কবি অজিত বাইরীর কবিতা
*
সতীশমাস্টারের মেয়ে
কবি অজিত বাইরী

আজ আকাশে ছাইরঙা মেঘের ছড়াছড়ি,
যে-কোন সময় বৃষ্টি নামবে।
আজ সীতাপুর প্রাইমারী স্কুলের সতীশমাস্টারের
.                ছোট মেয়েকে মনে পড়ছে খুব।
লাজুক মুখ, পিঠের উপর খোলশ-ছাড়া
সাপের মত লম্বা বিনুনি দুলিয়ে
আমাকে প্রতিসন্ধ্যায় উপহার দিতে যেত
.                একথোকা গন্ধরাজ।

আজ এই মেঘলাবেলা মনে হয়,
পৃথিবীর সারা অঙ্গে সেই গন্ধ
দিঘির জলে সবুজ সরের মত ভেসে আছে।

সেই কিশোরী কবেই পরি হ’য়ে গেছে
.                শূন্যের শাহীবাগে।
প্রতিরাতে সে ফুল পাড়ে, ফুল কুড়োয়
কিন্তু কে নেয় হাত পেতে তার অর্ঘ?
সে কি কোন দেবদূত? সে কি কোন সমুদ্র-কিন্নর?
আজ আকাশে ছাইরঙা মেঘের ছড়াছড়ি,
থেকে থেকে মনে পড়ছে বৃষ্টিক্ষতের মত
সতীশমাস্টারের ছোট মেয়ের মুখ।

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আমাকে নিবেদিত হ’তে দাও
কবি অজিত বাইরী

আমি মানুষের মত বাঁচব,
আমাকে অশ্রুহীন কোর না।
আমার দুঃখের কালো সলতেগুলি
অশ্রুতে ডুবিয়ে নিতে দাও।

আমি মানুষের মত বাঁচব,
আমাকে অবিনয়ী কোর না।
ব্যথার অক্ষরগুলির কাছে
আমাকে নিবেদিত হ’তে দাও।

আমি মানুষের মত বাঁচব,
আমাকে মিথ্যাচারে কৃতঘ্ন কোর না।
ভালবাসার ঋণ স্বীকারে
মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে দাও।

যে আগুনে স্পষ্ট হয় মুখচ্ছবি,
সেই আগুন হোক আমার ধর্ম।

.              ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
এ আমার বাপের জমি
কবি অজিত বাইরী

এ আমার বাপের জমি
এ জমি চোদ্দপুরুষের চোখের জলে নোনা
এ জমি কালো ঘামের মত কালো
চোয়াল-ভাঙা চাষাড়ের মুখের মত এবড়ো-খেবড়ো
এ আমার বাপের জমি।

বলদোর লেজ মুচড়ে লাঙল ঠেলতে
এ গাঁয়ে তাঁর জুড়ি ছিল না।
এ গাঁয়ে আমার বাপই প্রথম
বন্দুকের সামনে তুলে ধরেছিল লাঠি
এ জমি চোদ্দপুরুষের চোখের জলে নোনা
এ জমি কালো ঘামের মত কালো
এ আমার বাপের জমি।

.              ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দ্রোহ
কবি অজিত বাইরী

গণার ঘরে আগুন দিতে যাসনি লখা,
হাওয়ার গতিবিধি ভাল না, কখন যে
হাওয়ার টান কোন দিকে, বোঝা দায়।

ওর ঘরের আগুন তোর ঘরের চালে
ঝাঁপ দেবে না---কে বলতে পারে?
পরের কথা শুনিসনি লখা, ঘরে ফের।
এখন যারা পাশ থেকে তাতিয়ে তুলছে
আপদকালে কেউ থাকবে না পাশে,
ফের লখা, ঘর সামার দে নিজের।
ঝাণ্ডা উড়িয়ে যারা টানতে চায় দলে,
তারা তোর কেউ না ; পড়শীকে শত্রু
বানাবার ছলে তোর সুখ কেড়ে নেবে।

তির-ধনুকে সেজে কার বুক বিঁধতে চাস?
জমি দখলের লড়াই? --- মিছে কথা।
গণার বুকে রক্ত ঝরলে, তোর বুকেও বিঁধবে
তির ;  কথা শোন, মাথা খা আমার।
হাওয়ার গতিবিধি ভাল না, অন্যের কথায়
নেচে নিজের সব্বোনাশ করিসনি বাপ!

.              ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মুরা কার কথা শুনি
কবি অজিত বাইরী

ই-গাঁয়ে ইস্কুল বানাইচে পুলিশ
লিখাপড়া শিখাবে মুদের।
ইসকুলে মিড্-ডে মিল দিবেক নাই?
দিবে, দিবে।
অপুষ্টির জন্যি পচা চাল-ডালের
খিচুড়ি দিবে।
লিখাপড়া শিখাতে ই-গাঁয়ে ইসকুল
বানাইচে পুলিশ।

কিন্তুক, ইসকুলে যাবেক কে?
ডর লাগচে বুকে।
উরা বলচে, বন্দুক ফিঁকা শিখাব,
মাইন-পাতা শিখাব।
উরা গেরিলা বানাইবে মুদের।
জান কবুল, মুরা কার কথা শুনি?
ডর লাগছে বুকে।

.              ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কুয়ো
কবি অজিত বাইরী

কুয়োর পাড়ে জড়ো হয়েছে দূর দূর
গ্রামের মেয়েরা ;
ঘড়া ভ’রে ফিরে যাবে নিজ-নিজ গ্রামে।
গ্রামে গ্রামে জলের আকাল।

জলেরও কত জাত বিচার।
জলকে ছুঁলে জলও কি অস্পৃশ্য
হয়ে যায়?

তাই এক হরিজন সারাজীবনের সম্বল
দিয়ে একটি কুয়ো খোঁড়ার কথা ভাবে---
একটি কুয়ো, যার কোনো
জাত ধর্ম থাকবে না।

যে কেউ তৃষ্ণা মেটাবার কালে
ভাবনে না, এটা একজন
হরিজনের খোঁড়া কুয়ো।

.              ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
খাজনা
কবি অজিত বাইরী

---দলিলে সব নিকা আছে, দেকে দেন্ গো বাবু
.                        খাজনা মুকুব হবে কি না।

---কোঁচড়ে কি এনেছিস? ---ঘুষ নিই না,
.                তা ব’লে তো এমনি-এমনি হয় না।

---বড় গরিব গো বাবু, নুন আনতে পানতা ফুরোয়
তোমরা বাবু নোক, বড় নোক, দেকে দেন্ গো বাবু,
.                                        দেকে দেন্
খাজনা মুকুব হবে কি না? ---জলে নামি গো বাবু
কলমি তুলি, গায়ে হেলেদুলে ওঠে সাপ---
.                        কোমরে জড়ায় ঢ্যামনা।

---ঘুষ নিই না ; কিন্তু দিবি, কিছু ভেট তো দিবি।

---ঘরেতে আছে একখানি ঘড়া, ছেঁড়া-কাঁথা, আধফালি
.                কাপড়---যা আছে পরনে।
কিছু দিবার লাই গো বাবু।

---তুই, তুই-ই তো আছিস ;
মহাজনের মত তোর ওই দেহের জমিন---
.                        তা-ও দিবি না?

.              ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বন্দুকের নল শেষ কথা বলে না
কবি অজিত বাইরী

বন্দুকের নল শেষ কথা বলে না ;
শেষ কথা বলে মানুষের বিবেক |
বিশ্বাসের এই জমিতে দাঁড়িয়ে
আমি অনুভব করি কবিতার উষ্ণতা |

আমি জানি, প্রতিটি শব্দের বীজের মত
বিস্ফারিত হবার ক্ষমতা |
জানি, পাখির অন্দোলিত পাখায় ঝড়ের মত
প্রতিটি শব্দের অমোঘ গতিময়তা |

চঞ্চল মথের মত হয়ত
বন্দুকের নলের মুখে কাঁপে মৃত্যু-ভয়;
কাঁপে না মানুষের বিবেক |
সময়ের ক্রান্তিকালে মানুষই মানুষের বুকে রেখে যায়
ভালবাসা, ভোর, পৃথিবী ও কবিতা |

.              ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পরগাছা
কবি অজিত বাইরী

শিকড় ছিল না, শুধু ডালপালা ছিল |
মাটির গন্ধ কেমন ? ---- কোনদিন জানাই হল না |
ঝুলে আছি আশ্রয়ী বৃক্ষের শীর্ষডাল থেকে
মাটি সে বহুদূর, নাগালের বাইরে, কোনদিন
স্পর্শ পাব না ; তবু বুকের ভেতরে
তৃষ্ণা বাড়ে, যদি মাটিতে ওষ্ঠ ডুবিয়ে
মাটির স্তন থেকে টেনে নিতে পারতাম নির্যাস |

ঝুলে আছি শীর্ষডাল থেকে মাটির
অনেক উপরে, সারা গায়ে রোদ্দুর মাখি
ভোরের প্রথম রোদ্দুর, কাঁচা ও তরল ;
তবু ভরে না মন | বাতাস আসে,
বাতাস দোলা দেয় | পরম সুখে দোল খাই |
তবু মরে না বুকের বজ্রকীট ;
দংশন টের পাই, নড়েচড়ে, হুল বিঁধিয়ে
ঢালে বিষ, সে-বিষের দাহ বোঝে না
আশ্রয়দাতা বৃক্ষ, বোঝে শুধু সেইজন, যে
উদ্ভিদ হবার অধিকার নিয়ে জন্মেও
আমৃত্যু মাটির স্পর্শসুখ থেকে বঞ্চিত |

.                ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বাংলাদেশ
কবি অজিত বাইরী

অই যে দ্যাখ্ ছেন, ওপারে বাংলাদেশ, মাঝি বলল |
আমরা পার হচ্ছি ইছামতী, চাঁদ উঠছে |
আমাদের ডিঙিনৌকোর মতই ভাসমান
বর্ষা-অতিক্রান্ত শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ |
ওপারে যে বাংলা, এপারেও সেই বাংলা –
একই ভাষা, একই মাটি, ইছামতীর তীর ছুঁয়ে
একই বনরেখা----কিঞ্চিৎ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি
ভাবালুতায়, দিবাস্বপ্ন দেখা মানুষের মত
অসম্ভব বাসনা হঠাৎ উঁকি দেয় বুকে---
যদি মেলান যেত দুটি ঢেউকে !
দুই পারের মানুষ আর দুটি দেশকে যদি মেলান যেত !
সম্বিত ফেরে মাঝির কথায়, অই দিকে দ্যাখেন,
অই হল সীমা---
চোখ রাখি আকাশে, সন্ধ্যার আকাশ উজিয়ে
পুবে পশ্চিমে দেখি শুধু পাখিদের পারাপার

.                   ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর