কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা |
জন্মভূমি (বীরবাহুর উক্তি, বীরবাহু কাব্য থেকে নেওয়া) কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মাগো ওমা জন্মভূমি! আরো কত কাল তুমি, এ বয়সে পরাধীনা হয়ে কাল যাপিবে | পাষণ্ড যবনদল বল আর কত কাল, নির্দয় নিষ্ঠুর মনে নিপীড়ন করিবে || কতই ঘুমাবে মাগো, জাগো গো মা জাগো জাগো, কেঁদে সারা হয় কন্যা পুত্র সকলে | ধুলায় ধূসর কায়, ভূমি গড়াগড়ি যায়, একবার কোলে কর, ডাকি গো মা, মা বলে || কাহার জননী হয়ে, কারে আছ কোলে লয়ে, স্বীয় সুতে ঠেলে ফেলে কার সুতে পালিছ ? কারে দুগ্ধ কর দান, ও নহে তব সন্তান, দুগ্ধ দিয়ে গৃহমাঝে কালসর্প পুষিছ || মোরে দিলে বনবাস, প্রিয়ে আছে কার পাশ, হায় কত পীড়া পাও, হে সুধাংশু-বদনে ! কোথা বসো, কোথা যাও, কিবা পর কিবা খাও, হায় পুনঃ কতদিনে জুড়াইব নয়নে || . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
কৌমুদী কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হাস রে কৌমুদী হাস সুনির্মল গগনে, এমন মধুর আর নাহি কিছু ভূবনে ; সুধা পেয়ে সিন্ধু তলে দেবতারা সুকৌশলে লুকাইয়া চন্দ্রকোলে :-- লেখা আছে পুরাণে, বুঝি কথা মিথ্যা নয়, নহিলে চন্দ্র উদয়, কেন হেন সুধাময় ব্রহ্মাণ্ডের নয়নে | আহা কি শীতল রশ্মি চন্দ্রমার কিরণে, যেখানে যখন পড়ে, প্রাণ যেন লয় কেড়ে, ভুলে যাই সমুদয়, চেতনা নাহিক রয়, জাগিয়া আছি কি আমি কিম্বা আছি স্বপনে | আহা কি অমিয়খনি শরতের গগনে ! কিবা সন্ধ্যা কিবা নিশি, যেই হেরি পূর্ণ শশী, ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে যাই, শুধু সেই দিকে চাই, হেরি পূর্ণ সুধাকরে অনিমিষ নয়নে | পড়ে কিরণের ঝারা ঢাকি হৃদি বদনে, যত হেরি সুধাকরে, হৃদয়ের জ্বালা হরে, কোথা যেন যাই চলে, স্বপ্নময় ভূমণ্ডলে, সংসারের সুখদুঃখ নাহি থাকে স্মরণে || . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
জীবন-সঙ্গীত কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলো না কাতর স্বরে, বৃথা জন্ম এ সংসারে, এ জীবন নিশার স্বপন, দারা পুত্র পরিবার তুমি কার কে তোমার বলে' জীব করো না ক্রন্দন | মানব-জনম সার এমন পাবে না আর বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন | কর যত্ন হবে জয় জীবাত্মা অনিত্য নয় অহে জীব কর আকিঞ্চন | করো না সুখের আশ, প'রো না দুঃখের ফাঁস জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়, সংসারে সংসারী সাজ কর নিত্য নিত্য কাজ ভবের উন্নতি যাতে হয় | দিন যায় ক্ষণ যায়, সময় কাহারো নয় বেগে ধায় নাহি রহে স্থির ; সহায় সম্পদ বল সকলি ঘুচায় কাল আয়ুঃ যেন শৈবালের নীর | সংসার-সমরাঙ্গনে যুদ্ধ কর দৃঢ়পণে ভয়ে ভীত হয়ো না মানব ; কর যুদ্ধ বীর্যবান্ যায় যাবে যাক প্রাণ মহিমাই জগতে দুর্লভ | মনোহর মূর্তি হেরে অহে জীব অন্ধকারে ভবিষ্যতে ক'রো না নির্ভর ; অতীত সুখের দিনে পুনঃ আর ডেকে এনে চিন্তা ক'রে হইও না কাতর | সাধিতে আপন ব্রত স্বীয় কার্যে হও রত এক মনে ডাক ভগবান ; সঙ্কল্প সাধন হবে ধরাতলে কীর্তি রবে সময়ের সার বর্তমান | মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন হয়েছে প্রাতঃস্মরণীয় ; সেই পথ লক্ষ্য ক'রে স্বীয়কীর্তিধ্বজা ধ'রে আমরাও হব যে অমর ; সেই চিহ্ন লক্ষ্য করে অন্য কোনো জন পরে যশোদ্ধারে আসিবে সত্বর | ক'রো না মানবগণ বৃথা ক্ষয় এ জীবন সংসার-সমরাঙ্গন-মাঝে ; সঙ্কল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা রত হয়ে নিজ নিজ কাজে | . *************** আমরা কৃতজ্ঞ জনাব নুরুস সাফার কাছে, কারণ তিনি এই কবিতাটির কিছু ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন। তাঁর ইমেল - nurus.safa@gmail.com . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
পরশমণি কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কে বলে পরশমণি অলীক স্বপন ? অই যে অবনীতলে পরশমাণিক জ্বলে বিধাতা-নির্মিত চারু মানব-নয়ন | পরশমণির সনে লৌহ-অঙ্গ-পরশনে, সে লৌহ কাঞ্চন হয় প্রবাদ-বচন,--- এ মণি পরশ যায়, মানিক ঝলসে তায়, বরিষে কিরণধারা নিখিল ভূবন | কবির কল্পিত নিধি মানবে দিয়াছে বিধি, ইহার পরশগুণে মানব-বদন দেব তুল্য রূপ ধরি' আছে ধরা আলো করি', মাটির অঙ্গেতে মাখা সোনার কিরণ | পরশমণি যদি অলীক হইত, কোথা বা এ শশধর, কোথা বা ভানুর কর, কোথা বা নক্ষত্র-শোভা গগনে ফুটিত ? কে রাখিত চিত্র করে চাঁদের জোছনা ধ'রে তরঙ্গে মেঘের অঙ্গে এমন মাখায় ? কে বা এই সুশীতল বিমল গঙ্গার জল ভারত-ভূষণ করি রাখিত ছড়ায়ে ? কে দেখা'ত তরুকুল, নানা এঙ্গে নানা ফুল, মরাল, হরিণ,মৃগে পৃথিবী শোভিয়া ? ইন্দ্রধনু-আলো তুলে সাজায়ে বিহঙ্গ-কুলে, কে রাখিত শিখি পুঞ্জে শশাঙ্ক আঁকিয়া ? দিয়াছে বিধাতা যাই এ পরশমণি--- স্রগের উপমাস্থল হয়েছে এ মহীতল, সুখের আকর তাই হয়েছে ধরণী ! কি আছে ধরণীর অঙ্গে, নয়নমণির সঙ্গে না হয় মানব চিত্তে আনন্দদায়িনী ! নদীজলে মীন খেলে, বিটপীতে পাতা হেলে, চরে বালুকণা ফুটে, তৃণেতে হিমানী, পক্ষী পাখে উড়ে যায়, কীটেরা শ্রেণীতে ধায়, কঙ্করে তুষার পড়ে, ঝিনুক চিক্কণী | তাতেও আনন্দ হয়--- অরণ্য কুজ্ঝটিময়, জ্বলন্ত বিদ্যুত্লতা, তমিস্রা রজনী | অপূর্ব মাণিক এই পরশ-কাঞ্চন ! জননী-বদন-ইন্দু জগতে করুণা-সিন্ধু দয়াল পিতার মুখ, জায়ার বদন | শত শশি-রশ্মিমাখা চারু ইন্দীবর-আঁকা পুত্রের অধর-ওষ্ঠ, নলিন আনন ; সোদরের সুকোমল, স্বসা-মুখ নিরমল, পবিত্র প্রণয়পাত্র, গৃহির কাঞ্চন--- এই মণি পরশনে হয় সুখ দরশনে, মানব-জনম সার, সফল জীবন |--- কে বলে পরশমণি অলীক স্বপন ? . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |