বিদ্রোহী
কবি অপূর্ব্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
কবি কালিদাস রায় সম্পাদিত মাধুকরী (১৯৬২) কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।

সিন্ধু-বলাকার শ্রেণী চলে গেছে বহুক্ষণ দিগন্তেপ পারে,
বিহঙ্গের স্তব্ধ গীতি। দিবসের নির্বাপিত হোম কুণ্ড ধারে
পূরবীর কণ্ঠ শুনি, গায়ত্রীর রূপ-চ্ছান্দা যজ্ঞটিকা পরি’
মন্ত্র পাঠ করে একা, আনন্দের পুষ্পদল ফোটে চিত্তভরি।
সপ্তর্ষির জ্যোতিঃপুঞ্জে জাগে নাই নীলাম্বরে, অন্ধকার ছবি
ধরিত্রীর মর্মে রহে, বসে আছি উপকূলে, বিদ্রোহের কবি!
শান্ত হও, আর কেন? হৃদয়ের সন্ধি ক’র অনন্তের সনে,
কেন তুমি রুদ্ররূপে আনিয়াছ উন্মাদনা ধূর্জটির মনে!
অন্তহীন দ্বন্দ্ব তব চলিয়াছে অবিশ্রান্ত অসীমের মাঝে
নিত্য মহাকাল সাথে। কি বেদনা বক্ষে তব নিশিদিন বাজে
কহ তাহা, হে চঞ্চল! তব নীল তরঙ্গের উন্মাদনা রাখি
ক্ষান্ত হও ক্ষণকাল। দিবসের হোমাগ্নির ভস্ম দেহে মাখি
এস মোরা সন্ধ্যাজপে দেবতার নাম নিয়া ধ্যান করি চুপে,
অশান্তির উদ্দীপনা রাখো তব, সুনির্মল! রহ সৌম্যরূপে।

.                ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
কবি অপূর্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর কবিতা
*
ত্রাণ কর্ত্তা পৃথিবীর নবজন্ম আঁকে
কবি অপূর্ব্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত দেশ পত্রিকার মাঘ ১৩৫০ (জানুয়ারী ১৯৪৪) সংখ্যা থেকে।

সিঁদুরে রঙের মেঘ দিগন্ত ছাপিয়ে এলো,
গেল বেলা।
ঠান্ডা হাওয়া খরকোয়া নদীটিরে করে এলোমেলো,
দীর্ঘশ্বাসে চঞ্চলতা পল্লব প্রচ্ছন্ন চোখে করে খেলা।
সৈনিকের ক্লান্ত পদক্ষেপে বাদুড়ের কাঁপে ডানা,
কি যেন একটা ভয়! কেন এ আতঙ্ক!
*

.                               ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
স্থবির রাত্রির মাঝে
কবি অপূর্ব্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার মাঘ ১৩৫০ (জানুয়ারী ১৯৪৪)
সংখ্যা থেকে। পুনঃপ্রকাশিত পৌষ ১৩৬৬ (জানুয়ারী ১৯৬০)।

জীবনের কথা যত অশ্রুজলে হোলো লেখা
একে একে হারায়েছে দুরন্ত সমীরে।
ছায়াভরা গোধুলিতে দিকচক্রে ছিন্ন রেখা
দেখেছিনু বর্ণময় নীল সিন্ধুতীরে।

ভঙ্গুর স্বপ্নের সাথে অতীতের স্মৃতি ভাসে
*
আগামী দিনের নীড়ে প্রভাতী কূজন-ধ্বনি
পশিবে কি কানো মোর রজনীর সাথে রণি’?


.                   ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
রণ-মন্থনের যুগে
কবি অপূর্ব্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫৩ (মার্চ ১৯৪৭)
সংখ্যা থেকে।

অন্যায়ের স্বাধিকারে এ সমরোত্তর চিত্ত মোর
আহত তরঙ্গ সম সংসারের তটপ্রান্তে কাঁদে।
আগ্নেয় গিরির মত অশান্তির উন্মাদনা সাথে
মহাকাল করে চক্রমণ। অন্ধকারে হোলো ভোর
রক্তস্নাত বিষণ্ণ রজনী। জীবনের আরাধনা---
উজ্জীবন আশা আর আনন্দের উত্সব-কাকলী
বাতাসের হাহাকারে জনারণ্যে বিলুপ্ত সকলি :
নামে মনে বিক্ষোভের ছায়াচ্ছন্ন অব্যক্ত যাতনা।

এখনো রক্তের স্রোত! শূন্যে ওড়ে শকুনের দল,
উজ্জ্বল বাসনা-পুঞ্জ পরিম্লান স্থবির হৃদয়ে ;
রণ-মন্থনের যুগে বিভীষিকা ঢাকা নভস্তল,
স্বার্থতার কোলাহল বিপ্লবের বৈরী-পরিচয়ে
পৃথিবীর বসন্তেরে স্বপ্নান্তরে দিয়েছে বিদায়!
রিক্ত রাহী,---পথে একা, মোর পানে কেহ নাহি চায়

.                   ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কণ্বসূতা হোলো কি চঞ্চল
কবি অপূর্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
প্রমথনাথ বিশী ও ডঃ তারাপদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যবিতান (১৯৬৬) কাব্য
সংকলন থেকে।

গৌরীশৃঙ্গ-শিরে হেরি শিশুসূর্য, ঊষা অনুরাগে
বিছায়ে দিল কি তার স্বচ্ছ শুভ্র পুষ্পিত অঞ্চল !
সাগরের স্বর শুনি অরণ্যের অভিসার জাগে,
কুরঙ্গীর নৃত্যরঙ্গে কণ্বসূতা হোলো কি চঞ্চল ?
এ ধরণী চিরশ্যাম মানুষের অশ্রুজলে জানি,
জীবন-সমাধিক্ষেত্রে জন্মে প্রেম তৃণ সম জনারণ্য মাঝে,
সেই প্রেম রোমন্থন করে কত প্রাণী ;
সে প্রেমের রসায়নে সঞ্জীবিত শস্যশীর্ষে স্বর্ণচ্ছটা রাজে |
অঙ্কুরের মাঝে সুপ্ত রহে যারা, কেন অসহায় !
কল্পনায় কামনায় ভাবগত মহাকেন্দ্র ‘পরে
আশা-নৈরাশ্যের গান অন্তরের তন্ত্রী হতে ধায়,
মায়াজালে লীলায়িত সুরগুলি ঝরে ঝরে পড়ে |

আত্মিক লোকের যাত্রী আমারে যে ডাকে,
সুন্দর ভুবনে মোর রেখে যাবো মৃত্যুরেখাগুলি ;
নীহারের মত অশ্রু ঝরিল কি পল্লবের ফাঁকে,
কাহিনী কালের নীড়ে স্মৃতিলোকে র’বে পুচ্ছ তুলি !

কালোত্তর ক্ষণে তার কাকলী কূজন
লোকোত্তর পান্থজনে করিবে কি কভু আকর্ষণ !
জীবনের পরিক্রমা প্রবাসীর মত,
দুঃখে সুখে নির্যাতনে চিত্ত যেন ফলভারে-নুয়ে-পড়া পাদপের সম,
পর্ণগৃহে দৈন্য গ্লানি বক্ষে ধরি উপেক্ষিত কাব্য লয়ে দিন যায় মম ;
সত্তা মোর নহে বিশ্বগত !

অসংখ্য বৈচিত্র্য মাঝে সংখ্যাতীত শতাব্দীর বিস্মৃতির স্তূপে
চিরদিবসের বাণী সমুজ্জল রয় |
ঐতিহ্যের পুষ্প গন্ধ ধূপে
মহাকাল-অর্চনায় ধ্যানমন্ত্রে এ ধরণী ঐক্যধ্বনিময় |
আমার নিখিলে আজ স্মারক-চিহ্নিত হয়ে প্রেম জ্বলে তব অঙ্গুরীয়
তোমার নিখিলে মোর যৌবনের গানখানি সমাদরে কন্ঠে তুলে নিও ||

.                   ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
হে সৈনিক! হে নির্ভীক!
কবি অপূর্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
সুকুমার সেন সম্পাদিত বাংলা কবিতা সমুচ্চয় (১৯৯১) কাব্যসংকলন থেকে।


রাত্রির তপস্যা ব্যর্থ ; প্রাণসূর্য উদিবে কি আর ?
মরু প্রান্তরের সম জনচিত্ত করে হাহাকার |
প্রাচীন দেশের আত্মা সভ্যতার ঊর্দ্ধ স্তর হতে
নামিয়া এল কি আজ রক্তাকীর্ণ রুক্ষ রাজপথে |
দেবহীন দেবালয়ে দীনভগ্ন সোপানেরে ভেদি
কালসর্প গরজিছে, পূজাহীন দেবতার বেদী |
পূর্বসীমান্তের মাঝে জনতার ঝরে অশ্রুলোর ;
হে সৈনিক ! হে নির্ভীক ! ভাঙ্গিল কি তব ঘুমঘোর ?

আতঙ্কের আবরণে স্বপ্নাঙ্কুর মৌনম্লান রহে,
অসত্যের অহঙ্কারে | অন্নপূর্ণা ভিক্ষাপাত্র বহে
জাতির ভাণ্ডার শূন্য, নিঃসম্বল বীর্যহীন জাতি,
হে সৈনিক ! হে নির্ভীক ! পোহাবে কি ঘোর আমারাতি ?
পাষাণ-পেষণ সহি নির্ঝরের গুমরে বেদনা,
স্বামীর কঙ্কাল লয়ে বেহুলা যে হারাল চেতনা |
লজ্জা শঙ্কা অপমান হতে করো স্বদেশেরে ত্রাণ,
হে সৈনিক ! হে নির্ভীক ! গর্জে ঘোর ঝটিকা-তুফান |

প্রত্যাসন্ন ভবিষ্যৎ চক্রান্তের অসংখ্য পরিখা
বরিল কি অপ্রসন্ন সভ্যতার অগ্নিগর্ভ শিখা !
বিষাক্ত তমসাভরা দয়াহীন সংসারের কূলে
স্মৃতির পিঞ্জরদ্বার, হে সৈনিক ! দিতে পার খুলে ?

.                   ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
জীর্ণ পুঁথির উড়্ ছে পাতা
কবি অপূর্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৩৮ (মার্চ ১৯৩২) সংখ্যা
থেকে।


পশ্চিমে ঝড় ঐ আসে পূবে অন্ধকার !
.        মহাকালের বাজ্ ছে প্রলয় ভেরী |
বসুন্ধরার কাঁপন বড় ভাঙছে তোরণ দ্বার,
.        তুফান আসার নেইকো বেশী দেরী ||

ধূলোয় নয়ন অন্ধ হোলো আকাশ ডাকে গুরু,
.        মাথা গুঁজার নাইকো কোথাও ঠাঁই,
কালনাগেরি শতেক ফণায় বক্ষ দুরু দুরু –
.        পালিয়ে যাবার পথ তো জানা নাই |

জীর্ণ পুঁথির উড়্ ছে পাতা বহু যুগের পরে !
.        আপনভোলা সবাই বাঁধন হারা,
কালোয় সাদায় মিশ্ বে সবে মরা বাঁচার তরে
.        টুট্ বে যত লৌহ প্রাচীর কারা |

পাগ্ লা ভোলার শিঙ্গার মাঝে অনাগত সুর
.        জেগেই আছে, উঠবে সৃজন প্রাতে—
হাহাকারে ভাসেই যদি মায়ার মধুপুর,
.        ক্ষতি কিবা আছেই মোদের তাতে !

.                   ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
তাহারি কেশের গন্ধ মিশেছে কেয়ার গন্ধে
কবি অপূর্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৪৬ (অগাস্ট ১৯৩৯) সংখ্যা
থেকে।


সে যদি আসিত ফিরে মুখর হোতো যে আজ মৌন ম্লান জীবনের ভিটে,
সে যদি আসিত ফিরে এমনি বাদল রাতে অন্তরের শূন্য পাদপীঠে,
হয়তো প্রেমের দীপ নিবিয়া যেতনা মোর বিরহের বিষণ্ণ ছায়ায়,
সে কি গো ভুলেছে সব সুখ দুঃখ, আলো-ছায়া সুদূরের মেঘের মায়ায় |
দামিনীর দ্যুতি মাঝে জাগে তার রূপ-ছন্দা নিমেষের চপল ইঙ্গিতে,
ভেসে যায় সমীরণ কালি-মাখা মেঘপথে গুরু গুরু শ্রাবণ-সঙ্গীতে |
আকাশের কোণে কোণে তাহারি আঁচলখানি ভ্রমিতেছে বিজুলীর সনে,
তাহারি কেশের গন্ধ মিশেছে কেয়ার গন্ধে বাদলের নব বরিষণে |
অসীম গগনে তার নয়নের তারা দু’টী জ্বলে কি-না, কেবা তাহা জানে !
আমারি সজল আঁখি হতাশে রহিল চাহি’ সেই দূর দিগন্তের পানে |

প্রথম পেয়েছি তারে শরতের শুভ্রালোকে অভিসারে লজ্জা-মুকুলিত,
বসন্তের পুষ্পতটে যে-মাল্য দিয়েছি গাঁথি, বক্ষে তার হরষে দুলিত |
অধর পরশি তার দিবসের শেষ আলো চলে যেত কালের কল্লোলে,
উঠিত যে চিত্ত-চাঁদ নিশীথের সঙ্গোপনে আত্মহারা মানসীর কোলে |
প্রত্যুষের গানে গানে উড়ায়ে দিত সে তার পুলকিত প্রেমের বলাকা ;
সে ছিল মরমে মোর রূপসী মানস-প্রিয়া অলক্ষিত স্তব্ধতায় ঢাকা |
দুরন্ত বৈশাখী বায়ে সে গেছে দিগন্ত পারে ফিরে আর আসে না কুটীরে,
জীবনের প্রতি রাত্রি তার স্মৃতি অশ্রু নিয়া চেয়ে থাকে শূন্য নদীতীরে |

.            
                 ******************               
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কবিতার জন্মতিথি দিনে
কবি অপূর্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার আশ্বিন ১৩৪৬ (অক্টোবর ১৯৩৯) সংখ্যা থেকে।


জীবনের বাতায়ন প’রে সেইদিন স্বপন-দুর্ল্লভ
জ্যোত্স্নার হাসি
পড়েছিল আজিকার মত |
গগনের নীল সিন্ধুপারে আমার এ নয়ন-পল্লব
ঊর্দ্ধগ উদাসী
ধ্যানস্তব্ধ ছিল অবিরত |
দূর কোন্ মৌন গোষ্ঠগৃহে গ্রামান্তরে ধান্যক্ষেত্রপারে
প্রাণের বেণুকা
বেজেছিল সকরুণ সুরে !
শতশর্ব্বরীর বার্ত্তা বহি’ সমীরণ শ্যামল কিনারে
আলোর রেণুকা
দিয়েছিল দিগন্তবধূরে |

কৈশোরের কিশলয় ঢাকা চিত্তপুষ্প উদার প্রাঙ্গণে
ঋতু-পরিক্রমে
দিল তার প্রথম প্রণাম,
স্নিগ্ধ শ্যামছায়াছন্ন পথে বনবধূ নুপূরশিঞ্জনে
সুপ্ত বিহঙ্গমে
জাগাইয়া মত্ত অবিরাম ;--
সেইদিন স্বর্গ হতে আসি আকাশের নক্ষত্রের তলে
বনের কুটীরে
সঙ্গোপনে দিলে তুমি দেখা,
দুরন্ত ভাদ্রের কলোচ্ছ্বাসে না জানি কি যাদুমন্ত্র বলে
সুনিভৃত তীরে
পুষ্পায়িত হোলো স্বপ্ন-লেখা !

মোর চারু চিত্রবীথি মাঝে শরতের মিলন বাসরে
আনন্দ-চন্দন
পরাইয়া দিনু তব ভালে |
সেদিনের সেই সুখস্মৃতি মনে পড়ে বহুদিন পরে
নিত্য চিরন্তন
জন্ম মৃত্যু-উর্ম্মি নৃত্য তালে |
আসো নাই তুমি যবে মোর দীর্ণ ক্ষুদ্র উটজ আসনে
গাঢ় অন্ধকারে
ঢাকা ছিল দিবসযামিনী |
কল্পনার আলেপন রেখা জাগে নাই মৃত্তিকার মনে
শুঝু পারাবারে
বরষায় ভ্রমিত দামিনী |

আজি তব জন্মতিথিক্ষণে মোর জন্ম-পরাধীন ভূমি
তোর পানে চাহি’
দিল তার অশ্রু-আশীর্ব্বাণী |
হৃদয়ের ব্যর্থতার লিপি আমি দিই তব গণ্ড চুমি’
আর কিছু নাহি,
কাব্যলক্ষ্মি ! অঙ্কে তোরে টানি’ |
কত সাধ ছিল মোর প্রাণে রত্ন সৌধে বসায়ে তোমারে
পরাইয়া রাখী
দিব অর্ঘ্য স্বর্গ-সুধা সেবি’
দুঃখ শোকে জীবন কুটীর ভেঙ্গে পড়ে তীব্র হাহাকারে,
সে কুটীরে থাকি’
অন্নহীনা দুঃখ পেলে দেবি |

.                             ******************   
                          
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
এই নববর্ষ পথে এস প্রভু   
কবি অপূর্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত দেশ পত্রিকার বৈশাখ ১৩৪৮ (এপ্রিল ১৯৪১) সংখ্যা থেকে।

 
দূর  কোন্ শতাব্দীর গাঢ় ঘন দূরন্ত দুর্যোগে
যে ক্রন্দন-আর্তনাদ উঠেছিল দিগ্ দিগন্তরে,
আনন্দের লেশমাত্র ছিলনাক সর্বচিত্তলোকে,
অভিশাপদগ্ধ এই ভারতের  ব্যথিত অন্তরে
যে করুণ সংগীতের অশ্রুসিন্ধু তোমারি সন্ধানে
জীবনের কূল ভাঙ্গি ছুটেছিল চঞ্চল পবনে
বর্ষার বর্ষণ সাথে সংসারের শতদিক পানে,
মহাকাল ভুজঙ্গের অবিশ্রান্ত নিষ্ঠুর দংশনে,
যে বেদনা মরণের আবাহন করেছে হতাশে,---
তাহাদের সবাকারে বক্ষে নিয়া পাষাণ কারায়
হে অরূপ নব রূপে জন্ম নিলে মায়াবদ্ধ পাশে
যেথা কাঁপে ক্ষিতিতল শাসিতার শোণিত ধারায় |

অবিচার, অত্যাচার, অন্যায়ের ভীষণ ভ্রূকুটি
পাপের পতাকা বহি’ জনারণ্যে আনিল যেদিন
মরণের আর্তনাদ --- শান্তি গেল বিশ্ব হ’তে টুটি
ঊষার উদয়লক্ষ্মী কালগর্ভে রক্তস্রোতে লীন,
কংসের করাল মূর্তি উদ্দীপিত দুর্বল মানব,
ধ্বংসের বিজয়ধ্বজা গর্বোদ্ধত আনন্দ উচ্ছ্বাসে
এনেছিল অভিযান ধরণীতে দুরন্ত দানব
স্রষ্টার বিরূদ্ধে য’বে চূর্ণ করি তীব্র পদাঘাতে---
সত্যশিব সুন্দরের অবদান, মানব সংসার
গ্রাসিতে উদ্যত য’বে ধরণীরে রুদ্র আঁখিপাতে
এসেছিলে সেইক্ষণে দানবেরে করিতে সংহার |
                                                             
তোমার জীবন-কাব্য বন্দিনীর বক্ষে ধীরে ধীরে
রূপচ্ছন্দে নৃত্য করি’ উন্মেষিত শৃঙ্খল বন্ধনে |         
তোমার জীবন-কাব্য পুষ্পায়িত যমুনার তীরে,
সে কাব্যের পূর্ণ রূপ উদ্ভাসিত যুগসন্ধিক্ষণে
ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে.—হে জ্যোতিষ্ক ! তোমরি মহিমা
নির্বীর্য জাতির শিরে জাগাইল যে ভীষণ শক্তি,
তাহারি স্পন্দনে নব ভারতের বিলুপ্ত গরিমা
আসিল ফিরিয়া পুন, যোগৈশ্বর্যে জাগিল আসক্তি |

.           হে পার্থ সারথী !---
সে নহে ক্রন্দন-ভরা ক্লীবতার মৌন হতাশ্বাস,
ভাগবত ছন্দে গাথা লীলায়িত জ্ঞানকর্মযোগ ;
সুম্বুদ্ধু কর্তব্য লাগি আত্মদানে দৃঢ় অভিলাষ
শোণিত লালিমা ঢালি শৌর্য বীর্য করিতে সম্ভোগ |    
দানবীয় শক্তিময় ক্ষাত্রশক্তি --- পাপের প্রতীক,
তাই তুমি নিঃক্ষত্রিয় করে গেছ হে পার্থ সারথি !
ব্রাহ্মণের মদগর্ব উপেক্ষিয়া দুর্বার নির্ভীক,
শ্রীভাগবদ্ গীতা তুমি করে গেছ জীবন-ভারতী |
যুগে যুগে মহাপাপ যেইদিকে রচিতেছে ব্যূহ
অধর্মের অবস্থিতি দিনে দিনে রক্ষিতে নিয়ত ---
সেই ব্যূহ ভেদ করি’ উদ্ভাসিয়া সত্য-সরোরুহ
তারি পরে দাঁড়ায়েছে অবিদ্যারে করিয়া নিহত |

সেই দূর শতাব্দী পথ বাহি’ আমারি সম্মুখে
যে শতাব্দী আসিয়াছে অধর্মের জীবন্ত প্রতীক---
ন্যায় ধর্ম লুপ্ত করি’ ছলনার বীভত্স কৌতুকে
সতীরে লাঞ্ছনা করে দেবালয়ে নিভায়ে প্রদীপ,
পৌরুষ পুরুষে নাহি, স্ত্রৈণতার নানা রঙ্গ হেরি,
বিকৃত নিষ্ঠায় দেশ দৌর্বল্যের সংকীর্তনে রহে |
বীর্যের দারিদ্র্য  আজি জীবগণে রহিয়াছে ঘেরি,
পরকীয়া তত্ত্বধর্মী অতনুর ফুলধনু বহে |
*

.                        ******************                             
.                                                                             
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর