কবি আবদুস শুকুর খান-এর কবিতা
*
প্রেম পদাবলী
কবি আবদুস শুকুর খান


দেখা মাত্রই বুকের কুঁড়ি ফেটে ঝরে গেল রেণু
দেখা মাত্র-ই, সূর্যাস্তের বর্ণময় আলো
আরক্ত স্বরে বলে গেল---তোমার চোখের মতো
সুন্দর পৃথিবীতে আর কিছু নেই ; সেই থেকে
রোজ বুকের গভীরে ডেকে ওঠে পাখি, গান ধরে
সন্ধ্যার আসন্ন স্বপ্ন আনে বয়ে---- ধান জ্যোত্স্নায়
কুয়াশা ঢাকা মাঠ বিস্ময়ে, জিজ্ঞাসায়
কী এক লাবণ্য নিয়ে চেয়ে থাকে ; যেন বা
বন-ময়ূরী পেখম মেলে প্রকাশ করে সঙ্গম ইচ্ছা |


তোমার চোখের ভুবন ছাড়া স্বপ্নময়
অন্য কোনো চোখ নেই আমার ভুবনে |
তোমার শরীরে ঘ্রাণে ভিজে এ-শরীর
উষ্ণ হাতের যাদু পায় এ-হৃদয়
তোমার কন্ঠ যেন মেঘের নিক্কণ, নর্তকীর নূপুর,
কথার মাধুর্য যেন ঐশ্বর্য পুরাণ
তোমার চুলের মতো এত প্রশান্তির সমুদ্র কোথায় আছে
কোনখানে অরণ্য মায়া---
কত শতাব্দী ধরে পথ চেয়ে আছি
কত জন্ম জন্ম বেঁচে আছি
তুমি সত্য, চিরসত্য, চিরন্তন তোমার ভুবনে |


শরৎ মেঘের শুভ্রতার মায়া তোমার মুখে
ওই মুখে সম্প্রদান করব বিরহ, রাগ-অনুরাগ
অঞ্জলি দেব প্রেম, স্বপ্ন, আকাঙ্খা
স্বপ্নিল সুখে অমরত্বে যাব আমি,
বলব, তুমিই আমার আত্মার আত্মা,
বেঁচে থাকার অমেয় আলো, হে মায়া
তোমার জন্য পবিত্র জায়নামাজে, তসবিদানায়
মগ্ন উচ্চারণে সমর্পণে একা,
বসে আছি, দাঁড়ের পাখির মতো ঘরের খাঁচায় |


মননের আলো ঢেলে, স্বপ্নিল ভাষা দিয়ে
তোমাকে আকাশের নীলে নীল করে
বেঁধে রাখি, রাত্রি দিন তোমার নামে ঘুমাই
জেগে উঠি, অন্তহীন ডেকে যাই
দূর থেকে দূরান্তে, অন্তরীক্ষে, শূন্যের---- বিষে,
স্বপ্ন বিভাষে, একা, একাই |


কি নাম তোমার ? জানা হয়নি | নামেই বা কি কাজ !
তোমাকে যে নামেই ডাকি, তুমি আমার
আরাধ্য, হৃদয় রঞ্জিত কথাকার, চিত্রী, আমার তুমি |
আমি জানি ----- তুমি এলে
গাছে গাছে ফুল ফোটে, দুধ আসে ধানে
জ্যোত্স্নার প্লাবনে ভাসে পৃথিবী, তুমি এলে
ঋতুমতী হয় নারী, গর্ভে আসে ভ্রুণ |
তুমি চলে গেলে ---- ডানা মেলে পাখি
হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছাড়ে, ফাঁকা স্টেশনের স্তব্ধতায়
একা মন চুপচাপ, শিশির পতনের শব্দে কাঁপে পৃথিবী
তুমি চলে গেলে ;
পুষ্পবতী গাছ গর্ভ উন্মোচনের প্রতীক্ষা করে |
ঘাসের কুঁড়ি থেকে শিশির ঝরে ধুয়ে দেয়
তোমার চলার পথ |
হৃদয়ের অদম্য ইচ্ছা ছাই হয়ে ঘনায় আঁধার |


কে তুমি ?
তোমাকে দেখিনি কখনও ; শুধু কল্পনায়
বাস্তব অবাস্তবের ঘোরে নামিয়ে আমি চোখ
পদ্মপাতার জলের মতো ঢলে পড়ি ;
কে তুমি ?
আমাকে স্বপ্নাচ্ছন্ন করো আজীবন |
কী এক মায়া, সন্মোহনে নারীর জ্যোত্স্নায়
স্নিগ্ধ শান্ত করে মারো,
কে তুমি, দেখা-না দেখার অবস্থানে
আমাকে ডাকো |


তোমাকে না দেখে কাটে না সময়
নক্ষত্রবীথিতলে শুয়ে দিন যায়, রাত যায়
শবযাত্রীর মন্থর পায়ের মতো শুধু স্বপ্ন আসে
ভাবনার বৃত্ত থেকে অসীম ভাবনার |
তোমার কাছে যাবার কোন মাধ্যম নেই
শুধু চোখ বুজলেই-----
এস এম এস কিংবা ইন্টারনেটের চেয়ে দ্রুত
পৌঁছে যাই |
আমার হৃদয়ে অফুরন্ত আলো----তোমার রৌদ্রমাখা চিঠি |


চিঠি লিখি, অক্ষরবৃত্তে, পয়ারে, দলবৃত্তে
চিঠি লিখি, কবিতার ভুবনে
শিকড়ের ব্যঞ্জনায়, মেঘ পুঞ্জে, উপমার আকাশে |
জ্যোত্স্নার অক্ষরে,
তোমার লেখার সমস্ত বয়ান দেয় প্রকৃতি
হৃদয়ের কাক জড়ো করে ঘটনার খড়কুটো
সমুদ্র লহরী দেয় সুর ছন্দ
পাহাড় দেয় শৌর্য্য ; একাত্ম থাকার মন্ত্র |
তবুও লেখা হয় না, তোমাকে লেখা হয় না আমার |


তোমাকে জানার পর, হে প্রেম
গভীরে জন্মায় একটা নদী
যার স্রোতধ্বনি আমাকে জাগায়
যার কল্লোলে, বহমান ছন্দে তোমার সুপ্ত
জাগরণ, ঘুম |
তোমাকে দেখার পর,  হে প্রেম
আমার ঘুমন্ত সত্ত্বা যেন এক দুরন্ত ঘোড়া
দৌড়ে দৌড়ে ছুঁয়ে যায় তোমার নাভি
শ্বেত শুভ্র যোনি |
তোমাকে দেখার পর, আমি ভালো নেই------
হে প্রেম
এই জনপদে, মানব সংসারে বেঁচেও মরে থাকি |

১০
দিনে দিনে কত কিছু রূপান্তর হয় এ-পৃথিবীর |
যুগ বদলে যায়, মুখের ভাষা বদলে যায়
কত নতুন দিন জীর্ণ করে পুরানো দিন
জংধরা টিনের বাক্সের মতো পড়ে থাকে ধুলোয়
প্রাণের সজীবতা মরে যায়,
যুগ এসে দাঁড়ায় আসন্ন সন্ধিতে |                                                   
নবজন্মে ফিরে আসি আমি-----
তোমার জন্য হে প্রেম,
উদাসীন ডাকবাক্স হয়ে ঝুলে থাকি জীবনের
দেয়ালে ----

১১
আমার চোখের আলোয় লেখা এ প্রেম পদাবলী
জানি তোমার যোগ্য নয়
হৃদয়ের খসে পড়া পলেস্তারায় সহস্র স্বপ্ন
জানি আমাদের হবে না
আমি জানি ---- স্বপ্নের কেন্দ্র বিন্দুতে আমরা কেউ
কখনও পৌঁছব না,
আমাদের সীমারেখা আমাদের ব্যারিকেড করে দাঁড়াবে |
আমাদের অতিক্রম করে যাবে কাল
আমাদের ছুঁয়ে থাকবে মহাকাল
জন্ম-মৃত্যুর ঋজু রেখায় দাঁড়িয়ে দেখব ----
আমাদের চোখের গভীরে জন্ম হয়েছে অজস্র চোখ
আমাদের কথার ভিতরে জন্ম হয়েছে কথা
আমাদের মাটি হওয়া দেহের মাটিতে
উহ্য থেকে গেছে আকাঙ্খার মাটি
তুমি আছ--- এই সত্যনিয়ে আমি
পৃথিবীর প্রেমময় ঘাস হয়ে বাঁচব আরও সহস্র বছর |
বেঁচে থাকবে আমাদের প্রজন্ম-----
আমাদের মৃন্ময় পৃথিবী ----

.             *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর