কবি তপন গাঙ্গুলীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
কবি তপন গাঙ্গুলীর পরিচিতির পাতায় . . .
আহ্বান
কবি তপন গাঙ্গুলী

ভগ্ন মরুদ্যানে এখন
কৈশোর যৌবনের স্মৃতিচারনায়
এখন দ্বি-প্রহর বেলা।
মনের অলিন্দে বর্নাক্ষরগুলো
মানব বন্ধনের মতো
শব্দগুচ্ছ থেকে বাক্য হয়ে গেলে
বিশ্বাসের দুর্লভ তেজ কেমন
নিপাট ভদ্রলোক সাজে।
ক্লান্তির স্খলন বেড়ে
প্রবাহিত তরঙ্গ সামিল।

শুখা মাটি,শুখা ডোবা,
পত্রহীন গাছের শরীর
সোহাগে চুম্বন নিয়ে
বর্ষনের রাতে
নিশ্চিত ঋতুবতী হবে।

হাজারো কাজের মাঝে
হারিয়েছি যারে,ফিরে পেতে চেয়ে তাকে
কেন আজ নির্দয় আঘাত বাড়ায়।
সে কি শুধু ভেসে থাকা
নাক্ষত্রিক মেঘ ?

হাসি আছে,প্রান আছে,ভালবাসা
সেও আছে। ঐতিহ্যের ষোড়শ প্রচারে
ডালিভরা প্রাচুর্যের মাঝে,স্বাগত জানাব তোমায় -
তুমি আমার আজন্মের নবাগত মুখ।

এখানে বড় ই কষ্ট,মানুষের দীর্ঘশ্বাস
বোঝা হয়ে বাড়ে।অনাহারে মাটি চষে চাষা,
শষ্যের ঘ্রাণ নেয় নাকে।
গতর বিক্রীর বাজারে চলে নিরুদ্দেশে
বিদেশ -বিভুই মজুরের দল।
হাত আছে,কাজ নেই
পেট আছে,ভাত নাই,
শক্ত-পোক্ত হয়ে ওঠে
কল-মজুরের হাতের শেকল।

অভাগিনী রূপবতী দেশে আজ
দুধে স্নান,গোমূত্র সেবন।
সাধু-সন্তরা এখানে পণ্যের ফাঁদ পেতে
কর্পোরেট থেকে লোকমান্য হয়।

এসো তুমি নবাগত সাথী
বর্ষার ধারা নিয়ে চমকিত প্রবল গতিতে
ঋতুপর্ণ হয়ে ওঠো যৌবনের প্রথম সাক্ষাতে।
তছনছ করে সব-
ভ্রষ্টাচার ,দুরাচার,কুনীতির বিধি
মঙ্গল শঙ্খ বাজাও প্রতি ঘরে ঘরে।

সেই তুমি --
যে আমার আলিঙ্গন নিয়ে
কল্লোলিনীর রাজপথে,মানুষের সঙ্গে থাকার
একমাত্র শর্ত দিয়ে
রক্তের জোয়ারে আমৃত্যু ভেসে যেতে পারে।








*
দোটানা
কবি তপন গাঙ্গুলী

রক্তভেজা পথ ছিল নিজের
জলের মতো ফর্সা সকাল
ঝাঁপ দিতে ছিলোনা দোটানা,
পারিনি তখন পায় দ্বিধার দৈরথ
সোনারং দুপুর গড়িয়ে কিশোরেরা
গিয়েছিলো ছুটে।
তামাটে মাঠের দিকে অস্থির স্থিরদিক
রূপগঞ্জ জানে চিত্রার লিরিক
শিবশার জল জানে তুঙ্গভদ্রার লাল নদ।
শিউলি কুড়োনো সকালের সবটুকু রোদ
বুকে নিয়ে চঞ্চলা হারালো হাওড়ার ভিড়ে
আমাদের শৈশব হারালো ফুল্ল রোদ
মধ্য রাতে হুন্ডির হাতে পাল্টে গেলো
জন্মের শহর।
দুবের জঙ্গলে ফেলে টায়ারের চপ্পল,
খদ্দর পাঞ্জাবি,
মাওয়ের চাংসা ,
দাস ক্যাপিটাল,
পকেট পঞ্জিকার মতো শতফুলের বন্ধ্যা বন্দুক,
পৌঁছে গেছি থতোমতো খোয়াড়ে আটক.
জান্তব ট্যাংকগুলো নিয়ে গেছে রক্তভুক চাকা।
পকেটে নেই কারো দাহ্য কবিতার জিদ।
নক্ষত্র হারায় রোদ
নদী থামে জলের গহ্বরে
পাখিরা হারিয়ে ফেলে ডানার পালক
দমে দমে টের পাই লেনিনগ্রাদের চেয়ে শক্ত
টিকে আছে অনড় ভাস্কর্য।
মৌনতায় বেঁচে আছে বিশ্বাস দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসে !
পিয়ানোয় বাজে ঝাঁক ঝাঁক পাখোয়াজ
বেদনার বন্দিশে।








*
নির্বাসন
কবি তপন গাঙ্গুলী

এই কালো নির্বাসনে
অন্ধকার হয়ে উঠলো সাদা পাতা
জোনাকিরা হয়ে উঠলো অক্ষরমালা
সত্যকে টেনে এনে
ভ্যান থেকে ঠেলে ফেলে
গল্প বানালাম নিজের স্বার্থেই -
যদিও তার কোনও
স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ নেই।
নিরাপদ ট্রেন্চ খোড়া হয়নি
প্রতিরক্ষা ব্যুহ নেই,
তবুও ঈশ্বরের নিভৃত কক্ষে যেতে চাইলে
তারা থামিয়ে দিয়েছে নাস্তিক বলে।

উলঙ্গ ধরিত্রীর বুকে
অন্ধকার স্বভূমি
নিজের ধমনী কেটে
নিজেই করে রক্তপাত
এ যেন এক স্বেচ্ছামৃত্যু
পরিকল্পিত এক নদীর বুকে
যম নিয়ম আর সময়ের ব্যবধান
যার পর আর কিছু নেই








*
দ্রোহ কালের কণ্ঠ
কবি তপন গাঙ্গুলী

ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে
পোশাকের মত জড়িয়ে ধরেছি তোমাকে
এই নাও হৃদয়ের গন্ধ- -
শরীরের গন্ধ ভাসছে বাতাসে বাতাসে
আমার ইহকাল উড়ে গেছে
পরকাল ও ভেসে গেছে লতায় পাতায়
আমাকে দক্ষিণী বলো অথবা বামা .....

পোশাক ছাড়লেই শুরু হবে গণধর্ষন---
তারও পরে কালচে জলে ভাসবে মৃতদেহ

তুমি আমি অথবা আমাদের সন্তান
প্রশ্ন তুলবেই--
এটি কোন্ শর্ত আজ বিস্তৃত দুনিয়ার?








*
বর্ষা রানী অথবা নবজন্মের কাল
কবি তপন গাঙ্গুলী

দিনে রাতে মৃত্যুর পাঁচালি
ক্ষুধা,পুষ্টিহীনতা,অস্বাস্থ্যের বিধি
অথচ মানুষ দেখে সব সুখ কেড়ে নিয়ে
পৃথিবীকে চুষে খায়
সেও এক ভিন্নতর অন্য মানুষ।

শাল,মহুয়া,কেন্দু,ছাতিমের শরীর ধরে
শুকনো ঘাসের ডাঙায়
মালতী-মাধবের সাঁওতালী খড়ের চালায়
তুমি এলে প্রবল পুলকে।

বিষন্ন,বিমর্ষ সময় এখন-
গাঙুরের জলে কবে বেজেছিল
বেহুলার পায়ের নুপুর!
গাঙচিল উড়েছিল রূপসী বাংলার মাঠে
নুপুরের রুনুক ঝুনুক পায়ে
তুমি এলে,ক্রমশ আকাশগঙ্গা এনে
দহনের সব ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে।

আমি দেখি, কালোবরন কন্যার নাচে
রুপোলী শস্যের ঢেউ।
সংযমের সব কিছু লোকাচার ছেড়ে
নিথর বিবশ শরীর যৌবনের যৌনতা নিয়ে
শাল,মহুয়া,কেন্দু,ছাতিমের
উজাড় সমর্পনের
লাজে মাখা ভিজে যাওয়া
ব্যকুল প্রেমের ছবি।

স্তন বেয়ে রূপোলী দুধের ফোঁটা
জীবনের প্রথম মিলনের সোহাগ চুম্বনে
কামার্ত শরীরের নান্দনিক কলা।

আজ সারাক্ষন ধরে উৎসব হোক।
মিলনের উৎসব।
তোমার স্নিগ্ধ ধারায় কেবল আমি
মাথা গুঁজে খুঁজে নেবো
সেইসব পবিত্র ছবি,
যেখানে আমার তোমার সঙ্গম ঘিরে
জন্ম নেবে নবাগত-নবজাতকের মুখ।

তুমি থেকো রানী,
চিরকাল তোমার আমার দাম্পত্যের সুখে
ফুল ফুটুক শুকনো ঘাসের ডাঙায়।
পল্লবিত হয়ে উঠুক শ্যামল বনানী,
পৃথিবীর সব রোগ সব শোক সেরে
স্বস্তির গহনে যেতে শুধু প্রেম চাই।








*
ভাল মানুষের পো
কবি তপন গাঙ্গুলী

ভালো মানুষ ভেসে চলে সরল প্রলাপে
সে যেন শেকড়বিহীন এক মনোহারি গাছ
তার নিজস্ব গ্রাম,তার নিজস্ব শিল্প
নিজস্ব সৃষ্টি ভেবে গন্তব্যের দিকে যায় ----

কাকে ভালবাসে,আর কাকে ভালবাসতে চায়,
এরকম ভুল সে বরাবরই করএ--
ভালবাসা কোথাও বসত করেনি তার
তাই সে থাকেনি কোনও ব্ক্ষমূলে --

কালো ধরিত্রীর বুকে আরোও গভীরে
কোথাও তো জল আছে যা তার তৃষ্ণা মেটায়
ফসল নষ্ট হয় খররোদে,
চোখের কোনে জাগে বালিয়াড়ি ---

খুড়ে চলে দিনমান,জল শুধু জল চাই
ভেসে যায় তৃষ্ণার শব।
নৌকার কথা কখনও লেখেনা সে
তীর থেকে দূরে যেতে তার আজন্ম ভয়।

ভালবেসে তার মুগ্ধ রস পান করে যায়
মাটির কথা বলে,বৃক্ষের শরীর চিনে নেয়।








*
অর্ধেক আকাশ
কবি তপন গাঙ্গুলী

নীলাম্বরী শাড়ী আর এলোচুলে
তুমি যেন ঠিক অর্দ্ধেক আকাশ।
নক্ষত্রমালার মত বেলিফুলের কন্ঠহারে
অনেক রূপসী লাগছে তোমায়
ঠিক যেন শ্রাবন বর্ষার মত
ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আমায়
ঠিকানাহীন কোনও অমর্তলোকে।

এখানে রুক্ষ মাটি ভিজে ছপছপে হলে
কৃষকের কর্ষনভূমি থেকে
মাটির সোয়াদের গন্ধ নেমে আসে
দিগন্তে বিস্তৃত হয় গোধূলির
লাল টুকটুকে মেঘ

এখানে বটের ছায়ায় পাতার ফোকর দিয়ে
সূর্যি উঁকি মারে।
পাকুড়ের বীথি ঘিরে ঘোমটা দিয়ে চাঁদ
ফিসফিসিয়ে কথা বলে নির্জন প্রেমের।

আমি তখন তোমার অবগাহনে থেকে
স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ক্রমশ উত্তপ্ত হই..








*
ভিন্ন স্বর
কবি তপন গাঙ্গুলী

কাঁচা ঘাসকুটো দাঁতে চিবোতে চিবোতে
ঘনিয়ে তুললো চরম প্রতিবাদী স্বর

ধরো, এটাই দোষ আমাদের
এরপর আমরা ফিরে যাই যে যার আবর্তে
ছোট ঘরে দিন গুজরান
রুটি-কাপড় আর মকানের লড়াইয়ে
তুমি আমি সম্মিলনে নেই
অথচ--

কি সব লজ্জার কথা
আমরা দিনভর পথে
আর পথ ই আমাদের ঘর
সে ঘরে উলঙ্গ ধরিত্রী এসে
উড্ডীয়মান পতাকার আহ্বান জানালে
শুনি রক্তজীবনের আক্ষেপ -
খাদ্য চাই,খাদ্য দাও!

খাদ্য দাও !!

খাদ্য দাওও!!!

খাদ্য দাওওও!!!!








*
শহীদের উচ্চারণ
কবি তপন গাঙ্গুলী

আগুন রক্তের সোয়াদে
শহীদের উচ্চারণ -- ঘরে ফেরা হবে না।
সোনালী গমের শীষ সুগন্ধি রুটি,
গাঢ় অথচ কোমল গেহুবীজের আকর্ষণ
বিদায় বন্ধুরা যারা আমাদের ভালবেসেছিলে
গান গাইতে গাইতে প্রান্তর পেরিয়ে যাই
ফিরে যাই মাটির শিকড়ে
নিজেকে উজ্জীবিত করব বলে --
ঠিকানায় শীতার্ত তাঁবুর অবসর
বাস করি উত্তুঙ্গ প্রান্তিক প্রবেশ দুয়ারে।
পুরো দেশটাই আমাদের তামাম পৃথিবী।
রাস্তা মানেই তো -- আমাদের চলে যাওয়া,
সঙখ্যা মানে -- রয়ে যাবে আমাদের দৃঢ় শপথ।








*
ভালবাসাবাসি---
কবি তপন গাঙ্গুলী

স্বপ্নেরা ডানা ঝাপটালেই
তুমি বলো --
মাটি আর মানুষের দিকে তাকাও।

রাগী চোখে মাটির দিকে তাকালাম
কোনো সাড়াশব্দ নেই।

হাঁটু ভেঙ্গে মাথা নীচু করে
মানুষের দিকে তাকালাম
মানুষ নিরুপায়।

জীবনের দিকে হাত বাড়াই
মাটিতে দাঁড় করিয়ে রেখে
ডাই করা স্বপ্নদের নিয়ে
আকাশে উড়ে গেল জীবন।

হাজারো বিড়ম্বনায় জবুথবু মানুষ
স্বপ্ন উড়ানের লাল পরীকে
ক্রমশ আয়ত্তে আনার ভঙ্গীমায়
হাত বাড়াতেই ---

বৃষ্টিতে রোদে মেঘে মেঘলায়
নানাভাবে এই ভূবনডাঙ্গায়
উচ্চারিত হলো--ভালবাসি--ই--ই--ই---