রাত ছিল পূর্ণিমার - জ্যোৎস্নার অনির্বার প্রয়াস ; স্বচ্ছন্দ ; সাবলীল। সীমাহীন কালো প্রেক্ষাপটে ছিল কিছু তারা, গভীর প্রত্যয় বুকে নিয়ে। মোটামুটি এই ছিল আমার আকাশ – ভরা ভাদ্রের দুকুল ছাপানো জলের মতো।
নীচে, মহানগরীর অমাবস্যা। বিজ্ঞানের সমস্ত প্রয়াস যেন আজ হতবাক। কাগজে কাগজে রঙবেরঙের সুফলা আত্মপ্রচার। হ্যালোজেন, মার্কারীর ঘনীভূত সুষমা – আমাদেরই দিকে বুমেরাং – জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডের মতো। জল, আলো, পাখা আলেয়ার দিকে ছুটে থাকা এক দল বুবুক্ষু। কড়ি বরগার চতুবর্গ – যা কিছু সুখ-স্বর্গ সব কিছু নিস্তব্ধ – নিস্প্রাণ।
ছাদে – প্রাচীরের ঘেরা ফাঁদে ধরা দেয় চাঁদ। অশালীন হাওয়া – করে আসাযাওয়া রঙীন বিজ্ঞাপনের ক্রোড়পত্র হাতে নিয়ে। পূর্ণিমার চাঁদ – এখনো টানে। মটমিটে তারা – এখনো ভালো লাগে। এছাড়া আরো কিছু স্বপ্ন – যা মহানগরীতে দুর্লভ – স্বপ্ন মনে হয়। শুধু দেখি উচুঁ উচুঁ প্রাণহীন বাড়ীগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। - বিংশ শতকের অগ্রগতির জয়রথ। চারিকোনা দিগন্তের কালো বর্ণচ্ছটা – সভ্যতার নবতর ঘনঘটা – অলীক, অস্ফুট, অবাক। যেন একঝাঁক জালে পড়া মাছ – অবিরত মুক্তির উন্মাদনায় ছটফট করে স্থির হয়ে গ্যাছে। পলক-না-পড়া দুটি ব্যাথাতুর চোখ ; কানে কানে বলে – চারিবর্গে তারাগুলি অবিরাম জ্বলে। অবশেষে উত্তীর্ণ প্রহরে, - দিগন্তের ঘেরা বৃত্ত ছেড়ে চলে যায় অন্ধকারে – আলোর ওপারে যে পারের হাওয়া বয়ে আনে মুক্তির সাধ। মধুর আস্বাদ।
নীচে এখনো অমারাত্রির ভয়াল ভ্রুকুটি। সভ্যতার আলোর ঝলকানি এখনো মেগাওয়াটের খপ্পরে বাঁধা পড়ে আছে। ইউনিট – বিকলাঙ্গ ; ক্লান্তিতে অবসাঙ্গ বিংশ শতাব্দীর অগ্রদূত আমরা অদ্ভুত। হিসাবের তুল্যমূল্য - কথা কাটাকাটি – এড়ানোর সযত্ন প্রয়াসে ; আমরাও অনায়াসে সয়ে গেছি। শুধু বেঁচে আছি এইটাই অমরত্ব। কে জানে কোনক্ষণে করেছি অমৃত-পান।
বড় ভয় ছিলো – প্রকৃতির ধারালো যাদুগুলো একে একে গিয়েছিল চলে। নগর ও সভ্যতার অকৃপণ বিস্তারে সভ্যতার গর্বভারে চোখ ছিল অন্ধ ; মন ছিল বন্ধ খড়খড়ির অন্তরালে। যন্ত্রিকতার নিগুঢ় আড়ালে নেশা লেগেছিল মনে ; সবুজের ছোপধরা বনে – পড়ত না চোখ আর প্রকৃতির পানে। গল্পে গানে – শুধুই ইঁট, কাঠ, বালি অথবা নোংরা ডাস্টবিনের অকৃপন উদ্ধৃতি।
আর নাই ভয় – দিতেছে অভয় এই শহরের প্রাণ। দমবন্ধ করা গুমোট আস্তানা ছেড়ে চলো যাই – মুক্তাকাশের নীচে, যেথা এখনো ঝরে জ্যোৎস্নার শিউলি – গলিত হৃদয়গুলি এখনো দেখতে পায় সন্ধ্যার আকাশে কত তারার উদয়। মনে হয় – প্রকৃতির নেই কোন লয়। আকাশের তারায়, পূর্ণিমার চাঁদে এখনো মন জাগে।
যদি কিছুকাল আর এইভাবে থাকে – আবার লাগবে গ্রহণ সূর্যে ও চাঁদে। আশার আশ্বাস ; প্রকৃতির দিকে চেয়ে ফেলব নিশ্বাস।।
কি করে বোঝাই বলো শব্দের এত অভিমান, এত লুকোচুরি খেলা। লোকে বলে, শব্দ নাকি নিরাকার, ব্রহ্ম। একবার উপুড় হয়ে পড়লে আর নিস্তার নেই। ট্রিগার একবার চেপে ধরলে – গুলি তো বেরোবেই, যদি না মরচে ধরে থাকে ঐ পথে। তাও কি কেউ শোনে! ট্রিগার টিপবেই ; টিপতেই থাকবে মনের সুখে। যেন রাগমোচনের ক্ষণিক আনন্দের শিহরনে, উল্লসিত সারমেয়কূলের রাত্রের চীৎকার। শান্ত নিরিবিলি শব্দের, শবদাহের প্রস্তুতি।
ব্যবহারে অনিচ্ছা তো – থাক না। কেউ তো কালীর দিব্যি দেয় নি, যে শালপাতাতেই খেতে হবে রাতের খাবার ! গন্ডীর গান্ডুরা আজ অস্তিত্বে বিপন্ন। শব্দেরা থাকে যেন সেই দুধে ভাতে। উপজ্ঞার জড়িমায় বন্ধকী, শব্দের প্রবাহ। শব্দের পাখীদের উচ্চকিত শিস – এদের দুঃসহ রাত্রির নিকষ অন্ধকার।
পাখীরা উড়বেই। মুক্ত শব্দের গতিময় হাওয়ায় হাওয়ায়। পরিযায়ী শব্দেরা আসবেই ডান মেলে। ভোর হবেই। “আমরা করবো জয় নিশ্চয়...”
কেন এত রাগ তোর ? এত অভিমান। বুকের ভেতরে কেন জমে আছে - ঘুম পাড়ানোর গান। শ্রাবনের এই বর্ষাবেলায় – আকাশ যখন ভিজে। অভিমানের ব্যাথায় কেন মরিস নিজে নিজে। তোর যে আকাশ অনেক বড়, যদিও মেঘে ভরা – তাই বলে তুই এমন করে – নিজের মনে একলা ঘরে – অলস বাতাস জাপটে ধরে – মন কেমনের শুকনো বুকে করবি এমন ধারা ? রিন রিন রিন চূড়ীর আওয়াজ, কেমন যেন লাগছে যে আজ, উদাস উদাস ভাবখানা ওই আমার কানে বাজে। দুপুর বেলায় শূন্য সোফায় – বৃষ্টি যখন গান গেয়ে যায়- কাঁঠাল গাছের গায়ে – রিম ঝিম ঝিম সেই আওয়াজে, মন কেন তোর সাজিয়ে চলে ভায়োলিনের সুর। আমায় নিয়ে ভাবনা যে তোর- নয় যে অলীক, নয় যে পাথর, যায় না তাকে ফেলা। তবু কেন, এমন করে – হাল্কা রাগে ঠেলিস দূরে – তোর সে লালন-গান। মনের ভেতর টান - যতই বাড়ে - পুকুর পারে সন্ধ্যে নামার পর। ঘরের আলো আরশিজলে কেঁপে কেঁপে ঘুরে ঘুরে পাড়ের দিকেই যায়। পুকুর পাড়ের সেই সে ধারে আলো মেশে অন্ধকারে – সেই খানেতেই তোর আমি যে অবাক চোখে চায়। সে কোন ঈশারায় ? তোর সে ডাকে আকাশ ভাঙে শ্রাবণ রাতের মধ্যযামে – আমি তো কোন ছার ! তোর সে অভিমানের বেড়া – অবাক রাতে দূরের তারা - বিঁধছে এসে আমার বুকে আধফোঁটা যুঁই হয়ে। তখন আমার বুকের তাপে ফুটছে যে যুঁই, অনুতাপের - গন্ধ মেখে - সারা পুকুর পাড়ে। আমি তখন দু হাত ভরে - খুঁজছি তোকে, চাইছি কাছে আরো অনেক ক’রে। সব অভিমান শুষে নিতে এক নিমেষের তরে। আমার মনের ভাঁড়ার ঘরে। চারদিকে জল খেলা করে - আকাশ উজাড় করে। একবার তুই আয়না কাছে, বৃষ্টিপড়া জলের নাচে সারা শরীর ভিজিয়ে নিয়ে আমার বাহুডোরে। দেখব কত অভিমানে - থাকতে পারিস অন্যমনে, আমায় দূরে ঠেলে। আবার আমি মাতাল হব রাতের শেষে মিলিয়ে যাব তোর অভিমানের জলে।
তুমি বলেছিলে – “বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের,”। আজ দেখি তাহাদের – বয়স গিয়েছে থেমে অকারণে, হিজলের ডাল থেকে নেমে সেই থুরথুরে অন্ধ পেঁচা, স্থবির হ-তে, হ---তে, নীলনদীটির তীরে সেই মৃত মমিদের মতো চেয়ে আছে শুধু - । নির্বাক, নিষ্পন্দ, ভাষাহীন। চারিদিকে এতো ভাঙাগড়া, এতো উথালপাথাল – কিছুই পরে না আর তার চোখে। হাসি গান কান্না শোকের বোধ, সবকিছু সেদিনের চেয়েও শূণ্য মনে হয়। জীবনের তরে জীবন গড়ায় শুধু – শশাফুল থেকে এখনো’তো মধু পায় মৌমাছি, প্রজাপতি, অসংখ্য কীটেরা। তবে কেন - ? এইসব নরনারী আজ – খোঁজে শুধু নষ্টকীট। এখন কি প্রেম জাগে এইসব কোমল হৃদয়ে ! চাল-ধোওয়া সাদা হাত বাড়ায় কি কেউ আর ? চারদিকে, সুন্দর অতৃপ্ত হাহাকার !
তোমার কবিতা থেকে জীবন গিয়েছে চলে – কতো, ক-তো কুড়ি কুড়ি বছরের পার ! সত্যি কি নিভেছে সূর্য – কমেছে কি আলো তার ? তা না হলে দেখি কেন – কচি মেয়েটির স্বামী সতীদাহ করে আজ, ঘরের ভেতর – কেরোসিন ঢেলে গায় ? নির্জন গীর্জা অথবা কোনো এক লোনাধরা মন্দিরের পাশে – প্রায়শই রাতে – শরীর লুন্ঠিত হয় সেই নরে’দের হাতে। বয়স কি বাধা মানে তার ? মানুষী’র তরে আর – জাগে নাকি মন - ? শুধু প্রয়োজন ভোগের আসঙ্গলিপ্সা। টাকা টাকা টাকা ! আর শরীরের টান। হৃদয় তো খানখান – পড়ে আছে চিতা তার, একা অন্ধকার।
তবুও তো ফুল দেখি – হলদে রঙের ফুল ! সবুজ ঘাসের ভেতর ! শিউলির কমলা বোঁটা, এখনো তো ঝরে – রাত শেষ হ’লে পরে। যুঁইরজনীতে, গন্ধ তো ছড়ায় এখনো ! তবে কেন ? কেন এতো রাগ ? কেন এই স্খলিত ভ্রুকুটি ? একি শুধু অকারণ নীতিখেলা – ? ভোরবেলা – পূবাকাশে, এখনো তো ভাসে লাল টিপ। টুপ করে ডুবে যায় সাঁঝে – পশ্চিম আকাশের মাঝে।
ফিরে যেন আসে কবি – তোমার সে কথামত – “মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।“ যেন জেগে রয় – সব পাখীদের গান। আর সব মানুষের তরে সব মানুষের – বাঁচার আহ্বান।
বন্ধ কোরো না – দরজা খানা, অত জোরে। না হয় বেশ রেগেই আছো, আমার ‘পরে। অফিস থেকে ফিরলে না হয় – আবার বোকো। থমথমে মুখ, আরো কঠিন - তখন না হয় দরজা খুলো। আমায় দেখে। শ্রান্ত শরীর, তাকিয়ে দেখেও – মুখটা না হয় ঘুরিয়ে নিও, - আমার থেকে।
কিন্তু এখন, একটু তাকাও - আমার মুখে। ভরবে আমার সারা শরীর – গোপন সুখে। সারাদিনের একলা থাকা, জানি আমি – কেমন ফাঁকা, লাগে তোমার, দুপুরবেলা। কিন্তু এ’তো জীবন ধারন। ওই দুপুরে আমারো হয় – মনটা কেমন। মাঝে মাঝেই।
কাজে কাজেই – তাইত বলি, আমার অলি – কথা না হয় নাইবা বলো, আমার সাথে। সাত পাকা বাঁধ ক্ষইছে নাকি – আজকালকার, দুর্বিপাকে ? হোয়াটস এপের আনা গোনায় – ফেসবুকেরি জানা শোনায় – ভাবছ নাকি ? – মনেক কোনায় জল জমেছে ?
বুঝতে পারি – তোমার জ্বালা। সেই কবেকার সতীন-মালা, আঁকড়ে আছে তোমার বুকে। অবচেতন খেলছে খেলা – মা-ঠাকুমার পুতুল বেলা, মনের চোখে। যায়নি তারা কোনোখানেই – সন্ধ্যে হলে রাত নামে যেই, চতুর্দিকে। সত্যি করে বলবে আমায় ? নিজের মুখে ? অবিশ্বাসের দোলা কেন জাগছে চোখে। তার মানে এই – হার’তে পারে, সব কিছুতেই সেদিনের সেই - গামছা বাঁধা। এতই ধাঁধা ? দুতিন দিনের জীবন জ্বরে ? চুপটি করে ভাবতে থাকো – তোমার নিজের মনের ঘরে।