কবি অজিত বাইরীর কবিতা
*
সেই দিনটির অপেক্ষায়
কবি অজিত বাইরী
কবি মনোজ মাজি কবিকে জানিয়েছিলেন যে এই কবিতার শেষ চারটে লাইন নাকি
আসানসোলের বহু অটো-চালক তাঁদের অটোরিক্সার পেছনে লিখে রেখেছিলেন।


আমি সেই দিনটির অপেক্ষা করি,
যেদিন সমস্ত বন্দুকের নলে ধরবে মরচে।
যেদিন জলপাই রঙের গাড়ি
আর জলপাই রঙের পোশাকের ভেতর থেকে
.                        বেরিয়ে আসবে প্রকৃত প্রেমিক।

কামানের গর্জন নয়, শোনা যাবে ত্রস্ত ডানার শব্দ :
সুদূর মানস-সরোবর থেকে
শুভেচ্ছা বয়ে আনবে পাখির দঙ্গল।

আমি সেই দিনটির অপেক্ষা করি,
মানুষের ঘন বসতির উপর গোলা নয়,
নেমে আসবে ঝাঁক ঝাঁক পাখি ;
শিশু আর ফুলের গুচ্ছে ছেয়ে যাবে রণাঙ্গন।

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ক্ষণোজ্জ্বল
কবি অজিত বাইরী
কবি আশিস সান্যাল ও কবি মৃণাল বসুচৌধুরী সম্পাদিত “বাংলা কবিতা ভূবন” (২০০৭)
কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।

রহস্য মনে হয়, ওই যে লতাবিতান
দুলছে --- আঁশের মতো অস্বচ্ছ জ্যোত্স্নায়।
কেউ কি এসে দাঁড়াত ওখানে ? দু'হাতের কাঁকন
বেজে উঠত শব্দ করে। পায়ের কাছে
নম্র নিবেদনে জড়ো হোত কয়েক ফালি জ্যোত্স্না।
জ্যোত্স্না নয়, নগ্ন পায়ের পাতা দু’টিকেই মনে হোত
অপরূপ, নৈসর্গিক, পবিত্র।

আজও বারান্দার ও-প্রান্তে এলিয়ে আছে লতাবিতান।
আজও চোখ বুজে দেখি সেই অপরূপ নিরাভরণ পা।
কেউ কি শুধাত কানে কানে : লেখো না কি
আজও ? কবিতার ভেতর দিয়ে ছুঁতে চাও আমাকে ?
বলেই যেন সহসা অদৃশ্য।
শুধু কানে বাজে রিনরিন কাঁকনের শব্দ,
দূরে থেকে দূরে সেই শব্দও ক্রমে বিলীন।
শুধু জেগে থাকে অস্পষ্ট যন্ত্রণা ;
তাকে ঠিক ছুঁতে পারি না, সারা জীবন
চেষ্টা করি মাত্র, যদি কখনও নাগাল পাই ক্ষণোজ্জ্বল মুহূর্তে।

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
সাত সমুদ্রের ঢেউ
কবি অজিত বাইরী
কবি অজিত বাইরী সম্পাদিত “দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকদের ১৫০ বছরের প্রেমের কবিতা”
(২০০৪) কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।


আমি তোমার শাড়ির পাড়ে এঁকে দেবো
আস্ত একটা নদী।
তোমার আঁচলে দেব সাত সমুদ্রের ঢেউ।
আর চুলে দেব ভরা-ভাদরের মেঘ।

আমি তোমার ওষ্ঠে জ্বালিয়ে দেবো আগুন
আমি তোমার উরুদেশে পাঠাবো অরণ্যের শিহরণ
আমি তোমার সর্বাঙ্গে এঁকে দেবো মাতাল চুম্বন
দুটি সমুন্নত পাহাড় কথা বলবে আমার সঙ্গে
সন্ধ্যায় তীরে ফেরা রাজহংসীর গ্রীবার
দুলুনি লাগবে তোমার গ্রীবায়
আর খোলা পিঠের অর্ধবৃত্তাকার আকাশ
আমার দৃষ্টিকে দেবে হাতছানি।

তুমি শুধু আমার হবে, হ্যাঁ, আমারই
আমি ততোটাই স্বার্থপর, বুনো বাইসন
যেমন ছেড়ে দেয় না দখলীকৃত জমি।

আমি পৃথিবীকে দু’টুকরো করে
এক টুকরো রাখবো নিজের জন্য, অন্য টুকরো তোমার
আমি তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেবো কুঁজো ভর্তি জল
আমি তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেবো ক্ষুধার অন্ন
আমি তোমার সঙ্গে জীবন ভাগ করে নেবো।

আমি স্বপ্ন দেখবো দূর-ভ্রমণের
যে ভ্রমণ আমাকে নিয়ে যাবে তোমার অন্তঃপুরে
আমি জাল বুনবো মাকড়সার মতো
সূক্ষ্ম, চিকণ ; প্রতিটি ব্যর্থতাকে ভরাট
করে নেবো মনোরম বয়ন-শিল্পে।
আমি পিঁপড়ের মতো সংযম ও শ্রমে
বয়ে নিয়ে যাবো জীবনের প্রতিটি মাধুর্যের দানা।
তুমি শুধু আমার হবে।

আমি তোমার শাড়ির পাড়ে এঁকে দেবো
আস্ত একটা নদী।
তোমার আঁচলে দেব সাত সমুদ্রের ঢেউ।
আর চুলে দেব ভরা-ভাদরের মেঘ।

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিশ্বজননী
কবি অজিত বাইরী
পার্থ ঘোষ ও অনীশ ঘোষ সম্পাদিত “বড়োদের আবৃত্তির কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া।


বুড়িমাকে মনে পড়ে ? সেধে বাড়ি বয়ে এসে
.                বলেছিলেন, ‘সুখে থাকো বাবা---
তোমরা সুখে থাকলেই আমার সুখ |’

আমি বুড়িমার সুখানুভবের আপাত
.                কোনো কারণ খুঁজে পাই না |
আমি কখনও তাঁর কোনো উপকারে লেগেছি
.                মনেও পড়ে না |

দারিদ্র-লাঞ্ছিত বুড়ি, শুধু আমি গ্রামে ফিরেছি
জেনে, অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে
একপলক চোখের দেখা দেখতে এসেছেন |

লোলচর্ম দু’খানি বাহু, ততোধিক নিষ্প্রভ চোখ—
স্পর্শ করতে চাইলেন আমাকে | আঙুল
বোলালেন চোখে-মুখে ; আর
তাঁর সারা মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো

টের পাচ্ছিলাম, তাঁর আঙুল-চুয়ানো
.                স্নেহের শিহরন |
আমি তার সুখের নিমিত্তভাগী হইনি কখনও
দুটো পয়সা হাতে দিয়ে বলিনি,
.                যা ইচ্ছে হয় কিনে খেয়ো |
মানসিক কৃপণতায় আমার দারিদ্র
.                প্রকট হয়ে ওঠে |
আর ঐ সম্বলহীন বুড়ি, পার্থিব
সুখ থেকে বঞ্চিত, শুধুমাত্র
.                ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে আছে ;
এমনই কাঙালপনা, এমনই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার
.                বুক-ভরা আকুলি-বিকুলি !
স্নেহদানে অকৃপণ, ঘোর-বিস্ময়ে
.                তাকাই বুড়ির মুখে—
অন্ন, বস্ত্রের নেই যার সংস্থান ; নিত্যদিন
আপন মৃত্যু – কামনাই যার অভীষ্ট, খাঁচার মতো
.                ঐ-টুকু ছোট্ট বুকে
পুষে রেখেছেন এমন স্নেহকাতর মহাপ্রাণ ?

স্বার্থের চোরাবালিতে নেমে সম্পর্ক খুঁজি ;
ভাবি, বুড়ির সঙ্গে কি আমার সম্পর্ক ?
.                না রক্তের না আত্মীয়তার |

পা ছুঁয়ে প্রণাম করব কিনা
.                ভাবছি মনে মনে,
তখনই তাঁর স্নেহার্দ্র হাত আমার শিয়রে |
বিশ্বজননী, সেই স্বার্থহীন বুড়ি, ভাগ্যিস
.                আমার ভেতরটুকু দেখতে পাননি !

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আঁশবঁটি
কবি অজিত বাইরী
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” থেকে নেওয়া।

খাড়া হয়ে আছে আঁশবঁটি
আর স্তব্ধ হয়ে আছে সংসার !
জানু ভেঙে বসেছে
মুহূর্তের মাঝখানে তেজস্বী রমণী ;
আগুনের মতো জ্বলছে ডুরে শাড়ি |

আগুনের মতো জ্বলছে ডুরে শাড়ি
মন্ত্র-মুগ্ধ বিশ্ব-সংসার
সেই তীব্র মুহূর্তটিকে বিদ্ধ করছে |
আর শীতল পিচ্ছিল রৌপ্যোজ্জ্বল
দীর্ঘ-পুচ্ছ মীন তার দু’হাতের মুঠিতে বন্দী |

তার দু’হাতের মুঠিতে বন্দী
প্রায় হিম, নিস্তেজ, শান্ত মীন |
এখুনি রক্তপাতে ঘটে যাবে চরম বিপ্লব |
রৌদ্র-শাসিত উঠোনে তীব্র খাড়া আঁশবঁটি |
চকিত চাবুকে কেঁপে উঠবে দিগন্ত ;
আর দুটি দেহ-খণ্ড জীবনের অন্তিম জেহাদে লাফাবে |

জীবনের অন্তিম জেহাদে লাফাবে দুটি দেহ-খণ্ড
আর একটি রক্তের ধারা নদী হয়ে সাগরে ছুটবে |

নদী হয়ে সাগরে ছুটবে রক্তের ধারা |
খাড়া হয়ে আছে আঁশবঁটি
আর স্তব্ধ হয়ে আছে সংসার |
আগুনের মতো জ্বলছে ডুরে শাড়ি |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বাঙ্ময় পৃথিবী
কবি অজিত বাইরী
নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী ও কালিদাস ভদ্র সম্পাদিত “আবৃত্তির শ্রেষ্ঠ কবিতা” থেকে নেওয়া।

বোবা ছেলেটি গরাদ ধরে জানালার
আকাশে বিছিয়ে রেখেছে চোখ |
তারায় তারায় ঘন্টাধ্বনি
কানে তার পৌঁছোয় কি না কে জানে !

গরাদের ফাঁকে আকাশে চোখ—
নিসর্গ করেছে রচনা স্তব্ধতার কবিতা |
ভাষা উচ্চারণে অক্ষম
হৃদয় দিয়ে পড়ে সে অক্ষরমালা |

বিলোল পাতা খসে গ্রীষ্মসন্ধ্যায়
ছেলেটি চেয়ে থাকে নির্নিমেষ |
না-বলা কথার ভেতর
বুদ্ বুদ হয়ে ফোটে শত কথা |


দিন আসে, দিন যায়, রাত আসে
বোবা ছেলেটির চোখ গরাদের ফাঁকে,
মুখে তার ভাষা নেই,
দু-চোখে পৃথিবী বাঙ্ময় হয়ে আছে |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ধুলো থেকে তুলে নেব স্তব
কবি অজিত বাইরী
মেঘ বসু সম্পাদিত “হে প্রেম” থেকে নেওয়া।

ফিরে যাচ্ছি তোমার দরজা থেকে দহনবেলা
সাক্ষী রইল পথের তৃণ ও তরুশ্রেণি |
সাক্ষী রইল ঘুঘু-ডাকা দুপুর আর
কঞ্চির ডগায় জলাশয়ের নীলকন্ঠ পাখিটি |

ফিরে যাচ্ছি, পা সরছে না, মন
পড়ে রইল পিছনে, কিছুতে ভ্রূক্ষেপ
নেই তোমার, অন্যমনস্ক নাকি ইচ্ছাকৃত
উদাসীনতার মোড়কে মুড়েছ নিজেকে ?

ইচ্ছে করে কাচের দুর্গের মত ভেঙে তছনছ ক’রে দিই
তোমার নির্লিপ্ততা, আমি অধিকার
প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলাম, পৌরুষের
আত্মাভিমান নিয়ে ফিরে যাচ্ছি,
একদিন ঠিক প্রতিশোধ নেব |

দরজা হাট ক’রে ডাকবে যেদিন
সমস্ত অনুনয় ধুলো হয়ে ঝরবে ;
আমি ধুলো থেকে তুলে নেব স্তব |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নির্জন স্টেশন থেকে
কবি অজিত বাইরী

নির্জন স্টেশন থেকে নির্জনতম স্টেশনের দিকে
.                        চলে যাব একদিন।
টেবিলে পড়ে থাকবে কাপ-ডিস
প্যাড, লেখার কলম, ছাইদান।
ছোট্ট জানালা, জানালার বাইরে পৃথিবী,
নিজেকে চুপিচুপি সরিয়ে নেব আড়ালে।
মেঝের উপর পড়ে থাকবে টুকরো কাগজ
ছেঁড়া খাম, বাতিল পাণ্ডুলিপি, খালি রিফিল।

নির্জন স্টেশন থেকে নির্জনতম স্টেশনের দিকে
.                        চলে যাব একদিন।

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
উন্মোচিত হও
কবি অজিত বাইরী

‘তুমি আকাশের মত নির্ভাণ হও’---নিজেকেই বলি।
চতুর্দিকে আত্মক্ষয় আর মূল্যহীন জীবন-যাপন---
নিজেকেই বলি ‘কোমল বাগান হও তুমি।’        
দু’চারজন থাকে, মানুষ সম্পর্কের যারা ভুল ধারণার
জন্ম দেয়, তুমি তাদের উপেক্ষা করতে শেখো।
ভালো মানুষ আগে ছিল, এখনো আছে, পরেও থাকবে।
দু’ একজনকে দিয়ে সমস্ত মানুষ সম্পর্কে
.        ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ো না।
নিজেকেই বলি ‘দিগন্তের মত উন্মোচিত হও,
.        আকাশ হও তুমি।’

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শাশ্বত
কবি অজিত বাইরী

গন্ গনে আগুনের দিকে তাকিয়ে
ভাবছিলাম তোমার কথাই ;
আগুন সত্য, তুমি তার থেকে কম সত্য নও।
হৃদয়ের চেয়ে বড়ো মহাদেশের কথা
জানা নেই আমার,
শুনিনি, জীবনের চেয়ে দীর্ঘ স্বপ্নের কথা।
দাঁড়িয়ে রয়েছি না-ফুরনো পথের উপর
আর ভাবছি,
আমার এই দুটি চোখে
আকাশ-ভরা বিন্দু বিন্দু আলোর মতই
তুমি শাশ্বত।

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর