কবিআশিস সান্যাল-এর কবিতা
*
উৎসের প্রতি  
কবি আশিস সান্যাল
শেষ অন্ধকার: প্রথম আলো কাব্যগ্রন্ত থেকে, ১৯৬০

আমার সর্বস্ব দিয়ে আজ আমি ফিরে যাব দূরে----
হে মৌনা প্রীতির কন্ঠ ! হে গাঢ় বিষাদ !
সব রেখে সুদূরান্ত পথের গভীরে
ফিরে যাব অন্ধকারে হে করুণাহীনা----
সম্পূর্ণ বাউল হব----ঘরানার কোনো স্মৃতি মনেও রাখব না |

তোমাদের ভুলে যাব হে বিশাল পবিত্র জলধি |
ভুলে যাব অন্তরঙ্গ বিমুগ্ধ প্রহরে
প্রসারিত স্নিগ্ধতায় বিবেক অবধি
সুতীব্র ব্যাকুল স্বরে স্নিগ্ধতার অবারিত গান ;
সূর্যাস্তে কি সূর্যোদয়ে কি নিবিড় বিনত সন্ধ্যায়
প্রার্থনার ভাষা দিয়ে রচিত সে ক্ষমার ভুবন
আজ আমি ভুলে যাব; কোনো কথা মনেও রাখব না |

নীরব স্মৃতির স্পর্শ মমতার ঘনিষ্ঠ প্রহরে
সলাজ বধূর মতো কে বা ভালোবাসে ?
কে আর উৎসের স্মৃতি বুকে ভরে রাখে ?

আমার সর্বস্ব দিয়ে আজ আমি হে গাঢ় বিষাদ,
ফিরে যাব অন্ধকার সুদূর বিজনে |
সম্পূর্ণ বাউল হব ; ঘরানার সব স্মৃতি ভুলে
তোমাদের ভুলে যাব হে করুণাহীনা----
সর্বস্ব ছড়িয়ে রিক্ত আমি কারে মনেও রাখব না |

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
চতুর্দশপদী
কবি আশিস সান্যাল
মৃত্যুদিন জন্মদিন কাব্যগ্রন্ত থেকে, ১৯৬৩

একটি মুখশ্রী তার সমস্ত শিল্পের অভিনয় |
যাকে সে আড়ালে রেখে সময়ের বিদগ্ধ রেখায়
তরল গভীর শান্তি নিয়ে আসে হৃদয়ের কাছে |
আবার রহস্য মৃত্যু | দ্যুতিহীন ব্যর্থ বেদনায়
হারায় সর্বস্ব শান্তি | নিরুত্তাপ দূরের আঁধারে
একশ’ প্রেমিক বন্ধু হাহাকারে সুদৃশ্য সন্ধ্যার
রমণীয় পটভূমি পূর্ণ করে তোলে | যন্ত্রণার
অনুগামী অভিসার জ্বলে ওঠে আগ্নেয় পাহাড়ে |

দূর থেকে খুশি হয়ে অন্ধকার কেঁপে ওঠে জলে |
স্মরণীয় দিনগুলি সম্মুখের বিশুদ্ধ প্রান্তরে
জেগে উঠে খেলা করে | মনে হয় সব হারাবার
পরেই অপর যাত্রা | সে আনন্দ শায়িত এবার
প্রশান্ত মৃত্যুর কোলে, তার গান পরবর্তী ঝড়ে
আবার মুখর হবে প্রেমিকের অনন্ত শিখায় |

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
যে গান ভালোবাসার
কবি আশিস সান্যাল
মৃত্যুদিন জন্মদিন কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৩

স্রোতের মুখেই সব ব্যাপ্ত হয়েছিল | নদীর ওপাশে
সহজ ভোরের মতো আত্মীয়তা | যে গান ভালোবাসার
নিরবধিকাল পেয়ে হারাবার মতো বিষণ্ণতা | যে স্মৃতি
বিগত জন্মের খোঁজে শালবনে, সুদূরের বিস্তৃত ছায়ায়
নিমজ্জিত ; সম্পন্ন বুকের বৃন্তে অন্ধকার যে শুদ্ধ বেদনা ;
কঠিন সান্নিধ্যে টেনে সীমারেখা ভুলে গেলে তবু বার বার
জন্মান্তরে সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা এবং এ নিরভ্র আকাশ,
এই শান্তি, নিরবধিকাল পেয়ে হারাবার মতো বিষণ্ণতা |

স্রোতের মুখেই সব ব্যাপ্ত হয়েছিল | নদীর ওপাশে
তার বাড়ি | প্রবাসী ভোরের মতো যে নির্জনতা, জানে
দৃশ্যান্তরে উপনীত হওয়া ছাড়া কোনো প্রণত বিভাস
ব্যক্তিগত প্রত্যাশার জলকন্ঠ বাজাতে পারে না | যে গান
ভালোবাসার, যে স্মৃতি বিগত জন্মের দ্বারে অনুপ্রাণিত ----
শুধু হারাবার ---- নিরবধিকাল পেয়ে হারাবার বিষণ্ণতা |

.                    *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
একটি অনুভব  
কবি আশিস সান্যাল
মৃত্যুদিন জন্মদিন কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৩

একবার নিভে যাব, অন্যবার জ্বলে উঠব ভীষণ আঁধারে----
তবু হে কৃতঘ্ন দুঃখ, এই মালা তোমাকে দেব না ;
যে আছে প্রতিষ্ঠ ঘরে শুধু মাত্র তকেই পরাব,
ক্ষয়ে যাব দাবদাহে তবু স্তব্ধ কোথাও হব না |

হানো তীব্র কশাঘাত হে কুটিল বৈরী প্রতিবেশী !
অসহায় রক্ত মেখে তোলো তবে শেষ হাহাকার ;
মানুষ কি কমনীয় হবে কোনো দিন ? নিজস্ব কুটিরে
অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে যাবে যেই দিন অস্তিত্ব আমার-----

তুলে ধরব উজ্জ্বলতা অন্ধকারে সমস্ত নিখিলে |
যেহেতু তোমার দাবি অসহায় সমগ্র বিধানে ;
নিসর্গে ঘোষিত মৃত্যু ; সঞ্চারিত ব্যাপক গভীরে
সময়ের নির্মমতা থামবে না কোনোদিন দীর্ঘ ব্যবধানে |

মৌনতায় সমাহিত চতুর্দিকে নিরুপায় শায়িত পৃথিবী |
হয়তো হারিয়ে যাব শব্দহীন দিগন্ত শহরে ;
সকালের প্রতিচ্ছবি ম্লান হবে বিকেলের প্রশস্ত আড়ালে ,
ঘণা, হিংসা, প্রতিরোধ ----- অবিরাম আগত প্রহরে

দেবে অন্য অভিলাষ মানুষের অবারিত প্রণয় স্বভাবে |
তারপরে মগ্নতায় দ্বিধাহীন মুগ্ধ অভিসার
রক্ত দেবে তীব্র বেগ | চেতনার বিপুল উত্সবে
জ্বলে উঠবে উজ্জ্বলতা চৈতন্যের প্রণতি আবার |

একবার নিভে যাব, অন্যবার জ্বলে উঠব ভীষণ আঁধারে-----
তবু হে কৃতঘ্ন দুঃখ, এই মালা তোমাকে দেব না ;
যে আছে প্রতিষ্ঠ ঘরে শুধুমাত্র তাকেই পরাব,
ক্ষয়ে যাব দাবদাহে তবু স্তব্ধ কোথাও হব না |

.                  *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ঝড়ের উষ্ণতা পেলে
কবি আশিস সান্যাল
মৃত্যুদিন জন্মদিন কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৩

ঝড়ের উষ্ণতা পেলে আমিও হতাম শেষে তোমার প্রতীক |
জামরুলের মতো শান্ত দেহের শিখায়
জ্বালাতাম দীপগুলি চৈতন্যের মুখর বিশ্বাসে |
দিতাম উজ্জ্বল কন্ঠে আনন্দের প্রস্তুত খেলায়
প্রভূত ফুলের গুচ্ছ | স্নিগ্ধতার বিচিত্র ধেয়ানে
হতাম আমিও শেষে এ জন্মের বিখ্যাত প্রণয়ী |

সবুজ প্রান্তর ঘেঁষে সারারাত অভিজ্ঞ প্রণয়ে
দাঁড়াতাম মুখোমুখি তোমার দক্ষিণে |
কুয়াশার ম্লান শব্দে উপদ্রুত হাওয়ায় হাওয়ায়
ছড়াতাম দিন শেষে সহজ প্রার্থনা |
এবং নির্ণেয় পথে প্রেরণার প্রখর আবেগে
সাজাতাম আভরণে ক্লান্তিহীন দেহশ্রী তোমার |

উন্মোচিত সরোবরে স্বাভাবিক স্রোতের রেখায়
ভাসাতাম ঘনীভূত আনন্দ অপার
নির্ভীক দু’হাত ভরে | প্রশান্ত পালকে
ছড়াতাম বহুবিধ প্রণয়ের অজস্র কাহিনী |
সময়ের ধূসরতা, রক্ত-ভয়, ঘৃণা, প্রতিরোধ
ভুলে গিয়ে প্রতিদিন আমিও হতাম এক আশ্চর্য প্রেমিক |

অথচ ঝড়ের দীপ্তি কোনোদিন পুষ্পিত পাহাড়ে
জাগেনি নির্ভয় শব্দে | মসৃণ আলোকে
মেলেনি দু’চোখ আর | প্রার্থনায় সমগ্র আকাশে
দেয়নি নিথর স্পর্শ | দ্বিধাহীন স্রোতের মতন
কেবল বেদনা ছুঁয়ে নিরবধি নির্মম প্রহরে
দিয়েছে ধূসর ক্লান্তি হৃদয়ের অভ্যস্থ দুয়ারে |

তাই আজ ভেসে যাব ক্রমাগত নিশ্চল আঁধারে |
প্রিয়তম পটভূমি এ জীবনে আর
সহজ সৌহার্দ্য ভরে দেব না তোমাকে
অমোঘ আনন্দ কিছু | দিগন্ত সমীরে
যাত্রার পবিত্র ধ্বনি | মন্দিরে আবার
ফিরে আমি যাব না হে ঘৃণিত বিষাদ |

তবে হে স্বাগত মৃত্যু অন্ধকার একক প্রহরে
নিরুপায় স্পর্শ করো | যেন শেষবার
সর্বস্ব হারিয়ে আমি নির্মেঘ প্রান্তরে
জেগে উঠি বাণীময় নক্ষত্র কুমার | অভিজ্ঞ আলোকে
স্বাদহীন দৃশ্যরেখা ভুলে গিয়ে প্রজ্ঞার নিবিড়ে
তুলে ধরি উজ্জ্বলতা ----- আনন্দের শব্দিত বাসনা |

.                  *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
একটি শোকসভা স্মরণে
কবি আশিস সান্যাল
আজ বসন্ত কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৫

আমারও মৃত্যুর পরে একদিন শোকসভা হবে | প্রবন্ধে, কাগজে
প্রকাশিত হবে কত আশ্চর্য রটনা |
অনেক উদাত্ত ছিল, সহৃদয় এবং সভান্তে কিছু শোক প্রস্তাবনা
গ্রহণ করার শেষে বন্ধুরা সবাই বলবে অতি ক্লান্ত স্বরে----
দু’মিনিট নীরবতা পালন করতে হবে,
না হলে আত্মার না কি সদ্ গতি হবে না |

হাসপাতালে নীরবতা | কেউ আর নিকটে আসে না
সবাই দূরত্বে থাকে | কেননা এখানে
ম্রিয়মান অসুস্থতা | আগুনে অঙ্গার দেহ |
কী আছে শরীরে ? রমণীর মতো বুক ?
অর্থাৎ উন্মুক্ত স্থান দেখাবার মতো কিছু নেই |
কে তবে নিকটে আসে | অশোক চ্যাটার্জী ছাড়া আত্মীয়স্বজন
এবং নিয়ম রক্ষান্তে কোনো বন্ধুবর্গ মাসান্তে কখনো |

কবিতা লিখব ভাবি | ছাপাব কোথায় ?
হয়তো মৃত্যুর পরে হতে পারি স্মরণীয় কবি |
শোকসভা হবে জানি | প্রবন্ধে, কাগজে
প্রকাশিত হবে কত আশ্চর্য রটনা |
বন্ধুরা বলবে ভালো--- আপাতত ছড়াক বিদ্বেষ---
অথবা নির্মম-ভাবে বিষাক্ত করুক এই বিশুদ্ধ প্রাঙ্গণ |
অ্যালবার্ট হলে যুদ্ধ হোক যথারীতি | তবু একদিন
মৃত্যুর সপ্তাহ পরে শোকসভায় কেঁদে উঠবে বান্ধব কবিরা |

.                  *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
অনুভব
কবি আশিস সান্যাল
স্বপ্নের উদ্যান ছুঁয়ে কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৬৯

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় |
.                চেয়ে দেখি
দূরের আকাশ থেকে
.     রূপবান পূর্ণিমার চাঁদ
.          ডাকছে দু’চোখ মেলে |
শিউলি ঝরার শব্দ
.              শব্দ  শব্দ
চারিদিকে শব্দময় শিউলি ফুলের
.            অবিরাম প্রতিধ্বনি |

.             কতদিন
এমন নির্মল দৃশ্য দেখিনি উচ্ছ্বাসে |
.     দেখব এমন কথা
.         ভাবিনি তো আর |
.     দেখলাম চোখ মেলে
কিশোরী মেয়ের মতো মায়াবতী চাঁদ
.               ভাসমান অন্ধকারে |
শ্যামল বল্লরি শোভা |
.    স্তন দুটি তার
.             জলের মতন স্নিগ্ধ |
ঠোঁটের কিনারে দীপ্ত
.             নিবিড় আহ্লাদ |
.     বাঁচার অনেক সুখ
.             ভাবলাম
এই বুঝি জীবনের সবচেয়ে স্বাদ |

হরিদ্রা বনের পাশে জ্বলে উঠল
.              সাতটি জোনাকি
.                সাতটি তারার মতো |
.     সজনে ফুলের
.               ছড়ালো হাওয়ায় স্পর্শ |
যেন কোন অভিসারী এসেছে আবার
.               পৃথিবীর এই পথে |
.    নক্ষত্র স্পন্দিত তাই
.               আকাশ আঁধার----
.    দেখলাম চোখ মেলে
সে এক নারীর মতো শ্যামশ্রী কান্তার |

চারিদিকে অনুরত নিবিড় আহ্লাদ |
.     বাঁচার অনেক সুখ-----
.               মনে হল
.     এই বুঝি জীবনের স্বাদ ||

.           *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
যে মানুষ চলে গেছে
কবি আশীস সান্যাল
যেতে যেতে কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৮২

একটি মানুষ আমি সারা রাত খুঁজেছি শহরে |
‘এখনি আসব ফিরে’ ---- এই বলে কাল
যখন সে গিয়েছিল প্রাজ্ঞ তার দু’টি চোখ মেলে
ভাবিনি তো এই তার চির অন্তর্ধান -----
বুকের ভেতর ঘর শূন্যতায় ভরে
জ্বালাবে চন্দন কাঠে বিবেক নামক মঞ্চে আদর্শ শ্মশান |

সব কিছু ঠিক আছে | শুধু তার পদক্ষেপহীন
প্রবীণ দুঃখের ভারে নতজানু সমস্ত বাগান |
সভ্যতার সিঁড়ি-পথে আর আমি ছুঁয়েছি আকাশ ----
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ভাসিয়েছি ভেলা |
তবু যেন মনে হয় পুষ্প নেই বোধিদ্রুমে----
প্রতিকূল ধূলি-ঝড়ে সারাক্ষণ বিক্ষত একেলা |

সব আছে তবু শ্রেয় নেই | পুণ্য-পাপ আছে---
তবু প্রেয় নেই | আজ এই শতকের দুর্গম প্রহরে
কী যেন হারিয়ে ক্লান্ত | চোখে কারো আশ্চর্য করুণা
হয় না ভোরের ফুল | এমনি করেই
ইতিহাস স্পর্শ করে বয়ে যাবে বিখ্যাত বরুণা
অনেক শতাব্দী আরো | প্রত্যহ সকাল
সোনার রোদ্দুর দেবে | পারবে কি দিতে পুনর্বার
‘এখুনি আসব ফিরে’ ---- এই বলে কাল
যে মানুষ চলে গেছে ধ্বংস করে জীবনের মৌলিক পাহাড় |

.               *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
পটভূমি কম্পমান
কবি আশিস সান্যাল
পটভূমি কম্পমান কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৭২

এ কোন্ উদ্ ভ্রান্ত হাওয়া ? ছলাত্ছল জলের প্রবাহ ?
এ কোন্ দিগন্ত জুড়ে বিপুল বর্ষণ ?
বিদ্যুৎ স্যাবারে কোন ত্রস্ত বনস্থলি ভয়ানক আন্দোলিত ?
মেঘে মেঘে ঘোষিত এখন
এ কোন চৈতন্যবাহী জলীয় ঝঞ্ঝার উদ্দাম উদ্ধত ধ্বনি ?

হে ত্রিকালদর্শী সপ্তর্ষি আকাশ !
এ কোন্ দিনান্তে আমি নিপতিত ?
যে দিকে তাকাই
.                    শুধু ভাঙনের প্রতিধ্বনি |
আচ্ছাদিত অন্ধকারে চেয়ে দেখি আর
.                     ক্ষয়িষ্ণু শৃগাল
.                                  কম্পমান মৃত্যুভয়ে |
গেরিলা মরশুমি
দিকে দিকে নিনাদিত এ কোন প্রান্তরে ?

কোনদিকে ফিরে যাব তবে ?
রক্তভয় মৃত্যুভয় থেকে
.                    নন্দন কাননে কোন কুড়াব বকুল ?
গাঁথব নিরভ্র মালা ?
প্রেয়সীর ঘরে
শয্যায় ছড়াব কোন প্রত্যাশার বিস্তীর্ণ মুকুল ?

কোনোদিকে পথ নেই |
.                         ফিরবার
সমস্ত দুয়ার রুদ্ধ |
.                         সর্বত্র ভীষণ
উত্তাল স্রোতের ধ্বনি |
বাতাস কামান
.        ভাঙবেই ব্যর্থতার দীর্ণ পটভূমি |

এক যুগ আলোকিত |
তারপর ক্ষণিক আঁধার ---
পুনর্বার জাগরণে সেই অন্ধকারে
আলোড়নে হেঁকে ওঠে প্রত্যাশী বিমান |

রক্তে পরিস্নাত হয় বসুন্ধরা |
.                   গঞ্জে ও খামারে
আসন্ন জন্মের লগ্নে
কেঁপে ওঠে পটভূমি গর্ভিণী মাতার |

কম্পমান পটভূমি |
কোনোদিকে আর
.                  ফিরবার পথ নেই |
চতুর্দিকে অবিরত জলীয় ঝঞ্ঝার
.                   ভয়াল বিপুল শব্দ |
ইতিহাস গর্জে ওঠে |
রক্তে তার অভিরাম জেগে ওঠে ধ্বনি |
কোথাও বিদ্যুৎ ফোটে,
স্বাগত প্রথম রৌদ্রে
যেন তার উদ্ভাসিত শুনি প্রতিধ্বনি |

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
মৌলকন্ঠ প্রতিধ্বনি
কবি আশিস সান্যাল
পটভূমি কম্পমান কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৭২

এত জাগরণ তবু জাগরণহীন আলো চৈতন্য অবধি |
রোদের ভেতরে দুঃস্থ রোদের ঝঙ্কার ----
ভালোবাসা মধ্যরাত্রে শ্বাপদসঙ্কুল বনে স্তব্ধ বনস্পতি |
এত প্রেম বিরাজিত তবু প্রেম তোমার আমার
কুয়াশায় ভেসে ভেসে ক্রমাগত ক্ষীণ |
মৌলকন্ঠ প্রতিধ্বনি হেঁকে যায় প্রতিদিন অরব প্রান্তরে----
মানুষ কি রমণীয় হবে কোনোদিন ?

কেননা রক্তাক্ত স্মৃতি যতদূর প্রতিভাত মানব সংসার,
নিসর্গে বিজন বৃষ্টি প্রখ্যাত ছলনা |
প্রত্যেক কান্তারে বৃক্ষ অবনত | শাশ্বত আঁধার
হরিণের মতো ত্রস্ত যেন ধ্রুব মৃত্যুর উপমা |
সর্বত্র বিরাজে ক্লান্তি | নিমগ্ন উচ্ছ্বাসে
দুর্লভ কিশোরী এক কবেকার সজল আকাশে
চোখ মেলে স্নেহময় | গোপন পাহাড়ে
বাউল প্রেমিক তার হেঁটে যায় ম্লান অন্ধকারে |

শব্দময়, ধ্বনিময়, রৌদ্রময় প্রতিদিন প্রথম আঙিনা |
জাগরণহীন আলো তবু দৃপ্ত চৈতন্য অবধি----
ক্রমে ক্লান্তি আবির্ভূত, ক্রমে দুঃখ আবির্ভূত, ক্রমে
নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে প্রতিহত নদী
প্রবল আঘাত হানে চৈতন্যের নির্জন প্রস্তরে-----
ভেঙে যায় পটভূমি | ভেঙে যায়---- নৈঃশব্দ্যে বিলীন
মৌলকন্ঠ প্রতিধ্বনি হেঁকে যায় প্রতিদিন অরব প্রান্তরে
মানুষ কি রমণীয় হবে কোনদিন ?

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর