কবি অজিত বাইরীর কবিতা
*
জঠরাগ্নি
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


ভাত দে হতচ্ছাড়ি ; বলে লোলচর্ম বুড়ি
জেহাদ ঘোষণা করে দুপুরের খর-রোদ্দুরে |

অভাবের সংসারে একমুঠো ভাত কত যে মহার্ঘ
কী করে বুঝবে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা বুড়ি !

পেটে জ্বালা ধরলেই বুড়ি চেঁচায়, আর
দুর্বল হাতে লাঠি ঠোকে ক্ষোভে-আক্রোশে |

বেশি কিছু চায় না, নুনভাত পেলেই খুশি
সময়ে সময়ে সেটুকুও জোটে না ;
হাঁড়ি বাড়ন্ত, উপোষে দিন কাটে |

তোবড়ানো গাল, বুড়ির চোখে জ্বলে ধুনি ;
ভাত দে হতচ্ছাড়ি, খিদেয় পেট জ্বলে |

হাঁড়ি ঝেড়ে দু-চারটি সাদা দানা বেড়ে
থালা ধরে দেয় বুড়ির গ্রাসের সামনে |

হতচ্ছাড়া কাকগুলো কোথায় ছিল কে জানে ;
এক পা, দু পা বাড়িয়ে পাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে |

বুড়ি লাঠি উঁচিয়ে খেদায়, যা—যা, যমের অরুচি ;
ভাতের থালা শূন্য করে কাকগুলো ডাকে, কা—কা—

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কর্ণ
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


দিগন্তের ঢালে অস্তসূর্যের মত রথের চাকা
.                     পুঁতে গেছে কাদায় |
রথের দুর্মর ঘোড়া জোড়া পা সামনে তুলে
.                                চিঁ—চিঁ করছে ;
চাকা টেনে তুলতে পারছে না |

এই তোমার নিয়তি,  সুতপুত্র,  তুমি বীর
অথচ এমনই অদৃষ্টের পরিহাস, সম্মুখ সমরে
.                                  তুমি অসহায় |
পান্ডবভ্রাতা হয়েও তাদেরই বিরুদ্ধে রণাঙ্গণে---
সে-ও তো সহোদরের দুঃসহ আত্মযন্ত্রণা !

জন্ম থেকে মৃত্যু বাঁধা পড়ে আছ নিয়তির চক্রে
প্রতিযুগেই কর্ণরা ভাগ্য-বিড়ম্বিত ;  বীরত্ব
.                                     সহায় হলেও
রথের চাকা বারবার পুঁতে যায় কাদায় ;
কারও সাধ্য নেই অদৃষ্টের সেই কর্দম থেকে
.                            চাকা টেনে তোলে |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
লিটল ম্যাগাজিনের কবি
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


স্বভাবের দ্বিচারণ করিনি কখনও ;
নীল নদের মত বাহিত ছিল
রক্তে সেই ধারা, যা দরিদ্র স্কুল-শিক্ষক পিতা
আজীবন বহন করেছিলেন বংশপরম্পরায় |
ফলত অমেরুদন্ডী প্রাণীর মত কুঁজো হতে
.                            শিখিনি কখনও
খোলামকুচি কুড়োনোর মত কুড়োতে শিখিনি
.                                আনুগত্য |
এর জন্য মূল্যও দিতে হয়েছে ঢের—
তবু থেমে থাকেনি কলম |
কবিতার জন্য রক্তক্ষরণ সেসব কাগজের ধর্ম
তাদের প্রতি থেকেছি কৃতজ্ঞ |
কেননা, এরাই আমার কলমকে কখনও বন্ধা
.                                  হতে দেয়নি,
এরাই ছিল বিপন্ন কবির আত্মরক্ষার বর্ম |
আমি যেদিন সত্যিকার আগুনে পুড়ব,
লিটল ম্যাগাজিন, পাখার বাতাস দিও
.                             চিতার আগুনে |        
.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পাঁচমাথার মোড়ে ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু                
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


শ্যামবাজারে পাঁচমাথার মোড়ে
ঘোড়ার পিঠে আসীন
ব্রোঞ্জের মূর্তিটি দেখেছেন অনেকেই |
একটু এগোলেই দেখবেন চিত্পুর খাল ;
মজা খালের দু-পাশে বস্তি এলাকা—
নারী পুরুষের বেআব্রু জীবন-যাপন |

স্বাধীনতা শব্দের অর্থ ৬৮ বছর পরেও
এদের কাছে স্পষ্ট হল না |
রক্তের বিনিময়ে দিতে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা—
ভারতবর্ষ তাঁর কাছ থেকে কিছুই নিল না ;
শুধু স্ট্যাচু বানিয়ে রাখল |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পরকীয়া
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


সেদিন বিষণ্ণ চাঁদ উঠেছিল যমুনা পাড়ে ;
ক্ষীণতনু যমুনা বইছিল প্রিয় সখীর মত |
তুমি যমুনা পুলিনে একা একা কী ভেবে
এসে দাঁড়ালে অন্যমনস্ক ; গাগরি ভরার ছলে
যজ্ঞিডুমুরের পাতা ছিঁড়ে স্রোতে ভাসাতে গিয়ে
.                        ভাসিয়ে গেলে মন |

চাঁদের কলঙ্কের মত তখন তোমার শ্রীমুখে
পরকীয়ার লাজ, ভয়, সংকোচ ; সবকিছু
তুচ্ছ তোমার কাছে----মান, কুলমর্যাদা | গুঞ্জন-মুখর
ভ্রমরের মত দু’চোখে শুধু ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ |
কী ভেবে যমুনা পুলিনে গাগরি ভরার ছলে
.                        স্রোতে ভাসিয়ে গেল মন |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পৌরাণিক
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


গাভীরা ফিরছে খুরে খুরে ধুলো উড়িয়ে
তাদের পিছুপিছু ফিরছে বালকৃষ্ণ |
গোধূলি রঙে রেঙেছে আকাশ, দ্বারে
.                            অপেক্ষায় যশোদা |
গাভীদের বাঁটে বাঁটে দুধ, যেন দুগ্ধস্নানে
.                              স্নাত হবে বসুধা |
অপরূপ নামছে সন্ধ্যা পৃথিবীর পারে,
.                                    মাটির প্রদীপ
জ্বলছে ঘৃতে ; সুগন্ধে ভরে আছে গোকুল ;
কুলবধূদের উলুধ্বনিতে মজেছে যাদবপল্লি |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
টান
কবি অজিত বাইরী
কলকাতা বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত “অর্ধেক আকাশ তুমি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


সাজিয়ে রেখেছ ঘর-গৃহস্থালি ;
তারই টানে ছুটে আসা |
অষ্টপ্রহর খাটুনির ফাঁকে রেখেছ একবুক ভালবাসা ;
তারই টানে ছুটে আসা |

উঠোনে ফুটেছে দোলনচাঁপা ;
উঠোনে ফুটেছে শিশুর হাসি ;
তারই টানে ফিরে ফিরে আসা |


সারাদিন ঝোড়োকাকের মত কোথায় কোথায় ঘুরি ;
দুপুরের ঝাঁ—ঝাঁ রোদে পুড়ে
মনে মনে ভাবি, একটি মুখচ্ছবি |

সব ঠাঁই ছেড়ে ক্লান্তির ঘাম মুছব বলে
এসে দাঁড়াই উঠোনে ;
মাথার উপর ছড়ান বিন্নিধানের খই |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
স্তব্ধতার পড়ুয়া
কবি অজিত বাইরী

সন্ধে হয়ে এল, তুমি এলে না ;
ফিরে এল সমস্ত পাখিরা |
দিনের দর্পণ থেকে পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নিল রাত্রির আয়নায় |
রাতের পাঠশালায় কয়েকটি পড়ুয়া নক্ষত্র---
কি পড়ে স্তব্ধতার পাতা খুলে ?

প্রান্তরের নিশ্বাস লাগে চোখে মুখে ;
অন্ধকার নিবিড় হয় নদীর বুকে, ইতস্তত নুড়ির অক্ষর |
কতকাল দেখিনি তোমাকে ভোরের প্রচ্ছদে ;
ধাবমান ট্রেনের জানলায়
ছোট ছোট টিলার মত স্মৃতি পিছু হাঁটে |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দূরে গেলে
কবি অজিত বাইরী

দূরে গেলে দেউলের ঘন্টার মত বাজো |
কাছে থাকলে, বধির আমার কান,---
.                শুনতে পায় না তোমাকে |
দূরত্ব কি মায়া জানে ? দূরত্ব কি জাদু জানে ?
মনের স্বভাবই  এই----  কাছে পেয়ে রাখতে
জানে না ;  দূরে গেলে কষ্ট পেতে জানে |

যখন কাছে থাক, ক্ষণমুহূর্তে মনেও পড়ো না ;
দূরে গেলে দেউলের ঘন্টার মত বাজো |

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
খোকা, এলি !
কবি অজিত বাইরী


কেউ লন্ঠন তুলে ধরে,
দূর গ্রামে সেই লন্ঠন ইশারায় কাঁপে |
গাছের আড়ে-আড়ে আরও অনেক কুঁড়ে
অন্ধকারে গা’ ঢাকা দিয়ে আছে |
অন্ধকারে আমি ঠিক পথ চিনে নিই,
আলোর ইশারা ক্রমাগত কাছে টানে |
কাছাকাছি হতেই
অপেক্ষায় অধীর কম্পমান একটি কন্ঠ
ঘনিষ্ঠ মমতায় আশ্বস্ত হ’তে চায়:
খোকা, এলি !

.                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর