কবি দিলীপ বাগচী - জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার পাবনার এক রক্ষণশীল পরিবারে। পিতা
দুর্গাদাস বাগচী ও মাতা সুরমাদেবী। সাত ভাই বোনেপ মধ্যে দিলীপ ছিলেন তৃতীয়। তাঁদের আদি বাড়ী ছিল
পাবনার তাঁতিহন্ধ গ্রামে, ইছামতী নদীর ধারে। দুর্গাদাস বাবু যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে হিন্দু
মহাসভায় আসের পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের প্রভাবে। বাড়ীতে গান-বাজনার চল ছিল অতি উচ্চ মার্গের।
পিতা, চণ্ডীফ্লুট কোম্পানির একটি হারমোনিয়ামও কিনে এনেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত এক আধটা গাইতেন
কিন্তু তাঁর প্রিয় ছিল রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান। প্রবাসী, ভারতবর্ষ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা বাড়ীতে
রাখা হোতো। বড়দি একসঙ্গে সেতার ও এসরাজ শিখতেন। মেজদি শিখতের ধ্রুপদী ও রবীন্দ্রসঙ্গীত।
দুর্গাদাস নিজে তাঁর মেজকন্যাকে গাত তুলিয়ে দিতেন। তাঁর ভাই অকাল প্রয়াত দেবপ্রিয় বাগচী ছিলেন ছাত্র
রাজনীতিতে নেতৃস্থানীয়।
কবির দাদা কাজ করতেন রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির সিগন্যালিং বিভাগে। একবার ছুটিতে এসেছিলেন প্রচুর
টাইপ করা কাগজ নিয়ে। সেগুলি ছিল নেতাজীর বেতার-বক্তৃতা। বলাবাহুল্য ঐ সব বক্তৃতা
সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতো না। কিন্তু যাঁদের কাছে সেই সময়ে রেডিও ছিল, তাঁরা দরজা জানালা বন্ধ
করে সেই সব বক্তৃতা ( আমি সুভাষ বলছি ) শুনতেন। এই দাদার আরও একটি পরিচয় ছিল। তিনি
ইংরেজ শাসনের শবাধারের শেষ পেরেক, নৌবিদ্রোহের অংশিদার ছিলেন। সেই বিদ্রোহের জন্য তিনি
গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। তিনি “কল্লোল” নাটকটি দেখে কবিকে বলেছিলেন যে গল্পের গরু হলেও এত উঁচু গাছে
ওঠানো ঠিক নয়! পরে সেই দাদা প্রবল নেহেরুভক্ত ও কমিউনিস্ট বিদ্বেষী হয়ে যান।
দেশ ভাগ হবার পরে তাঁরা সপরিবারে চলে আসেন বাঁকুড়া জেলার পলাশীবোনা গ্রামে। সেখানে পিতা তাঁর
মামা ডাঃ নগেন্দ্র মোহন চৌধুরীর জমিদারীতে ম্যানেজারের কাজে যোগ দেন। শুশুনিয়া পাহাড়ের ঠিক নীচেই
ছিল পলাশীবোনা গ্রাম। কবি ভর্তি হয়ে গেলেন শুশুনিয়া স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে। সেখানে তাঁর সঙ্গী সাথী ছিল
বাউরী সম্প্রদায় ও সাঁওতালী ছেলে মেয়েরা। পরে কবি জেনেছিলেন যে তাঁদের মধ্যে থেকেও কেউ কেউ
নকশাল আন্দোলনে জেলে গিয়েছিলেন।
এরপর পিতা হাওড়ায় এসে তাঁর মামার আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে শালিমারে রেলের মাল পাঠাবার ব্যবসায়ে
যোগ দেন। কবি ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। তাঁরা থাকতেন গোলমোহর এভিনিউয়ের পাশে মুখরাম
কানোরিয়া রোডে। সেখানেই এক জলসায় তিনি প্রথম শোনেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের “বাঁচবো রে বাঁচবো আমরা”
এবং সলিল চৌধুরীর “ঢেউ উঠেছে কারা কারা” টুটেছে গানদুটি। বাঁচবো রে বাঁচবো আমরা গানটি কবিকে
ভীষণভাবে নাড়া দেয় এবং গণসঙ্গীতের জগতে প্রবেশ করার তথা সাম্যবাদী আন্দোলনের শরিক হতে
প্রেরণা জাগায়। সেই থেকে তিনি নিজেকে “হেমাঙ্গদার একলব্য শিষ্য” বলে মনে করতেন।
এই হাওড়া জেলা স্কুলেই কবির সহপাঠি ছিলেন ভবিষ্যতের প্রখ্যাত অভিনেতা ও কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সেই সময় কবির গান গাওয়ার জন্য স্কুলের নাটকের গায়ক চরিত্রটি তাঁরই বাঁধা থাকতো। স্কুলের এক প্রাক্তন
ও বর্তমান ছাত্র সম্মেলনে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বন্ধু” নাটকটি মঞ্চস্থ করার ঠিক করা হল। কবি পেলেন
নায়িকা মন্দার ভুমিকা এবং সৌমিত্র পেলেন নায়কের ভুমিকাটি। কিন্তু মহড়া চলাকালীন হঠাৎ তাঁকে চলে
যেতে হয়েছিল জলপাইগুড়িতে মেজদির বাড়িতে। নাটকটি আর করা হলো না! যদি হোত তাহলে তিনিই
হতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম নায়িকা! এরপর আর কবি কোনো নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করার
সুযোগ পাননি! বরাবরই পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কবির ১৭ বছর বয়সে, ১৯৫১ সালের দাঙ্গার
সময়ে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করার কাজে গিয়ে প্রথম তিনি সাম্যবাদীদের সংশ্রবে আসেন। ঘটনাটি
স্কুলে জানাজানি হয়ে যায়। এরপর খাতায় এক শিক্ষকের কার্টুন আঁকায় হেডমাস্টারমশায় তাঁর
বাবাকে, স্কুল থেকে বহিষ্কারের নোটিস পাঠান। কিন্তু বাবা স্কুলে এলে তাঁকে বলা হয় যে কার্টুন আঁকা ততটা
অপরাধ নয় কিন্তু নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ থাকার জন্য সরকারী স্কুলে আর রাখা সম্ভব
নয়।
এরপর তিনি ভর্তি হলেন হাওড়া টাউন স্কুলে। সেখানে তাঁর সহপাঠি ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমারের
মাসতুত ভাই পুষ্পনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই সূত্রে তাঁর উত্তমকুমারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়ে যায়। এই
স্কুলে, কবি সহজেই বাঁশী বাজানো শিখে ফেলেছিলেন।
হাওড়া টাউন স্কুল থেকে ভালোভাবে স্টার আর লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করে নরহরি দত্ত কলেজে আই.এস.
সি. ক্লাসে ভর্তি হন। এই সময়েই হয় এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন। কবি মিছিল করে
ধর্মতলায় গিয়েছিলেন। সেখানে চলে পুলিশের গুলি! জানুতে গুলি খেয়ে এন্টালি এলাকার এক বাড়ীতে দুদিন
থেকে, একটু সুস্থ হতেই, বাড়ী ফিরে এসে জানালেন ডাব পাড়তে গাছে উঠে শকুনের তাড়া খেয়ে নীচে পড়ে
গিয়ে লেগেছে! বাবা বিশ্বাস করেননি! তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের নিজের বাড়িতে, কৃষ্ণনগরে। এখান
থেকেই আই.এস.সি পাশ করে কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিছু কাল বম্বেতে বড়দির কাছে থেকে
কৃষ্ণনগর কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। বম্বেতেই দিদির, আন্ধেরীর স্টুডিও পাড়ায় বাসা হওয়ার
সুবাদে, তাঁর দেখা ও পরিচয় হয় বহু বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন বাসু চ্যাটার্জী, স্বদেশ
সরকার, হিমাংশু বিশ্বাস, রুমা গুহঠাকুরতা, সলিল চৌধুরী প্রমুখ।
১৯৫৬ সালের কৃষ্ণনগরের বন্যায় কবিদের বাড়িও ডুবে যায়। একটি উঁচু বাড়িতে স্থান পান। লেগে পড়েন
বন্যাত্রাণের কাজে। সেখানেই লেখেন "ঢল ঢল ইছামতী” গানটি।
তাঁর কলেজ জীবনের সবটাই তিনি বাম ছাত্র আন্দোলন বা কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শে অনুপ্রাণিত
থেকেছেন। ১৯৫৭ সালে পার্টি কংগ্রেসে ডাক দেওয়া হয় “গ্রামের দিকে মুখ ফিরাও”। তখন থেকেই তিনি
সর্বক্ষণের পার্টির কর্মী হিসেবে তেহট্ট থানা এলাকায় কাজ করা শুরু করেন। পার্টির তরফ থেকে মাসিক দশ
টাকা পাবার কথা থাকলেও পার্টি তখন তা তাঁকে দিতে পারছিল না। তাই শেষমেষ পার্টির নেতা সমর
সান্যালের (মটরদা) পরামর্শে ১৯৫৮ সালে কবি মুর্শিদাবাদ জেলার নওদা থানার এক প্রত্যন্ত গ্রাম টুঙ্গী তে
জুনিয়ার হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেই স্কুলে তিনি সংস্কৃত, অঙ্ক, ইংরেজী, ভুগোল সহ সব
বিষয়ই দক্ষতার সঙ্গে পড়াতেন। এমনকি তিনি ড্রয়িং ক্লাসও নিতেন। একবার তিনি স্কুলের সরস্বতী পূজার
পরদিন সমস্ত হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের এক পংক্তিতে বসিয়ে মাংস ভাত খাওয়ার আয়োজন
করেছিলেন। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের মাতব্বরদের যা মোটেই ভাল লাগেনি।
তিনি ছিলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী এবং পার্টির নির্দশেই তিনি নদীয়া-মুর্শিদাবাদ
এলাকার কৃষক সমিতি ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের দায়িত্বে কাজ করছেন।
একবার ইয়ুনিয়ান বোর্ডের নির্বাচনের আগে টুঙ্গীতে এক বিস্ময়কর কাজ করেন। সেখানকার
দাসপাড়ার প্রায় ১৫০ ঘর গরীব মানুষরা যাতে নিজের ভোট ঠিকমত দিতে পারেন তার জন্য এক বিচিত্র
কৌশল নিলেন। ভোটের আগের রাতকে বলা হোত কাতালের রাত। সেই দিন কংগ্রেসের মাতব্বরেরা গ্রামে
ঢুকে বাড়ী বাড়ী দেশী মদের বোতল আর বিড়ির তাড়া দিয়ে আসতো। তাঁর নেতৃত্বে কৃষক সমিতির
সদস্যরা পাহারা দেওয়া শুরু করলো। ঘোষপাড়ার লেঠেলদের নিয়েও মোড়লরা গ্রামে ঢুকতে পারলো না।
পর দিন মিছিল করে গিয়ে সবাই ভোট দিয়ে এল। ১৯৫২ সালের পর এই প্রথম কংগ্রেস সেখানে হেরেছিলো।
এর পর দিলীপ বাগচীকে গ্রাম থেকে সরানো এমন কি তাঁকে প্রাণে মারার পরিকল্পনাও শুরু হয়।
তিনি গণশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ১৯৬২ সাধারণ নির্বাচনে তেহট্ট বাজারে, তিনি জ্যোতি বসুর
জনসভায় গান গেয়েছিলেন “আমরা তো ভুলিনাই শহিদ, সে কথা ভুলবো না”।
১৯৬২র চীন ভারত যুদ্ধ কে কেন্দ্র করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (CPI) বিভাজিত হয়। ১৯৬২র ডিসেম্বরে
দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দিলীপ বাগচীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১২ই জানুয়ারি ১৯৬৬ তে তিনি সেই
অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। গ্রামের মানুষের চাপে, তাঁকে আবার টুঙ্গী
স্কুলে যোগ দিতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখানে বেশীদিন থাকেন নি। এরপর তিনি উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন। তিনি সেখানে উত্তরবঙ্গ ছাত্র সংগঠনের
সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অচিরেই দার্জ্জিলিং জেলার কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে
ওঠেন। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে কানু সান্যাল, চারু মজুমদার, কদম মল্লিক প্রমুখদের সাথে।
১৯৬৬র খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল হল সারা দক্ষিণবঙ্গ। এই আন্দোলনের ফল দেখা গেল ১৯৬৭ এর নির্বাচনে।
প্রফুল্ল সেনের কংগ্রেস দলকে মানুষ প্রত্যাখান করে। কংগ্রেস ভেঙে অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে গঠিত
হয় বাংলা কংগ্রেস। নির্বাচনে জিতে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। অজয় মুখার্জী মুখ্যমন্ত্রী এবং জ্যোতি বসু
পুলিশ মুখ্যমন্ত্রী।
শুরু হয় উত্তরবঙ্গে, নকশালবাড়ি আন্দোলন চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের নেতৃত্বে। এই আন্দোলনের
ছাত্রনেতাদের প্রথম সারিতে ছিলেন দিলীপ বাগচী, পবিত্র পাণি ও কিষণলাল চ্যাটার্জী।
জ্যোতিবসুর পুলিশ কঠোরভাবে এই আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে। নকশালবাড়ির প্রসাদুজোতে, একটি
মহিলাদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে দুই শিশু সমেত সাতজন মহিলাকে হত্যা করে। এই সময় দিলীপ
বাগচী রাজবংশী ভাষায় রচনা করেন জনপ্রিয় “ও নকশাল নকশালবাড়ির মা” গানটি। তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয়
গানের মধ্যে রয়েছে “হিমালয়ের সোনা গলা জলের চোঁয়ায় ফসল দোলে” (জেলে বসে রচনা), “নভেম্বরের ডাক
শোনো” এবং আরও অনেক। অচিরেই সারা বাংলায়, এমন কি বাংলার বাইরে, ছড়িয়ে পড়েছিল সেই সব
গানের ঝংকার। গণসঙ্গীতের জগতে দিলীপ বাগচী কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন।
এই সময়েই বন্ধু অজিত পাণ্ডে রচনা করেন “তরাই কান্দে গো, কান্দে আমার হিয়া” গানটি যাও জনপ্রিয়তা
লাভ করে।
১৯৬৮র প্রথম দিকে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। সিপিআই (এম.এল.) দল গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে দিলীপ
বাগচীর মতভেদ ছিল। তাই তিনি নতুন দলে যোগ দেননি। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর ভাবনা
এবং জীবনচর্চায় সর্বহারা-দর্শনের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। সাংস্কৃতিক চর্চা, বিশেষত গণসঙ্গীত
ও লোকসঙ্গীত নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন।
১৯৬৮-৬৯ সালে তিনি বিবাহ করেন এবং মুর্শিদাবাদের “রাঢ়বঙ্গের” গঙ্গাটিকুরী এলাকার বনোয়ারী বাদ
হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখান থেকে চলে যান মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুর থানার লাউদহ হাই
স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে। ১৯৭৭ সালে সন্তোষ রাণার হয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারও করেন। ঐ সময় রচনা
করেন তাঁর বিখ্যাত “সুবর্ণরেখার সোনা সোনা জলে” গানটি।
১৯৮৩-৮৪ সাল নাগাদ তিনি চলে আসেন নিজের জেলা নদীয়ার তেহট্ট হাইস্কুলের হেডমাস্টার হয়ে। এর
কিছুদিন আগে থেকেই দিলীপ বাগচী যুক্ত হন এ.পি.ডি.আর. এর সঙ্গে এবং তাঁর রাজ্য কমিটির
সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি এই সংঘটনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি লিখেছেন “শিগক”, “এবং জলার্ক”, “প্রতিবাদী চেতনা”, “গ্রাম গ্রামান্তর”, দীপংকর চক্রবর্তী সম্পাদিত
“অনীক”, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত “ধ্রুবপদ” প্রভৃতি পত্রিকায়। তিনি অসাধারণ মজাদার ব্যাঙ্গাত্মক ছড়াও
রচনা করে গিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট “ছমিনুল চাচা” এক অনবদ্য চরিত্র। “সংক্রান্তি” ও “বিসর্জন” নাটকে তিনি
অভিনয়ের জন্যও খ্যাত হন। ৭০ ও ৮০-র দশকে বহু ফেরারী রাজনৈতিক কর্মীকে তিনি বুক দিয়ে আগলে
রেখেছিলেন।
দিলীপ বাগচীর অঙ্কনের হাতও ছিল দক্ষ। তিনি তাঁর শিক্ষকজীবনে অঙ্কনের ক্লাসও নিয়েছেন।
ব্যাঙ্গচিত্রতেও তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত ছিল কারণ তাঁর হাওড়া জেলা স্কুলে পড়ার সময়ে কোন শিক্ষকের
ব্যাঙ্গচিত্র আঁকার জন্য তিনি তিরস্কৃত এবং বহিষ্কৃত হয়েছিলেন! ডঃ নীরদ হাজরা প্রণীত নীচু ক্লাসের একটি
ব্যকরণ বই-এর অলঙ্করণ (বিচিত্রিত ইলাস্ট্রেশন) করেছিলেন শিল্পী দিলীপ বাগচী।
জীবনের শেষ দিকে, বামফ্রন্ট সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা তেহট্ট হাই স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের
কাছ থেকে আঘাত পান। অন্যায়ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। তাঁর
অবসরকালীন পাওনা ও পেনশন আটকে দেওয়া হয়। তাঁর শেষ জীবন বড় কষ্টে কেটেছে। যে দিলীপ বাগচী
রসিকতা করে টিউশনকে প্রসটিটিউশন বলতেন, তাঁকেই প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে বরখাস্ত হওয়ার পরে
টিউশন করেই তাঁর সংসার চালাতে হয়েছিল। শেষ জীবনে নিদারুণ অর্থকষ্ট ভোগ করলেও তত্কালীন
শাসকদলের অন্যায় ও অনৈতিক কাজকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। মাথা উঁচু রেখেই আপোষ প্রস্তাবকে
প্রত্যাখ্যান করেছেন। সামাজিকভাবে সম্মানহানির চেষ্টাও নোওয়াতে পারেনি এই বিরল মানুষটিকে। তিনি
মনে করতেন যে গানের বক্তব্যের সাথে যদি গায়কের জীবন-চর্চার মিল না থাকে তাহলে গানগুলির
বিশ্বসযোগ্যতাই নষ্ট হয়ে যায়।
কবি গণসঙ্গীতকার দিলীপ বাগচীর গান ও কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই
প্রচেষ্টার সার্থকতা।
আমরা কবি রাজেশ দত্তর কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ, কবি দিলীপ বাগচীর এই পাতাটি তৈরী করার সবরকম
তথ্য, ছবি, গান আমাদের দেবার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। আমরা আরও কৃতজ্ঞ শ্রী চিররঞ্জন
পালের (+৯১৯৪৩৪৫১৬৮৯৮) কাছে তাঁর নানাভাবে এই পাতাটি করতে সাহায্য করার জন্য। কবি দিলীপ
বাগচীর ছবি, কবিতা, লেখা তথা অন্যান্য লেখকের বিভিন্ন লেখা, নেওয়া হয়েছে শংকর সান্যাল ও তাপস
চক্রবর্তী সংকলিত ও সম্পাদিত “এক অসাধারণ সাধারণ মানুষ, দিলীপ বাগচী জীবন ও সৃষ্টি” নামক দিলীপ
বাগচী স্মারক গ্রন্থ (২০১৩) থেকে। আমরা তাঁদের ও তাঁদের সংঘটন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি,
নদীয়া জেলা-কে জানাই আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। এছাড়া আমরা কৃতজ্ঞ বিশিষ্ট সাংবাদিক, তথ্যচিত্র
নির্মাতা তথা সমাজ কর্মী তুষার ভট্টাচার্যের কাছে যিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে, আমাদের দিয়েছেন
দিলীপ বাগচীর সাক্ষ্যাত্কার এবং নিশান্তিকা দ্বারা প্রকাশিত তরাইয়ের গান অডিও সি.ডি.টি।
উত্স - তাপস চক্রবর্তী, এক অসাধারণ সাধারণ মানুষ - প্রবন্ধ,
. দিলীপ বাগচী, মিছিলে মিছিলে গান গাই - প্রবন্ধ,
. দীপংকর চক্রবর্তী, দিলীপ দা-ও (বাগচী) চলে গেলেন - প্রবন্ধ,
. প্রিয় বিশ্বাস, দিলীপ বাগচী : গানওয়ালা কলমচী - প্রবন্ধ, শংকর সান্যাল ও তাপস চক্রবর্তী
. সংকলিত ও সম্পাদিত “এক অসাধারণ সাধারণ মানুষ, দিলীপ বাগচী জীবন ও সৃষ্টি” নামক দিলীপ
. বাগচী স্মারক গ্রন্থ, ২০১৩।
কবি দিলীপ বাগচীর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ১৪.১০.২০১৫
...