কবি অতীন্দ্রলাল দাশের কবিতা
*
নাম নামী
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা – ১১ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

হরিনামে মাতোয়ারা বালক জগৎ
পান করি নাম সুধা
মিটে যে সকল ক্ষুধা
নাম মন্ত্রে দূরে যায় আপদ বিপদ |
সঙ্গীদল নিয়া সাথে
কীর্তন লীলায় মাতে
মধু সুরে উঠে বোল নাম মধুময় |
কীর্তনে কীর্তনে হয় অপূর্ব আবেশ
শিহরি শিহরি উঠে
অঙ্গে অঙ্গে দীপ্তি ফুটে
সুরে সুরে লাস্যে নাচে বন্ধু সুরেশ |
নব গোরা নাচে যেন শিশু বন্ধু রায়,
হেম দন্ড বাহু দ্বয়
ঊর্দ্ধে তুলি সমুচ্চয়
নাম বোলে নাচে গায় জগৎ মাতায় |
রাতুল চরণশোভা ছন্দে দোলে
কমল নয়ন দুটি
ভাব মুগ্ধ উঠে ফুটি
বদন ভাসিয়া যায় নয়নের জলে |
নামময় নামী যেন বন্ধু সুধাকর,
হৃদয় বীণার তারে
অনাহত ঝঙ্কারে
আনন্দে ভাসিয়া যায় সর্ব চরাচর |
সর্ব দেহে মনে প্রাণে জীবন স্পন্দনে,
নাম রসে মহা ভাব
নামময় আবির্ভাব
নাম, রূপ, গন্ধ, স্পর্শ, সুন্দর ভুবন |
নামের সাগরে ডুবে কভু মূর্ছা যায়
ভাবের সমাধি মাঝে
নামের মুরলী বাজে
শুভ শতদল সম ধূলাতে লুটায় |

.                         ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রহ্লাদ
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –১৩/ ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

হরিনামে মাতোয়া জগৎ সুন্দর
হরি কথা, হরি নাম,
হরি ভক্ত, যাত্রা গান,
জগতের সদা প্রিয় হরি-পরাত্পর |

*    *    *  

অগণিত শ্রোতা সনে বসি নিরুপম
শুনিতেছে ভক্তকথা
‘প্রহ্লাদ চরিত্র’ গাথা
ভাবেতে বিভোর হল বন্ধু রতন |

*    *    *  

হিরণ্য কশিপু সুত প্রহ্লাদ কিশোর,
হরি ধ্যান, হরি জ্ঞান,
হরি-ভক্ত-পরায়ণ,
হৃদয় হরেছে তার হরি মনোচোর |
বিষ্ণুদ্বেষী পিতা তার কুলিশ বচনে
শাসায়ে বলিল তারে,
“হরি নাম ছাড় ওরে---
বাঁচিবার সাধ যদি থাকে তোর প্রাণে” ;
“হরি তোর পিতৃ অরি, ভজিস তাহারে !
পাইবি উচিত শিক্ষা,
কিছুতে না পাবি রক্ষা,
হরি সহ তোরে আমি ডুবাব সাগরে |”

“ভষ্ম করি দিব তোরে ভীষণ অনলে,
লয়ে সে চিতার ছাই
হরি মুখে দিব তাই
অথবা মরিবি, দুষ্ট হস্তী-পদ-তলে |”

শিশু বলে, “ভজ হরি, তবে মুক্তি পাবে,
অনলে অনিলে হরি,
জলে হরি, স্থলে হরি,
কে কারে বধিবে, পিতঃ, কে কারে রাখিবে |”

এত শুনি দৈত্যপতি গর্জিলে ভীষণ,
“বধ এই হরি ভক্তে
আজি তার তপ্ত রক্তে
তৃপ্ত হবে হৃদি মোর শান্ত হবে মন |”
মশানে লইয়া গেল প্রহ্লাদের তখন ;
হরি ভক্তে বধিবারে
শাণিত কৃপাণ করে
ঘাতক দাঁড়াল আসি, নিকট শমন |
ভক্ত-শিশু ভক্তি-পূতঃ ভক্তিতে মগন ;
কৃতান্তে সম্মুখে হেরি,
কাতরে ডাকিছে, “হরি,
কোথা আছ, প্রিয়তম, দাও দরশন ;
জীবন গ্রাসিবে এবে আসন্ন মরণ ,
যুগল রূপেতে তবে
আর কবে দেখা দিবে ,
দেখা দাও বনমালী, জুড়াও নয়ন  |”

*    *    *  

ভক্তের ক্রন্দন রবে বন্ধু বিচলিত ,
ভক্তের লাঞ্ছনা হেরি,
আকুলিত বন্ধু হরি,
ভূতলে লুটায়ে পরে হইল মূচ্ছিত |

.                                  ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
“ধ্রুব”    
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –১৩ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

যাত্রা চলিছে “ধ্রুবচরিত্র” শালগাড়িয়ার গ্রামে,
হাজারে হাজারে লোক জমিয়াছে সম্মুখে, পিছনে, বামে |
জগৎ বন্ধু এসেছে ছুটিয়া “ভক্ত ধ্রুবের” টানে,
তন্ময় হ’য়ে শুনিছে “যাত্রা” এক মনে এক ধ্যানে ||
সখারা সকলে নিষেধ করেছে, যাস্ নে যাত্রা গানে,
মূর্চ্ছিত হ’য়ে পড়িবি কোথায়, কখন কেহ না জানে |”
আশ্বাস দিয়া বলেছে জগৎ, “ভয় নাই, ভয় নাই,
আজিকে মূর্চ্ছা কিছুতে হবে না দেখে নিস্ তোরা ভাই ||”

*     *     *     *    

উত্তান-পাদ রাজার পুত্র, সুনীতি মায়ের ছেলে,
বিমাতার কোপে, জননীর সাথে বনবাসে গেছে চলে |
অবোধ বালক সুকুমার তনু খেলিয়া বেড়ায় বনে,
বন বিহঙ্গ, বন কুরঙ্গ, বনবাসী শিশু সনে |
একদা সখারা জিজ্ঞাসে তারে, “পিতা তোর কেবা হয়,
কি নাম তাহার, কোথায় নিবাস, কিবা তার পরিচয় ?”

*     *     *     *  

সরল বালক জানে না কিছুই ; আসিয়া মায়েরে পুছে,
পিতার কি নাম, কোথায় বসতি, যাইব তাঁহার কাছে ;
সখাদেরে নিয়া যাইব তথায়, উঠিব পিতার কোলে,
মলিন কেন গো বদন তোমার, জননী, দাওনা ব’লে ?
জননীর কাছে জানিয়া সকল ধ্রুব গেল অবশেষে,
পিতার সকাশে আসিয়া বালক পিতার কোলেতে বসে |
হেন কালে হায় বিমাতা সুরুচি নিরদয় নিরমম
কোথা হতে এল ক্রোধে গরজিল ক্ষুব্ধ ঝটিকাসম,---
“নেমে আয় ওরে হতভাগা ছেলে, নেমে আয় বলি তোরে,----
রাণী-সুত শুধু বসিবারে পারে রাজার অঙ্ক প’রে,
জননী যে তোর জনম দুঃখিনী, ভিখারিণী, বনবাসী,---
কেমনে বসিবি রাজার অঙ্কে রাজার প্রাসাদে আসি ?
যুগ যুগ দরি হরি সাধনায় কঠোর তপস্যাতে
সিদ্ধি লভিয়া জনম আসিয়া সুরুচির জঠরেতে ;---
তবে সে বসিবি রাজার অঙ্কে রাজ প্রাসাদের মাঝে ;
সুনীতির সূত ভিক্ষুক ধ্রুবে রাজ-সুখ নাহি সাজে |”
বিমাতা সরোষে দূর করি দিল পদাঘাত করি তারে,
দুচোখে বহিছে বেদনার ধারা, ধ্রুব চ’লে যায় ধীরে |
গভীর নিশীথে ধ্রুব চলিয়াছে গহন বনের পথে,
সাধনার বলে হরিরে লভিবে, কামনা রয়েছে সাথে |
বুকের ব্যথায় অশ্রু সজল নয়নে ডেকেছে বান,
ব্যথার কমল আসনেতে জাগে ব্যাথাহারী ভগবান |
আর্ন্ত ভক্ত কন্ঠে, “কোথা জগতের হরি,
পদ্ম পলাশলোচন শ্যামল, দেখা দাও কৃপা করি |”

*     *     *     *  

শুনিয়া জগৎ বিচলিত হল চোখেতে লাগিল ধাঁধা,
শত সংযম সুকঠিন পণ কিছুতে না মানে বাধা |
ভাবে উতরোল লুটাইয়া পড়ে মূর্চ্ছিত ধরাতলে,
জীবনের গতি থামিয়াছে যেন প্রবাহ নাহিক চলে |

.                           ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ডাক্তার কালী
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –১৩ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

ধ্রুব চরিত্র যাত্রা চলেছে, বন্ধু গিয়াছে তথা,
ভক্তের মুখে হরি-গুন-গান শুনিবারে হরি-কথা,
ভক্ত ধ্রুবের হরিনাম গানে হইল ভাবান্তক
মূর্চ্ছিত হয়ে জগৎবন্ধু লুটাল ভূমির পর ;

*     *     *     *   

সেখানে আছিল ডাক্তার এক চন্দ্রশেখর কালী,
দেহ বিদ্যায় পণ্ডিত সে যে আছে তার চতুরালী |
ভাব-সমাধিতে বিশ্বাস নাই ধারে না কিছুরই ধার,
দেহ যন্ত্রের যান্ত্রিক সে যে যন্ত্র করেছে সার !
জগতের ভাব-মূর্চ্ছা দেখিয়া বলে, “এ যে হিষ্টিরিয়া,
আমার বাড়ীতে নিয়ে চল এরে, শোয়াও টেবিলে নিয়া |”
চলে পরীক্ষা টেবিলে শোয়ায়ে, লাগায়ে টেথিস্কোপ,
ধরা নাহি যায় কিসের কারণে কেন এত সংক্ষোভ |
নাড়ী নাহি চলে, প্রাণহীন দেহ, হৃদয়ের ক্রিয়া বন্ধ,
বিস্ময়াহত ডাক্তার কালী, লেগে গেল মহাদ্বন্দ্ব |
যন্ত্র তাহার--- যন্ত্রই শুধু, দেহ যন্ত্রই চিনে,
যন্ত্র-অতীত --- যন্ত্রী-যে আছে তার কভু নাহি জানে |
দেহ-তত্ত্বের ডাক্তার কালী অভিমানে ভরপুর,
দেহী যে বাজায় দেহের বাঁশরী শোনেনি’ত তার সুর |
দীর্ঘ দিনের শিক্ষা তাহার অনেক অভিজ্ঞতা,
আজি বালকের মূর্চ্ছা নিদানে সকলি হইল বৃথা |
অদ্ভুত রোগী, দেহেতে তাহার নাহিক প্রাণের সাড়া,
প্রাণহীন দেহে লুকায়ে রয়েছে কোথায় প্রাণের ধারা |
ডাক্তারী তার মানিয়াছে হার হারেনি’ত ডাক্তার,---
সবলে ধরিল রোগীর নাড়ীরে, দুচরণ লঘুভার ;--
পরশ মাত্র চকিতে খেলিল বিজলি কালীর দেহে ;--
চপল কিশোর নাচিতেছে বুঝি ‘কালীর’ কালীয়-দহে |
প্রাণের দেবতা বাজায় বাঁশরী হৃদয় যমুনা কুলে
নাম রসে যেন শিহরে অঙ্গ নাচিয়া নাচিয়া দোলে |
অনেক রোগেতে বিধান দিয়েছে প্রবীণ চিকিত্সক
দিব্য শিশুর দিব্য এ রোগ অতীব সংক্রামক |

.                           ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অগ্নি পরীক্ষা
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –৯৪ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

হরি নামে মাতোয়ারা জগৎ কিশোর,
নাচে গায় মধু-নাম নামেতে বিভোর |
কভু বা কীর্তন-রসে আকন্ঠ ডুবিয়া,
ভূমিতে লুটায়ে পড়ে মূর্চ্ছিত হইয়া |
কেহ তারে ভালবাসে, কেহ বুঝে ভুল,
ভক্তি ভরে কেহ ধরে চরণ রাতুল |
কেহ নিন্দে ; কেহ স্নেহে করিছে ভর্ৎসনা ;
কেহ ভাবে, “মূর্চ্ছা এই ছলের ছলনা |”

*    *    *    *    

একদা কীর্তন-মুগ্ধ-মূর্চ্ছিত জগতে,
সত্য কিনা ভাব-মূর্চ্ছা ইহা পরীক্ষিতে,
জগতের বাম-পদ-বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পর
পাষণ্ড স্থাপিল এক জ্বলন্ত অঙ্গার ;
কুসুম-কোমল পদ জ্বলিতে লাগিল ;
জগতের ভাব-মূর্চ্ছা তবু না ভাঙ্গিল |

*    *    *    *  

ভয়ে ভীত পাষণ্ডের ভেঙ্গে গেল ভুল,
নিমেষে সংশয় তার হইল নির্ম্মূল,
অনুতাপে দগ্ধ নয় সকল হৃদয়,
বর্ষে বর্ষে জীবনের হ’ল অপচয় ;
অবশেষে স্থান লভি বন্ধুর চরণে,
মুক্তির পরশ পায়, শান্তি মনে প্রাণে |

.                     ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পুন্টুর বন্ধু
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –৯৪ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

পুন্টু যাইবে শ্বশুর বাড়ীতে, নব-বিবাহিতা সে যে,
প্রিয়তম তার পথ চেয়ে আছে রমণীয় বর সাজে,
নয়নে খেলিছে বিলোল চাহনি অধরে হাঁসির রেখা,
অঙ্গে অঙ্গে তনুর তনিমা ভাসিছে রূপের শিখা |
তবু পুন্টুর কি যেন হইল, ভাবনা কিসের তরে,
ছন্দ বিহীন বেসুরা বাজিছে হৃদয় বীণার তারে,
বিরহের তান বেহাগে ধ্বনিছে করুণ ঝঙ্কারে,
হৃদয়ের ধন দূরে চলে যায়, বুঝি না আসিবে ফিরে |
পুন্টু জগতে ভালবাসিয়াছে সকল পরাণ দিয়া,
জগৎ তাহার প্রিয়তম সখা ; জুড়ায় সকল হিুয়া,
জগতেরে ছাড়ি কেমনে থাকিবে, হয়ে থাকে মন মরা,
বিরহ-বিধুর আকুলিত চিত্ত, ভেবে ভেবে হল সারা |
অপরাধী সম দাঁড়ায়ে পুন্টু মলিন বদন খানি,
বন্ধু তাহারে নিকটে ডাকিল স্নেহের পরশ দানি,
বুঝায়ে বলিল, “প্রাণের পুন্টু ভুলিব না আমি তোরে,
ভকতি প্রীতির কঠিন বাঁধনে বাঁধিয়াছ তুমি মোরে |
যেথায় চলেছ যাও যথা কাজে, প্রাণে যদি পাও ব্যথা,
যদি কভু আসে ভয় আশঙ্কা, লইয়া তুলসী পাতা,
আমার নামেতে আমারে স্মরিয়া ভাসাইয়া দিও জলে,
আমি যে তোমার চির সখা, প্রিয় একথা যেয়ো না ভুলে |
আমার নামেতে তুলসীর পাতা সলিলে ভাসাও যদি,
তখনি জানিব, অচিরে তরাব, সব তাপ নিরবধি |
প্রেমের আলোকে ফুটিয়া উঠিল সখার আনন খানি
পুন্টুর সখা বন্ধু জগৎ হৃদয়ে প্রেমের খনি |

.                     ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ক্ষ্যাপা
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –৯৬ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

পাবনা জেলার শহরতলীতে বৃদ্ধ বটের তলে
ভাঙ্গা দালানের নিরালা কোণায় ক্ষ্যাপা থাকে কুতূহলে |
হারাণ ক্ষ্যাপার কত যে বয়স কোথায় নিবাস তার,
জীর্ণ দালানে আবর্জনায় জীর্ণ ক্ষ্যাপার বাস ;
সাপে সমাকুল কুটুরীর মাঝে কাটে তার বার মাস |

*     *     *     *      

খেয়ালী পাগল হাসে গাহে আর মুখে বিড়্ বিড়্ করে,
মিঠাই মোণ্ডা আনিয়া জমায় দোকানে ভিক্ষা করে ;
বালক বালিকা শিশু যত দেখে ডেকে আনে অবশেষে
কচি মুখে দেয় মিঠাই মোণ্ডা, মহা আনন্দে ভাসে |

*     *     *     *    

বৈশাখে এক চাকী গৃহিণীরে ফুটি ফল দিল ক্ষ্যাপা,
বলিল তাহারে, “দূর্গা পূজায় করিবি মায়ের সেবা,
দিবি এই ফল মায়ের চরণে |”   গৃহিণী  ভকতি ভরে
নিয়া সেই ফল পরম যতনে রাখিল শিকার’ পরে |
মাস ছয় পরে মহা সমারোহে আসিল মায়ের পূজা,
অবাক গৃহিণী নামায়ে দেখিল সে ফল রয়েছে তাজা |

*     *     *     *    

রথের সময় রথ বামাইতে ভাল কাঠ কোথা পাবে,
ক্ষ্যাপা বলে দিল, “খুঁড়ে দেখ্ হোথা ভাল কাঠ মিলে যাবে |”
খনন করিয়া সেথা ভূগর্ভে সকলে অবাক মানে,
কেমনে আসিল এত কাঠ সেথা কেহ কিছু নাহি জানে |

*     *     *     *    

বালক জগৎ ভালবাসে তারে, ছুটে যায় তার কাছে,
তারে পেয়ে ক্ষ্যাপা মহা উল্লাসে, “জগা, জগা” বলি নাচে,
নেচে নেচে বলে, “জগারে, জগারে, তুইত দেশের লোক,
তোরে ধরি বুকে দূরেতে পালায় সকল ভবের রোগ |”
জগতের ক্ষ্যাপা কভু বুকে নেয়, কভু সুখে কোলে করে,
কভু বা আদরে দুবাহু জড়ায়ে ভূতলে শুইয়া পড়ে |
জগৎ ক্ষ্যাপারে শিব বলি ডাকে, ক্ষ্যাপা তারে জগা ডাকে
জগা আর শিব যেন হরি হর মিশে আছে বুকে বুকে |

.                     ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ভৃগুপদ-চিহ্ন
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –৯৫ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

বালক জগৎ থাকে পাবনায় গোলক মনির গেহে,
দিদিমনি তারে রাখেন যতনে, শাসন করেন স্নেহে |
খেয়ালী জগৎ খেয়ালেতে করে যখন যা খুসি তাই,
ভাইটীরে নিয়ে চিন্তিত দিদি, ভআবনার শেষ নাই |
অতি ভোরে উঠে কখন যে যায় স্নান করিবার তরে,
বেলা বেড়ে যায়, চিন্তিত দিদি, ভাইটী না আসে ফিরে |
হরিনামে মেতে ভাব দশা হয়ে মূর্চ্ছিত হয় যদি-----
তাই জগতের কীর্ত্তন গাওয়া নিষধ ক’রেছে দিদি |
সারাটা দিনেতে খেয়ালী জগৎ স্নান করে বহুবার,
কাপড়ে জড়ায়ে রাখে সে সতত সকল শরীর তার ;
তেল নাহি মাখে রুক্ষ কেশেতে রুক্ষ শরীরখানি,
মলিন বস্ত্র, জীর্ণ অঙ্গ ; ----- ভেবে মরে দিদিমণি |

#                         #                           #

বহে মাঘ মাসে শীতের বাতাস জগৎ গিয়াছে স্নানে,
“কত বেলা হল, ভাই নাহি এল” দিদি ভাবে মনে মনে ;
যে পথে গিয়েছে সেই পথপানে চেয়ে থাকে বারে বারে,
“বুঝিবা বিশদ ঘটেছে কোথাও, তাই না আসিছে ফিরে,
বুঝি কীর্ত্তনে মূর্চ্ছিত হ’য়ে ভূতলে লুটায় দেহ,
সোনার অঙ্গ ধূলিধূসরিত, দেখিয়া না দেখে কেহ |”
হেনকালে তথা জগৎ আসিয়া দাঁড়াইল ধীরে ধীরে,
মলিন বসনে শুষ্ক বদনে কথাটী নাহিক সরে ;
বলিল জগৎ, “বেলা হ’য়ে গেল, এই আসি স্নান সেরে”,
দিদি তারে বলে, “কিরূপ হয়েছে --- থাম দেখি থাম ওরে,
এত শীতে তুমি কত কর স্নান, তেল নাহি মাখ গায়ে,
মলিন বস্ত্র শীর্ণ গাত্র, অলক উড়িছে বায়ে,
জড়ায়ে জড়ায়ে মলিন বসন নিজেরে রেখেছে ঘিরি,
দেখেছ কি কভু নিজের রূপটী, কেমন হয়েছে ছিরি ?---
বারে বারে শুধু ডুব দিয়ে এলে হয় না কিছুই স্নান,---
সারা গায়ে আজি মাখাইব তেল খোলরে বসন খানি
গরম জলেতে স্নান করাইব মেজে দিব সারা গাত্র,
কিছুতেই ফাঁকি দিতে না পারিবি, নহি আমি সেই পাত্র----“
এত বলি দিদি ধরিয়া ফেলিল জগতের হাতখানি
চপল জগৎ হাত ছাড়বারে করে শুধু টানাটানি ;
আকুলি বিকুলি করিছে জগৎ কতই ভঙ্গিমা,
বলিছে কাতরে, ছেড়ে দাও দিদি, তেল আমি মাখিব না |
হঠাৎ ছুটিয়া পালাতে জগৎ, কাপড় ধরিল দিদি,
বস্ত্র-হরণে মেতেছে গোলোক, ঘুরে অঞ্চল নিধি |
ভাইটী তখন আর নাহি পারে করিতে সম্বরণ,
মুক্ত হইল বিশাল বক্ষ অদ্ভুত দরশন |
চকিতে কি যেন হেরিয়া বক্ষে স্তব্ধ গোলকমণি
স্তম্ভিত হ’ল সকল শরীর থেমে গেল টানাটানি ;
থর থর করি কাঁপিয়া কাঁপিয়া মূর্চ্ছিত হ’য়ে পড়ে
“হরে-কৃষ্ণ” মন্ত্র জপিয়া জগৎ ধরিল তারে ;
অমৃত-পরশ-করপল্লব বুলাইয়া দিল ভালে ;
চাহিয়া দেখিল দিদিমণি তারে অবাক নয়ন মেলে ;
দিদি বলে তায়, “ও কিরে জগৎ, কি দেখিনু বুকে আঁকা,
কে পরাল তোরে বনফুলমালা এমন অমিয় মালা ?”
জগৎ বলিল, চিহ্ন দেখেছ, ভৃগুপদরেখা বুকে,
তাইত গো দিদি রেখেছি অঙ্গ বসনে বসনে ঢেকে |
এ কথা বলিয়া নিমেষে পালাল দিদির সমুখ হতে,
বিস্মিত দিদি কিছু না বুঝিল ভাবনা বাড়িল তাতে |

#                         #                             #

স্নেহেতে অন্ধ দিদি ভাবে শুধু জন্ম-দাগ বা হবে,
হৃদয় তাহার মুগ্ধ হ’য়েছে বন-ফুল-সৌরভে ||

.                     ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
উদ্ধারণ
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –৯৯ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

বালক বন্ধু প্রেমের সিন্ধু অটুট ব্রহ্মচারী,
পাবনা শহরে তরুণের দল জুটেছে তাহারে ঘিরি |
শুভ আদর্শে নবজীবনেতে হইয়াছে তারা ব্রতী,
“কি জানি কি হবে” ভাবে গুরুজনে ভীত শঙ্কিত অতি ;
“জগতের সনে মিশিবিনা কভু” সরোষে শাসন করে,
শত শাসনেতে তরুণের দল জগতেরে নাহি ছাড়ে |
জগৎ ফুটেছে ক্ষেতের মাঝে মধুময় শতদল,
অন্তরে তার স্নেহ প্রীতি-ধারা সুধারাশি পরিমল,
ছুটে আসে তাই বালকের দল লুদ্ধ অলির সম ;
ব্যর্থ হইল সকল শাসন নিরদয় নিরমম |
অসুরের দল গণিল প্রমাদ জগতে দেবতা দেখি ;
চক্রীর বুকে হীন জিঘাংসা জ্বলিতেছে ধিকি ধিকি |

*     *     *     *   

একদা জগৎ শেষ রজনীতে ইছামতী নদীতীরে,
আপনার মনে গাহে হরিনাম অনিয় মাখান সুরে,
সুর-সুধা-রাশি ধীরে বঁয়ে যায় দিগ্ দিগন্তপানে,
আকাশ বাতাস সহসা পুরিল সুরমাখা হরিনামে ;
স্বরগসুষমা মূরছনা তার, পাষাণও গলিয়া যায় ;
অসুরের দল লুকায়ে দেখিছে, তারা না গলিল হায় |
সুযোগ বুঝিয়া জগতেরে তারা করিল আক্রমণ,
আঘাতে আঘাতে জর জর দেহ মূরছে বন্ধুধন :
একবার শুধু নিমেষে হেরিল কমল নয়ন খুলি,
তিন পাষণ্ডপরিচিত তার, রূঢ় ভাষে দেয় গালি |
সুকুমার তনু লুটাইল ভূমে, মৃত্যু পথের যাত্রী ;
জীবন নদীর তীরে তীরে হায় ঘনাইয়া আসে রাত্রি |
ঝোপের আড়ালে পড়িয়া রহিল লাঞ্ছিত দেহ তনু,
ফুটিয়া উঠিছে জ্যোতির ঝলক প্রকাশইছে যেন ভানু |
চৌকিদার এক পাহারায় রত হেরিয়া সে জ্যোতিরাশি,
ছুটে এসে দেখে ধূলাতে লুটায় জগতের আলো শশি ;
পড়ি গেল সাড়া ছুটে এল যবে আলুথালু দিশাহারা,
মূর্চ্ছিত দেহ নিয়ে এল ঘরে, আকুল পাগল পারা |
পাষাণ গলান বেদনা ব্যথিত উঠে ক্রন্দন-ধ্বনি
শোকে বিহ্বল অশ্রুসজল প্রসন্ন গোলোকমণি |
বহু প্রক্রিয়ায় চলে শুশ্রূষা চোখ মেলি চাহে বন্ধু,
ব্যাথার জগৎ ব্যাথায় ব্যথিত হৃদয়ে করুণা সিন্ধু ;
আকুল পরাণে পুছে প্রসন্ন, “বলনা জগৎ ওরে,
কোন পাষণ্ড হেন নিরমম আঘাত করিল তোরে ?”
বেদনা বারিধি স্তব্ধ অতল স্তম্ভিত কলরোল,
অপলক আঁখি শুধু চেয়ে রয় মুখেতে না সরে বোল |
সখারা সকলে ব্যথিত চিত্তে জিজ্ঞাসে বারে বারে,
“কেবা পাষণ্ড, বল তার নাম, দন্ড দানিব তারে |”
বন্ধু সুধীরে লিখিয়া জানাল বেদনা বিধুর বাণী,
“দন্ড কাহারে দানিব না, শুধু উদ্ধারণ বটে আমি |”
রক্ত আখরে শ্বেত মর্ম্মরে ফুটে মরমের লিখা ;
আলোকের শিশু বালক জগৎ পাবনী পাবক শিখা |”

.                     ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
হরিরলুট
কবি অতীন্দ্র লাল দাশ
রচনা –৯৯ / ১২  / ১৯৫৮
শ্রীমতী মাধুরীকণা দাশ প্রকাশিত “পঙ্কজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

জগতের বাধা বিঘ্ন অশুভ সংবাদ
ষড়যন্ত্র পীড়নাদি বহু পরমাদ,
শুনি দিদি দিগম্বরী, নিয়ে গেল তারে,
রাখিবে নিজের কাছে পরম আদরে ;
চোখে চোখে রাখে তারে শঙ্কিত পরাণে
সতত অশুভ চিন্তা জাগে মনে মনে |
সহসা পড়িল মনে স্মৃতি পুরাতন,---
মধুমাখা বাল্যকথা জাগিল তখন,---
হরিলুট দানিবারে করিয়া ওজন
জগতের দেহভার হয় যত মন,
করিয়া মানত এক দেবী রাসমনি
হরিলুট পণ-রক্ষা করেনি জননী---
তাই বুঝি গ্রহদোষে জগৎ ভুগিছে
রন্ধ্রগত সনি বুঝি ছুটে পিছে পিছে ;
করিলে মানত রক্ষা হরিলুট দিয়া
আসিবে সুদিন পুনঃ বিঘ্ন বিনাশিয়া |
এত ভাবি দিদিমণি করে আয়োজন
হরিলুট দানিবারে করিয়া ওজন |

*    *    *    *  

আম কাঁঠালের দিন শুভ জ্যৈষ্ঠমাস,
ভারে তারে আসে ফল সুমিষ্ট সুবাস,
বাতাসা মিষ্টান্ন আদি বিবিধ রকম,---
তুলাদন্ডে তৌল হল জগৎ রতন |
তুমুল কীর্তনানন্দে মাতিল সকলে
নাচে গাহে ভাবে মাতে বন্ধু কুতুহলে,
কীর্তনান্তে সকলের প্রসাদ দানিল,
ভাবে দিদি জগতের বিপদ কাটিল |

.                     ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর