কবি অজিত বাইরীর কবিতা
*
খাটাল-জীবন
কবি অজিত বাইরী

অন্ধকার খাটালে ডাঁশের কামড় খেতে খেতে
মোষ কান ঝাপ্ টায়, লেজ নাড়ে আর ক্ষুর ঠোকে
আর ভাবে খাটাল-জীবনে কোন পরিবর্তন নেই---
বাপ-ঠাকুর্দা-খুড়োরা যেভাবে কাটিয়ে গেছে
একইভাবে কাটছে তারও হাড়ভাঙা খাটুনির জীবন |
ঘাড়ের উপর দগ্ দগে ঘা নিয়ে টেনে চলেছে
দু চাকার গাড়ি, থেকে থেকেই গাড়োয়ান
খিস্তি করে, চাবুক চালায় আর গুষ্টি উদ্ধার করে |
জোতে থাকার সময় দুটি মোষ ইচ্ছে থাকলেও
কথা বলার সুযোগ পায় না, বাঁধন আলগা হলে
মুখোমুখি হয় তারা, দুজনের চোখেই ফুটে ওঠে
অসহায়তা, জীবনের প্রতি বিবিক্ত বেদনায়
চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে চটচটে আঠাল অশ্রু |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বৃষ্টি এবং আমি
কবি অজিত বাইরী

বৃষ্টি,  মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাগুলিকে –--    তন্বী,  মনোলোভা, সুন্দরী সন্ধ্যা |
হ্যারিকেনের পল্ তে উস্ কে এক কিশোর প্রাণপণ মুখস্ত করত পানিপথ | জীবনের
বিভিন্ন পথ  ঘুরে  ঘুরে  আজ সে সামান্য কেরাণী |   জয়ের গৌরব নেই |
পরাজয়ের গ্লানি নেই |  শুধু স্রোতে ভেসে থাকা |

ভোরের স্কুল, নিশানের মত কলাপাতার  রি রি ---, কুয়াশার আড়ালে আধফোটা
নৌকো----     সব ছবির মত দৃশ্যমান | বৃষ্টি,  কী অনুপম আবেশে ভ’রে দিতো
গ্রীষ্মের প্রথম সন্ধ্যাগুলি | আমার মন ছুটত পানিপথ থেকে খেয়াঘাটের দিকে |
হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করত, কেবলই হারিয়ে যেতে নিরুদ্দেশে | বৃষ্টি, এস আজ
এই স্মৃতিদীর্ণ সন্ধ্যায় | খোলা জানালার পাশে সেই পড়ুয়া কিশোরকে একবার
দেখি | ভাটির নৌকোর ছইয়ের মুখে আরবার দূরতর নক্ষত্রের মত দুলে উঠুক
সবুজ লন্ঠন |

.                                 ****************                  
           
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দাহ
কবি অজিত বাইরী

হু-হু হাওয়ায় গঙ্গার ঘাটে পুড়ছেন
একজন মানুষ |
মধ্যবিত্ত জীবনের ফাঁদে আটকে ছিলেন ;
এখন মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন |

আগুন যেন তাঁকে নয়,
তিনিই আগুনকে গ্রহণ করছেন ;
শিল্প হয়ে লাফিয়ে উঠছে শিখা |

কোন ভার রইল না, কোন পিছুটান...
পাড়ের উপর অশ্রুসজল যারা
একটু পরেই হয়ে উঠবে হিসেবী,
ভাববে :
কতটুকু প্রয়োজন ছিল মানুষটার !

.               ****************                  
         
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নীল নভে পাখি ওড়ে
কবি অজিত বাইরী

নীল নভে পাখি ওড়ে, পাখি তো দেখি না ;
দেখি মহাশূন্যের গভীরতা |
জানালার পাশে ঐ আধো আলো-ছায়া মুখখানি
বুকের ভিতরে এলে, মুখ তো দেখি না ;
মুখের আদলে দেখি মানস-প্রতিমা |

.               ****************                  
       
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আমার ছোট্ট কবর
কবি অজিত বাইরী

আমার ছোট্ট কবরে আমি যখন ঘুমিয়ে থাকব
তখনও অনেক অত্যাচার সইতে হবে আমাকে...

আমার বুকের উপর সমাধিবেদিতে ব’সে
তখনও যুদ্ধের গল্প শোনাবে দু’জন সৈনিক --

আমার বুকের উপর সমাধিবেদিতে ব’সে
তখনও রক্তমাংসের হিসেব কষবে দু’জন বণিক...

.               ****************                  
     
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অঙ্গুরীয়
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


অঙ্গুরীয় গিলে ফেলে কি ভুল করেছিল
মালিনীর মীন ? ধীবরের জালে
ধরা পড়ে তাই দিতে হল আত্মহুতি |
শীতল পিচ্ছিল পেট চিরে মিলল
শকুন্তলা-দুষ্মন্তের অনুরাগের অভিজ্ঞান |
এমন তো কতই ঘটে প্রেমের উপাখ্যানে
আত্মদান ;  কেইবা মনে রাখে শোণিতের
উষ্ণ প্রস্রবণ ? শুধু প্রেমের মহিমাই
ঠাঁই পায় মহাকালে, বাকি সবই বিস্মৃতি |

.               ****************                  
  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অর্ধেক আকাশ তুমি
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


এত যে তোমায় ডাকি, তুমি দাও না সাড়া ;
তুমি কি নিচ্ছিদ্র দেয়াল ? মোহিনী আড়াল ?
আমার প্রহর পুড়ে যায় অপেক্ষায় অপেক্ষায় ;
তুমি অর্বাচীন বৃক্ষের মত পাতার চোখ বুজে
দাঁড়িয়ে থাক |

প্রলয়ের বার্তা আনে যে বাতাস, আমি তার
চিত্কার, আছড়ে পড়ি তোমার দেয়ালে |
যতবার তুচ্ছ কর আবেদন, ততবার ফিরে আসি
ঝড় হয়ে ; এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিতে পারি সব তারা ---
যা তুমি বেঁধেছ আঁচলে |  অর্ধেক নয়,
আমি চাই এক আকাশ সম্পূর্ণ তোমাকে |

.               ****************                  

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বাড়ি
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


চারদিকে ঢালু আকাশ, মাঝখানে বাড়ি |
দিনভর বাতাস বয় উপর্যুপরি |
দু-চার ঝাড় লাগিয়েছি জুঁই ও চামেলি |
নিসর্গ থেকে নেমে আসে পাখিরা—
.        এ-ডাল ও-ডাল করে |
পাশে একটা নদী থাকলে ভাল হোত ;
না থাকুক, নিজেই
মনে মনে এঁকে নিই নদী |
রাতে বাড়ির চারপাশে নক্ষত্রের ঝালর ;
যেন অনন্তের মাঝখানে দুয়ার-খোলা বাড়ি—
ভেসে আছে কবিতার উদ্যানের মত |

.               ****************                  

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বুদ্ধপূর্ণিমা
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


আজ বুদ্ধপূর্ণিমা ; আকাশের পেয়ালা থেকে
উপচে পড়ছে জ্যোত্স্না |
পৃথিবীর মুখ যেন করুণাঘন
বুদ্ধের মুখের মত শান্ত, নির্ভাণ |

আজ কোথাও হিংসা বসবে না ওৎ পেতে |
সমস্ত আততায়ী নদীজলে ধুয়ে ফেলবে
রক্তমাখা হাত | পৃথিবীর
গাছেরা স্নাত হবে পরিশুদ্ধ জ্যোত্স্নালোকে ;
আজ সারারাত ব্যাপী রচিত হবে চর্যাপদ |

আজ পরমান্নের বাটি হাতে
বোধিসত্ত্বের পাশে এসে দাঁড়াবেন সুজাতা |

.               ****************                  

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ধান
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


দুধ সাদা জ্যোত্স্নায় ডুবে আছে ধানক্ষেত ;
রাতের শিশির জমছে সবুজ শিষে,
আলবাঁধা ক্ষেত নিবিড় হয়ে আছে রাত্রিকালে |
কে এসে হাত রাখে গোছা গোছা শিষে ?
কার হাতের স্পর্শে দুধ বসে ধানে ?
অবাক হয়ে ভাবি, বিস্ময়ের কিনারা মেলে না ;
এত মানুষের মুখের অন্ন জোগায় এই মাঠ ?
সারা মাঠ প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে দুধ সাদা জ্যোত্স্নায় |

.               ****************                  

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর