কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
নদী
কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী’, ১৯৯৮ থেকে নেওয়া।


জীবনের সবুজ কঙ্কন এনে দাও
পৃথিবীর গভীর প্রেমিকের কাছ থেকে
ততক্ষণ আমি চোখ মেলে থাকব
আমি আমার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকব |

বাড়ি আমার পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তরে
সমস্ত কারখানায়---
যেখানে মেসিনের ঘড় ঘড় শব্দ
উদাত্ত হাওয়ায় ছুটে বেড়ায় |

‘এ-সবুজ কঙ্কন খুলে নিতে আসবে
তোমার বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলবে
ক্ষুধা তৃষ্ণা হাহাকার
তখন তুমি বন্দুক তুলো |’
আরো বলেছিলে :
‘তুমি মানুষ
সেই হবে তোমার সুন্দরতম বিস্ফোরণ’

হৃদয় আমার হাহাকার পথের
এই সময়ের নিষ্ঠুর হাওয়ায়
আবার একদিন আমি গলে গলে
নদী হয়ে যাব
সমস্ত মানুষের যন্ত্রণা
আমি নদী
হে ফলন্ত শস্য
আমি তোমার বুক বেয়ে বয়ে যাই |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
উত্তরের আগুনকে
কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী’, ১৯৯৮ থেকে নেওয়া।


সমস্ত ফুলগুলো ফুটে উঠল
সমস্ত আগুনগুলো জ্বলে উঠল
মানুষ মুখর হল অন্ধকারের গ্রন্থি খুলে---
ফুল আর আগুন জ্বললো উত্তরে
বেদনা আর ভালবাসা
ক্রোধআর ঘৃণা নিয়ে
সূর্য তার সাক্ষী হয়ে আকাশে মুক্তি জানিয়েছিল

জোর করে তুষ দিয়ে ঢেকে রেখে
অনেকগুলো বসন্ত দাবিয়ে রাখা যায়
কিন্তু সূর্য অন্ধকারের অবসান করবেই
ফুল ফুটবেই----
আগুন জ্বলবেই ----

সমস্ত অন্ধকার মৃত্যুর দিকে
সমস্ত ফুল
সমস্ত আগুন
এই সব প্রেম
কেননা তারা পৃথিবীর সমস্ত রূপসীকে নিয়ে
অসংখ্য আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করছিল |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অব্যক্ত যন্ত্রণা
কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী’, ১৯৯৮ থেকে নেওয়া।


সময়গুলো কেমন গুম্ টে দুপুরের তালে
তাল মিলিয়ে, অসহ্য হয়ে প্রতিবাদের ঝড়ে
আকাশের মেঘগুলোর সাথে ছটফট করছিল |
একদল মানুষ চারিদিকে সূর্যকে ঘিরে দাঁড়িয়ে
.       অকথ্য ভাষায় চিত্কার করে চলেছে |
পৃথিবীর মানুষ এখনও কেন তুমি নিস্তব্ধ ?

এই অসহ্য যন্ত্রণায় তোমাকে যদি কাছে পেতাম
তা হলে বুকের অতলে ডুবুরী হয়ে দেখতাম
তোমার বুকে কত---- কতখানি স্বর্ণ আছে
.         যা নিয়ে ওদের পিপাসা মেটে |

সমাদর কেটে গেলে রুদ্ধ ঘরে তীব্রআলোড়ন,
নক্ষত্রগুলো আমার সহচর হ’য়ে
কার কাছে ফিরে যেতে চায়,
কতদূর সেই পথ --- যার উপর দিয়ে আমি যাব,
আমি তার আহ্বানের ডাক শুনতে পাচ্ছি |

তুমি এমনি করে অজস্র হিমানী প্রপাতে
আমার সারা দেহ কংকালে আবৃত করো,
তখনই হবে তোমার সুন্দর মৃত্যু দিন----
যা দিয়ে চিরদিন মানুষকে ভালবাসতে পারবে |

অথচ সময় হবার আগে
একবার আমি সাগরের বুকে
গাঙচিল হয়ে বর্ষণ করে যাব
অজস্র ধারায় রক্তিম গোলাপের স্তবক |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
জমির ক্ষুধা বন্দুকের মুখে
কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী’, ১৯৯৮ থেকে নেওয়া।


বৃষ্টি !  বৃষ্টি !    সারাদিন বৃষ্টি পড়ে
ভারতবর্ষের উত্তরের উত্তপ্ত পাহাড়ের
গহন গভীর জঙ্গলে মানবিক মনে |
ঢেউ তোলে চিত্কার করে
জলন্ত অগ্নি |

বন্দী পশুর হিংস্রতা
রক্তের উল্লাসে টগবগ মনকে
রাশটানে পিছনের ভয়ার্ত হুঁশিয়ার |
হুজুর !
যতই শক্তি হানো সূর্যাংশের শিখাকে
হাজারো তেজে ব্যর্থ কর বিদ্রোহী স্বপ্নকে |

তোমার অন্বেষণে যারা ব্যস্ত
সেই সব সৈনিক
কালের গহ্বরে অভিজ্ঞতা কুড়োয়
অস্ত্র ধরে হিংস্র শত্রুকে চরম ব্যর্থতার
ক্ষয়ে ক্ষয়ে একে একে শেষ করে করবে |
উলঙ্গ মনে অগ্নি শিখা জ্বলে
হাজারো শক্তি উত্তাল তরঙ্গে আছড়ায় শত্রু শিবিরে
পাহাড়ীয়া মনে ধ্বস নামে স্বপ্নের স্বর্গের |

জমির ক্ষুধা গর্জে ওঠে বন্দুকের মুখে
হে মানব মানবী তোমরা দেখ
যারা জন্মালো শ্রমিকের চাষীর বাচ্চা হয়ে
তারা স্ফুলিঙ্গের আগে সঙ্গীনের খোঁচায়
নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
উত্তরের পাহাড়ের কালো মানুষগুলো
কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী’, ১৯৯৮ থেকে নেওয়া।


ওহে মানব মানবী আমরা এসেছি |
রক্তে রক্তে উন্মত্ততার ঢেউ তুলে
সূর্য-রাঙা দিগন্তের কোলে কোলে অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস,
শেকল ভাঙার তেজদীপ্ত স্ফুলিঙ্গচ্ছটায়
সন্ধ্যায় অগ্নিময় ঢেউগুলো সমস্ত পেশীর সাথে সাথে
নেচে উঠেছিল এক কোণ থেকে আর এক কোণে, আমরা
দিন গুনেছি, আমরা আভাস পেয়েছি পশ্চিমের আকাশটা
সীমাহীন বেদনায় ছটফট করছিল, উত্তরের পাহাড়ের
আক্রোশ এখনি বুঝি আছড়ে পড়ে, এই ক্ষতগুলোয়
ছদ্মবেশী একদল প্রলেপ বুলিয়ে ভরিয়ে তুলতে চাইছিল |

তখন মহল্লায় মহল্লায় মায়েদের চিন্তার রেখাগুলো
স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, ছেলেদের ব্যস্ততায়
একদল কুকুল চেঁচিয়ে ফিরছিল পরিশ্রান্ত অবস্থায়,
কোথাও একটু বিশ্রাম অথবা গলা-ভরা সুতীব্র ঝাঁঝালো
পানীয় যা স্নায়ুগুলোকে দুর্বল করতে পারে |

কোন মা বা কোন রমণী অথবা প্রেয়সী সাবধানে লালন
করছে আপন প্রাণের ধনকে, আবার এও দেখেছি ঐ দ্বীপওয়ালা
জায়গাটা যেখানে অনেকগুলো শ্রমিক আর চাষী জড়ো
হয়ে কি যেন একটা করতে চাইছিল, বিশাল প্রাসাদটা
সাক্ষী হয়ে আজও অতীত ইতিহাসের
রক্তাভ দিনগুলোর সেই স্বপ্ন দেখছে
এখনও আমরা পশুর হিংস্র লোলুপ
রক্তাভ চোখের যাদুকরী ভিনদেশী ভালবাসা,
নারীর হৃদয়কে বিদ্ধ করল সীমাহীন মনুষ্যত্ব |
পৈশাচিক হিমেল সান্ধ্যদীপ রচনায়, তখন আমি
বা আমরা তোমার শীতলপাটি রচনা করছিলাম
সুখনিদ্রায়

গঙ্গা মেকং হোয়াং-হো থেকেই আমাদের উত্পত্তি |
বহুযুগের স্মৃতি আমরা বহন করে আসছি | মমি, মহেঞ্জোদারে
হরপ্পা চীনের প্রাচীর তারা কথা বলে যে আমরা ছিলাম
অবশেষে আমরা থাকব |   মাও থেকে গিয়াপ হো-চি-মিন
আর ভারতবর্ষের উত্তরের পাহাড়টার কালো মানুষগুলো
ভেঙে ফেলল হাজার বছরের শেকলটা |

ভোরের সূর্য তখন মধ্যাহ্নের আকাশের আর আমার ছায়া
ঠিক পায়ের তলায় |  আমরা যে-স্বপ্ন দেখছিলাম
মানুষের পায়ের শুভ সঙ্কেত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে |
এ পৃথিবী দিগন্তে হাজারো কন্ঠ হিমালয় থেকে
সুন্দরবনে আছড়ায় মুক্তির নামে |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আমি গান করি না সময় অতিক্রান্তের
কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী’, ১৯৯৮ থেকে নেওয়া।


আমি তোমাকে নিরাশ করতে পারি
যখন আমি সত্যের ছবি আঁকি
যদি আমি স্বাধীনতার আশ্রয় নিই
আমার ক্ষমা চাইবার প্রয়োজন নেই-----
পৃথিবী আমার জানালার সামনে প্রসারিত
যখন আমি খড়খড়ি বন্ধ করি অথবা করি না |
এবং যদি অনবরত আমার সম্মুখে দেখা দেয়
আমার কি সে রকম কোন পছন্দ আছে ?

আমি গান করি না সময় অতিক্রান্তের
পৃথিবী আমার জানালার সামনে প্রসারিত
যেহেতু ঝঞ্ঝা এখন থেমে গেছে
যেহেতু গর্ভজাত শিশু উত্তাপ দেয়
এবং বসন্তকালে পুষ্পগুলি বরফাসিক্ত হয়
আর বিজয়োল্লাসের গানে ত্রাসের সঞ্চার করে
অর্থলোভীরা অস্ত্র নিয়ে চাঞ্চল্যের
প্রচণ্ডতা হানে

ঈশ্বর আমার ঈশ্বর সকলের লজ্জা
রুটির জন্য এবং ফুলের জন্যে লড়াই
অবশেষে বাহুর দৃঢ়তা
অসুস্থ প্রেমের সাক্ষীর জন্যে
যে-চীত্কার বক্ষদেশ পরিচ্ছন্ন করে
লরকা থেকে মায়াকবস্কি
যে কবিকে গোপনে হত্যা
অথবা যার জন্য যাদের জন্য নিজেরা নিজেকে
হত্যা করেছে
আমি গান করি না---- সময় অতিক্রান্তের |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
রাক্ষুসে যন্ত্রণায় ভুগছ
কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়
পুলক চন্দ সম্পাদিত রক্তে ভাসে স্বদেশ সময়, সত্তর দশকের কবিতা – থেকে নেওয়া।


জানালার ধারে বসে রাক্ষুসে যন্ত্রণায় ভুগছ
অথচ এই যন্ত্রণা আমাকে পাহাড় করছে |
আগুনের লাল শিখায়
তুমি আমি পুড়ছি,
অজস্র প্রজাপতি নিদ্রাহীন আকাশের বুকে
ভালবাসার দ্বীপ খুঁজছিল
তুমি ও আমি কথা দিয়েছিলাম
মানুষকে ভালবাসবো বলে |
যাদের বলেছিলে ভালবাসতে
তারা তোমাকে ফুল দেখিয়ে
বাগানের সৌন্দর্যের সীমানায়
নীল আকাশের তলায়
গড়েছিল স্বর্ণের প্রবাল দ্বীপ

জানালার ধারে বসে রাক্ষুসে যন্ত্রণায় ভুগছ
অথচ একই যন্ত্রণা আমাকে পাহাড় করছে
পায়ে পায়ে ঠেলে দূরে বহুদূরে
সমুদ্রের সাথে গাঙুরের জলে
বাসী ফুলগুলোকে ভাসিয়ে
লাল নদীর জলকে রক্তবর্ণ ক’রে
আমি তোমাকে দেখেছিলাম |
গাঢ় অন্ধকারের বুক চিরে
একফালি সোনামুখী রোদ এনে
উজ্জ্বল আনন্দে নাইতে নামলাম |
পৃথিবীর ফুলে
রক্তলাল নদীতে
বাতাসের স্নিগ্ধতায়
আমাকে রাক্ষুসে যন্ত্রণা থেকে
তোমাকে রাক্ষুসে যন্ত্রণা থেকে
রূপসী অসামান্য রূপবতী পৃথিবীতে নিয়ে গেল |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর