জটিল অরণ্যে তুমিই একমাত্র বিটপী শালের মত অটল, সেগুনের মত নমনীয় ও কোমল ঝাউয়ের মত তোমার মর্মরিত মাধুর্যের দিকে, কাঠুরেও তার কুড়ালের হাতলে আলতো হাত রেখে দাঁড়ায় ফিরে |
তুমি সেই বোধিদ্রুম যার প্রতি, দিবাবসানে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত ভবঘুরেও দাঁড়ায় ফিরে দিক নির্দেশের জন্য, তুমি সেই লক্ষভেদী অনুকূল আগুনের প্রতি প্রলুব্ধ করে জ্বেলে দাও লেলিহান শিখা আলোকিত করে তোল সমগ্র পশ্চাৎপট |
তুমি সেই বৃক্ষ, আমি কুঠার হয়ে দেখেছি : তোমার সমারোহের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে চিহ্নিত করি তোমাকে নিজেরই জন্য, সহিষ্ণু , ধূর্ত ও কুশলী হাতে তোমার দেহকে অনাবৃত করে নিয়ে যাই তোমার হৃদয় নিজেরই গূঢ় প্রয়োজনে |
সারাদিন আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে কী দেখেছিলাম ? ভাট ফুল, আকন্দের ঝোপঝাপ . মাছরাঙাদের অকারণ খিটিমিটি ? গ্রামীণ ছবিতে আজ আর নেই সেই কিংবদন্তীখ্যাত . মসলিন, নকশিকাঁথার দিন !
গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুর বরা মাছ এ জাতীয় কথারা আজ সেরেফ কথার কথামালা গ্রামগুলি হতশ্রী, এমনকি অগুনতি, অনেক মানুষ মিলিয়ে যে-মানুষের ছবি চোখের সামনে জেগে ওঠে তার মত হতকুচ্ছিত প্রাণী যেন আর কিছুই হয় না---- লিকলিকে সরু পা, রোগা কাঠাম আর ডিগডিগে পেট, চোখেমুখে ঘোলাটে নির্বোধ শূন্যতা ---- তবু ঐ সব মানুষের ভিড়ে একজন মানুষের খোঁজে পথ হাঁটছিলুম আমি আপন মনে তখন না-বিকেল না সন্ধ্যা এমন একটা আলগা সময় পাখিরা কুলায়ের পথে কূজন মুখর ঠিক আমার বা পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি শীর্ণতোয়া . রোগা দুঃখী নদী, কুলুকুলু শব্দ বা গরুর খুরে ধুলো ওড়া কাব্যিক গোধূলি কিন্তু তার ধারে কাছে কোথাও পড়ল না চোখে, বরং দেখলুম বাঁশের খুটিতে আড়াআড়ি টানা দড়ির ওপর শুকোতে দেয়া ঝুলন্ত জালের গায়ে লেগে থাকা মৃত কিছু মাছের সাদা পেট, আঁশ;---- তার অন্য পাশে ছিল পথের লাগোয়া একটি প্রাচীন মসজিদ আগাছা শ্যাওলা ও খরখরে গুল্মের জরাজীর্ণ দেওয়ালের গা ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসা অশ্বথ্বের একটি ডাগর চারা নদী থেকে ভেসে আসা ঝিরঝিরে হাওয়ার লাবণ্যে মুখ বাড়িয়ে যেন দেখছিল নদীটিকে এই দুই ভিন্ন প্রেক্ষিতের মাঝখানে একাকী দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার মনে হল : এই বিংশ শতাব্দীর একজন নিঃস্ব . নিঃসঙ্গ মানুষ আমি ভান করি স্বেচ্ছা নির্বাসিতের, অনিকেত বলতে উদ্বাহু হয়ে উঠি অথচ জন্মেছি এই সব অখ্যাত গ্রামে গঞ্জেই পূর্বপুরুষেরা ছিলেক কৃষিকর্মী ; অধুনা আত্মপ্রতারণায় নগরনিবাসী আমি আর কতকাল এমন করে নিজেকেই নিজের চোখ ঠাওরাবো |
আমি আছি ব্যাপ্ত হয়ে তোমার রৌদ্রছায়ায় এই তো তোমার ঘামে গন্ধে তোমার পাশাপাশি তোমার ছায়ার মতো তোমার শরীর জুড়ে তোমার নদীর কুলকুল স্রোতে ; তোমার যেমন ইচ্ছে, আছি আমি---- ঝিরিঝিরি পাতার ভেতর ভেতর হাওয়ার নাচে রাত্রিদিন তোমার ধানের ক্ষেতে উদাসী বাউল ; ভাটিয়ালি গান ভেসে যায় কোন নিরুদ্দেশে ; আছি আমি বেলা শেষের রোদের মতো গড়িয়ে তোমার পায়ে পায়ে আছি আমি তোমার ধানের দুধে তোমার আঁচল ছোঁয়া নীলাম্বরী মেঘে আছি আমি এই তো তোমার নাকছাবিটির মুক্তো যেমন জ্বলছে কেবল জ্বলছে কেবল |
শহরতলি ছাড়িয়ে লোকালয়কে বানিয়ে বহুদূরের ধূ-ধূ বুক ভরে টাটকা সতেজ সবুজ নিশ্বাস নিতে নিতে গহীন বনের কিনারায় এসে দেখি তাকে, গৈরিক বসনাবৃত পরম নিবিষ্টচিত্ত একা একা বসে, কে তিনি, পথিক না পরিব্রাজক? প্রবল নৈরাজ্যের মাঝে রৌদ্রের দৌরাত্ম্য, পেছনে দাঁড়িয়ে কৌতূহলভরে ছায়া ফেলে ঘাড়ে চাক্ষুষ হয়, কি এক আশ্চর্য তৎপরতায় এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় সেলাই করে চলেছেন অদৃশ্য কোনো আচ্ছাদন, বুকে যেন তার উদভ্রান্ত অস্থির প্রতিবিম্বের ঝিরঝির নড়াচড়া ---- পেছনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসির তাচ্ছিল্য ছিটিয়ে ভাবি লোকটা কি পাগল না অন্য কিছু !
পা বাড়াতেই হেঁচকা টানে হুমড়ি খেয়ে পড়ার দশা, এ আবার কোন গেরো রে বাবা, অযথা জড়িয়ে পড়লুম কীসে . না কীসে ! কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেজে ওঠে গমগমে স্বর ; ---- রোস, সেলাই হয়ে গেছ তুমি, তোমরা ছায়া জরাজীর্ণ আমার এই কাঁথার সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধন তার, এখন থেকে আমরা পরস্পরের বশংবদ ও সখা ;
কাহিনীর নটে গাছটি মুড়িয়ে তাঁর চোখে চোখ রেখে দেখি নির্নিমেষ তিনি আমারই দিকে, মাঝখানে নিতল, নিথর হিমবাহ . এক !