কবিআশিস সান্যাল-এর কবিতা
*
দাদা
কবি আশিস সান্যাল

বাড়ির দাদা পাড়ার দাদা
দাদার ছড়াছড়ি,
সব দাদাকে সঙ্গে নিয়ে
কখন কী যে করি !

এক দাদা যান মাছ ধরতে
চূর্ণী নদীর পার,
ইচ্ছেটি তার সারাক্ষণই
সঙ্গে থাকি তার |

আরেক দাদা মস্ত গায়ক
মধুর কোমল চিত্ত,
তার বাসনা গানের সঙ্গে
তবলা বাজাই নিত্য |

ক্রিকেট পাগল পটলদাদা
রাত্রি হলেই ছাতে,
তিনিও চান তার সঙ্গেই
খেলি প্রতি রাতে |

এত দাদার ইচ্ছে পূরণ
কেমন করে করি !
সকল দাদার ভালবাসায়
আমি যে প্রায় মরি |

.  *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
নন্দিত বিভব
কবি আশীস সান্যাল

ব্যর্থতায় কেটেছে সকাল |
আর কতকাল
প্রতীক্ষায় ধূলিরুক্ষ বিপন্ন তিমিরে
হেঁটে যাব অসহায় ?
বলো কতদিন
নির্জন বিষাদে
এভাবেই যেতে হবে হে করুণাহীনা ?
হয়তো হারিয়ে যাব-----
জানি কেউ তারপরে মনেও রাখবে না |

অথচ সর্বস্ব আমি
তোমাদের ভালোবেসে দিয়েছি রঞ্জনা,
হৃদয় বিচূর্ণ করে
দিয়েছি তোমার পাত্রে সব সম্ভাবনা |
বিনিময়ে তার কিছু
চাইনি তোমার কাছে জানি কোনোদিন
তবু যেন ব্যর্থ সব----
চলেছি নীরবে একা সীমানাবিহীন |

যাদের হৃদয়ে কোনও প্রেম নেই
বুকে নেই প্রাঞ্জল পিপাসা,
স্বার্থের সন্ধানে, যারা লুব্ধ প্রতিদিন
তারাই সফল আজ----
পৃথিবী তাদের জন্য প্রত্যহ নবীন |
অথচ দু’হাত ভরে
যারা শুধু দিয়ে যায় জীবনের সব
সমাজে তারাই ব্রাত্য-----
কোথাও পায় না আনন্দের নন্দিত বিভব |

.          *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
কবিতার নাম নেই
কবি আশিস সান্যাল

নদীর কিনারে বসে
কাল সারা রাত
দেখেছি ধানের শিষে জ্যোত্স্নার প্লাবন |
আকাশের আলপথে
অনেক রূপালি তারা দেখেছি সেদিন
তোমার মুখের মতো
দেখেছি সে প্রত্যাশার প্রিয় কাশবন |

তোমার বুকের শব্দে
ধ্বনিময় ছিল সব দীর্ঘ বনস্থলি |
মনে হল কাছে ডাকি
তোমাকেই কাছে ডেকে সব কথা বলি :
এ-জন্মে আমার ছিলে
অন্য জন্মে হলে তুমি কার ?
এখনো তোমার জন্যে
এইখানে অশ্রুময় প্রতীক্ষা আমার |

জ্যোত্স্নার প্লাবনে যদি
কোনোদিন ভেঙে যায়
হৃদয়ের সব বাঁধ সীমিত জীবন
তাহলে কোথায় যাব
কোথায় তাহলে পাব মধু বৃন্দাবন ?

.       *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
তবু রোজ
কবি আশিস সান্যাল
এখন তথাগত কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৮৭

উড়ে এসে একদিন এক ঝাঁক পাখি
বসেছিলো এই গাছে ;
তাদের শরীর থেকে ঝরেছিলো অজস্র পালক |
এখন সর্বত্র দেখি শূন্যের ভেতরে
পড়ে আছে চিহ্ন তার |
আর কিছু নেই----
দেখি না কোথাও আর রঙিন পাখির ঠোঁট চোখ রাখলেই |
হয়ে গেছে ইতিহাস সেই সব পাখিদের উড়ালিয়া রূপ |
হলুদ সবুজ সব পাখি
পড়ে আছে স্পন্দনহীন বহুদূর প্রসারিত স্মৃতিময় ঘরে |
তাদের বুকের টিপ্ এখনো বাতাসে
চূর্ণ হয় নিয়মিত কঠিন প্রস্তরে |
অতীত জেনেছি তাই সময়ের পরাভূত স্মৃতি আর শ্রুতি |
গতিময় শুধু বর্তমান ----
আমাদের এই জন্ম অন্য এক জন্মের প্রস্তুতি |
তবু রোজ চেয়ে দেখি আমি
বাড়ছে বুকের ক্ষত,
চতুর্দিকে স্ফীতমান আমাদের-ই প্রভূত নষ্টামি |

.       *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
সময়
কবি আশীস সান্যাল

সময় দাম্ভিক বড় |   চিরন্তন বুকে ধরে কিছুই রাখে না |
হও তুমি দিক্-বিজয়ী সম্রাটের মতো
অথবা ভিক্ষুক বুদ্ধ : তবুও সময় স্থিত কোথাও থাকে না |
যতোটুকু প্রয়োজন শুধু তারপরে
চলে যায় পেলে রেখে অন্ধকারে একদিন সমস্ত সঞ্চয় |
পড়ে থাকে ইতিহাস |  দেখো গতিহীন----
নির্বোধ বালক খোঁজে তার বুকে স্নিগ্ধতার নন্দিত প্রণয় |

.       *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
আজো ঠিক
কবি আশিস সান্যাল
এখন তথাগত কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৮৭

আজো ঠিক ভোর হয়
যে-রকম ভোর হতো কোটি যুগ আগেকার প্রথম শৈশবে ;
তারা ফোটে অন্ধকারে |
সুবর্ণরেখার তীরে প্রাকৃত উত্সবে
উড়ে যায় প্রজাপতি----
হাওয়ায় স্পন্দিত বুকে পৃথিবীর চোখে নামে ঘুম |
আজো ঠিক ভোর হয়
ভেঙে যায় নির্ধারিত রাতের নিঝুম |

বয়স গিয়েছে বেড়ে-----
কৈশোর, যৌবন
অতিক্রান্ত হয়ে তবু সময়ের আলোড়িত মন
বিস্ময়জড়িত চোখে
দেখে শুধু অস্তিত্বের চারদিকে গাঢ় অন্ধকার |
বাতাসে ছড়ায় শুধু
সংগ্রাম, সংঘাত আর বেদনার ঘ্রাণ ;
বুদ্ধ, যীশু, হজরত,
এখনো সর্বত্র খোঁজে মুক্তিকামী মানুষের সার্বিক নির্বাণ |

এত ব্যাপ্ত আয়োজনে
তবু দেখি আজো প্রয়োজন,
পুরুষের কাছে প্রিয়
দুগ্ধবতী রমণীর স্নেহ আর্দ্রমন
এখনো নারীর কাছে
একটি পুরুষ
অনেক বিজয় থেকে আরো বেশি দামী ;
আজো ঠিক ভোর হয়-----
হীরের পাপড়ি মেলে ফুল দেয় প্রত্যহ প্রণামী  |

.       *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
আরণ্যক
কবি আশীস সান্যাল
কাছেই রয়েছে নদী, কাব্যগ্রন্থ থেকে

ভয়ার্ত পাখির ডাকে
ভেঙে যায় ঘুম,
হরিণের পদশব্দে
অন্ধকারে
কেঁপে ওঠে ভয়ঙ্কর রাতের নিঝুম |

আদিম বাঘিনী খোঁজে
অতর্কিতে
শাবক চিত্রল ----
তৃষ্ণায় হায়েনা সব
হ্রদের নির্জন বুকে
পান করে
রক্তমাখা পিপাসার একমাত্র জল |

চতুর শৃগাল চাটে
মৃত শব
সিংহের উচ্ছিষ্ট ক্ষত নারীদের স্তন |
সন্ত্রস্ত বাতাসে ভাসে
পচা গন্ধ
মিশর-প্রাসাদে হত
গণিকার নগ্ন-নীল দেহের মতন |

পেঁচার সংকেত পেয়ে
উড়ে যায়
সারসেরা দূর কোনও সিন্ধুর ওপারে
খুঁজে ফেরে
আরেক আশ্রয় |
অরণ্যের অন্ধকারে
ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে
শতাব্দীর ক্লান্তিকর শুধু এক ভয় |

.       *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
তবু তাকে
আশিস সান্যাল

তবু তাকে পারিনি বোঝাতে
প্রতিটি মৃত্যুর শেষে আছে ফের জন্মের উদয় |
প্রত্যেক সাম্রাজ্য ভাঙে ----
তারপর আবির্ভূত অন্য এক নতূন বিস্ময় |
অযোধ্যা বিগত আজ
হস্তিনাপুরের পথে নেই আর শেঠিদের ভিড়
তবু তুমি স্বপ্নবতী----
আবির্ভূতা প্রতি বাঁকে অন্য পৃথিবীর |

সঙ্ঘ কোনও শক্তি নয়
বুদ্ধের বিবেক ভাসে দু’চোখের জলে
স্থবির বৃক্ষের মতো
দগ্ধ হয় প্রবীণ পৃথিবী জানি স্মৃতির অনলে |
ধ্বংসের ভেতর থেকে
জন্ম নেয় অন্য এক নব-সম্ভাবনা,
একদিন ক্ষয়ে যাব-----
আমরা তো চিরন্তন কেউ থাকব না |

কেবল স্মৃতির মধ্যে
বিস্তারিত হবে সব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস
শিশিরে ভিজবে জানি
কলিঙ্গের রণাঙ্গনে যাবতীয় ঘাস |
সবুজ হলুদ
হলুদ সবুজ হবে জানি প্রতিদিন
প্রতিটি দৃশ্যের শেষে
সঙ্ঘ ভেঙে জন্ম নেবে অন্য এক প্রত্যাশা রঙিন |

.       *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
যে কথা আজ ব্যাহত বুকে
কবি আশিস সান্যাল
গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত

আকাশে মেঘে বিপুল ঝড় | আভাসে বেগে বন্যা |
কাঁপছে ঘরে একলা শুধু রাত |
কি যেন চাই হৃদয় ভরে সে কথা কেউ জানো ?
কলমিলতার মতন কারো হাত
জাগেনি রোদে | এখনো তাই বুকের দোরে ক্লান্তি
দাঁড়িয়ে আছে | শব্দ কিছু নেই-----
কোথাও পাব অনুভবের মগ্ন দারুণ শান্তি ?

মৌন সুরে বাতাসে কাঁপে বুকের কোলাহল |
মনের মধ্যে দীঘল অন্ধকার |
যে কথা আজ ব্যাহত বুকে
যে কথা ভেবে দিগ্বিদিকে
যে কথা শুনে মুখর হয় মনের অভিসার |
যে কথা আজো হয়নি বলা কে নেবে সেই ভার ?
মৌন সুরে বাতাসে কাঁপে বুকের অন্ধকার |

তবে কি শুধু হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব দূরে ?
জলের মতো রাত্রি যাবে ঝরে ?
হবে না বলা তোমাকে আর
যে কথা শুনে রাত্রি তার
বুকের আঁচল ছড়িয়ে দেয় তরল অভিসারে |
যে কথা ভেবে আবার মেঘে
আকাশে বেগে ঝড় ;
যে কথা শুনে রাত্রি তার
স্পর্শকাতর বুকের ভার
বিজন বনে মুখরতার
ছড়িয়ে দেয় শান্তি |
হায়-রে কিছু হয়নি বলা ; বুকের দোরে ক্লান্তি |

কেন যে মেঘে বিপুল তবে ঝড় ? আভাসে বেগে বন্যা ?
এ রাত তবে হারিয়ে যাক
চাই না কোনো শান্তি |
বুকের দোরে ব্যাপক হোক অভিশাপের ক্লান্তি |
দু’হাত ভরে জড়াব ভয়,
শীর্ণা স্রোতের অবক্ষয়
ক্রমশ যেন ছড়িয়ে দেয় হিজলর বনের ভ্রান্তি |
এ রাত তবে হারিয়ে যাক
চাই না কোনো শান্তি |

আমাকে তবে ডেকো না কেউ রাত্রি নিভে গেলে,
ঝড়ের বেগ হারিয়ে গেলে পর |
যে কথা আজ ব্যাহত বুকে
সে কথা অতঃপর
হবে না বলা | এ কথা জেনে শিশির জলে ভেসে
এসো না আর বেসো না কেউ ভালো ;
ঝড়ের বেগ হারিয়ে গেলে
কি হবে জ্বেলে আলো ?

তবে কি শুধু হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব দূরে ?
গহন বনে জাগবে না কি সুর ?
হবে না বলা তোমাকে আর
যে কথা শুনে রাত্রি তার
বুকের আঁচল ছড়িয়ে দেয় নিথর দিগ্বিদিকে |

যে কথা আজ ব্যাহত বুকে
হারাবে পথ তার |
তোমাকে ভেবে আকাশে মেঘে জাগবে নাকো আর
প্রখর অনিভূতি |
যে কথা শুনে রাত্রি তার
স্পর্শকাতর বুকের ভার
বিজন বনে মুখরতার
ছড়িয়ে দেয় শান্তি |
হায়-রে কিছু হয়নি বলা, বুকের দোরে ক্লান্তি ||

.       *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
প্রতিদিন পঁচিশে বৈশাখ
কবি আশিস সান্যাল
শেষ অন্ধকার: প্রথম আলো, কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬০

চেয়ো না উজ্জ্বল কন্ঠ আর কোনো দৃশ্যকে চেয়ো না |
যারা কাল ফিরে গেছে শব্দহীন ফিরে গেছে কাল
দেখেছে বিক্ষত ছায়া সারাদিন বিবর্ণ প্রহরে
পায়ে পায়ে পথ হেঁটে অর্বাচীন নিমগ্ন সন্ধ্যায়
এঁকেছে ধূসর চিহ্ন ;  তার ছায়া স্মৃতিমুখ আর
চেয়ো না উজ্জ্বল তুমি আর কোন দৃশ্যকে চেয়ো না |

দৃষ্টিকে গভীর করো ; ধ্বনিময় প্রসারিত দূরে
দ্যাখো রে জন্মের দিন প্রতিদিন পঁচিশে বৈশাখ |
অবাক আলোর সূর্য ---- দ্যাখো দ্যাখো সম্মুখে সংসার
সম্পন্ন পৃথিবী মগ্ন প্রত্যাশার গভীর উত্সবে ;
স্বর্ণাভ দিনের স্বপ্নে ভালোবাসা প্লাবিত প্রান্তরে ----
স্পর্শকে দিগন্ত করে প্রতিদিন পঁচিশে বৈশাখ |

.              *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর