ব্যর্থতায় কেটেছে সকাল | আর কতকাল প্রতীক্ষায় ধূলিরুক্ষ বিপন্ন তিমিরে হেঁটে যাব অসহায় ? বলো কতদিন নির্জন বিষাদে এভাবেই যেতে হবে হে করুণাহীনা ? হয়তো হারিয়ে যাব----- জানি কেউ তারপরে মনেও রাখবে না |
অথচ সর্বস্ব আমি তোমাদের ভালোবেসে দিয়েছি রঞ্জনা, হৃদয় বিচূর্ণ করে দিয়েছি তোমার পাত্রে সব সম্ভাবনা | বিনিময়ে তার কিছু চাইনি তোমার কাছে জানি কোনোদিন তবু যেন ব্যর্থ সব---- চলেছি নীরবে একা সীমানাবিহীন |
যাদের হৃদয়ে কোনও প্রেম নেই বুকে নেই প্রাঞ্জল পিপাসা, স্বার্থের সন্ধানে, যারা লুব্ধ প্রতিদিন তারাই সফল আজ---- পৃথিবী তাদের জন্য প্রত্যহ নবীন | অথচ দু’হাত ভরে যারা শুধু দিয়ে যায় জীবনের সব সমাজে তারাই ব্রাত্য----- কোথাও পায় না আনন্দের নন্দিত বিভব |
নদীর কিনারে বসে কাল সারা রাত দেখেছি ধানের শিষে জ্যোত্স্নার প্লাবন | আকাশের আলপথে অনেক রূপালি তারা দেখেছি সেদিন তোমার মুখের মতো দেখেছি সে প্রত্যাশার প্রিয় কাশবন |
তোমার বুকের শব্দে ধ্বনিময় ছিল সব দীর্ঘ বনস্থলি | মনে হল কাছে ডাকি তোমাকেই কাছে ডেকে সব কথা বলি : এ-জন্মে আমার ছিলে অন্য জন্মে হলে তুমি কার ? এখনো তোমার জন্যে এইখানে অশ্রুময় প্রতীক্ষা আমার |
জ্যোত্স্নার প্লাবনে যদি কোনোদিন ভেঙে যায় হৃদয়ের সব বাঁধ সীমিত জীবন তাহলে কোথায় যাব কোথায় তাহলে পাব মধু বৃন্দাবন ?
তবু রোজ কবি আশিস সান্যাল এখন তথাগত কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৮৭
উড়ে এসে একদিন এক ঝাঁক পাখি বসেছিলো এই গাছে ; তাদের শরীর থেকে ঝরেছিলো অজস্র পালক | এখন সর্বত্র দেখি শূন্যের ভেতরে পড়ে আছে চিহ্ন তার | আর কিছু নেই---- দেখি না কোথাও আর রঙিন পাখির ঠোঁট চোখ রাখলেই | হয়ে গেছে ইতিহাস সেই সব পাখিদের উড়ালিয়া রূপ | হলুদ সবুজ সব পাখি পড়ে আছে স্পন্দনহীন বহুদূর প্রসারিত স্মৃতিময় ঘরে | তাদের বুকের টিপ্ এখনো বাতাসে চূর্ণ হয় নিয়মিত কঠিন প্রস্তরে | অতীত জেনেছি তাই সময়ের পরাভূত স্মৃতি আর শ্রুতি | গতিময় শুধু বর্তমান ---- আমাদের এই জন্ম অন্য এক জন্মের প্রস্তুতি | তবু রোজ চেয়ে দেখি আমি বাড়ছে বুকের ক্ষত, চতুর্দিকে স্ফীতমান আমাদের-ই প্রভূত নষ্টামি |
সময় দাম্ভিক বড় | চিরন্তন বুকে ধরে কিছুই রাখে না | হও তুমি দিক্-বিজয়ী সম্রাটের মতো অথবা ভিক্ষুক বুদ্ধ : তবুও সময় স্থিত কোথাও থাকে না | যতোটুকু প্রয়োজন শুধু তারপরে চলে যায় পেলে রেখে অন্ধকারে একদিন সমস্ত সঞ্চয় | পড়ে থাকে ইতিহাস | দেখো গতিহীন---- নির্বোধ বালক খোঁজে তার বুকে স্নিগ্ধতার নন্দিত প্রণয় |
আজো ঠিক কবি আশিস সান্যাল এখন তথাগত কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৮৭
আজো ঠিক ভোর হয় যে-রকম ভোর হতো কোটি যুগ আগেকার প্রথম শৈশবে ; তারা ফোটে অন্ধকারে | সুবর্ণরেখার তীরে প্রাকৃত উত্সবে উড়ে যায় প্রজাপতি---- হাওয়ায় স্পন্দিত বুকে পৃথিবীর চোখে নামে ঘুম | আজো ঠিক ভোর হয় ভেঙে যায় নির্ধারিত রাতের নিঝুম |
বয়স গিয়েছে বেড়ে----- কৈশোর, যৌবন অতিক্রান্ত হয়ে তবু সময়ের আলোড়িত মন বিস্ময়জড়িত চোখে দেখে শুধু অস্তিত্বের চারদিকে গাঢ় অন্ধকার | বাতাসে ছড়ায় শুধু সংগ্রাম, সংঘাত আর বেদনার ঘ্রাণ ; বুদ্ধ, যীশু, হজরত, এখনো সর্বত্র খোঁজে মুক্তিকামী মানুষের সার্বিক নির্বাণ |
এত ব্যাপ্ত আয়োজনে তবু দেখি আজো প্রয়োজন, পুরুষের কাছে প্রিয় দুগ্ধবতী রমণীর স্নেহ আর্দ্রমন এখনো নারীর কাছে একটি পুরুষ অনেক বিজয় থেকে আরো বেশি দামী ; আজো ঠিক ভোর হয়----- হীরের পাপড়ি মেলে ফুল দেয় প্রত্যহ প্রণামী |
তবু তাকে পারিনি বোঝাতে প্রতিটি মৃত্যুর শেষে আছে ফের জন্মের উদয় | প্রত্যেক সাম্রাজ্য ভাঙে ---- তারপর আবির্ভূত অন্য এক নতূন বিস্ময় | অযোধ্যা বিগত আজ হস্তিনাপুরের পথে নেই আর শেঠিদের ভিড় তবু তুমি স্বপ্নবতী---- আবির্ভূতা প্রতি বাঁকে অন্য পৃথিবীর |
সঙ্ঘ কোনও শক্তি নয় বুদ্ধের বিবেক ভাসে দু’চোখের জলে স্থবির বৃক্ষের মতো দগ্ধ হয় প্রবীণ পৃথিবী জানি স্মৃতির অনলে | ধ্বংসের ভেতর থেকে জন্ম নেয় অন্য এক নব-সম্ভাবনা, একদিন ক্ষয়ে যাব----- আমরা তো চিরন্তন কেউ থাকব না |
কেবল স্মৃতির মধ্যে বিস্তারিত হবে সব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস শিশিরে ভিজবে জানি কলিঙ্গের রণাঙ্গনে যাবতীয় ঘাস | সবুজ হলুদ হলুদ সবুজ হবে জানি প্রতিদিন প্রতিটি দৃশ্যের শেষে সঙ্ঘ ভেঙে জন্ম নেবে অন্য এক প্রত্যাশা রঙিন |
যে কথা আজ ব্যাহত বুকে কবি আশিস সান্যাল গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত
আকাশে মেঘে বিপুল ঝড় | আভাসে বেগে বন্যা | কাঁপছে ঘরে একলা শুধু রাত | কি যেন চাই হৃদয় ভরে সে কথা কেউ জানো ? কলমিলতার মতন কারো হাত জাগেনি রোদে | এখনো তাই বুকের দোরে ক্লান্তি দাঁড়িয়ে আছে | শব্দ কিছু নেই----- কোথাও পাব অনুভবের মগ্ন দারুণ শান্তি ?
মৌন সুরে বাতাসে কাঁপে বুকের কোলাহল | মনের মধ্যে দীঘল অন্ধকার | যে কথা আজ ব্যাহত বুকে যে কথা ভেবে দিগ্বিদিকে যে কথা শুনে মুখর হয় মনের অভিসার | যে কথা আজো হয়নি বলা কে নেবে সেই ভার ? মৌন সুরে বাতাসে কাঁপে বুকের অন্ধকার |
তবে কি শুধু হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব দূরে ? জলের মতো রাত্রি যাবে ঝরে ? হবে না বলা তোমাকে আর যে কথা শুনে রাত্রি তার বুকের আঁচল ছড়িয়ে দেয় তরল অভিসারে | যে কথা ভেবে আবার মেঘে আকাশে বেগে ঝড় ; যে কথা শুনে রাত্রি তার স্পর্শকাতর বুকের ভার বিজন বনে মুখরতার ছড়িয়ে দেয় শান্তি | হায়-রে কিছু হয়নি বলা ; বুকের দোরে ক্লান্তি |
কেন যে মেঘে বিপুল তবে ঝড় ? আভাসে বেগে বন্যা ? এ রাত তবে হারিয়ে যাক চাই না কোনো শান্তি | বুকের দোরে ব্যাপক হোক অভিশাপের ক্লান্তি | দু’হাত ভরে জড়াব ভয়, শীর্ণা স্রোতের অবক্ষয় ক্রমশ যেন ছড়িয়ে দেয় হিজলর বনের ভ্রান্তি | এ রাত তবে হারিয়ে যাক চাই না কোনো শান্তি |
আমাকে তবে ডেকো না কেউ রাত্রি নিভে গেলে, ঝড়ের বেগ হারিয়ে গেলে পর | যে কথা আজ ব্যাহত বুকে সে কথা অতঃপর হবে না বলা | এ কথা জেনে শিশির জলে ভেসে এসো না আর বেসো না কেউ ভালো ; ঝড়ের বেগ হারিয়ে গেলে কি হবে জ্বেলে আলো ?
তবে কি শুধু হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব দূরে ? গহন বনে জাগবে না কি সুর ? হবে না বলা তোমাকে আর যে কথা শুনে রাত্রি তার বুকের আঁচল ছড়িয়ে দেয় নিথর দিগ্বিদিকে |
যে কথা আজ ব্যাহত বুকে হারাবে পথ তার | তোমাকে ভেবে আকাশে মেঘে জাগবে নাকো আর প্রখর অনিভূতি | যে কথা শুনে রাত্রি তার স্পর্শকাতর বুকের ভার বিজন বনে মুখরতার ছড়িয়ে দেয় শান্তি | হায়-রে কিছু হয়নি বলা, বুকের দোরে ক্লান্তি ||
প্রতিদিন পঁচিশে বৈশাখ কবি আশিস সান্যাল শেষ অন্ধকার: প্রথম আলো, কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬০
চেয়ো না উজ্জ্বল কন্ঠ আর কোনো দৃশ্যকে চেয়ো না | যারা কাল ফিরে গেছে শব্দহীন ফিরে গেছে কাল দেখেছে বিক্ষত ছায়া সারাদিন বিবর্ণ প্রহরে পায়ে পায়ে পথ হেঁটে অর্বাচীন নিমগ্ন সন্ধ্যায় এঁকেছে ধূসর চিহ্ন ; তার ছায়া স্মৃতিমুখ আর চেয়ো না উজ্জ্বল তুমি আর কোন দৃশ্যকে চেয়ো না |
দৃষ্টিকে গভীর করো ; ধ্বনিময় প্রসারিত দূরে দ্যাখো রে জন্মের দিন প্রতিদিন পঁচিশে বৈশাখ | অবাক আলোর সূর্য ---- দ্যাখো দ্যাখো সম্মুখে সংসার সম্পন্ন পৃথিবী মগ্ন প্রত্যাশার গভীর উত্সবে ; স্বর্ণাভ দিনের স্বপ্নে ভালোবাসা প্লাবিত প্রান্তরে ---- স্পর্শকে দিগন্ত করে প্রতিদিন পঁচিশে বৈশাখ |