কবি গোলাম কুদ্দুস-এর কবিতা
*
অথচ
কবি গোলাম কুদ্দুস

স্বার্থের হাওয়া ছাড়া
সংসার অরণ্যে
জীবন-তরুর একটি পাতাও নড়ে না |
অথচ তেমন করে দুশমনের মুখোমুখি
দাঁড়াতে পারলে,
নিঃস্বার্থ আবেগ নিয়ে
অচেনা বন্ধুরা এসে জোটে |
হঠাৎ দুঃখ হতে চায় সুখের প্রতিচ্ছবি---
যে ছবি আমি আঁকতে পারতাম
যদি চোখের কালিপড়া দাগ দিয়ে লেখা যেত বিদ্যুৎ,
বুকের হাহাকারের সুর দিয়ে ফোটানো যেত মেঘ-মল্লার
অস্ফুট অঙ্কুরের নির্ভীক চক্ষুরুন্মীলনের
বিস্ময় দিয়ে রাঙানো যেত অন্ধ আঁখি,
জননীর বেদনার গান দিয়ে
শোনানো যেত ভ্রূণের ক্রমবর্ধমান আনন্দ |

.             *************************            
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
অস্থি-মাংস-সংবাদ
কবি গোলাম কুদ্দুস

অস্থি |    বাতায়ন হতে আজ কেন হাতছানি ?

.           অন্য কোনো দিন যদি দেখা হয় হবে |
.           রাস্তায় প্রচন্ড রৌদ্র বোজ অনুভবে ?
.           আমাদের শক্ত হাড়ে সূর্য ঝলকায় |
.           তোমার ননীর দেহ, রৌদ্রে গলে যায় !

.           মধ্যাহ্নের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
.           অকস্মাৎ কাব্য এলো, শোনো মন দিয়ে |
.           হে চঞ্চল ঢাকা মাংস, হে ছায়াবাসিনি,
.           কেন জান তোমাদের সান্নিধ্যে আসিনি
.           বহুদিন ? হাড়ে মাংসে বিকট বেহাগ
.           যেই বাজে আলিঙ্গনে, তপ্ত অনুরাগ
.           লুপ্ত হয় | প্রেমিক নধর ননী চোর !
.           ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর’ !


মাংস |    তুমি স্বপ্ন সমাচ্ছন্ন দৃষ্টির আড়ালে
.            কত কন্টকিত পথে চরণ বাড়ালে
.            কত ক্লান্ত অপরাহ্নে কত অন্ধকারে |
.            আমি একা একা ঘরে জানালার ধারে
.            আহারান্তে এসে শুনি কপোত কূজন |
.             আহা রে এমন ঘরে আমরা দু’জন
.             বুকে বুক চোখে চোখ হাতে রেখে হাত
.             কাটিয়ে দিতাম চিন্তাহীন দিনরাত |

.             বল তুমি, এত কি সহজ পথ চলা ?
.             পথে যে গড়ায়ে যাবে এ-মাংসের দলা |
.             দক্ষিণ পঞ্জর হতে আদমের কালে
.             একখণ্ড অস্থি মাত্র কী এক খেয়ালে
.             আমার মেদের স্তূপে ফেলে দিলে ছুঁড়ে
.             সেই থেকে স্থির আছি মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে |

অস্থি |     মেদভারশূন্য তন্বি হে স্তন্যময়ী |
.            অতনুর অন্ধ নৃত্যে তুমি চিরজয়ী,
.            নূপুর জড়ায়ে কাঁদে বহু ক্লান্ত হাত !
.            বহু জীবনের রিক্ত মৃত্যুর প্রপাত
.            পরভোজী তনুতটে যেন কল্লোলিত |
.             প্রবল দ্বীপের পুষ্প অস্থি সুরভিত |
.             নিষ্পেষিত অস্থি বজ্র পল্লবিনী লতে |
.             বিশীর্ণ ছায়ারা লুপ্ত নিরুদ্দিষ্ট পথে |

.             সচেতন অস্থিদল স্নিগ্ধ স্বর্গধামে
.             তোমাকে বিচূর্ণ করে সম্মুখ সংগ্রামে
.             উড়িয়ে গুঁড়িয়ে যাবে, ছিন্ন খণ্ড হতে
.             দীর্ণ জীর্ণ অগ্নিমোহ ফুটবে আলোতে
.             অস্থি মাংস এক হ’য়ে ! আদমের দেনা
.             আমরা ব্যতীত আর কেউ শুধবে না |

.                 *************************            
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
আতর আলির মন্দির-মসজিদ
কবি গোলাম কুদ্দুস

ভারা-করা ভাঙা বাড়ির ফুটো ছাদ সারাতে গিয়ে
রাজমিস্ত্রি আতর আলির সঙ্গে আমার পরিচয় |
সে বলেছিল, কোথাও তার একটানা বেশিদিনের কাজ জুটছে না,
অনেক নতুন বাড়ি হচ্ছে বটে, অনেক দিন ধরে সেখানে কাজো চলে বটে,
কিন্তু বুড়ো আতর আলিদের সেখানে কাজ জোটে না,
কেবল জীর্ণ বাড়ি মেরামত কালে তাদের ডাক পড়ে |
যেদিন কাজ থাকে না, কী করো তুমি আতর আলি ?
সে কাতর হয়ে বলেছিল, তা নাই শুনলেন বাবু |
কথায় কথায় জানা গিয়েছিল একদা আতর আলিরাই বানিয়েছিল
আমাদের পাড়ার বড় মসজিদ, আর পাশের পাড়ার নবদূর্গা মন্দির |
দুটোর মধ্যে কোনটা তোমার বেশি পছন্দ আতর আলি ?
কোনটাই না, উত্তর দিয়েছিল সে,
পরে শুধরে নিয়ে বলেছিল----
নিজের হাতে গড়া কোনটার মায়া কি একেবারে ছাড়া যায় বাবু ?
একদিন আতর আলিকে দেখেছিলাম তার তৈরি মসজিদের সামনে
অপেক্ষমাণ ভিক্ষুকদের মধ্যে, রুটির আশায় দাঁড়িয়ে আছে |
আমি উল্টো দিকে হাঁটা দিয়েছিলাম |
অন্য একদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখেছিলাম
সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল সবুজ পাতার ফাঁকে
স্বর্ণকিরণ বিকম্পিত বর্ণছটা ঝরছে যেন সিঁদুরের মতো |
হৈ-হুল্লোড়ের শব্দে আমাকে লাবণ্যলীলা থেকে
ফেরাতে হয়েছিল চোখ----
আতর আলি তার তৈরি নবদুর্গা মন্দিরের সামনে
আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে ভিক্ষুকদের ভিড়ে !
মস্ত মোটর গাড়ি থেকে মোটাসোটা মহিলা বিলি করেছিলেন
পাউরুটি আর সিঙ্গাপুরী কলা |
সে দিকে আতর আলির স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ !
এবারও সে আমায় দেখতে পায়নি |

.         *************************            
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
সুখের দেশে সুখে থাকো
কবি গোলাম কুদ্দুস

হ্যালো
কাকে চাই ?
হ্যাঁ, আমি, কথা বলছি
কে ? পাঞ্চালী ?
এতদিন পড়ে বাবাকে মনে পড়ল,  মা ?
কোথা থেকে ফোন করছিস ?
সানফ্রান্সিসকো ? না ? তবে ?
ও তোরা নিউইয়র্কে এসেছিস ? বেশ |
আমরা কেমন আছি ? ভালোই আছি ?
মা-র খবর চাইছিস ?
তিনি তো গত মাসে গত হয়েছেন |
হ্যালো ! হ্যালো ! চুপ করে গেলি কেন মা ?
কথা বল্ ! কাঁদছিস ! কেঁদে কী হবে মা ?
কী বললি ? একটাও খবর দিইনি কেন ?
তোর মা আমাকে মানা করেছিলেন যে,
তোদের সুখে ব্যাঘাত ঘটাতে চাননি,
সুখের দেশে তোরা সুখে থাকলেই আমাদের সুখ |
মা-র একখানা ফটো ? আচ্ছা, পাঠিয়ে দেব |
কী বললি,  এরপর নিয়মিত খোঁজখবর নিবি ?
তুই আমায় হাসালি পাঞ্চালী !
দেখবি রিং হয়ে যাচ্ছে, ধরার লোক নেই |

.           *************************            
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
লেনিন যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন
কবি গোলাম কুদ্দুস

সুবিধাবাদের কবরের উপর লেনিনের স্বপ্নসৌধ |
তার কক্ষে কক্ষে চেতনার নতুন আলোকমালা,
সোপানে সোপানে যুগসন্ধানী কলাকৌশল,
সিংহদ্বারে ধারাল বর্শাফলক, সুতীক্ষ্ম তরবারি,
শত্রুব্যুহভেদী অগ্নিবর্ষী কামান |
বাতায়ন থেকে চোখে পড়ে
মেনশেভিক আর সোসালিস্ট রেভ্যুলিউশনারি আর
.                                                     কাউটস্কিদের
ধরাশয়ী কবন্ধগুলির প্রেত-ছায়া |
তাই বলে মনে কোরো না সুবিধাবাদের হাতে ছিল না অস্ত্র,
তাই ব’লে ভেব না লেনিনের ছিল না রক্তমাংসের দেহ,
তাই বলে কল্পনা কোরো না লড়তে গিয়ে লেনিনকে হতে হয়নি
.                                                               ক্ষতবিক্ষত |
যদি ওল্টাও ইতিহাসের পুরানো পাতা,
.                                    কিম্বা স্মৃতির উজ্জ্বল পৃষ্ঠা,
দেখবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা কষার পর
.                                    লেনিনের কী দশা হ’ত,
স্নায়ুতন্ত্রী শিরাউপশিরা আপাদমস্তক বিকল হ’ত কিনা,
বিশ্রাম এবং প্রকৃতির কাছে লেনিনকে নিতে হত কিনা
.                                                        আশ্রয়,
বনের ছায়ায়, ঝর্ণার পাশে, পাহাড়ের নির্জনতায়
.                                                      খুঁজতে হ’ত কিনা নতুন শক্তি |
তোমার আমার মতোই নরদেহধারী
.                                  আবার ফিরে আসতেন রণাঙ্গনে,
আবার তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হ’ত, ওরা মার্কসবাদের উপর
.                                                      শুয়ে পড়েছে, কমরেড |
এসো আমরা ওদের চিতা সাজাই,
মার্কসবাদের উপর উঠে দাঁড়াই !
এবার লেনিনের নাম ধ’রেই যদি উঠে আসে
.                                                   আর এক সুবিধাবাদ ?
তার উপর চিত্পাত হয়ে যদি
.                                  বিপ্লবের গাঁজার কল্কেয় দম দেয় ?
রাজা-উজির মারতে থাকে আর পথিকের পথ ভোলায় ?
নিত্যনূতন পথচলার মানস-চেতনার ক্লেশ না বহন করে ?
তাহলে আবার হয়তো জন্মের শতবর্ষে
.                                     শোনা যাবে একই কন্ঠস্বর,
আমার উপর শয়নসজ্জা ছাড়ো, কমরেড !
আমাকে ভর ক’রে উঠে দাঁড়াও দয়া ক’রে!
তবেই আমি বাঁচব, তবেই আমি চলব !
আর সুবিধা থাকবে যতদিন, সুবিধাবাদের কীটাণুকীটও
.                                                     জন্মাবে ততদিন !
তাই উদ্যত অসি কোষবদ্ধ করো না, কমরেড !
জীবনের রণাঙ্গনে ক্ষতবিক্ষত হতে পিছপা হয়ো না কখনো !’
এমন কোনো বীর আছে যার দেহমনে নেই আঘাতের বহু চিহ্ন ?

.                  *************************            
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর