লাল পতাকার গান বা মে দিবসের গান কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক সারাজীবন কম্যুনিষ্ট ছিলেন দুখীরাম কৈরী। আমার দাদাশ্বশুর। বাংলা ভালো বুঝতেন না। হিন্দিতে লেখা আমার আসে না। তবু, সেই শ্রমিক কমরেডরই দাবীতে দুই ভাষায় মিলিয়ে মিশিয়ে গান লেখার চেষ্টা। সময়টা ১৯৮৩। [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
সাধের স্বাধীনতা হায়রে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক অনেক মণিমুক্তো দিয়ে সাজানো স্বাধীনতা নিয়ে অনেক গান আছে | তবু বিষয়টা নিয়ে বলার ইচ্ছেটা দমাতে পারিনি | ’৮২-র শেষভাগে এ গান লেখা | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
এক হাত থেকে আর এক হাতে বদল হ’লো ছড়ি, দেশটাকে ভাগ করলো ফেলে স্বাধীনতার দড়ি | দংশাইলো বাস্তু সাপে জীবন পুড়ে ছাই, নিজভূমে পরবাসী হলেম ভাই হলো কসাই | . আদর করে ডাকলে না হয় পদ্মলোচন নাম ধরে | . ছেলেটা যে জন্মকানা ভোলাবে কেমন করে ||
. আদর করে ডাকলে না হয় পদ্মলোচন নাম ধরে | . ছেলেটা যে জন্মকানা ভোলাবে কেমন করে ||
সেই লাঠি সেই কয়েদখানা সেই গুলি সেই গালি, হুকুমজারির হাকিম হুজুর বদলে গেছে খালি | বুকের কথা আনলে মুখে চাইলে অধিকার, নামাবলির ঢাকনা খোলে দেখায় দাঁতের ধার | . আদর করে ডাকলে না হয় পদ্মলোচন নাম ধরে | . ছেলেটা যে জন্মকানা ভোলাবে কেমন করে ||
আমার মায়ের বুকের আঁচল টানছে দুঃশাসন, আমার বোনের সিঁথির সিঁদুর মুছলো দশানন | আমার ভাইয়ের কলজে ভাঙা রক্তে আরোয়াল, বুকের মধ্যে মাদল বাজে পলাশ ফোটে লাল |
. আদর করে ডাকলে না হয় পদ্মলোচন নাম ধরে | . ছেলেটা যে জন্মকানা ভোলাবে কেমন করে ||
মরার জন্যে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচবো কেন আর, বাঁচার জন্যে মরতে হবে এই কথাটাই সার | লড়লো যারা লড়ছে যারা তাদের প্রাণের কথা, নাফা লোটার সমাজ ভেঙেই আসবে স্বাধীনতা |
. আদর করে ডাকলে না হয় পদ্মলোচন নাম ধরে | . ছেলেটা যে জন্মকানা ভোলাবে কেমন করে ||
ভোটের গান – ১ কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক ভোটে রাজা বদলায়, দিন বদলায় না | তাই ভোট বিরোধী এই গান | ১৯৮২ তে রচনা | বহু বহু মিটিং মিছিলে গাওয়া | সময় যেমন পাল্টেছে, তেমনি পাল্টেছে কিছু ছত্র, কিছু শব্দ | এ গান আজও প্রাসঙ্গিক | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
ও দাদা জমছে না ভোটের বাজার, ভোটের নেতায় বুকনি বেচেন চটকদার || সবাই ভাবেন দিল্লী যাবেন পাবেন গদি দিলবাহার ||
মনরে ভোলা কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক ভাঙে তবু মচকায় না, এমন মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে আর্থিক বাস্তবতা থেকে তার ভবিষ্যৎ এর কর্তব্য দেখাবার চেষ্টা ছিল | ১৯৮৩ তে তৈরী | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
ও কি হায়রে মন দিন কানা আপন ভালা দেইখাও দ্যাখ্ লো না ||
আইজ তুমার যা খানিক আছে লাখো হাতে তাও খুবলাইতাছে দিশি বিদিশি মালিক জুজুর দলে | যার কথা ভাইব্যা রইলা সইব়্যা হেই পোলায় বাঁচাই বা কি কইব়্যা কাইল য্যাখন আর কিছুই থাকবো না ||
পুরনো সেই দিনের কথা কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক নকশালপন্থীরা গুণ্ডা, খুনে ইত্যাদি অপপ্রচারের জবাবে, তাদের যারা ভালবাসতো, সেই সব চাষীবাসীদের কাছে শোনা ; তাদেরই মনোভাবকে গানে বাঁধবার এই প্রচেষ্টা ১৯৮২ সালে | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
মানিককে মনে রেখে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক কমরেড কাঞ্চন স্মরণে গেয়েছি | লেখা কিন্তু অনেক আগে | যতদূর মনে পড়ছে ‘৮২-র শেষদিকে | বাহাদুরপুর থেকে বাসে সবজির বোঝা নিয়ে কৃষ্ণনগর আসার সময় বাস দুর্ঘটনা | তাতেই মারা যায় যুবসংগঠন আর.ওয়াই.এল.এর কর্মী মানিক | শহীদ ? বিতর্ক | তারই ফসল এ গান | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
সাত রাজার ধন মানিক আমার ভাই গিয়েছে খোয়া | বিন বাদলে খসলো আকাশ বুকেরই লাগোয়া || আমার ভাই গিয়েছে খোয়া ||
পোড়া পেটের দারুন জ্বালায় চলছে টহল জংলা জলায়, সুযোগ বুঝে ফাঁদ পেতে যায় খুন খেকো ফাঁদুয়া | মানুষখেকোর দুনিয়াতে রক্ত চোষার ভোজের পাতে, লাল কলিজা চিরলো লেগে চিকণ দাঁতের ছোঁয়া || আমার ভাই গিয়েছে খোয়া ||
যেখানে মিছিল কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক সেটা সম্ভবত ১৯৮২ | আমার সাংস্কৃতিক কর্মীরাও তখন একটু অন্ধ্র-উদ্বেল | সেটা স্বাভাবিকত্ব | ‘অন্ধ্রপ্রদেশের নাগরিক মুক্তি কমিটি’-র সম্পাদক ডঃ বালগোপালকে পুলিশ গুলি করে মেরেছিল | প্রতিবাদে স্মরণসভা আয়োজন করেছিল ‘বিপ্লবী লেখক বুদ্ধিজীবী সংঘ’ স্টুডেন্টস হলে ; সেই সভায় গিয়েছিলাম | বিশেষ করে আমার কাছে এই গানটা যথেষ্ট স্মরণীয়, কারণ ঐ সভায় উপস্থিত শ্রদ্ধেয় সুরেশ বিশ্বাস নিজে আমাকে ডেকে গানটার গায়কি, পরিবেশনা এবং কথার প্রশংসা করেছিলেন | আমার কাছে সে এক বিরল সম্মান | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
যেখানে মিছিল . মেজাজে ধারালো মিছিল চলে, পাঁজেরের তাপে যেখানে দুচোখে . আগুন জ্বলে, মানুষ যেখানে গোলামখানার . ভিত ধরে মারে টান, সেখানে তাদের দেখি, সেখানে তাদের চিনি, বাঁচার লড়াইয়ে একদিন যারা . কুরবানি দিল জান ||
. নাম জানি আর নাইবা জানি . চিনি কিংবা নাহি চিনি . খুনের দামে হইয়াছে আপন . ও শহীদের বন্ধু রে ---- . সাথী আমার পরম স্বজন ||
শক্ত হাতে ওঠাও হাতিয়ার কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক সমাজ বদলের লড়াই সশস্ত্র হতেই হবে, একথা দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক দু’ভাবেই সত্য | দেশের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সে সত্য তুলে ধরার চেষ্টা এই গান | সময়টা ১৯৮৪ | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
( ও ভাই ) শক্ত হাতে ওঠাও হাতিয়ার . কেড়ে নাও হকের মাটি | . শক্ত হাতে ওঠাও হাতিয়ার ||
. মুক্তির লাল নিশান ওড়াও . ভাঙ্গো দুষমণের ঘাঁটি ||
. কয় সেয়ানে যুক্তি করে মোদের পেটে লাথি মারে, . আমরা মরি গতর খেটে নেপোয় মারে দুধের বাটি ||
. সাগর পারের গোরা ভূতে . এলো যখন এই দেশেতে, ( ওরা ) কতই ফন্দি ফিকির করে . ধনে প্রাণে নিল লুটি |
. তখন জানের বাজী ধরে দেশের মানুষ লড়াই ক’রে, . মারের চোটে ভূত ভাগালো উল্টে দিল পাশার পাটি ||
. কিন্তু ওরা যেতে যেতে . রেখে গেল ফাঁদটি পেতে, . ওদের ধামাধরার হাতে . দিয়ে গেল চাবিকাঠি |
ভ্যালারে উন্নয়ন কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক উন্নয়নের গাওনা তো নেতা-মন্ত্রীরা গেয়েই চলেছ চিরকাল | আমরা পেলামটা কী ? শুধু বলি আর এঁটো কাটা | তাই এ গান ৮৫ শোনানো শুরু | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
ধন্যি মায়ের ধন্যি পোলায়, একলাফে বিশ বছর লাফায়, দেশ বেচিলো বিদেশীদের পায়ে--- ধারে মাথায় চুল বিকাইলো, শিখের রক্তে হাত রাঙাইলো, ( আবার ) বন্যা খরায় অকালে যায় জান || রে কাঁই না না --- ||
হেসে বলে শ্রীমনমোহন, ঘোমটার নীচে খেমটার নাচন নাচবো না আর, নাচবো খোলাখুলি---- খুল্লমখুল্লা দাদা এসো, নাফার বেওসা খুলে বসো, যায় যদি যাক ভারতভূমির মান || রে কাঁই না না ---- ||
আগমার্কা হিন্দুত্বের পোলা রাম নাম নিয়ে মারণ খেলা মন্দির-মসজিদ-দাঙ্গায় পটু ভারী--- আমরা যতো হাড় হাভাতে ছুরি ধরায় তাদের হাতে আওয়াজ তোলে হিন্দু-হিন্দুস্তান || রে কাঁই না না ----- ||
মন মোহিনী আজব দাওয়াই, জ্যোতিবাবুর দোকানে পাই, লাল বুলি আর লাল কাগজে মোড়া --- ( ওদের ) বাইরে যতো গালাগালি, তলায় তলায় ঢলাঢলি, একই আত্মা একই মনপ্রাণ || রে কাঁই না না ----- ||
গরীব গুর্বো আমরা যারা, একেই আছি জ্যান্ত মরা, বেল্ট কষণের জায়গা নাই কোমরে --- ( ওরা ) হাড় খাইয়াছে মাস খাইয়াছে, চামড়া কেবল বাকী আছে, ( এবার ) তাতেই হবে ডুগডুগি বাজান্ || রে কাঁই না না ---- ||