কবি অমল বিশ্বাসের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
কবি অমল বিশ্বাসের পরিচিতির পাতায় . . .
মাশুল
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

সম্পূর্ণ জীবনে স্বরচিত ভুল
মাশুল দিতে গিয়ে যোগ্য শব্দগুলো জটিল হয়ে যাচ্ছে,
তবু ভাবছি, অসহ্য সুন্দর সেই কৈশোরবেলা
আবার ফিরে আসুক
যখন আমি শুদ্ধ স্বাধীন সত্য মানুষ ছিলাম।

নীরবে পড়ে থাকা মেঘবালকের প্রথম কবিতায়
আজ আর কষ্টবোধ নেই,
অস্তমিত সূর্যের মধ্যে রাত্রিশেষে ভোরের ইঙ্গিত পাই না
আলাদা করতে পারি না আলো আর অন্ধকার।

সেদিন অনেক পরিচিতের খোঁজখবর নিতে গিয়ে
বোকার মতো ঘরে ফিরে এলাম,
জন্মকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চেষ্টা করছিলাম
কাউকে ফিরিয়ে আনার
কিন্তু এখন আর সাঁতার কাটার সেই পুকুরটি নেই
সেখানে এখন অনেক বসতি।

আমার ভেতরকার অস্তিত্ব এলোমেলো যতিচিহ্ন সরিয়ে
যখন একটি কবিতা লিখতে বসলো
কে যেন বললো, ভুলের ধুলোতে সব ঢাকা পড়ে গেছে,
আগে মাশুল দিন।

*********************









*
রাগ কমলে আসিস
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

তোর রাগ কমলে একটু আসিস।
চোখের উল্লাস যখন অপেক্ষায় কাঁপতে থাকে
তখন অচেনা নদীর জন্যে অপেক্ষমান সমুদ্র
রুদ্র হয়ে যায়,
সীমাহীন সম্পর্ক, সৃষ্টির কিছু শ্রেষ্ঠ আবেগের
বিচ্ছুরণ ঘটায়।

বেশিরভাগ ফুল রাত্রিতে ফোটে,
অসতর্ক জলের গ্লাসে আঙুলে আঙুল লেগে
একটি বয়সে সবার জীবনে কবিতার জন্ম হয়।

নিঃশব্দে উন্মুখ সব ছন্দের আভিজাত্য খুলে
লজ্জা আর ইচ্ছেকে কিছুক্ষণ প্রতিনিধিত্ব করতে দে,
দেখবি আধো-আধো ঘুমঘুম চোখ থেকে
রাগের বর্ণ মিলিয়ে যাবে।

গলার স্বর থেকে আচমকা যখন বাঁধ ভেঙে ফেলবি
দেখবি মাঘের শীতেও শরীর থেকে ঘাম ঝরে
এ একধরণের যৌবনিক সংসর্গ,
তোর রাগ কমলে হৃদয়ের উষ্ণ অন্ধকারে
খোলামেলাভাবে একটু গল্প করতে আসিস,
রোজ আসিস।

*********************









*
অপ্রাসঙ্গিক জীবনধারা
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

সত্যি করে বল্ তো
না-খেয়েও তোরা কেমন করে বেঁচে আছিস!
খাই তো! গনতন্ত্রের এঁটোকাটা
রাজনৈতিক মেঠো-বক্তৃতার নির্যাস
স্বর্গীয় আদপকায়দায় উপাসনালয়ের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ
আর ডাস্টবিনে পশুদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে
বাসিখাবার, নৈশ-আবর্জনা, বোতল থেকে ঝরে পড়া মদ
সবকিছু ঘন্ট বানিয়ে খেয়ে ফেলি,
হজম হয়ে যায় কুকুরের লালচে লালায়।

মড়ক সঙ্গী করে চামড়ায় শরীরের হাড়গোড় ঢেকে
ধনিক-বণিকের কাছে কাঁচুমাচু হয়ে হাত পাতি,
চড়-লাথিগুঁতো শেষে
দুই-একটি প্লেটের কোনায় জমা মাংসের ছাট
আর ভেতরকার মজ্জা চেটেপুটে খাই।
তারপর মেঘের মতো সারাদেশ ঘুরে স্মৃতিসৌধ দেখি
দেখি অত্যাচারিত-অভুক্ত জীবন,
দিনকাল যা পড়েছে! দারোয়ানের হাতেপায়ে ধ'রে
সেখানে রাজকীয় ঘুম দিই।

মৃত্যুর মতো চুপচাপ ঘুম থেকে উঠে যখন ফটক ডিঙাই
নিজেকে রাজা-রাজা মনে হয়,
পথেপথে ঘুরে যখন বিবাহোৎসব, জন্মদিন দেখি
আনন্দে চিৎকার করে বলি, আর একটা দিন বেঁচে গেলাম!
ঠিক তখন মৃত্যু আর স্বাধীনতা গুলিয়ে ফেলি
অপ্রাসঙ্গিক জীবনধারায়।

জানতে এসেছেন
না-খেয়ে কেমন করে চিরবঞ্চিত হয়ে বেঁচে আছি,
অদ্ভুত মর্যাদাবান লোক আপনি!
সম্ভবত বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরবেন,
কী লাভ তাতে! যাদের কাছে অভুক্তের সংবাদ যাবে
তারা এ সংবাদ সমাধিস্থ করবে উদোম মাটিতে
যেমন আপনিও করেন।

আপনি ইতিহাসবিদ হবেন
চিত্রশিল্পী হবেন, ভুখানাঙ্গা দরিদ্রকে পুঁজি ক'রে
পুরস্কার-টুরস্কারও পেতে পারেন,
অথচ বিবর্ণমুখগুলো দেখে আপনার দয়াদাক্ষিণ্য হয়নি
আকাশি জামা কিনে দেয়ার ইচ্ছে হয়নি
ইচ্ছে হয়নি নোংরা শরীর স্পর্শ করে জানতে চাওয়া
প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছি কতোদিন!
কিংবা বকবক করার পর দুইমুঠো ভাত দেয়ার কথা
ঘুনাক্ষরেও আপনার বিবেককে নাড়া দেয়নি।

আপনি যেতে পারেন
আমাদেরকেও যেতে দিন, ডাস্টবিন খুঁজতে হবে,
না হলে পৌরসভার গাড়ি
ভাগাড়ে নিয়ে যাবে আমাদের বাঁচার খাবার।

*********************









*
তৃষ্ণা আমার বক্ষে
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

চোখ আচ্ছন্ন হলে কান দিয়ে দেখি
এবং যখন গভীরে যাই শুধুই শূন্যতা,
যতোই উপরে তাকাই
নীলকন্ঠ ফুলের রঙ আঙুলে মেখে অপেক্ষা করি।

অপেক্ষার বুকে
একজনের অনুপস্থিতি অনুভব করতে থাকি,
সে এখন অন্যপথে হাঁটে।

ছোট্টজীবনে বিচ্ছেদে কষ্ট পেয়ে কী লাভ!
হৃদয় ঝেড়েমুছে অন্য কাউকে বলি---
পাহাড়ের মাটি ছুঁয়ে ঝর্ণার জল হয়ে এসো
বড্ড তৃষিত আমি।

*********************









*
পালক বোনা রুমাল
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

একটি পাখি ঠোঁট দিয়ে তার পালক তুলে
রেখে গেছে ঝুলবারান্দায়,
তা দিয়ে এই বুকপকেটে রাখার মতো রুমাল হবে।

হঠাৎ আকাশ নীলবর্ণ ছড়িয়ে দিলে
আমার বাড়ির খোলা জায়গায় বিশাল একটি বাগান হবে
নীলকন্ঠ ফুল ঝুলবে নরম লতায়।

ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি নামবে
হয়তো কারো পায়ের নুপুর বেজে উঠবে ঘরের কোণায়,
নীল-তোয়ালে ছুড়ে দেবো তার উদ্দেশ্যে।

বৃষ্টি থামতে একচিলতে রোদ্দুর আসবে,
গান শোনাতে শ্রেষ্ঠ সুরে একটি পাখির বোল ফুটবে
পালক বোনা রুমালটিতে তখন একটি কবিতা লিখবো।

*********************









*
স্পর্শ মনে রাখতে পারি
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

যাকে ভালোবাসলাম
সে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখেনি কখনও,
জন্মান্ধ হয়েও লাবন্য ধরে রেখেছে
বুকে স্বপ্ন বেঁধে লালন করছে
ভালোবাসার দাগ।

ইন্দ্রিয় বিলাসে সে পারঙ্গম কি না
চেতনাঋদ্ধ হয়ে কখনও জানতে চাইনি
কতোটা তৃষ্ণা তার!

একদিন তার খোঁজে বেরুলাম
তখন স্নিগ্ধ সিক্ত ভোর,
ঘোর কাটতে এক অন্ধমেয়ের ধাক্কা খেলাম।

বিনয়ের সাথে সে বললো
জন্মান্ধ হলেও স্পর্শ মনে রাখতে পারি,
আপনি কি কাউকে খুঁজছেন!

*********************









*
কিছু হাতকড়া খুব সুন্দর
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

ক'দিন আগে শিশু ছিলাম
পাঁচবছরের বড়ো মঞ্জুদি'র কোলে উঠতাম
চুমু দিতাম, সেও দিতো
কখনো আমাদের ঠোঁট অবহেলায় নষ্ট হয়নি।
যখন আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি
করুণ কষ্টে লেখা একলাইনের একটি চিঠি পেলাম
'আমাকে গ্রহন করিস',
সাথে অভিমানে ভেজা কয়েকফোটা চোখের জলের দাগ।

গহন অন্তরের বয়স কমিয়ে
এক সুন্দরী অন্ধের সামনে গিয়ে আধোসুরে বললাম
মঞ্জুদি', অনেকদিন পরে এলাম,
সেই ছোট্টবেলার মতো আমাকে একটু কোলে নেবে?
নদীর পাড়ে যেমন জলের দাগ লেগে থাকে
সেরকম একটা চুমু দেবে?
দাও না!

মঞ্জুদি' লজ্জায় উঠে গেল
আমার মতো তরতাজা যুবকের শরীরে শৈশব দেখলো,
অস্তগামী সূর্যের আলোর মতো
পশ্চিমদিগন্তে ধুলোর অরণ্যে আমিও হারিয়ে গেলাম
চোখের চিহ্নে খানিকটা কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম
নির্বোধের মতো।

পঁচিশবছরের মঞ্জুদি'
অনুগ্রহের পাত্র শাড়িতে ঢেকে দরজায় দাঁড়িয়ে বললো
জানিস, কিছু হাতকড়া খুব সুন্দর, ভোলা যায় না
কিছু হাতকড়া কখনো পুরনো হয় না,
ভালো থাকিস।

*********************









*
ভাবনার দেয়াল
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

এখানে ভাবনার দেয়াল নেই
তাহলে নিষ্পত্তি হয়ে যেতো বেলেহাঁসের পুচ্ছ নাচানো
নিষ্পত্তি হয়ে যেতো চোখের উদ্দেশ্য,
বুকের তীর্থভূমির চূড়া থেকে
কেউ তুলে নিতো রাধা-অষ্টমীর খয়েরি দানা।

সত্যি বলতে কি! পাপড়ির আড়ালে কীট আছে বলেই
ফুটপাত থেকে তুলে আনা সমাজচ্যুতও
অন্নপূর্ণা হওয়ার অধিকার রাখে।

বারবনিতার ভাত
একই মাটিতে-একই কৃষকের ঘামের জলে জন্মায়,
পার্থক্য কি জানেন!
বারবনিতারা দেহবিক্রি ক'রে ডাল-ভাত খায়
বাঁচার ধর্ম বুকে নিয়ে ভাঙাচোরা খাটে ঘুমায়,
আর আমরা মনুষ্যত্ব চিবিয়ে
নির্ঘুম নিঃশ্বাসে তুলতুলে বিষাক্ত বিছানায় ঘুমাই
এখানেই ভাবনার দেয়াল আছে,
জন্মকালীন পরিশুদ্ধ অনেক শিশুর অন্তরকে
আমরা আমাদের স্বার্থে অন্ধ করে দিই---
পুরোপুরি ধর্মান্ধ!

*********************









*
আর একবার উঠে দাঁড়ালাম
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

এ বুকে আর মধ্যরাত আসে না!
তবু কে একজন আমাকে নিয়ে সম্পাদকীয় লিখলেন,
তারজন্যে আর একবার উঠে দাঁড়ানোর দরকার।

যে কোনো রঙের মেয়ে
এভাবেই আসুক, যেখানে ইচ্ছে বা অনুরোধ নেই
বিচ্ছেদে অন্তত মুখোমুখি বসা যায়।

চিকচিক রোদে শরীরের ছায়া মেখে ভেবে নিই
এই সেই কালো অপ্সরী,
যে আমার অস্তিত্ব নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলো---
কোথায় সে কবি!
যার অপেক্ষায় তার সমস্ত শারীরিক ইন্দ্রিয়
খুঁজেছিলো সাদা বরফের মতো গোলানো জলের সুখ।

আমার বুকে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি অক্ষর শব্দে পরিণত হলো
একটু অপেক্ষা করে কলম ধরলাম,
না, কোনো সম্পাদিকার মুখে চুম্বনের কথা লিখবো না
পর্ণকবি হিসেবে ঘৃণিত হতে পারি।

আমার গন্তব্য আমার ভেতরে রেখে
লোমশ করে তুললাম এযাবৎকালের বুকের শূন্য উঠোন
নিশ্চয় সেই কালো অপ্সরী নাক গুঁজে গন্ধ নিতে আসবে,
আর একবার উঠে দাঁড়ালাম
সে তার ইচ্ছেমতো আমাকে সনাক্ত করতে আসুক।

*********************









*
শরীর বড়ো ইচ্ছুক
কবি অমল বিশ্বাস
মিলনসাগরে প্রকাশ ২৫.১০.২০২৩।

আগুনের পাশে জল আছে, পুরুষ বলতে আমি।
ধ্বংসস্তুপ দেখবে কিছুক্ষণ পর
যদি ওষ্ঠাধারে আঙুল চেপে বলো, রমণে আমার কষ্ট,
আর ফুলের পসরাও সাজাতে পারো
যদি ওষ্ঠাধারে জন্ম দাও দুগ্ধস্রোতরূপী নদীর।

তোমার শরীরে যদি চোখের রশ্মি আগুন ধরায়
তবে কিছুক্ষণের জন্য ভেবে নিও সূর্যের শুদ্ধ কিরণ,
অন্তত সরোবরে একটি ফুল ফুঁটুক যুগল ইচ্ছের মন্ত্রে।

তারপর চলে যাবো
সাজাপ্রাপ্ত কোনো এক কবির সন্নিকটে,
ধ্বংসস্তুপ অথবা সাজানো বাগানের অনুভূতি লিখবেন
অপেক্ষায় থাকা সাদা কাগজের বুকে
শিরোনাম দেবেন, শরীর বড়ো ইচ্ছুক।

*********************