কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
*
ভারত সঙ্গীত
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

আর ঘুমাইও না, দেখ চক্ষু মেলি ;
দেখ দেখ চেয়ে অবনীমণ্ডলী
কিবা সুসজ্জিত, কিবা কুতূহলী,
    বিবিধ মানবজাতিরে লয়ে |
মনের উল্লাসে, প্রবল আশ্বাসে,
প্রচণ্ড বেগেতে, গভীর বিশ্বাসে,
বিজয়ী পতাকা উড়িয়ে আকাশে,
    দেখ হে ধাইছে আকুতোভয় |---
হোথা আমেরিকা নয়া অভ্যুদয়,
পৃথিবী গ্রাসিতে করিছে আশয়,
হয়েছে অধৈর্য নিজ বীর্যবলে,
ছাড়ে হুহুঙ্কার, ভূমণ্ডল টলে,
যেন বা টানিয়া ছিঁড়িয়া ভূতলে
     নূতন করিয়া গড়িতে চায় |
মধ্যস্থলে হেথা আজন্মপূজিতা
চিরবীর্যবতী, বীর-প্রসবিতা,
অনন্ত-যৌবনা যুনানীমণ্ডলী,
মহিমা-ছটাতে জগত্ উজলি,
সাগর ছেঁচিয়া, মরু গিরি দলি,
      কৌতুকে ভাসিয়া চলিয়া যায় ||
আরব্য, মিশর, পারস্য, তুরকী,
তাতার, তিব্বত --- অন্য কব কি?
চীন, ব্রহ্মদেশ, অসভ্য জাপান,
তারাও স্বাধীন, তারাও প্রধান,
দাসত্ব করিতে করে হেয়জ্ঞান,
      ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয় |
বাজ্ রে শিঙ্গা, বাজ্ এই রবে,
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে,
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে,
      ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয় |
এই কথা বলি মুখে শিঙ্গা তুলি
শিখরে দাঁড়ায়ে গায়ে নামাবলি,
নয়ন-জ্যোতিতে হানিয়ে বিজলী
      গায়িতে লাগিল জনৈক যুবা |
আয়ত লোচন, উন্নত ললাট,
সুগৌরাঙ্গ তনু, সন্ন্যাসীর ঠাট,
শিখরে দাঁড়ায়ে, গায়ে নামাবলি,
নয়ন-জ্যোতিতে হানিল বিজলী,
      বদনে ভাতিল অতুল আভা | ---
নিনাদিল শৃঙ্গ করিয়া উচ্ছাস,
বিংশতি কোটি মানবের বাস
এ ভারতভূমি যবনের দাস ?
      রয়েছে পড়িয়া শৃঙ্খলে বাঁধা !
আর্যাবর্ত জয়ী পুরুষ যাহারা,
সেই বংশোদ্ভব জাতি কি ইহারা ?
জন কত শুধু প্রহরী পাহারা,
      দেখিয়া নয়নে লেগেছে ধাঁধা ?
ধিক হিন্দুকুলে ! বীরধর্ম ভুলে,
আত্ম-অভিমান ডুবায়ে সলিলে,
দিয়াছে সঁপিয়া শত্রু-করতলে,
      সোনার ভারত করিতে ছার !
হীনবীর্যসম হয়ে কৃতাঞ্জলি,
মস্তকে ধরিতে বৈরি-পদধূলি,
হ্যাদে দেখ ধায় মহাকুতূহলী,
      ভারতনিবাসী যত কুলাঙ্গার |                     
উপরে
এসেছিল যবে আর্যাবর্তভূমে,
দিক্ অন্ধকার করি তেজোধূমে,
রণ-রঙ্গ-মত্ত পূর্ব-পিতৃগণ,
যখন তাহারা করেছিল রণ,
করেছিল জয় পঞ্চনদগণ,
       তখন তাহারা ক'জন ছিল ?
আবার যখন জাহ্নবীর কুলে
এসেছিল তারা জয়ডঙ্কা তুলে,
যমুনা, কাবেরী, নর্মদা পুলিনে,
দ্রাবিড়, তৈলঙ্গ, দক্ষিণাত্যবনে ;
অসংখ্য বিপক্ষ পরাজয়ি রণে,
       তখন তাহারা ক'জন ছিল ?
এখন তোরা যে শত কোটি তার,
স্বদেশ-উদ্ধার করা কোন্ ছার,
পারিস্ শাসিতে হাসিতে হাসিতে,
সুমেরু অবধি কুমেরু হইতে,
বিজয়ী পতাকা ধরায় তুলিতে,
       বারেক জাগিয়া করিলে পণ |
তবে ভিন্ন জাতি শত্রু-পদতলে,
কেন রে পড়িয়া থাকিস সকলে ?
কেন না ছিঁড়িয়া বন্ধন-শৃঙ্খলে,
       স্বাধীন হইতে করিস মন ?
এই দেখ সেই মাথার উপরে,
রবি, শশী, তারা, দিন দিন ঘোরে,
ঘুরিত যেরূপ দিক শোভা করে
       ভারত যখন স্বাধীন ছিল !
সেই আর্যাবর্ত এখন (ও) বিস্তৃত,
সেই বিন্ধ্যগিরি এখন (ও) উন্নত,
সেই ভাগীরথী এখন (ও) ধাবিত,
       পুরাকালে তারা যেরূপ ছিল |
কোথা সে উজ্জ্বল হুতাশন-সম
হিন্দু বীর দর্প, বুদ্ধি, পরাক্রম,
কাঁপিত যাহাতে স্থাবর জঙ্গম,
        গান্ধার অবধি জলধি-সীমা ?
সকলি ত আছে সে সাহস কই ?
সে গম্ভীর জ্ঞান, নিপুণতা কই ?
প্রবল তরঙ্গ সে উন্নতি কই ?
       কোথারে আজি সে জাতি-মহিমা !
হয়েছে শ্মশান এ ভারতভূমি !
কারে উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেছি আমি ?
গোলামের জাতি শিখিছে গোলামি ! ---
        আর কি ভারত সজীব আছে ?
সজীব থাকিলে এখনি উঠিত,
বীর-পদ-ভরে মেদিনী দুলিত,
ভরতের নিশি প্রভাত হইত,
        হায় রে সেদিন ঘুচিয়া গেছে !
এই কথা বলি অশ্রুবিন্দু ফেলি,
ক্ষণমাত্র যুবা শৃঙ্গনাদ ভুলি,
পুনর্বার শৃঙ্গ মুখে নিল তুলি,
       গর্জিয়া উঠিল গম্ভীর স্বরে ---
এখন (ও) জাগিয়া উঠরে সবে,
এখন (ও) সৌভাগ্য উদয় হবে,
রবি-কর-সম দ্বিগুণ প্রভাবে,
        ভারতের মুখ উজ্জ্বল ক'রে |
একবার শুধু জাতিভেদ ভুলে,
ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ বৈশ্ব শূদ্র মিলে,
করি দৃঢ় পণ এ মহীমণ্ডলে
        তুলিতে আপন মহিমা-ধ্বজা |                   
উপরে  
জপ, তপ আর যোগ আরাধনা,
পূজা, হোম, যাগ, প্রতিমা-অর্চনা,
এ সকলে এবে কিছুই হবে না,
        তূণীর কৃপাণে কর্ রে পূজা |
যাও সিন্ধুনীরে, ভূধর-শিখরে,
গগনের গ্রহ তন্ন তন্ন ক'রে,
বায়ু, উল্কাপাত, বজ্রশিখা ধরে'
        স্বকার্য-সাধনে প্রবৃত্ত হও !
তবে সে পারিবে বিপক্ষে নাশিতে,
প্রতিদ্বন্দ্বী সহ সমকক্ষ হতে,
স্বাধীনতারূপ রতনে মণ্ডিতে,
        যে শিরে এখনে পাদুকা বও |
ছিল বটে আগে তপস্যার বলে
কার্যসিদ্ধি হ'ত এ মহীমণ্ডলে,
আপনি আসিয়া ভক্ত-রণস্থলে,
        সংগ্রাম করিত অমরগণ |
এখন সে দিন না হ'ক রে আর,
দেব-আরাধনে ভারত উদ্ধার
হবে না, ---হবে না ---খোল্ তরবার ;
        এ সব দৈত্য মহে তেমন |
অস্ত্র পরাক্রমে হও বিশারদ,
রণ-রঙ্গ-রসে হওরে উন্মাদ,---
তবে সে বাঁচিবে, ঘুচিবে বিপদ,
        জগতে যদ্যপি থাকিতে চাও |
কিসের লাগিয়া হলি দিশেহারা,
সেই হিন্দুজাতি, সেই বসুন্ধরা,
জ্ঞান-বুদ্ধিজ্যোতিঃ তেমতি প্রখরা,
        তবে কেন ভূমে পড়ে লুটাও ?
ওই দেখ সেই মাথার উপরে,
রবি, শশী, তারা দিনদিন ঘোরে,
ঘুরিত যেরূপে দিক্ শোভা করে,
        ভারত যখন স্বাধীন ছিল ;
সেই আর্যাবর্ত এখন (ও) বিস্তৃত,
সেই বিন্ধ্যগিরি এখন (ও) উন্নত,
সেই ভাগীরথী এখন (ও) ধাবিত,
         কেন সে মহত্ত্ব হবে না উজ্জ্বল ?
বাজরে শিঙ্গা বাজ্ এই রবে,
শুনিয়া ভারতে জাগুক সবে,
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে,
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে,
         ভারত শুধু কি ঘুমায়ে রবে ?

.             ***************  
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
জন্মভূমি
(বীরবাহুর উক্তি, বীরবাহু কাব্য থেকে নেওয়া)
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


মাগো ওমা জন্মভূমি!
আরো কত কাল তুমি,
এ বয়সে পরাধীনা হয়ে কাল যাপিবে |
পাষণ্ড যবনদল
বল আর কত কাল,
নির্দয় নিষ্ঠুর মনে নিপীড়ন করিবে ||
কতই ঘুমাবে মাগো,
জাগো গো মা জাগো জাগো,
কেঁদে সারা হয় কন্যা পুত্র সকলে |
ধুলায় ধূসর কায়,
ভূমি গড়াগড়ি যায়,
একবার কোলে কর, ডাকি গো মা, মা বলে ||
কাহার জননী হয়ে,
কারে আছ কোলে লয়ে,
স্বীয় সুতে ঠেলে ফেলে কার সুতে পালিছ ?
কারে দুগ্ধ কর দান,
ও নহে তব সন্তান,
দুগ্ধ দিয়ে গৃহমাঝে কালসর্প পুষিছ ||
মোরে দিলে বনবাস,
প্রিয়ে আছে কার পাশ,
হায় কত পীড়া পাও, হে সুধাংশু-বদনে !
কোথা বসো, কোথা যাও,
কিবা পর কিবা খাও,
হায় পুনঃ কতদিনে জুড়াইব নয়নে ||


.               ***************                 
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কৌমুদী
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


হাস রে কৌমুদী হাস সুনির্মল গগনে,
এমন মধুর আর নাহি কিছু ভূবনে ;
সুধা পেয়ে সিন্ধু তলে
দেবতারা সুকৌশলে
লুকাইয়া চন্দ্রকোলে :-- লেখা আছে পুরাণে,
বুঝি কথা মিথ্যা নয়,
নহিলে চন্দ্র উদয়,
কেন হেন সুধাময় ব্রহ্মাণ্ডের নয়নে |
আহা কি শীতল রশ্মি চন্দ্রমার কিরণে,
যেখানে যখন পড়ে,
প্রাণ যেন লয় কেড়ে,
ভুলে যাই সমুদয়,
চেতনা নাহিক রয়,
জাগিয়া আছি কি আমি কিম্বা আছি স্বপনে |
আহা কি অমিয়খনি শরতের গগনে !
কিবা সন্ধ্যা কিবা নিশি,
যেই হেরি পূর্ণ শশী,
ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে যাই,
শুধু সেই দিকে চাই,
হেরি পূর্ণ সুধাকরে অনিমিষ নয়নে |
পড়ে কিরণের ঝারা ঢাকি হৃদি বদনে,
যত হেরি সুধাকরে,
হৃদয়ের জ্বালা হরে,
কোথা যেন যাই চলে,
স্বপ্নময় ভূমণ্ডলে,
সংসারের সুখদুঃখ নাহি থাকে স্মরণে ||

.               ***************                 
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
জীবন-সঙ্গীত
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


বলো না কাতর স্বরে,                বৃথা জন্ম এ সংসারে,
এ জীবন নিশার স্বপন,
দারা পুত্র পরিবার                  তুমি কার কে তোমার
বলে' জীব করো না ক্রন্দন |
মানব-জনম সার                       এমন পাবে না আর
বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন |
কর যত্ন হবে জয়                    জীবাত্মা অনিত্য নয়
অহে জীব কর আকিঞ্চন |
করো না সুখের আশ,               প'রো না দুঃখের ফাঁস
জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়,
সংসারে সংসারী সাজ               কর নিত্য নিত্য কাজ
ভবের উন্নতি যাতে হয় |
দিন যায় ক্ষণ যায়,                       সময় কাহারো নয়
বেগে ধায় নাহি রহে স্থির ;
সহায় সম্পদ বল                          সকলি ঘুচায় কাল
আয়ুঃ যেন শৈবালের নীর |
সংসার-সমরাঙ্গনে                          যুদ্ধ কর দৃঢ়পণে
ভয়ে ভীত হয়ো না মানব ;
কর যুদ্ধ বীর্যবান্                       যায় যাবে যাক প্রাণ
মহিমাই জগতে দুর্লভ |
মনোহর মূর্তি হেরে                    অহে জীব অন্ধকারে
ভবিষ্যতে ক'রো না নির্ভর ;
অতীত সুখের দিনে                   পুনঃ আর ডেকে এনে
চিন্তা ক'রে হইও না কাতর |
সাধিতে আপন ব্রত                     স্বীয় কার্যে হও রত
এক মনে ডাক ভগবান ;
সঙ্কল্প সাধন হবে                         ধরাতলে কীর্তি রবে
সময়ের সার বর্তমান |
মহাজ্ঞানী মহাজন                         যে পথে করে গমন
হয়েছে প্রাতঃস্মরণীয় ;
সেই পথ লক্ষ্য ক'রে                    স্বীয়কীর্তিধ্বজা ধ'রে
আমরাও হব যে অমর ;
সেই চিহ্ন লক্ষ্য করে                    অন্য কোনো জন পরে
যশোদ্ধারে আসিবে সত্বর |
ক'রো না মানবগণ                        বৃথা ক্ষয় এ জীবন
সংসার-সমরাঙ্গন-মাঝে ;
সঙ্কল্প করেছ যাহা,                        সাধন করহ তাহা
রত হয়ে নিজ নিজ কাজে |

.               ***************             

আমরা কৃতজ্ঞ জনাব নুরুস সাফার কাছে, কারণ তিনি এই কবিতাটির কিছু ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন।
তাঁর ইমেল -
nurus.safa@gmail.com     

 
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পরশমণি
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


কে বলে পরশমণি অলীক স্বপন ?
অই যে অবনীতলে                        পরশমাণিক জ্বলে
বিধাতা-নির্মিত চারু মানব-নয়ন |
পরশমণির সনে                          লৌহ-অঙ্গ-পরশনে,
সে লৌহ কাঞ্চন হয় প্রবাদ-বচন,---
এ মণি পরশ যায়,                      মানিক ঝলসে তায়,
বরিষে কিরণধারা নিখিল ভূবন |

কবির কল্পিত নিধি                     মানবে দিয়াছে বিধি,
ইহার পরশগুণে মানব-বদন
দেব তুল্য রূপ ধরি'                আছে ধরা আলো করি',
মাটির অঙ্গেতে মাখা সোনার কিরণ |

পরশমণি যদি অলীক হইত,
কোথা বা এ শশধর,                  কোথা বা ভানুর কর,
কোথা বা নক্ষত্র-শোভা গগনে ফুটিত ?
কে রাখিত চিত্র করে                   চাঁদের জোছনা ধ'রে

তরঙ্গে মেঘের অঙ্গে এমন মাখায় ?
কে বা এই সুশীতল                        বিমল গঙ্গার জল
ভারত-ভূষণ করি রাখিত ছড়ায়ে ?
কে দেখা'ত তরুকুল,                   নানা এঙ্গে নানা ফুল,

মরাল, হরিণ,মৃগে পৃথিবী শোভিয়া ?
ইন্দ্রধনু-আলো তুলে                    সাজায়ে বিহঙ্গ-কুলে,
কে রাখিত শিখি পুঞ্জে শশাঙ্ক আঁকিয়া ?
দিয়াছে বিধাতা যাই এ পরশমণি---

স্রগের উপমাস্থল                        হয়েছে এ মহীতল,
সুখের আকর তাই হয়েছে ধরণী !
কি আছে ধরণীর অঙ্গে,                   নয়নমণির সঙ্গে
না হয় মানব চিত্তে আনন্দদায়িনী !

নদীজলে মীন খেলে,                 বিটপীতে পাতা হেলে,
চরে বালুকণা ফুটে, তৃণেতে হিমানী,
পক্ষী পাখে উড়ে যায়,                কীটেরা শ্রেণীতে ধায়,
কঙ্করে তুষার পড়ে, ঝিনুক চিক্কণী |

তাতেও আনন্দ হয়---                   অরণ্য কুজ্ঝটিময়,
জ্বলন্ত বিদ্যুত্লতা, তমিস্রা রজনী |
অপূর্ব মাণিক এই পরশ-কাঞ্চন !
জননী-বদন-ইন্দু                         জগতে করুণা-সিন্ধু

দয়াল পিতার মুখ, জায়ার বদন |
শত শশি-রশ্মিমাখা                    চারু ইন্দীবর-আঁকা
পুত্রের অধর-ওষ্ঠ, নলিন আনন ;
সোদরের সুকোমল,                       স্বসা-মুখ নিরমল,

পবিত্র প্রণয়পাত্র, গৃহির কাঞ্চন---
এই মণি পরশনে                          হয় সুখ দরশনে,
মানব-জনম সার, সফল জীবন |---
কে বলে পরশমণি অলীক স্বপন ?

.               ***************                 
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দেশলায়ের স্তব (সম্পূর্ণ)
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
কালীপ্রসন্ন শর্ম্মা সংকলিত ও সম্পাদিত “হেমচন্দ্র গ্রন্থাবলী” (১৮৬৪) অন্তর্গত “বিবিধ
কবিতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


নমামি বিলাতি অগ্নি দেশলাইরূপী,
গেহখানি চাঁচা ছোলা, শিরে বাঁধা টুপি!
যেমন ডেপুটি বাবু একহারা চেহারা,
মাথায় শালের বেড় --- রাগে দেহ ভরা।

নমামি গন্ধকবন্ধ মুণ্ডটি গোল লো,
সর্ব্বজাতি প্রিয় দেব গৃহ কর আলো,
শান্ত সভ্য অতি ধীর --- চাপে যতক্ষণ,
ধাপে উঠে চটে লাল --- গৌরাঙ্গ যেমন!

নমামি সর্ব্বত্রগামী দারু অবতার,
চৌর্য্য বিঘ্ন-বিনাশন কুটুম্ব টীকার!
নিদ্রিতের গুপ্তচর, পাচিকার প্রাণ,
লম্বাদাড়ি কাবুলীর শিরে যার স্থান!

নমামি [ খদ্যোৎশিখা ] নয়নরঞ্জন,
লালেতে নীলের আভা দিব্য দরশন!
পোয়াতির প্রিয়সখা বালকের অরি,
বিরাজ হে কাষ্ঠদেব কত রূপ ধরি!

প্রণমামি [ জ্বালামুখ ] শুভ্র দেশলাই,
সাহেব গোলাম তব কি কব বাদসাই!
সোণা টিন্ রূপা তামা গায়ে বাঁধা ফিতে,
লাটের পকেটে ওঠো লেডীর ঝাঁপিতে!

নমামি সহজদাহ্য বরষাদমন,
আঁচড়ে কিরণ ধর [ সখের জ্বলন! ]
আখা জ্বলে বিনা ফুঁয়ে বিনা চক্ষে জল,
কাঁদিয়া কাটিয়া তোর গুণে মাগীরা পাগল।

নমামি কলির কীর্ত্তি কাষ্ঠের চকমকি,
তোমার চমকে বিশ্বকর্ম্মা গেছে ঠকি!
বিল, খাল, বন, জল, যেখানেই যাই,
শিরে ভাঁটা সাদা শলা দেখি সেই ঠাঁই।

নমামি নমামি দেব [ পাইন নন্দন, ]
তোমার প্রসাদে হয় সাগরে রন্ধন,
সভ্য জগতের তুমি সোহাগের বাতি,
চুরুট ভক্তের মোক্ষ পদার্থ বিলাতি!

নমামি [ ফর্ফর ] শব্দ নাসিকা পীড়ন,
ধনীর নিকটে তুচ্ছ, কাঙালের ধন!
সন্ধ্যার সোণার কাটি, জোছনার ছবি,
ব্রহ্মার পঞ্চম মুখ, [ ব্রাইয়ন্টে রবি! ]

নমামি [ কিরণদণ্ড ] কোপন-স্বভাব,
রাজগৃহ চালাঘরে সমান প্রভাব!
সিন্ধুজলে, পথে, মাঠে, গাড়ি, ঘোড়া, রেলে,
সকলে তোমায় পূজে সূর্য্য শশী ফেলে!

ভিখারী কুটীরে সুখী, ভীরুতে সাহসী,
তব বলে খোঁড়া খাড়া, বুড়ীরা ষোড়শী!
বাঞ্ছাকল্পতরু তুমি সাহস-তারণ,
দীনবন্ধু তবগুণ কে করে কীর্ত্তন॥

প্রণমামি খর্ব্বদেহ অন্ধকারহারি!
নমামি অশেষরূপ অবনি-বিহারি!
নমামি মোমের ডাঁটি “ফস্ফয়ে”তে মলা!
উনবিংশ শতাব্দীর অনলের শলা!
তবগুণে, গুপ্ততাপ, তৃপ্ত জগজন।
প্রণমামি দেশলাই দেবের ইন্ধন!

.               ***************                 
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর