উৎসের প্রতি কবি আশিস সান্যাল শেষ অন্ধকার: প্রথম আলো কাব্যগ্রন্ত থেকে, ১৯৬০
আমার সর্বস্ব দিয়ে আজ আমি ফিরে যাব দূরে---- হে মৌনা প্রীতির কন্ঠ ! হে গাঢ় বিষাদ ! সব রেখে সুদূরান্ত পথের গভীরে ফিরে যাব অন্ধকারে হে করুণাহীনা---- সম্পূর্ণ বাউল হব----ঘরানার কোনো স্মৃতি মনেও রাখব না |
তোমাদের ভুলে যাব হে বিশাল পবিত্র জলধি | ভুলে যাব অন্তরঙ্গ বিমুগ্ধ প্রহরে প্রসারিত স্নিগ্ধতায় বিবেক অবধি সুতীব্র ব্যাকুল স্বরে স্নিগ্ধতার অবারিত গান ; সূর্যাস্তে কি সূর্যোদয়ে কি নিবিড় বিনত সন্ধ্যায় প্রার্থনার ভাষা দিয়ে রচিত সে ক্ষমার ভুবন আজ আমি ভুলে যাব; কোনো কথা মনেও রাখব না |
নীরব স্মৃতির স্পর্শ মমতার ঘনিষ্ঠ প্রহরে সলাজ বধূর মতো কে বা ভালোবাসে ? কে আর উৎসের স্মৃতি বুকে ভরে রাখে ?
আমার সর্বস্ব দিয়ে আজ আমি হে গাঢ় বিষাদ, ফিরে যাব অন্ধকার সুদূর বিজনে | সম্পূর্ণ বাউল হব ; ঘরানার সব স্মৃতি ভুলে তোমাদের ভুলে যাব হে করুণাহীনা---- সর্বস্ব ছড়িয়ে রিক্ত আমি কারে মনেও রাখব না |
চতুর্দশপদী কবি আশিস সান্যাল মৃত্যুদিন জন্মদিন কাব্যগ্রন্ত থেকে, ১৯৬৩
একটি মুখশ্রী তার সমস্ত শিল্পের অভিনয় | যাকে সে আড়ালে রেখে সময়ের বিদগ্ধ রেখায় তরল গভীর শান্তি নিয়ে আসে হৃদয়ের কাছে | আবার রহস্য মৃত্যু | দ্যুতিহীন ব্যর্থ বেদনায় হারায় সর্বস্ব শান্তি | নিরুত্তাপ দূরের আঁধারে একশ’ প্রেমিক বন্ধু হাহাকারে সুদৃশ্য সন্ধ্যার রমণীয় পটভূমি পূর্ণ করে তোলে | যন্ত্রণার অনুগামী অভিসার জ্বলে ওঠে আগ্নেয় পাহাড়ে |
দূর থেকে খুশি হয়ে অন্ধকার কেঁপে ওঠে জলে | স্মরণীয় দিনগুলি সম্মুখের বিশুদ্ধ প্রান্তরে জেগে উঠে খেলা করে | মনে হয় সব হারাবার পরেই অপর যাত্রা | সে আনন্দ শায়িত এবার প্রশান্ত মৃত্যুর কোলে, তার গান পরবর্তী ঝড়ে আবার মুখর হবে প্রেমিকের অনন্ত শিখায় |
যে গান ভালোবাসার কবি আশিস সান্যাল মৃত্যুদিন জন্মদিন কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৩
স্রোতের মুখেই সব ব্যাপ্ত হয়েছিল | নদীর ওপাশে সহজ ভোরের মতো আত্মীয়তা | যে গান ভালোবাসার নিরবধিকাল পেয়ে হারাবার মতো বিষণ্ণতা | যে স্মৃতি বিগত জন্মের খোঁজে শালবনে, সুদূরের বিস্তৃত ছায়ায় নিমজ্জিত ; সম্পন্ন বুকের বৃন্তে অন্ধকার যে শুদ্ধ বেদনা ; কঠিন সান্নিধ্যে টেনে সীমারেখা ভুলে গেলে তবু বার বার জন্মান্তরে সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা এবং এ নিরভ্র আকাশ, এই শান্তি, নিরবধিকাল পেয়ে হারাবার মতো বিষণ্ণতা |
স্রোতের মুখেই সব ব্যাপ্ত হয়েছিল | নদীর ওপাশে তার বাড়ি | প্রবাসী ভোরের মতো যে নির্জনতা, জানে দৃশ্যান্তরে উপনীত হওয়া ছাড়া কোনো প্রণত বিভাস ব্যক্তিগত প্রত্যাশার জলকন্ঠ বাজাতে পারে না | যে গান ভালোবাসার, যে স্মৃতি বিগত জন্মের দ্বারে অনুপ্রাণিত ---- শুধু হারাবার ---- নিরবধিকাল পেয়ে হারাবার বিষণ্ণতা |
একটি অনুভব কবি আশিস সান্যাল মৃত্যুদিন জন্মদিন কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৩
একবার নিভে যাব, অন্যবার জ্বলে উঠব ভীষণ আঁধারে---- তবু হে কৃতঘ্ন দুঃখ, এই মালা তোমাকে দেব না ; যে আছে প্রতিষ্ঠ ঘরে শুধু মাত্র তকেই পরাব, ক্ষয়ে যাব দাবদাহে তবু স্তব্ধ কোথাও হব না |
হানো তীব্র কশাঘাত হে কুটিল বৈরী প্রতিবেশী ! অসহায় রক্ত মেখে তোলো তবে শেষ হাহাকার ; মানুষ কি কমনীয় হবে কোনো দিন ? নিজস্ব কুটিরে অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে যাবে যেই দিন অস্তিত্ব আমার-----
তুলে ধরব উজ্জ্বলতা অন্ধকারে সমস্ত নিখিলে | যেহেতু তোমার দাবি অসহায় সমগ্র বিধানে ; নিসর্গে ঘোষিত মৃত্যু ; সঞ্চারিত ব্যাপক গভীরে সময়ের নির্মমতা থামবে না কোনোদিন দীর্ঘ ব্যবধানে |
তাই আজ ভেসে যাব ক্রমাগত নিশ্চল আঁধারে | প্রিয়তম পটভূমি এ জীবনে আর সহজ সৌহার্দ্য ভরে দেব না তোমাকে অমোঘ আনন্দ কিছু | দিগন্ত সমীরে যাত্রার পবিত্র ধ্বনি | মন্দিরে আবার ফিরে আমি যাব না হে ঘৃণিত বিষাদ |
তবে হে স্বাগত মৃত্যু অন্ধকার একক প্রহরে নিরুপায় স্পর্শ করো | যেন শেষবার সর্বস্ব হারিয়ে আমি নির্মেঘ প্রান্তরে জেগে উঠি বাণীময় নক্ষত্র কুমার | অভিজ্ঞ আলোকে স্বাদহীন দৃশ্যরেখা ভুলে গিয়ে প্রজ্ঞার নিবিড়ে তুলে ধরি উজ্জ্বলতা ----- আনন্দের শব্দিত বাসনা |
একটি শোকসভা স্মরণে কবি আশিস সান্যাল আজ বসন্ত কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৫
আমারও মৃত্যুর পরে একদিন শোকসভা হবে | প্রবন্ধে, কাগজে প্রকাশিত হবে কত আশ্চর্য রটনা | অনেক উদাত্ত ছিল, সহৃদয় এবং সভান্তে কিছু শোক প্রস্তাবনা গ্রহণ করার শেষে বন্ধুরা সবাই বলবে অতি ক্লান্ত স্বরে---- দু’মিনিট নীরবতা পালন করতে হবে, না হলে আত্মার না কি সদ্ গতি হবে না |
হাসপাতালে নীরবতা | কেউ আর নিকটে আসে না সবাই দূরত্বে থাকে | কেননা এখানে ম্রিয়মান অসুস্থতা | আগুনে অঙ্গার দেহ | কী আছে শরীরে ? রমণীর মতো বুক ? অর্থাৎ উন্মুক্ত স্থান দেখাবার মতো কিছু নেই | কে তবে নিকটে আসে | অশোক চ্যাটার্জী ছাড়া আত্মীয়স্বজন এবং নিয়ম রক্ষান্তে কোনো বন্ধুবর্গ মাসান্তে কখনো |
কবিতা লিখব ভাবি | ছাপাব কোথায় ? হয়তো মৃত্যুর পরে হতে পারি স্মরণীয় কবি | শোকসভা হবে জানি | প্রবন্ধে, কাগজে প্রকাশিত হবে কত আশ্চর্য রটনা | বন্ধুরা বলবে ভালো--- আপাতত ছড়াক বিদ্বেষ--- অথবা নির্মম-ভাবে বিষাক্ত করুক এই বিশুদ্ধ প্রাঙ্গণ | অ্যালবার্ট হলে যুদ্ধ হোক যথারীতি | তবু একদিন মৃত্যুর সপ্তাহ পরে শোকসভায় কেঁদে উঠবে বান্ধব কবিরা |
অনুভব কবি আশিস সান্যাল স্বপ্নের উদ্যান ছুঁয়ে কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৯
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় | . চেয়ে দেখি দূরের আকাশ থেকে . রূপবান পূর্ণিমার চাঁদ . ডাকছে দু’চোখ মেলে | শিউলি ঝরার শব্দ . শব্দ শব্দ চারিদিকে শব্দময় শিউলি ফুলের . অবিরাম প্রতিধ্বনি |
. কতদিন এমন নির্মল দৃশ্য দেখিনি উচ্ছ্বাসে | . দেখব এমন কথা . ভাবিনি তো আর | . দেখলাম চোখ মেলে কিশোরী মেয়ের মতো মায়াবতী চাঁদ . ভাসমান অন্ধকারে | শ্যামল বল্লরি শোভা | . স্তন দুটি তার . জলের মতন স্নিগ্ধ | ঠোঁটের কিনারে দীপ্ত . নিবিড় আহ্লাদ | . বাঁচার অনেক সুখ . ভাবলাম এই বুঝি জীবনের সবচেয়ে স্বাদ |
হরিদ্রা বনের পাশে জ্বলে উঠল . সাতটি জোনাকি . সাতটি তারার মতো | . সজনে ফুলের . ছড়ালো হাওয়ায় স্পর্শ | যেন কোন অভিসারী এসেছে আবার . পৃথিবীর এই পথে | . নক্ষত্র স্পন্দিত তাই . আকাশ আঁধার---- . দেখলাম চোখ মেলে সে এক নারীর মতো শ্যামশ্রী কান্তার |
চারিদিকে অনুরত নিবিড় আহ্লাদ | . বাঁচার অনেক সুখ----- . মনে হল . এই বুঝি জীবনের স্বাদ ||
যে মানুষ চলে গেছে কবি আশীস সান্যাল যেতে যেতে কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৮২
একটি মানুষ আমি সারা রাত খুঁজেছি শহরে | ‘এখনি আসব ফিরে’ ---- এই বলে কাল যখন সে গিয়েছিল প্রাজ্ঞ তার দু’টি চোখ মেলে ভাবিনি তো এই তার চির অন্তর্ধান ----- বুকের ভেতর ঘর শূন্যতায় ভরে জ্বালাবে চন্দন কাঠে বিবেক নামক মঞ্চে আদর্শ শ্মশান |
সব কিছু ঠিক আছে | শুধু তার পদক্ষেপহীন প্রবীণ দুঃখের ভারে নতজানু সমস্ত বাগান | সভ্যতার সিঁড়ি-পথে আর আমি ছুঁয়েছি আকাশ ---- গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ভাসিয়েছি ভেলা | তবু যেন মনে হয় পুষ্প নেই বোধিদ্রুমে---- প্রতিকূল ধূলি-ঝড়ে সারাক্ষণ বিক্ষত একেলা |
সব আছে তবু শ্রেয় নেই | পুণ্য-পাপ আছে--- তবু প্রেয় নেই | আজ এই শতকের দুর্গম প্রহরে কী যেন হারিয়ে ক্লান্ত | চোখে কারো আশ্চর্য করুণা হয় না ভোরের ফুল | এমনি করেই ইতিহাস স্পর্শ করে বয়ে যাবে বিখ্যাত বরুণা অনেক শতাব্দী আরো | প্রত্যহ সকাল সোনার রোদ্দুর দেবে | পারবে কি দিতে পুনর্বার ‘এখুনি আসব ফিরে’ ---- এই বলে কাল যে মানুষ চলে গেছে ধ্বংস করে জীবনের মৌলিক পাহাড় |
পটভূমি কম্পমান কবি আশিস সান্যাল পটভূমি কম্পমান কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৭২
এ কোন্ উদ্ ভ্রান্ত হাওয়া ? ছলাত্ছল জলের প্রবাহ ? এ কোন্ দিগন্ত জুড়ে বিপুল বর্ষণ ? বিদ্যুৎ স্যাবারে কোন ত্রস্ত বনস্থলি ভয়ানক আন্দোলিত ? মেঘে মেঘে ঘোষিত এখন এ কোন চৈতন্যবাহী জলীয় ঝঞ্ঝার উদ্দাম উদ্ধত ধ্বনি ?
হে ত্রিকালদর্শী সপ্তর্ষি আকাশ ! এ কোন্ দিনান্তে আমি নিপতিত ? যে দিকে তাকাই . শুধু ভাঙনের প্রতিধ্বনি | আচ্ছাদিত অন্ধকারে চেয়ে দেখি আর . ক্ষয়িষ্ণু শৃগাল . কম্পমান মৃত্যুভয়ে | গেরিলা মরশুমি দিকে দিকে নিনাদিত এ কোন প্রান্তরে ?
কোনদিকে ফিরে যাব তবে ? রক্তভয় মৃত্যুভয় থেকে . নন্দন কাননে কোন কুড়াব বকুল ? গাঁথব নিরভ্র মালা ? প্রেয়সীর ঘরে শয্যায় ছড়াব কোন প্রত্যাশার বিস্তীর্ণ মুকুল ?