হতাশা কেন কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক নিজের সাথে লড়াই খুব শক্ত | একজন লড়াকু কমরেড, একজন নেতা শহীদ হলে যন্ত্রণা, ঘৃণাই শুধু জাগে ? অবসাদও তো, সাময়িক হলেও আসতে পারে | ভীরুতা যখন সাহসের শক্তিকে ছাপিয়ে উঠতে চায়, তখনই তো নিজের সাথে নিজের লড়াই | নীলকমলের সাথে লালকমলের | আর সত্যের জন্যে তখনই তো গান গাওয়া | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
নীল কমলের আগে রে, লাল কমলেরা জাগে রে, জাগেরে লাল নিশান --- হাতুড়ির তালে কাস্তের চালে নব জীবনের গান | জাগে লাল নিশান---- ||
শহীদ স্মরণে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক সুন্দরপুর, হুগলীর কৃষক আন্দোলনের শহীদ বলরাম ভৌমিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিচলিত হবে | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
একরাশ জুঁইফুল রক্তগোলাপ হয়ে গেছে একমুঠো ভালোবাসা রক্তনদীতে করে স্নান, একবুক স্বপ্নের নিথর আকাশ ছুঁয়ে--- শত আগুনের পাখি গায় গান | . সোনা রং একফালি জমিতে . হরিয়াল দোয়েলের শুনে শীষ . বুনো ঘাসফুল মেলে পাপড়ি . পাণ্ডুর চাঁদ করে কুর্ণিশ | একপাল হায়েনার খরদাঁতে কলিজা ভেঙেছে, এক বুক যন্ত্রণা মা’র-ব্যথা ছেলের শ্মশান, একচোখা তারাদের আয়েসী শোক ছাপিয়ে---- শবযাত্রায় জাগে কলতান | . বালিয়াড়ি পথভাঙা জমায়েত . মিলবে যে সাগরের মোহনায়, . এ যুগের দধীচির পাঁজরা . জনতার হাতিয়ার হয়ে যায় | একজোট জীবনের মণিকোঠা আলোয় ধুয়েছে, এক গোটা সূর্যের রাত ভাঙবার আহ্বান, একঘাতী খড়্ গের ধারালো সীমানা ছুঁয়ে--- মুক্ত প্রাণের দেশে অভিযান |
এক যদি হই কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক ১৯৮৬ সালের কোনো এক সময় আমার শ্রদ্ধেয় এক বিপ্লবী নেতা আমাকে একটা বিদেশী গানের ক্যাসেট দিলেন | অদ্ভুত সুন্দর ছন্দোময় ব্যঞ্জনা আর তার চেয়েও সুন্দর সিম্ফনি দিয়ে একটা গান ভালো লাগলো | কথা বুঝিনি একটুও | অনেক কষ্টে জানা গেল স্প্যনিশ ভাষায় এই গানের মর্মকথা, ‘একতাবদ্ধ হলে জয় আসবেই’ | এটুকু সম্বল করে গান বাঁধলাম | গাইলাম | সেন্ট্রাল এক্সাইজ – বি এন. জি ইউনিয়ন প্রথম লাইনটাকে তাদের ব্যানার করলো | সেই বিপ্লবী কমরেড শহীদ হলেন পরে | তাঁর স্মরণসভা হলো | অসুস্থ আমি যেতে পারিনি | তাঁকে স্মরণ করে অসুস্থ অবস্থায় আর একটি গান লিথেছিলেন, তা গাওয়া হয়নি | হারিয়ে ফেলেছি | কিন্তু উপরের গানটি আমাকে তার কথা চিরকাল মনে করিয়ে দেবে | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
এক যদি হই তবে জিতবোই | . হারেনি হারেনা জোট---- . তাই এক হই || দশের হাতে লাঠি একের হলে বোঝা | একের কাছে ভারি দশের হলে সোজা | হাজার যদি মেলে পাহাড় ভেঙে ফেলে | সাগর সেঁচে ফেলা কোটির কাছে নয় বোঝা---
মজুর লাখে লাখে কিষাণ কোটি কোটি চালাই এ দুনিয়া সাজাই পরিপাটি | তবু আমরা হাভাতে আমরা হা-ঘরে মানুষ শুধু নামে বেঁচেও থাকি ম’রে |
সবাই বুক ঠুকে দাঁড়াই যদি রুখে, দুনিয়া জিতে নেবো লড়াই জয় ক’রে | লুটেরা এ জমানা সহজে তো দেবে না, ছিনিয়ে নিতে হবে জানের বাজী ধরে |
সব লোটে যারা শেষ হলে তারা . মেহনতী মানুষেরা . সবটা পাবোই ||
ঝুলি ফেঁসে গেছে হে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক যে বছর ঢাক ঢোল পিটিয়ে বামফ্রন্টের ২০ বছর পূর্তি উত্সব হোল, সে বছরই এ গান লেখার ও গাইবার প্রয়োজন বোধ করেছিলাম | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
‘দিচ্ছি দেবো’র ঝুলি ফেঁসে বেরলো বেড়াল | ‘হচ্ছে হবে’র ইচ্ছে ফানুস টলছে টালমাটাল | তোমরা বলছো দিইছি অনেক, দিচ্ছি আরো দিব | আমরা মোদ্দা পেলামটা কি সেই কথা কহিব ||
গণতন্ত্র চমত্কার ---- লাল ঝুঁটি তেরঙ্গা মোরগ দেখতে কি বাহার | আগেও যেমন আজও তেমন খোশামোদে খুশি | উল্টে কইলে ভোট না দিলে ক্যাডার বাগায় ঘুসি | বুকের ব্যথায় হেঁচকি তুলে আর কতো সহিব ||
গণ্ডা গণ্ডা ষণ্ডামার্কা নেতার নেই আকাল | দণ্ডমুণ্ডের মালিক তারা আমরা ভেড়ার পাল | তারা খাবেন মণ্ডা মিঠাই আমরা ঠোঁট চাটিব ||
পুলিশ পেল সার্টিফিকেট, আমরা পেলাম কি ! বাগুইহাটি ফুলবাগানে প্রমাণ পেয়েছি | বোনের ইজ্জত ভাইয়ের লাশ আজ কোন বুকে বহিব | বোনের ইজ্জত ভাইয়ের লাশ আজ কোথায় কবর দিব ||
গালি গুলি মিথ্যে বুলি পুলিশ আর ক্যাডার লাল হাতে, তেরঙ্গা হাতে একই হাতিয়ার তোমার ডাণ্ডায় আমার ঝাণ্ডা আর কেন বহিব সবুর কর সুদে মূলে উশুল করি নিব ||
নবান্নের গান কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক কোনো এক নবান্নের দিনে নদীয়ার এক কৃষক বন্ধুর বাড়ীতে ছিলাম | গান টান গেয়ে বেশ ক্লান্ত | রাতে খাবারের আগে দুখানা সরুচাকলি পিঠে আর একটু গুড় | “কমরেড, জলখাবার” | তখনই এ গানের ছক মাথার মধ্যে চাক বেঁধেছিলো | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
মাঠ ভর ভর রঙ সোনা চোখ ঝর ঝর জল নোনা . মনের গাঙে ঢেউ || বুক দিয়ে কেউ করলো যতন লুটলো রতন অন্য কেউ . মনের গাঙে ঢেউ ||
. জমিন যাদের মরণ বাঁচন জমিন যাদের মা, . না পেলে যার হাতের ছোঁয়া ফসল ফলে না, যার হাতে ফল সেই বেদখল সুদ ও আসল খাইল কেউ | . মনের গাঙে ঢেউ ||
ভুলি নাই কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক কমরেড ভবানী রায়চৌধুরী মারা গেলেন দীর্ঘদিন রোগভোগের পর | আমিও তখন অসুস্থ শয্যাশায়ী | শবযাত্রায় যেতেও পারিনি | স্মরণসভাতেও না | এ গানই আমার শ্রদ্ধা | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
আঁধার পথে যেতে যেতে . আকাশ হয়ে যাওয়া, আলোর খোঁজে জীবন হলো আলো ভোরের পাখী ডাকার আগে . প্রদীপ নিবে গেল ||
মুক্তি মিছিল ক্ষণেক দাঁড়াস্ . থেমে পথের মোড়ে, সামলে বুকের ঘর, নেই যে সাথী তারই স্বপন মাখা নিশান তুলে ধর | মধ্যরাতের তারার ব্যথায় . ভাঙা পাঁজর জ্বালো ||
বন্ধ কারখানার গান কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক আমার এক ভাই ছিল শ্রমিক | কল্যানীর কারখানায় | কারখানা বন্ধ হলে ওদের বেহাল অবস্থা হয়ে পড়লো | ওদেরই সাথী আর তার বৌ আত্মহত্যা করলো | তখন বেঁধেছিলাম এই গানটি | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
লোহার গেটে লোহার তালা লোহার কল চলেনা রে, . বন্ধ দেশের অগুণতি কারখানা রে || কত মজুর বেকার হইল হিসেব নাইকো জানা রে, . বন্ধ দেশের অগুণতি কারখানা রে ||
মেশিন কইতো কথা যাদের শক্ত পেশীর চাপে কঠিন হাতে কঠিন লোহার হাতুড়িখান কাঁপে | সেই হাতে আজ কৌটা নাচায় হায় কি বিড়ম্বনা রে ||
বয়লারে জ্বলছে না আগুন জ্বলছে পেটের চাম চোখের জলে ভিটে বেচার কোবলা লিখিলাম | অভাব চোরা খাইল আমার ভালবাসার মৌ মরণরশি গলায় পরে মরলো নয়ান বৌ | ( এখন ) দুধের ছেলে মা ডাকিলে কি দিব সান্ত্বনা রে ||
ছিল বড়াই, করবো লড়াই মানবো নাকো হার ফতোয়া পাই ধর্ণা দেওয়া আর্জি লিখিবার | মালিক চাইলো মজুর ছাঁটাই বাড়তি প্রোডাক্ শন কর্তাভজা নেতা দেখায় লেবার কমিশন | জাত গেল পেট ভরলো না হায়, সার শুধু যন্ত্রণা রে ||
দিন বদলের গান কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক কৃষক সম্মেলন, যুব সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলনে গান গেয়েছি কতোবার | ‘৮৫তে বিপ্লবী যুব লীগ এর রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল পুরুলিয়ার বলরামপুরে | সেই উপলক্ষে প্রথম গেয়েছিলাম | অবশ্য বৃন্দগান হিসাবে ‘গণভেরী সাংস্কৃতিক সংস্থার’ পক্ষে | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
এই সম্মেলনে এসো দিন বদলের গান গাই বুকের তুফানে মিছিলে শ্লোগানে ধ্বংসের সুরে নব সৃষ্টির তানে স্বপ্নের রঙেরসে দুনিয়া সাজাই || . এই সম্মেলনে এসো দিন বদলের গান গাই ||
কংসের কারাগারে নিয়তির পরোয়ানা হয়ে মৃত্যুর দরবারে জীবনের জয়গান গেয়ে ঘৃণার আগুনে কলিজার খুনে লড়াইয়ের সুরে মুক্তির সন্ধানে বনপলাশের রঙে আকাশ রাঙাই || . এই সম্মেলনে এসো দিন বদলের গান গাই ||
সাথী আমার ওরে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক মালদহ জেলার কৃষক সংগ্রাম সমিতির তরুণ নেতা সজল গোস্বামীকে অমানুষিক অত্যাচার করে মেরে ফেলল পুলিশ | স্বয়ং পুলিশ সুপার এই খুনের পাণ্ডা | তার স্মরণসভা করতে মালদায় যাবার পথে গাড়ীতে গান লেখা, মহড়া দেওয়া আর পরদিন সকালে গাওয়া ; ‘গণভেরী সাংস্কৃতিক সংস্থার’ কর্মীরা এরকমটাই করেছিল | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
মানী মন তোর মালিক হোল গরীব ভালোবেসে, নিশানা পেলি লাল নিশানের লাল মিছিলের দেশে | . ও শহীদ বন্ধু রে -----| দিন বদলের লড়াই গড়ে পেলি বাঁচার মতন বাঁচার সুখ ||
সোনাধান আর সবুজ ক্ষেতের জড়ায়ে সীমানা, রক্তচোষা হায়েনাদের নিত্য আনাগোনা | ও শহীদ বন্ধু রে -----| সেথা সবার সাথে বুক চিতিয়ে পোহালি প্রাণের আগুনটুক ||
মাটির দখল চাই কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক সাল-টাল মনে নেই | ঘটনাটা মনে আছে | শান্তিপুরে বিদ্যুতের দাবীতে চাষীদের মিছিল ও পথ অবরোধ | পুলিশ গুলি চালালো | তারই প্রতিবাদে এবং নিহত ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে কৃষ্ণনগরের জনসভায় গানটি প্রথম গেয়েছিলাম আমরা, ‘গণভেরী সাংস্কৃতিক সংস্থার’ –র কর্মীরা | [ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, ‘এবং জলার্ক, সঙ্গীত সমাজ ইতিহাস’ এপ্রিল—সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যা থেকে নেওয়া। ]
পাওনা হোল তিনটে জানের দাম | চাষীর এ লাশ মাটি দিতে মাটির দখল চাই, হিসেব কষে উশুল নেবার দিনে ভুলবো কি আর বামাচারী কসাই নেতার নাম |