কবি গীতিকার বিজয় মাহাতো - জন্মগ্রহণ করেন মেদিনীপুর জেলার জাম্বনী থানার দশ নম্বর
অঞ্চলের তারপিণ্ডা গ্রামে | ১৯৭১ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন জাম্বনী হাই স্কুল থেকে। এই কথা
থেকে আমরা তাঁর জন্মের সাল ১৯৫৪ ধরছি। পরে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে তিনি
নকশালবাড়ি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
কবির পিতা এতটাই অভাবী ছিলেন যে কোনো দিন খাওয়া জুটতো, কোনোদিন জুটতো না।
কবির ছোটবেলায় একটা প্রশ্ন ছিল আমরা এত গরীব কেন ? এ কথা বেশী করে মনে করাতেন সন্তোষ
রাণা। কিশোর সঙ্ঘ বলে একটা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রূপচাঁদ মুর্মু। লাইব্রেরী, খেলাধূলা ছাড়াও একটা
নতুন চিন্তাধারা এসেছিল তা হল মুক্তিসংগ্রামের চিন্তাধারা। এভাবেই কবি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন।
কবি বয়সে ছোট ছিলেন বলে তাকে বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিয়ে অথবা যোগাযোগ করে পাঠানো হত।
বিহারের শর্মা পুলিশ, নিতাই দারোগা মানুষের উপর খুব অত্যাচার চালিয়েছিল। গ্রামের মানুষ -- কাউকে
যদি পাঁচ টাকা দিত ; বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তা পাঁচশো টাকা হয়ে যেত। তার জমি বাস্তুভিটা সব দখল
করে নিত। পুলিশগুলো তাদের হয়ে কাজ করত। কবির মা বাবাও ওদের হাতে মার খেয়েছে। পয়সা দিতে
না পারলে বাড়িতে ডেকে নিয়ে মারত পুলিশ আর মহাজন। গ্রামের প্রত্যেকেই ওদের হাতে মার খেতো।
কবির বাবার দাঁত ভেঙে দিয়েছিলো। বাধ্য হয়ে কবিরা এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। গ্রামের
সাধারণ মানুষ সবাই কবিদের সমর্থন করলেন। ১৯৭১ সালের হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার ঠিক কুড়িদিন
আগে জোতদার চিত্তরঞ্জন সুঁই খুন হোল গণসংগ্রামের পরিণতিতে। সে কি না করত --- নারীনিগ্রহ, সুদখোরী,
অনাদায়ে গরীব মানুষকে মারতো, থানা পুলিশ ডেকে মামলা লাগিয়ে দিতো। অভিযুক্ত হয়েছিলেন
রূপচাঁদবাবু, দুর্যোধন মাহাতো, নির্মল মাহাতো ওদের সাজাও হয়েছিল।
কবির গানের সখ ছিল ছোটবেলা থেকেই। দেশে গাঁয়ে কীর্তনের রেওয়াজ ছিলো। কবির কাকারা খোল
বাজাতেন, আর কবি গাইতেন। হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন না। কবির বাবা গানের খুব বিরোধী
ছিলেন। ভাবতেন পড়াশুনায় ক্ষতি হবে। আর একজন মাষ্টারমশাই ছিলেন শ্রীকান্ত রঞ্জন পাল, খুব অভাবী
মানুষ ছিলেন, যাত্রায় সুর দিতেন। তার কাছেই শিখেছেন ছোটো ছোটো রাগ আলাহিয়া, কাফি, ভৈরবী।
পরবর্তীকালে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে যাবার সময় খুব ভালো বাঁশি বাজাতেন, প্রতি বছর প্রতিযোগিতায়
পুরস্কার পেয়েছেন।
কবিরা কলেজে পড়াশুনা করছেন আর বাকী সব জেলে। ক্লাসে ফার্ষ্ট বয় ছিলেন বলে মাষ্টারমশাইরা কবির
পক্ষে ছিলেন, তাই কবির নামে সরাসরি কোনো মোকদ্দমা হয়নি। কলেজ শেষ করে বিয়ে করলেন কবি,
কিন্তু চাকরী বাকরি নেই, চলে গেলেন কলকাতায়। পাতাল রেলে মাটি কাটার কাজ নিয়ে। বেলগাছিয়ায়
মাটি কাটতেন আর রাতে বাঁশী বাজাতেন। একদিন রাতে কবি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, এক ভদ্রলোক সুপুরুষ,
পুরু লেন্সের চশমা চোখে, পুরুষ্ঠু ঠোঁট, শাদা ধুতি, শাদা পাঞ্জাবী পরে দাঁড়িয়ে শুনছেন। এরপর কবির ঘর
বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন। কবিকে কার্ড দিলেন এবং দেখা করতে বললেন। কবি বিজয় মাহাতো সলিল
চক্রবর্তীর বাড়ি গিয়ে দেখলেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায় এরা সব বসে
আছেন। ওখানেই গান শেখা শুরু করলেন --- ক্লাসিক্যাল, নজরূলগীতি। খুব যত্ন করে গান শিখিয়েছিলেন।
উচ্চারণের খুব ত্রুটি ছিলো। পড়াশুনা জানা ছিলো বলে কবিকে সুপারভাইজারের কাজ দিয়েছিল কোম্পানী।
কবি বলেছেন নির্দিষ্ট করে শত্রু চেনানোর গান ঝুমুরে নেই। তবে সাধারণ মানুষের গানই হোল ঝুমুর গান ---
তাতে দুঃখদুর্দশার কথা আছে। সাধারণ মানুষের এসব কথা যদি গণসংগীতের মধ্যে পড়ে, তাহলে ঝুমুর
গানও গণসংগীত। ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন প্রথম দিকে। কারণ কবির ভাল
লেগেছিলো যে ওখানকার ধনসম্পদ, বনজঙ্গলের কথা বলছে, বাইরের লোকেরা চাকরী করছে আর
ওখানকার ছেলেরা চাকরী পাচ্ছে না আর নেতারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে, এসব দেখে কবি ঐ
আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
কবি বিজয় মাহাতো ১৯৯৫ পর্যন্ত প্রায় দু-তিনশ গান লিখেছেন। তবে নিজের গান খুব কম গেয়েছেন।
ভবতোষ সত্পথী, সুনীল মাহাতো, ললিত মোহন মাহাতো -- এদের গানই বেশী গান।
কবির আটটা ক্যাসেট বেরিয়েছে। কবি ভোটের গান লিখেছেন, সাড়াও পেয়েছেন। এখন আর কবি কোন
দলেই নেই। এখন রাজনীতি করেন না শুধু গান করেন। কবি মনে করেন না তিনি সুর দেন, তিনি একজন
সুরের সংকলক মাত্র। কবি মনে করেন নকশালবাড়ি আন্দোলন আবার ফিরে আসা উচিত। তখন যে
সকল জোতদারকে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের থেকে বড়ো বড়ো জমিদার জন্মে গেছে এখন। বুদ্ধিজীবী
জোতদার, আধুনিক স্টাইলের জোতদার। সেই যুগ ফিরে আসা দরকার। এসব নিয়ে ভবতোষ সত্পথীর গান
গেয়েছেন নিজের সুরে।
বিজয় মাহাতোর প্রকাশিত ক্যাসেটের মধ্যে রয়েছে “ঝুমুর দেশের গান”, “অঞ্জলি মাহাতোর সঙ্গে, ঝুমুর
সংসদ, ছোটনাগপুর”, “জনপদের গান” (১৯৮৮), “লোকজীবনের গান” (১৯৮৯ বোম্বাই-এর একটি সংস্থা বের
করে), “গঙ্গা নও তুমি কাবেরী নও” (১৯৯৯), “ধিতাং ধিতাং ধমসা বাজে” (কনকর্ড ১৯৯৩), “ধর ছাতা ধর”
(কনকর্ড ১৯৯৩), “শাল মহুলের গান” (এম.এফ.পি ১৯৯৪), “অ বাজাইরা ফুল বাবুরে” (কনকর্ড ১৯৯৫)
প্রভৃতি।
আমরা কবি রাজেশ দত্তর কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ, কবি বিজয় মাহাতোর এই পাতাটি তৈরী করার
সবরকম তথ্য, আমাদের দেবার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। আমরা আরও কৃতজ্ঞ শ্রী চিররঞ্জন
পালের ( +৯১৯৪৩৪৫১৬৮৯৮) কাছে তাঁর নানাভাবে এই পাতাটি তৈরী করতে সাহায্য করার জন্য।
তাঁরা আমাদের কবি বিজয় মাহাতোর ৭টি গানের রেকর্ডিং MP3 তে দিয়েছেন। আমরা তা সাউণ্ডক্লাউড এ
তুলে সেই গানের পাতা থেকে লিংক করে দিয়েছি।
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত “এবং জলার্ক” থেকে ০২.০৬.১৯৯৭ তারিখে প্রকাশিত “যুদ্ধ জয়ের গান”, গ্রন্থ
থেকে তথ্যাদি নেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞ।
আমরা মিলনসাগরে কবি বিজয় মাহাতোর গান ও কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে
পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।
উত্স - বিদ্রোহী ঝুমুর : বিজয় মাহাতো, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত “যুদ্ধজয়ের গান” (১৯৯৭)।
কবি বিজয় মাহাতোর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২৫.১১.২০১৫।
কবির ছবি সংযোজন - ২২.৬.২০২০।
...