কবি আশুতোষ মজুমদার - জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার সম্ভবত নোয়াখালিতে।  শৈশবের
একটা বড় অংশ কটেছে পূর্ববঙ্গে। দশ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট ভাই, তাঁর পরে এক বোন।
আশুতোষ মজুমদারের জন্মের তারিখ জানা যায়নি। তাঁর মেজদা অরুণ মজুমদারও জন্মের তারিখ বা সাল
কিছুই মনে করে বলতে পারেন নি! ১৯৬১ সালে তিনি স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিলেন, জানা যাচ্ছে। সেই
হিসেবে ১৯৪৫-৪৬ সালে তাঁর জন্ম, ধরে নেওয়া যায়।

পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে তাঁরা সপরিবারে এপার বাংলায় এসে যাদবপুর-
গরফা-বিবেকনগরে থাকতে শুরু করেন। ভর্তি হন নবকৃষ্ণপাল আদর্শ শিক্ষায়তনে। সেখান থেকেই তিনি
স্কুল ফাইনাল পাশ করেন। তিনি স্কুলের জনপ্রিয় ছাত্র ও সেরা অ্যাথলিট ছিলেন। শ্যামলা রঙ, চওড়া কাঁধ,
উঁচু উঁচু ভ্রু, বড় বড় চোখে গভীর দৃষ্টি, এক মাথা ঘনকালো কোঁকড়ানো চুল, মজবুত চেহারায় উপজাতীয়
সৌন্দর্যের মাদকতা নিয়ে আশু ওর সততা, সাহস ভালোবাসা আর আন্তরিকতায় ধীরে ধীরে সারা কলোনীর
প্রিয় হয়ে উঠেছিল। কলোনীর সমস্ত কাজে ওরাই এগিয়ে যেত সবার আগে, হাসপাতালে যাওয়া, অভাবী
পরিবারে যাওয়ার ব্যবস্থা করা, বিয়েতে পরিবেশন করা, শ্মশানে যাওয়া যাই হোক না কেন সঙ্গীসাথী
জুটিয়ে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ত। ছোটবেলা থেকে আশুতোষের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল নেতা হবার বা সংগঠক
হবার সব গুণ।

১৯৬১ সালে স্কুল ফাইনালের পর আশুতোষ শান্তিনিকেতনে প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে ভর্তি হন। কয়েক দিনের
মধ্যেই ওর সহপাঠীরা ওর ব্যবহারের জন্য প্রশংসা করতে আরম্ভ করলেন। হস্টেলের ছাত্রদের কারুর
অসুখ-বিসুখ হলে রাত জেগে সেবা করা ওর কর্মসূচীর অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো। ঐ সময় লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা
লিখত, দু’ একজন সাহিত্যিক শিক্ষকেরও প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলো। ১৯৬১ সালের পৌষমেলায়
সুনীল
গঙ্গেপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ এবং আরও কয়েকজন উঠতি কবি সাহিত্যিক কবির দাদার
দেড় কামরার ভাড়া বাড়ীতে গিয়ে ওঠেন। কবির বৌদি অপারেশন থিয়েটারে থাকার জন্য দাদা অরুণ
মজুমদারকে হাসপাতালে চলে যেতে হয়। কবির হাতে দায়িত্ব পড়ে এই অতিথিদের দেখাশোনা করার।
তরুণ আশুতোষ তা দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। এমনকি
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গলায় মাছের কাঁটা
বিঁধে গেলে, তাঁকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালেও ছুটোছুটি করেছিলেন। কবিরা আশুতোষের ব্যবহারে
খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন।

প্রি-ইউনিভার্সিটি পাশ করে কলকাতায় এসে
International relations–এ অনার্স নিয়ে ভর্ত্তি হন যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও আশুতোষ অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। স্বল্পভাষী হলেও ওর কাজ,
সহপাঠীদের প্রতি ওর সহমর্মিতা, শিক্ষকদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক দ্রুত ওকে সবার ভালবাসার মানুষে পরিণত
করে। তত্কালীন রেক্টর ডঃ ত্রিগুণা সেনের প্রিয় ছাত্র ছিলেন আশুতোষ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী কাজে
আশুতোষের ভুমিকাকে ডঃ সেন খুব প্রশংসা করেছিলেন। আশুতোষ তখন নিয়মিত কবিতা লিখতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে ওর জীবনে প্রেম আসে। কিন্তু তখনো রাজনৈতিক ভিত্তিটা অতটা দৃঢ় হয়নি।

১৯৬৪ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার পূর্বেই কংগ্রেসের নেতা
অতুল্য ঘোষ আশুতোষের সঙ্গে কথা বলেন।
আশুতোষ তখন
অতুল্য ঘোষকে  জানান যে গরফা রোডে কয়েক ঘর মুসলমান পরিবারের উপর হামলা
হতে পারে।
অতুল্য ঘোষ জানিয়ে দেন, এটা পুলিশ দেখবে। এই কথা আশুতোষ স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতা
অধ্যাপক শান্তিময় রায়কেও জানান। শান্তিময় রায় তক্ষুনি যাদবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে সেই
কথা জানিয়ে দেন এবং বলেন ওদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাবস্থার প্রয়োজনের কথা। দাঙ্গার দিন আশুতোষ
এবং তাঁর বন্ধু, পরবর্তিতে খ্যাতনামা সি.পি.আই.এম. এর নেতা-মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলী এবং মুষ্টিমেয় কয়েকজন
কে নিয়ে সেই দাঙ্গার সময়ে কয়েক ঘর মুসলমানকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রধাণত
আশুতোষের উদ্যোগেই গোটা গরফায় মুসলমান পরিবারগুলি প্রাণে বেঁচে যায়।

১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনে তখন উত্তাল সারা পশ্চিমবঙ্গ। খাদ্যের দাবীতে জেলায় জেলায় মিটিং,
মিছিল, হরতাল চলতে থাকে। খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ব্যার্থ কংগ্রেসের প্রফুল্ল সেন সরকার, আন্দোলনকে
শক্ত হাতে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। দৈনিক বসুমতীর পাতায় ফুটে ওঠে খাদ্য আন্দোলনের ছবি। কিন্তু
সেই সময়ের আনন্দবাজার পত্রিকার ভূমিকা ছিল উলটো, যা কমিউনিস্টরা মেনে নিতে পারেননি।
আনন্দবাজার পত্রিকার ভূমিকার বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টি নীতিগত সিদ্ধান্ত
নিলেও তাকে কাজে পরিণত করছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেকার অতি গোপন “সূর্যসেন গ্রুপ” (এই
গোষ্ঠির কথা দলও নাকি জানতো না) গোপন ও স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আনন্দবাজার পত্রিকা বিতরণের
ভ্যান পুড়িয়ে দেবার, ১৯৬৬ সালের দোলের দিন সকালে। সেই মত যাদবপুর ৮বি স্ট্যাণ্ডের কাছে যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে দাঁড় করানো আনন্দবাজার পত্রিকার ভ্যানে পেট্রল দিয়ে সবাইকে অনুরোধ
করে নেমে যেতে। কিন্তু অনেকেই নামে না, গাড়িতেই বসে থাকে। আশুতোষরা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে ওরা
এলাকা ছেড়ে চলে যায়। ঘটনাটি দুঃখজনক এক মর্মান্তিক ঘটনার রূপ নেয়। আগুন ধরে গেলে বিকট শব্দে
তেলের ট্যাঙ্ক ফেটে যায়। কোনমতে দুএকজন নেমে আসতে পেরেছিলেন। ড্রাইভার সহ তিনজন ভয়ঙ্কর
অগ্নিদগ্ধ হন। একজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। দুজন হাসপাতালে। এই ঘটনাটি আন্দোলনে একটি স্থায়ী ছাপ
রেখে যায়। ঘটনার এই পরিণতি আশুতোষদের কাম্য ছিলনা মোটেই। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য
সচেতনভাবে আনন্দববাজার পত্রিকার ভ্যান পুড়িয়েছিলেন। এর ফলে তাঁদের নামে পুলিশ ৩০২ ধারায়
খুনের কেস করেন। প্রায় এগারো মাস আশুতোষ আণ্ডারগ্রাউণ্ডে কাটায়।

সি.পি.আই.এম. দল এই ঘটনার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু পার্টির বেশ কিছু লোক তাঁদের সাহায্য
করতে থাকেন। ১৯৬৬ সালেই প্রমোদ দাশগুপ্ত একজন আইনজীবিকে বলেছিলেন, “দেখুন গাড়ির ভেতরে
তিন জন লোক ছিল, ওরা মারা গেছে। ওরা ওখানকার স্থানীয় লোক। হরতালের দিন বলে হয়তো গাড়িতে
যাচ্ছিল। পরের স্টপেজে নেমে যেত! ওরা সি.পি.এম.-এরই সমর্থক ছিল। কিন্তু যে ছেলেগুলো গাড়ীটাকে
পুড়িয়েছে তারা জানতো না যে ওরা গাড়ীর মধ্যে আছে। দ্বিতীয়ত যারা কফিহাউসে বসে কফিতে ধোঁয়া
তুলে মার্কসবাদের আলোচনা করে আর শু-শাইনার কে দিয়ে জুতো পালিশ করিয়ে মেট্রোয় গিয়ে কালচারাল
রিভলিউশন করে তাদের দিয়ে কোনদিন বিপ্লব হয়নি, হবেও না। বরং সেই সব ছেলেরা যারা জীবন হাতে
নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দিয়েই বিপ্লব হবে। ভুলচুক এরা করতেই পারে।
আমরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো ব্যারোমিটার দিই নি।  কাজেই ওরা যদি কিছু ভুল
করে থাকে এদের দায়দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। কেসটা আপনিই করুন। তবে পার্টি ব্যানারে নয়।
কেসের খরচ আমরা যোগাড় করে দেবো।”  অসিত গাঙ্গুলী এই কেসের ওকালতীর দায়িত্ব নেন। এক
সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের বেকসুর খালাস করে আনেন।

সূর্য সেন গ্রুপের কাজ যাদবপুর গরফা অঞ্চলে দ্রুত প্রসারিত হয়। গোবিন্দ চক্রবর্তী, আশুতোষ মজুমদার,
কান্তি গাঙ্গুলীদের চেষ্টায় তৈরী হয় রিকসাচালকদের ইউনিয়ন। ওদেরই নেতৃত্বে সংগঠিত হয় ১ এবং ১-এ
বাসরুটের কর্মীরা, গড়ে তোলে যাদবপুর হকার্স ইউনিয়ন। ত্রিগুণা সেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর
থাকা কালীন কোনো রাজনৈতিক দলই সেখানে প্রবেশ করতে পারছিল না। ১৯৬৭ সালে যাদবপুরের ছাত্র
মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আশুতোষ। রেজিস্ট্রার সুহৃদ বসুমল্লিকের সাহায্যে সেখানে ছাত্র সংঘটন ও
বামপন্থী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। নকশালবাড়ী আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই আশুতোষরা
গরফা-সন্তোষপুর অঞ্চলের কালিকাপুর, আনন্দপুর, মাদুরদহ, নয়াবাদ প্রভৃতি গ্রামে কৃষকদের নিয়ে কাজ
করছিলেন। তাঁরা সেখানে চাষযোগ্য জমি ভেড়িতে রূপান্তরের বিরোধিতা করেছিলেন, যা কমিউনিস্ট
পার্টির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল কিন্তু সে কাজে তাঁরা পার্টির তরফ থেকে কোনো বাধা দিচ্ছিল না। ১৯৬৮
সাল নাগাদ আশুতোষ কৃষক, স্থানীয় ঠ্যালা-চালক, ছোট কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে
প্রায় চার হাজার বিঘা, ভেড়ি ও সিলিং বহির্ভূত জমির দখল নিয়ে নেয়। এই জমি ভাগ করে দেয় চাষীদের
মধ্যে। কৃষরা চাষ করতে শুরু করে দেয় এবং ধান পেকে ওঠার সময়ে জোতদাররা আদালত থেকে
ইনজাংশন নিয়ে আসে। জমিতে ঢোকা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আশুতোষরা তখন রাতারাতি ধান কেটে নেওয়ার
বন্দোবস্ত করে। পুলিশ প্রশাসন জোতদার কিছুই করতে পারে নি।

এইরকম সময়ে কান্তি গাঙ্গুলী সূর্যসেন গ্রুপের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং সি.পি.আই.এম. পার্টির
সদস্য পদ পান। আশুতোষের দাদা অরুণ মজুমদার মহুল চট্টোপাধ্যায় কে বলেছিলেন “ . . . ৬৮-তে
কালিকাপুরের জমি দখল আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে। জমি দখলে স্থানীয় সি.পি.এম.-এর নেতৃত্বের সায়
গোড়া থেকেই ছিল না। কিন্তু একেবারে গোড়ায় বিরোধিতা করেনি। কিন্তু আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে,
সি.পি.এম. সুর বদলায়। আনন্দবাজারের ভ্যান পোড়ানোর মামলায় পুলিশের হাত এড়ানোর জন্য যখন
খোকা (আশুতোষের ডাক নাম) আণ্ডারগ্রাউণ্ডে, তখন সে বসন্ত রোগাক্রান্ত হয়। তার চিকিত্সার
জন্য লোকাল পার্টি কোন ব্যবস্থাই করেনি। সেকথা আমার মায়ের কাছে বলতে গিয়ে কান্তি গাঙ্গুলী কেঁদে
ফেলে এবং কিভাবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা চাঁদা তুলে খোকার চিকিত্সার ব্যবস্থা করে সে খবরও
দেয়। ঐ কান্তি গাঙ্গুলীই শেষ পর্য্যন্ত রাজনৈতিক উচ্চাকাংখার লোভে পড়ে খোকার উপর নজর রাখতে
পলিটিক্যাল স্পাই নিযুক্ত হয়। . . .” ( “আশু মজুমদার - এক সংগ্রামের কবিতা”-এর লেখক মহুল
চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধের টীকা তে জানিয়েছেন যে, “. . .ঐ বিষয়ে ও আশু সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে জানার
জন্য আজকাল পত্রিকার দেবাশিস ভট্টাচার্যের মাধ্যমে কান্তি গাঙ্গুলীর সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম।
শুনেছি তিনি সাক্ষাত্কার দিতে চাননি।” )

এই সময়ে নকশালবাড়ীর আন্দোলনে আশুতোষ স্বাভাবিকভাবে আকৃষ্ট হন কিন্তু তাঁর নানা প্রশ্নও ছিল মনে।
১৯৬৯ এর একেবারে শেষ দিকে তাঁকে সি.পি.আই.এম.এল. এর লোকাল কমিটির মেম্বার করা হয়। সেই
সময়ে তাঁরা সি.পি.আই.এম.এল. পাটির লাইন অনুয়ায়ী কাজকর্ম চালাতে থাকে। যাদবপুর-সন্তোষপুর-হালতু
সব এলাকাতে স্কুলে স্কুলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়। স্কুলে স্কুলে উড়িয়ে দেওয়া হয়
লাল পতাকা। এসবের দায়িত্বে থাকতো ছাত্ররা। অ্যণ্ড্র্যুজ স্কুলে গোলমাল হয়েছিল। পোড়ানো হয় অরবিন্দ
বালিকা বিদ্যালয়। তাঁদের বেশীরভাগ কাজই ছিল একশান স্কোয়াডের। যাদরপুর-গরফা অঞ্চলে সি.পি.আই.
এম. ও সি.পি.আই.এম.এল. (নকশাল) এর মধ্যেকার সংঘর্ষ এবং পুলিশের বিরুদ্ধে খতমের অ্যাকশন প্রাধান্য
পেতো।

১৯৬৮ থেকেই গ্রামে খতম শুরু হয়েছিল। পার্টির লাইন হিসেবে ১৯৬৯-এ প্রথমে গ্রামে পরে গ্রাম ও শহরে
ব্যক্তিহত্যা চালু হয়।  আশুতোষরা মূলত অত্যাচারী পুলিশ ও ইনফরমারদের টার্গেট করতো। শোনা যায়
যে ওরা প্রথমে আক্রমণ করে গোপীবল্লভপুরের একজন সি.আই. ( সার্কেল ইনস্পেক্টর ) পদেরপুলিশ
অফিসারের উপরে যিনি এই অঞ্চলে আত্মীয়ের বাড়ী থেকে ফিরছিলেন। কিন্তু ওকে চিহ্নিত করতে ভুল
করায় একজন সাধারণ লোক মারা যান। দ্বিতীয় অ্যাকশন সন্তোষপুরে একজন সাব-ইনস্পেক্টরের উপর।
তাতে ওরা ঐ অফিসারকে খতম করে তাঁর রিভলভার ছিনিয়ে নেয়। তৃতীয় অ্যাকশনে একজন উচ্চপদস্থ
পুলিশ অফিসারকে সেলিমপুরে খতম করে। ওদের প্রিয় কমরেড বিল্লুকে যাদবপুর থানায় পুলিশ গুলি করে
মারলে তার বদলা নিতেই ছিল এই অ্যাকশন। পুলিশী নিপীড়ন এবং এই খতমের ঘটনা নিত্যই বেড়েই
চলেছিল।    

দর্পণ পত্রিকার ১৫.৫.১৯৭০ এর সংখ্যায় লেখা হয় -“গত ছয়মাসেরও অধিককাল যাবত যাদবপুরের
রাজনৈতিক আবহাওয়া সি.পি.এম.-নকশাল সংঘর্ষের বীভত্সতায় বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। অথচ উভয় পক্ষই
এককালে মার্কসবাদী পার্টির ক্যাডার হিসাবে একসঙ্গে কাজ করেছিল। সর্বাপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো
এই যে বর্তমান সংঘর্ষ যে কোন মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে রক্তমাখা চেহারা নিয়েছে।…”

সি.পি.আই.এম. এর তখনকার সান্ধ্য দৈনিক “গণশক্তি”-এর নিজস্ব সংবাদদাতা ৭ই মে ১৯৭০ এই মর্মে
রিপোর্ট পেশ করেন যে “কংগ্রেসের আশ্রয়পুষ্ট উগ্রপন্থী সমাজবিরোধীদের সহযোগীতায় মার্কসবাদী পার্টির
কর্মী মৃত্যুঞ্জয় সেনকে বোমার আঘাতে হত্যা করেছে এবং দুজন মাধ্যমিক শিক্ষককে আহত করেছে।....”  

১৯৭১ সালের ১০ই মার্চ সাধারণ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়। সি.পি.আই.এম.এল. দল নির্বাচন বয়কট
করার ডাক দিল। নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই কিভাবে নির্বাচন বয়কট কর্মসূচী কার্যকরী করা হবে তা
ঠিক করা হয়। এর মধ্যে ছিল বাড়ী বাড়ী গিয়ে বক্তব্য রাখা, লিফলেটিং, দেওয়াল লিখন এবং নির্বাচন
পর্বকে অচল ও সন্ত্রস্ত করা। নির্বাচন ছিল ১০ই মার্চ ১৯৭১ তারিখে। প্ল্যান ছিল ৯ই মার্চ আশুতোষরা আদর্শ
শিক্ষায়তন স্কুল, ঋষি অরবিন্দ স্কুল, নিউ সন্তোষপুর ইত্যাদি নয়টি স্পটে নয়টি স্কোয়াড আক্রমণ চালাবে,
সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ব্যাপক বোমাবর্ষণ ক’রে। পরের দিন নির্বাচন থাকাতে পুলিশ বেশী অত্যাচার
করতে পারবে না। সেই মত সন্ধ্যায় যে যার মত গিয়ে বোম চার্জ করে এসেছিল। আশুতোষ শেল্টার
নিয়েছিলেন গরফার পাটোয়ারীপাড়ার একজনের বাড়ীতে। পর দিন সকাল দশটা নাগাদ একজন ওয়েস্ট
বেঙ্গল পুলিশ অফিসার, মিলিটারী কনভয় নিয়ে যাচ্ছিল কালিকাপুরের দিকে। একটি ব্রীজের কাছে কিছু
ছেলে আড্ডা দিচ্ছিল। মিলিটারী দেখেই তারা দোড়ে পালায়, এই বাড়ীর উপর দিয়েই, যে বাড়ীতে
আশুতোষরা আত্মগোপন করেছিলেন। তাদের তাড়া করে মিলিটারী এবং ওই বাড়ীতেই ছেলেরা লুকিয়েছে
ভেবে সেই বাড়ীটাকে ঘিরে ফেলে। সেখানেই এনকাউন্টারে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পড়ে যান
আশুতোষ। গুলি লেগেছিল ডান হাতে কাঁধের কাছে। সেই অবস্থায় তাঁকে যাদবপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়
এবং প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে তাঁকে থানায় আটকে রাখার পরে দুপুর একটায় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা
হয়। বাঙ্গুর হাসপাতালে ভর্তি করার একটু পরেই আশুতোষ মজুমদার মারা যান। হাসপাতালের রিপোর্টে
দেখা যায় যে তার দেহে অন্তত চারবার গুলি করা হয়েছিল। দেহের নানা স্থানে চাকু দিয়ে ফালা ফালা করে
কেটে দেওয়া হয়েছিল। মাথার চুল হাত দিয়ে টেনে উপড়ে ফেলা হয়েছিল। নখের আঘাতে মুখ বিকৃত করে
দেওয়া হয়েছিল। বলাবাহুল্য থানায় আনার পরে তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়েছিল স্বীকারোক্তির জন্য।
সঙ্গীদের একজনের নামও তাঁর মুখ দিয়ে বার করা সম্ভব হয়নি। স্বীকার করেননি যে তিনি খুনী আসামী।
ক্ষীণ কণ্ঠেও নাকি শোনা গিয়েছিল --- “সি.পি.আই.এম.এল. জিন্দাবাদ, কমরেড চারু মজুমদার জিন্দাবাদ”।
আশুতোষের দাদা বৌদী থানায় গিয়ে তাঁর অবস্থা জানতে চাইলে থানার ও.সি. রিভলভাল উঁচিয়ে তাঁদের
থানা থেক বেরিয়ে যেতে বলে এবং না বেরিয়ে গেলে রিভলভার দিয়ে মাথা উড়িয়ে দেবে বলে ভয় দেখায়।

দুদিন ধরে পুলিশ তাঁর মৃতদেহ ময়না তদন্তের নামে আটকে রাখে। দুদিন পর পুলিশের গাড়ী করে
কেওড়াতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁর দেহ আত্মীয় বন্ধুদের কাছে সমর্পণ করা
হয়নি। দোলের দিন সন্ধায়, সমস্ত শ্মশান পুলিশ দিয়ে ঘিরে রেখে, আশুতোষ মজুমদারের মৃতদেহ সত্কার
করা হয়।  

এই সব অ্যাকশানের নীট ফল ছিল কলকাতায় মানুষ সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসার তাড়ায় থাকতেন।
এই সব সংঘর্ষে বহু তরুণ, পুলিশ ও পথচারী এবং সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান, এই রাজনৈতিক মন্থনে
সামিল থেকে বা না থেকেও। সাধারণ নাগরিক সর্বদা থাকতেন আতঙ্কে। কলকাতার উপর দিয়ে সে এক
বিভীষিকাময় সময় গেছে। কোনো বিপ্লব সফলভাবে সংঘটিত হয় নি। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের বর্বরতা একটুও
কম হয়নি। মানুষের জীবন যাত্রার মানের কোনো উন্নতি হয়নি।

এই কবির জীবন সেই দুঃসময়ের সাক্ষ্য বহন করে। এরকম অ্যাকশন বা লড়াই বা গোষ্ঠিদ্বন্দ্ব আজও হয়ে
চলেছে। শুধু সময়, মানুষ ও উদ্দেশ্য বা আদর্শ বদলে গেছে। আশুতোষ মজুমদারের রাজনৈতিক অবস্থান
যাই হোক না কেন, তার সাথে আমাদের মতের মিল হোক বা না হোক, তাঁর কবিতা আমাদের নাড়া দিয়ে
যায়।

১৫ই অগাস্ট ১৯৬৫ তারিখে প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিশিং-এর গীতা দত্তের প্রকাশনায়, বিদ্যুত চক্রবর্তীর
প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জায় , “বাবা ও মাকে” উত্সর্গ করা, পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় ২২টি কবিতা নিয়ে কবির কাব্যগ্রন্থ
“সন্দেহের তির্যক চোখে সাতরঙ” থেকে নেওয়া কিছু কবিতা এখানে তোলা হলো। আমরা এই কবির কবিতা
পেয়েছি স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, "সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী" ১৯৯৮ গ্রন্থ থেকে।

তাই আমরা  
মিলনসাগরে  কবি আশুতোষ মজুমদারের কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে
পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।   

আমরা
কবি রাজেশ দত্তর কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ, কবি আশুতোষ মজুমদারের এই পাতাটি তৈরী করার
সবরকম তথ্য, আমাদের দেবার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।  আমরা আরও কৃতজ্ঞ শ্রী চিররঞ্জন
পালের  ( +৯১৯৪৩৪৫১৬৮৯৮)  কাছে   তাঁর  নানাভাবে  এই পাতাটি তৈরী করতে  সাহায্য করার জন্য।
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত “এবং জলার্ক” থেকে ২৫.০৫.১৯৯৮ তারিখে প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখক
শিল্পী”, গ্রন্থ থেকে নেওয়া তথ্যাদি নেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞ।


উত্স - মহুল মুখোপাধ্যায়, আশু মজুমদার - এক সংগ্রামের কবিতা, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত অধুনা
.         জলার্ক প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখ শিল্পী” গ্রন্থ, ১৯৯৮।
.          
মূল লেখাটি PDF-এ সম্পূর্ণ পড়তে এখানে ক্লিক্ করুন।  



কবি আশুতোষ মজুমদারের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।    



আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     



এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ৩১.১০.২০১৫
...