মাংস | তুমি স্বপ্ন সমাচ্ছন্ন দৃষ্টির আড়ালে . কত কন্টকিত পথে চরণ বাড়ালে . কত ক্লান্ত অপরাহ্নে কত অন্ধকারে | . আমি একা একা ঘরে জানালার ধারে . আহারান্তে এসে শুনি কপোত কূজন | . আহা রে এমন ঘরে আমরা দু’জন . বুকে বুক চোখে চোখ হাতে রেখে হাত . কাটিয়ে দিতাম চিন্তাহীন দিনরাত |
. বল তুমি, এত কি সহজ পথ চলা ? . পথে যে গড়ায়ে যাবে এ-মাংসের দলা | . দক্ষিণ পঞ্জর হতে আদমের কালে . একখণ্ড অস্থি মাত্র কী এক খেয়ালে . আমার মেদের স্তূপে ফেলে দিলে ছুঁড়ে . সেই থেকে স্থির আছি মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে |
অস্থি | মেদভারশূন্য তন্বি হে স্তন্যময়ী | . অতনুর অন্ধ নৃত্যে তুমি চিরজয়ী, . নূপুর জড়ায়ে কাঁদে বহু ক্লান্ত হাত ! . বহু জীবনের রিক্ত মৃত্যুর প্রপাত . পরভোজী তনুতটে যেন কল্লোলিত | . প্রবল দ্বীপের পুষ্প অস্থি সুরভিত | . নিষ্পেষিত অস্থি বজ্র পল্লবিনী লতে | . বিশীর্ণ ছায়ারা লুপ্ত নিরুদ্দিষ্ট পথে |
. সচেতন অস্থিদল স্নিগ্ধ স্বর্গধামে . তোমাকে বিচূর্ণ করে সম্মুখ সংগ্রামে . উড়িয়ে গুঁড়িয়ে যাবে, ছিন্ন খণ্ড হতে . দীর্ণ জীর্ণ অগ্নিমোহ ফুটবে আলোতে . অস্থি মাংস এক হ’য়ে ! আদমের দেনা . আমরা ব্যতীত আর কেউ শুধবে না |
ভারা-করা ভাঙা বাড়ির ফুটো ছাদ সারাতে গিয়ে রাজমিস্ত্রি আতর আলির সঙ্গে আমার পরিচয় | সে বলেছিল, কোথাও তার একটানা বেশিদিনের কাজ জুটছে না, অনেক নতুন বাড়ি হচ্ছে বটে, অনেক দিন ধরে সেখানে কাজো চলে বটে, কিন্তু বুড়ো আতর আলিদের সেখানে কাজ জোটে না, কেবল জীর্ণ বাড়ি মেরামত কালে তাদের ডাক পড়ে | যেদিন কাজ থাকে না, কী করো তুমি আতর আলি ? সে কাতর হয়ে বলেছিল, তা নাই শুনলেন বাবু | কথায় কথায় জানা গিয়েছিল একদা আতর আলিরাই বানিয়েছিল আমাদের পাড়ার বড় মসজিদ, আর পাশের পাড়ার নবদূর্গা মন্দির | দুটোর মধ্যে কোনটা তোমার বেশি পছন্দ আতর আলি ? কোনটাই না, উত্তর দিয়েছিল সে, পরে শুধরে নিয়ে বলেছিল---- নিজের হাতে গড়া কোনটার মায়া কি একেবারে ছাড়া যায় বাবু ? একদিন আতর আলিকে দেখেছিলাম তার তৈরি মসজিদের সামনে অপেক্ষমাণ ভিক্ষুকদের মধ্যে, রুটির আশায় দাঁড়িয়ে আছে | আমি উল্টো দিকে হাঁটা দিয়েছিলাম | অন্য একদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখেছিলাম সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল সবুজ পাতার ফাঁকে স্বর্ণকিরণ বিকম্পিত বর্ণছটা ঝরছে যেন সিঁদুরের মতো | হৈ-হুল্লোড়ের শব্দে আমাকে লাবণ্যলীলা থেকে ফেরাতে হয়েছিল চোখ---- আতর আলি তার তৈরি নবদুর্গা মন্দিরের সামনে আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে ভিক্ষুকদের ভিড়ে ! মস্ত মোটর গাড়ি থেকে মোটাসোটা মহিলা বিলি করেছিলেন পাউরুটি আর সিঙ্গাপুরী কলা | সে দিকে আতর আলির স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ ! এবারও সে আমায় দেখতে পায়নি |
সুবিধাবাদের কবরের উপর লেনিনের স্বপ্নসৌধ | তার কক্ষে কক্ষে চেতনার নতুন আলোকমালা, সোপানে সোপানে যুগসন্ধানী কলাকৌশল, সিংহদ্বারে ধারাল বর্শাফলক, সুতীক্ষ্ম তরবারি, শত্রুব্যুহভেদী অগ্নিবর্ষী কামান | বাতায়ন থেকে চোখে পড়ে মেনশেভিক আর সোসালিস্ট রেভ্যুলিউশনারি আর . কাউটস্কিদের ধরাশয়ী কবন্ধগুলির প্রেত-ছায়া | তাই বলে মনে কোরো না সুবিধাবাদের হাতে ছিল না অস্ত্র, তাই ব’লে ভেব না লেনিনের ছিল না রক্তমাংসের দেহ, তাই বলে কল্পনা কোরো না লড়তে গিয়ে লেনিনকে হতে হয়নি . ক্ষতবিক্ষত | যদি ওল্টাও ইতিহাসের পুরানো পাতা, . কিম্বা স্মৃতির উজ্জ্বল পৃষ্ঠা, দেখবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা কষার পর . লেনিনের কী দশা হ’ত, স্নায়ুতন্ত্রী শিরাউপশিরা আপাদমস্তক বিকল হ’ত কিনা, বিশ্রাম এবং প্রকৃতির কাছে লেনিনকে নিতে হত কিনা . আশ্রয়, বনের ছায়ায়, ঝর্ণার পাশে, পাহাড়ের নির্জনতায় . খুঁজতে হ’ত কিনা নতুন শক্তি | তোমার আমার মতোই নরদেহধারী . আবার ফিরে আসতেন রণাঙ্গনে, আবার তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হ’ত, ওরা মার্কসবাদের উপর . শুয়ে পড়েছে, কমরেড | এসো আমরা ওদের চিতা সাজাই, মার্কসবাদের উপর উঠে দাঁড়াই ! এবার লেনিনের নাম ধ’রেই যদি উঠে আসে . আর এক সুবিধাবাদ ? তার উপর চিত্পাত হয়ে যদি . বিপ্লবের গাঁজার কল্কেয় দম দেয় ? রাজা-উজির মারতে থাকে আর পথিকের পথ ভোলায় ? নিত্যনূতন পথচলার মানস-চেতনার ক্লেশ না বহন করে ? তাহলে আবার হয়তো জন্মের শতবর্ষে . শোনা যাবে একই কন্ঠস্বর, আমার উপর শয়নসজ্জা ছাড়ো, কমরেড ! আমাকে ভর ক’রে উঠে দাঁড়াও দয়া ক’রে! তবেই আমি বাঁচব, তবেই আমি চলব ! আর সুবিধা থাকবে যতদিন, সুবিধাবাদের কীটাণুকীটও . জন্মাবে ততদিন ! তাই উদ্যত অসি কোষবদ্ধ করো না, কমরেড ! জীবনের রণাঙ্গনে ক্ষতবিক্ষত হতে পিছপা হয়ো না কখনো !’ এমন কোনো বীর আছে যার দেহমনে নেই আঘাতের বহু চিহ্ন ?