কবি জয়ন্ত মণ্ডলের কবিতা
*
হতেও পারি
কবি জয়ন্ত মণ্ডল

এবার তোমার পাষাণ বুকে ঝরনা হবো
অহংকারের পাঁচিল-ভাঙা হড়পা বানে,
চোখ ভেজাবে পাথর-চেরা পাগলা-ঝোরা -
ভাসিয়ে দেবো প্রেম-পিয়াসী স্রোতের টানে l
হতেও পারি তোমার বুকে রামধনু রং -
আধেক চাঁদের বৃষ্টি-ভেজা মিষ্টি হাসি ,
মেঘের পিঠে একখনি দাঁত নোঙর ফেলে -
জোছনা মেখে বলবো-তোমায় ভালোবাসি l
হতেও পারি তোমার মনের কালবোশেখী -
বজ্র-আটন ফসকা-গেঁরোর বাঁধন খুলে,
ছড়িয়ে দেবো ঈষাণ কোণের পাগলা সাহস -
পরাগমেখে কাঁপতে থাকা জঙ্ঘামূলে l
হতেও পারি তোমার চোখে বৃষ্টি ফোঁটা
হটাত্ যদি হৃদয় ফেড়ে বর্ষা নামে ,
পোশাক ছেড়ে উদোম দেহে দখল নেবো -
যেতেও রাজী ভরদুপুরে জাহান্নামে l

.          **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অকাল বোধন
কবি জয়ন্ত মণ্ডল

আমার ডালপালায় চল্লিশের নিস্তব্ধতা
আর শেকড়ে গভীরতার ভার ,
তবু নিয়মিত নিয়ম ভেঙে,
সময়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে
ফুলশয্যার লজ্জা-রাঙা বুকে
সে পেতে চায় সদ্য ফোটা ফুলের অস্পষ্ট সুগন্ধ l
ছল্লিশটা বোশেখে পোড়-খাওয়া বুকের
অসতর্ক ওঠা-নামা নির্লজ্জের মতো লুকোচুরি খেলে ,
একদিকে নিষ্ঠুর সময় আর
অন্যদিকে আঠারোর পদধ্বনি
আমাকে নিয়ে মেতে ওঠে
দড়ি টানাটানি খেলায় -
ভিতর থেকে সঙ্গত প্রশ্ন ওঠে -
কোন দিকে যাবি ?
উত্তর দিই -
.             চলুক না অকালবোধন !

.          **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রতীক্ষা
কবি জয়ন্ত মণ্ডল

পনেরো বছর আগের সেই বৃষ্টি
কাল রাতে আমাকে ভিজিয়েছে -
দুচোখের সুনীলে-
কোনো এক প্রাক্ বসন্তে বলেছিল সে -
'অপেক্ষা কোরো '
তারপর যখন আমার অপেক্ষারা ক্লান্ত
তার পেয়ালায় তখন তরল চোখ
বাসা বদলের গানে উত্সুক্ ,
কাঙাল ভাবনা গুলো
নির্বাসিত হয়েছিল চিরদিনের জন্য ,
পরাক্রান্ত ইচ্ছের মতো কালরাতে
আবার তোমার রাজ্যের সম্রাট হলাম;
তুমি এলে মর্মর-প্রলিপ্ত মিষ্টি শব্দেমত
হাজার চাঁদের দাক্ষিণ্যে ভরপুর ,
কোথায় ছিলে এতো দিন ? - এ প্রশ্ন অবান্তর -
কী হবে চরিত্রহীন সময়ের হিসেব !
ভাঙলাম তোমার বুকের স্পন্দন -
আমি তখন তোমার সাগরে
হালভাঙা নাবিক -
একসময় শেষ প্রহের পৌরুষ কেড়ে
ঘুমিয়ে পড়লো সব মদিরতা -
গতকালের ঘুম-ছেঁড়া রাতের মতো
তুমি উড়ো চিঠির মতো আসবে
আমার শাশ্বত পিপাসায় -
এবার প্রতীক্ষা আর একটি রাতের l

.          **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
হিরোশিমা, জীবন্ত ক্ষত
কবি জয়ন্ত মণ্ডল

পরনে শতচ্ছিণ্ণ কাপড় -
আবরণ বললে ভুল হবে ,
চর্ম-মাংসহীন জীবন্ত কংকাল -
বয়সের ভারে শির-দাঁড়া বেঁকেছে ;
থাকার মধ্যে কুচকুচে কালো দুটি চোখ,
সরীসৃপের মতো চলছে
শ্যামবাজারের ফুটপাতে ;
এ দৃশ্য সকলের পরিচিত ,
তার লুপ্তপ্রায় নামটা ছিলো পিংকি -
আপনারা চমকে যাবেন না !
পিংকির একটা ইতিহাস আছে ;
ঘুমিয়ে আছে হিরোশিমার বাক্সবন্দী ফাইলে -
মা মরা মেয়েটার সব ইচ্ছে রেখেছিল
বাবা সুখেন কেরানী ,
পিংকি বলতো -
বাবা দেখো ,'' আমি মস্ত বিজ্ঞানী হবো ''
আশা অপূর্ণ থাকেনি -
প্রেসিডেন্সি থেকে ফিসিক্সে স্নাতক ,
তারপর জাপানি কম্পানির টেকনিকাল ম্যনেজার হয়ে -
জাপানে পাড়ি দিয়েছিল পিংকি ,
টকুয়ামাতে পরিচয়  তোজোর সাথে  -
ছেলেটি মিট্সুবিসি কম্পানিতে আছে ,
তখন শান্তির প্রয়াসে জল ঢেলে
চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি -
তোজোর শক্ত হাত ধরে
পিংকিও নিচ্ছিল ঘর বাঁধার প্রস্তুতি -
নানা আছিলায় চলে আসত তোজো -
পিংকির হাত ধরে চিতকার করে বলতো -
''আইসিটে ইমাসু , আইসিটে ইমাসু ''
আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি !
সে শব্দ ছোট্ট বিহোকু পাহাড় কাঁপিয়ে
প্রতিধ্বনিত হতো পিংকির হৃদয়ে ,
পাহাড়ের নির্জন প্রান্তে গোল্সু হ্রদের পাশে, তারা ঘর বেধেছিল -
কুড়িয়ে ছিলো পৃথিবীর সব সুখ -
তাদের অনুরাগের আঁতুড় ঘরে
এসেছিল নাকামা ;
ছোট্ট ফুটফুটে আদরের কন্যা -
তাদের প্রেমের সন্জিবনী সুধা ,
পিংকির সুগন্ধি বুকে তখন
পদ্মপাতার শিহরণ , আর
সবুজ ফসলের পুষ্টতার মতো
কোলজুড়ে নাকামার হাস্যময়তা -
1942সালের 5ই আগস্ট , সকাল -
হটাত্ টেলিগ্রাফ আসে -
বাবার মৃত্যুর খবরে হু হু করে ওঠে বুকটা -
এই প্রথম সে মায়ের অভাবও অনুভব করলো -
জাহাজে রওনা দিল সে -
6 ই আগস্ট -
সাজানো হিরোশিমা তখন ঘুমন্ত ,
ঘুমিয়ে ছিলো ছোট্ট নাকামা
তোজোর বিশ্বস্ত বুকে মাথা রেখে ,
ভোরের আলো-আঁধারি ওড়না ছিঁড়ে,
হটাত্ লক্ষ রং মশালের ঝলকানি আর
কোটি জয়ঢাকের কোরাস -
আমেরিকান বোমা পড়লো ;
শ্রেষ্ঠত্বের লেটেস্ট নিদর্শন -
মুহূর্তেই সমস্ত শহরটাই আগুনের দলা- লক্ষ মানুষ পেলনা মৃত্যু-যন্ত্রণার সময়-
আগুনে মেঘে প্রসবের আগেই
হারিয়ে গেলো সূর্য -
আর পুতুলের মতো নাকামা !
মৃত্যুর আগে আগুনে বাতাসে
গলাটা শুকিয়ে এসেছিল -
তার পোড়া হাত শেষবারের মতো
মায়ের জন্য আকুল হয়েছিল -
তোজোর ঝলসানো চোখে হয়তো
শেষবারের মতো জল ঝরেছিল তার
প্রিয়তমার জন্যে -
বাপ মরে গিয়ে বাঁচিয়ে গেলো পিংকিকে , কিন্তু মরে গেলো প্রেম -
মরে গেলো স্নেহ - মায়া - মমতা -
মেয়েটা সেই নারকীয় অতীত আঁকড়ে
আজও পড়ে আছে -
শ্যামবাজারের ফুটপাতে ,
চোখের জল আর ঝরেনি -
বোধ হয় শুকিয়ে গিয়েছিল !
কথা সে আর বলেনি -
বোধ হয় চিরতরে হারিয়ে গেছে !
শুধু নাকামার কথা ভেবে যখন
শুকনো বুকটা টনটন করত ,
তখন রেল লাইনে বসে
একটা ছাগল-ছানাকে রোজ
বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করত ,
তাই সে আজ পাগলী -
আজ হিরোশিমার সেই ভোর
শত শত পিংকির জন্ম দিয়েছে -
ছি ! তোমরা সভ্যতার বড়াই করো !
এতো পশুত্ব ছিলো তোমাদের মনে
যে , মায়ের কোল শূন্য করে উল্লসিত হও !
ওহে যুদ্ধবাজ , তোমাদের
মানুষ বলে অপরাধী হতে চাই না ,
জানোয়ার তোমাদের দেখে লজ্জা পাবে -
গল্প আমার শেষ-
যুদ্ধ থেমেছে -
শান্তি সংঘ এসেছে -
এসেছে শান্তির বার্তা -
Oh my son ! stop thy storm , Never , Never blood - sheed ,
Let the life live ,
Let them breathing fresh ;
Don't stab me further ,
Don 't , Don't , Don't !
পাগলীটা আজও ঘোরে ফুটপাতে , আর সভ্য সমাজকে অব্যক্ত ভাষায় বলে -
''আমি জাপানি নই , আমেরিকান নই , ভারতীয় নই -
আমি বাঁচতে চাওয়া মানুষ -
আমি তোজোর প্রেমিকা -
আমি ছোট্ট নাকামার স্বর্গ -
ফিরিয়ে দাও আমার অতীত -
তোমরাই কেড়েছো, তোমরাই ফিরিয়ে দাও !
কে শোনে তার কথা !
কে বোঝে তার ভাষা !
সবাই জানে -
সে একজন ভবঘুরে পাগলী l

.          **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর