত করে বসে আছি অনিমেষ পাহারায়।

রাজপথে অসহায় গনতন্ত্রের ঢেউ অবিরাম
পটভূমি থেকে উধাও রক্ত পিপাসুর কষাঘাত
জোনাকির শরীরে মুঠো মুঠো ভয়ের স্পন্দন
মাটিতে ও ধূলায় জেগে ওঠে যবনিকা পতন।








*
অস্তিত্ব
কবি তপন গাঙ্গুলী

মস্ত মাঠের মধ্যে দিয়ে গেছে
লালমনিরহাটের উঁচু রাস্তা
পথের ধারে ধারে আকন্দ গাছের ঝোপ
আকাশে জমে আছে কালো রঙের মেঘ
হয়তো একটু পরেই আসবে ঝড়!!!
কিশোরী মেয়েটিও হাঁটছে তাড়াতাড়ি
শঙ্খনথে পড়েছে অস্তসূর্যের আলো!!!

দুঃসহ বারুদগন্ধা দিবসের শেষে
খা খা শূন্যে বাজে পোড়া একা তালগাছ।
এমন প্রেক্ষিত জুড়ে শষ্যক্ষেত্রে বিচরণ --
ক্ষেতের পরিধি জোড়া ছায়া অবয়ব
বীজের মধ্যে জ্বলে ওঠা চকমকির পরাক্রমে
নৈশ হাওয়ায় আলোর গন্ধ ভাসে।
শস্যের স্তন বৃন্তে ঠোঁট চেপে
শিশু প্রজাপতি মুখ।
দেশ থেকে দেশান্তরে
পরবাসী হয়ে আমৃত্যু সূর্য স্তোক পাঠ।

কখনো রঙিন কবে এলাহি জীবন
কখনো নেহাতই কোনো ফেলে দেওয়া ভাঁড়ে
একমুঠো মাটি পেয়ে ঠাইনাড়া গাছ
অনিচ্ছাসত্ত্বেও তবু ঠিক বেঁচে যায়!

তবুও রক্তের জন্য কিছু স্বপ্ন রেখে যেতে চায়
যেমন রেখেছে কিছু পতন ও ঋণ
দাওয়ায় বসে ওর কাছে কিছু কিছু
মুনিয়া আর শ্বেতপদ্মের গল্প বলে যায়।
আজ আছি, কাল নেই -- পৃথিবীকে ভালবাসার
সময় পেল কৈ? আত্মজকে সে দায়িত্ব দিয়ে
রক্তের স্মৃতিকে দিয়ে গেল ছায়াপথ
আর অস্তিত্বের বন্ধকী দলিল।








*
নির্বোধ কবিতা
কবি তপন গাঙ্গুলী

পড়ন্ত বেলার শেষে
আকাশের শেষ সুর্য
দীপাবলী এঁকে দিয়ে
নিশ্চিন্তে লুকোলে
ক্রমশ জীবনের ব্যস্ততা ছেড়ে দিয়ে
সময়ের ক্লান্তি ফিরে আসে---
ড্র ইঙ রুমের সোফাতে হেলান দিয়ে
জানালায় আকাশের সামিয়ানায়
হাজার চুমকি বসানো জোনাকিরা
মিটমিট হাসছে---
দেওয়ালে টাঙানো ভারতের মানচিত্রখানা
ফুরফুরে হাওয়ায় কেমন হামাগুড়ি খায় ---

এখন রামের একটা নিব খুলেছি
প্রান জুড়াতে দু'পেগ নিতে চাই,
স্বপ্নের সমারোহ ইতস্তত থাকে কেন;
জড়ো হোক চাই,কৃষ্টির ভারতে ---
নিশ্চিন্তে প্রতিবেশী ধ্যানে মত্ত
সিরিয়ালের অলস সময়ে।
মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে আমার--
কবিতা লিখি কি করে;
সামনের ঢাউস টেবিলে হঠাৎ
ফোর-জি-র ওয়ালস্ক্রিনে জ্বলে ওঠে
ব্রেকিং নিউজ-এর লাইন-
ছাত্রাবাসে -কারাগারে মেয়েদের গোপনাঙ্গে হাত--
রাষ্ট্রযন্ত্র খুঁজে দেখে কি লুকোনো আছে !
খবর হয়েছে ---
অহনা,মধুজার অন্তর্বাসে পাওয়া গেছে
স্বাধিকারী গনতন্ত্রের পোড়ামুখ ছবি।








*
অকাল বোধন (২)
কবি তপন গাঙ্গুলী

অস্থির পায়চারির শেষে
ঠাকুরটাতো দিব্বি লাগছে বলতে বলতে
ভাড়া বেঁধে প্রতিমার মুখের কাছে
তরতর করে উঠে যায় রামু

চা দোকানের ছোট্ট ছেলেটার
বাপ মরেছে বিহানবেলায়
পাগলী মা-টা পাড়ার মোড়ে
ভিক্ষে করে রোজ দুপুরে --

রামুর পায়ে শৃঙ্খলের ক্ষতচিহ্ন
সে প্রতিমার কানে কানে
সড়ক কয়েদীদের কথা বলছিল
বলছিল গারদখানার কথা
যেখানে মানুষ গেলে
আর কখনও ফেরে না,
দীর্ঘ বিস্তীর্ণ উদ্দাম নদীমালা
আর প্রজাপতিদের নক্ষত্রপুঞ্জ
অথচ নদী আর রাত্রির
সারাটা দৈর্ঘ্য জুড়ে
রক্তাক্ত পদক্ষেপ!!!

পাহাড়ি ঝড়ের আবহে অসুরদলন
ফুল হাতে অসুরের সমর্পণ
শরীরী বিভঙ্গে গৎ ভাঙা শিল্পীর
মনের দুর্গা রামুর চোখে মা হয়ে ওঠে
পাগলী মা!!! হৃদয় ভাঙা মা!!!
সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত মা!!!








*
এই শরতে
কবি তপন গাঙ্গুলী

এখন শরত সময়-
চুপিসাড়ে শিশিরের বিন্দু
আসে নেমে।দুর্বার যৌবন নিয়ে
গঙ্গা ফড়িং সাথে
দোল খায় ফিঙে।

নদীর পালে জমে বাউলের সুর -
কমলা শরীর ভেঙ্গে
দেহবাদের ঢেউ,
আকাশ জুড়ে স্বপ্ন ভরে দিলে
দুর গাঁয়ের কৃষানীরা;
জ্যোৎস্নার সন্ধ্যায় নদী পার হয়।

এখনও বসন্ত ঢের বাকি-
নুপুরের শব্দে জাগে
নাচপরীদের ঢেউ।মস্তিস্কের শব্দকোষে
অক্ষরের জমাট আসরে
শুধু ভাললাগার অফুরান পদাবলী।

মেঘ আর জ্যোৎস্নার লুকোচুরি খেলা শেষে
একরত্তি চাঁদ ঘুমিয়ে গেলে একান্তে
কুমারী নদীতে স্নান সেরে যায়
দু:শাসন,দুর্যোধন অসুরের দল
চুরি করে নিয়ে যায় দেবীপক্ষের ষোলটা বছর।

চন্দ্রযুগ শেষে এত পথ এসে,
রাবন সংহারে -নীল পদ্মের খোঁজ
অকালবোধনে।পুড়িয়ে দাও আগুনে আগুনে
কুলুঙ্গিতে সযত্নে রাখা সংস্কৃতির পান্ডুলিপি যত
এখন শরত সময় -
নির্ভয়া দুর্গা চাই প্রতি ঘরে ঘরে।








*
একুশে ফেব্রুয়ারি
কবি তপন গাঙ্গুলী

একুশে আমার প্রথম প্রেম
একুশে প্রথম দৃষ্টি।
একুশে আমার ভাষাজ্ঞান
একুশে অমর সৃষ্টি।
একুশ মানেই ফাগুন আগুন
একুশ দামাল হাওয়া,

একুশ মানেই ফুলে পাতায়
দুলকি হাওয়ার খেলা।
একুশ মানেই ঘর সংসার
বন্ধু স্বজন সবাই
আহুতি আর আত্মত্যাগে
উজাড় করে দেওয়া।
একুশ মানে অভিমান আর
প্রতিরোধের মুখে
বেয়োনেটের গুলির সাথে
জীবন বাজি রাখা ।
একুশ মানে কৃষ্টি নিয়ে
সভ্যতার হাঁটা,
একুশ মানে ভাষা শহীদ
প্রাণের স্পন্দন তোলে,
শাহবাগের স্মৃতিফলকে
রক্ত গোলাপ ফোটে।
একুশ আমার চেতনার রঙ
আমার অনুসন্ধান,
একুশ আমার রক্ত তিলক
বিজয়কেতন উড়ান।
একুশ আমার অহংকার আর
গর্বে শপথ নেওয়া ;
একুশ মানে মাতৃভাষার

বিজয়মাল্য গলায়।
একুশ আমার নাড়ীর স্পন্দন
নিবিড় শান্ত ছায়া,
একুশ আমার মায়ের পরশ
আলতো আঁচল ছোঁয়া।
একুশ মানে ভাতৃত্ববোধ
আপন হতে পারা,
একুশ মানে চোখ রাঙানি
তুচ্ছ করে দেখা।
একুশ মানে জোয়ার-ভাঁটায়
ভাটিয়ালি সুর,
একুশ আমার প্রাণের আবেগ
স্বপ্ন সমুদ্দুর ।
একুশ মানে ভালোবাসার
আবির মাখানো হাত
একুশ মানে স্বপ্নপূরণে
জন্ম পুনর্বার।