পনেরো বছর আগের সেই বৃষ্টি কাল রাতে আমাকে ভিজিয়েছে - দুচোখের সুনীলে- কোনো এক প্রাক্ বসন্তে বলেছিল সে - 'অপেক্ষা কোরো ' তারপর যখন আমার অপেক্ষারা ক্লান্ত তার পেয়ালায় তখন তরল চোখ বাসা বদলের গানে উত্সুক্ , কাঙাল ভাবনা গুলো নির্বাসিত হয়েছিল চিরদিনের জন্য , পরাক্রান্ত ইচ্ছের মতো কালরাতে আবার তোমার রাজ্যের সম্রাট হলাম; তুমি এলে মর্মর-প্রলিপ্ত মিষ্টি শব্দেমত হাজার চাঁদের দাক্ষিণ্যে ভরপুর , কোথায় ছিলে এতো দিন ? - এ প্রশ্ন অবান্তর - কী হবে চরিত্রহীন সময়ের হিসেব ! ভাঙলাম তোমার বুকের স্পন্দন - আমি তখন তোমার সাগরে হালভাঙা নাবিক - একসময় শেষ প্রহের পৌরুষ কেড়ে ঘুমিয়ে পড়লো সব মদিরতা - গতকালের ঘুম-ছেঁড়া রাতের মতো তুমি উড়ো চিঠির মতো আসবে আমার শাশ্বত পিপাসায় - এবার প্রতীক্ষা আর একটি রাতের l
পরনে শতচ্ছিণ্ণ কাপড় - আবরণ বললে ভুল হবে , চর্ম-মাংসহীন জীবন্ত কংকাল - বয়সের ভারে শির-দাঁড়া বেঁকেছে ; থাকার মধ্যে কুচকুচে কালো দুটি চোখ, সরীসৃপের মতো চলছে শ্যামবাজারের ফুটপাতে ; এ দৃশ্য সকলের পরিচিত , তার লুপ্তপ্রায় নামটা ছিলো পিংকি - আপনারা চমকে যাবেন না ! পিংকির একটা ইতিহাস আছে ; ঘুমিয়ে আছে হিরোশিমার বাক্সবন্দী ফাইলে - মা মরা মেয়েটার সব ইচ্ছে রেখেছিল বাবা সুখেন কেরানী , পিংকি বলতো - বাবা দেখো ,'' আমি মস্ত বিজ্ঞানী হবো '' আশা অপূর্ণ থাকেনি - প্রেসিডেন্সি থেকে ফিসিক্সে স্নাতক , তারপর জাপানি কম্পানির টেকনিকাল ম্যনেজার হয়ে - জাপানে পাড়ি দিয়েছিল পিংকি , টকুয়ামাতে পরিচয় তোজোর সাথে - ছেলেটি মিট্সুবিসি কম্পানিতে আছে , তখন শান্তির প্রয়াসে জল ঢেলে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি - তোজোর শক্ত হাত ধরে পিংকিও নিচ্ছিল ঘর বাঁধার প্রস্তুতি - নানা আছিলায় চলে আসত তোজো - পিংকির হাত ধরে চিতকার করে বলতো - ''আইসিটে ইমাসু , আইসিটে ইমাসু '' আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ! সে শব্দ ছোট্ট বিহোকু পাহাড় কাঁপিয়ে প্রতিধ্বনিত হতো পিংকির হৃদয়ে , পাহাড়ের নির্জন প্রান্তে গোল্সু হ্রদের পাশে, তারা ঘর বেধেছিল - কুড়িয়ে ছিলো পৃথিবীর সব সুখ - তাদের অনুরাগের আঁতুড় ঘরে এসেছিল নাকামা ; ছোট্ট ফুটফুটে আদরের কন্যা - তাদের প্রেমের সন্জিবনী সুধা , পিংকির সুগন্ধি বুকে তখন পদ্মপাতার শিহরণ , আর সবুজ ফসলের পুষ্টতার মতো কোলজুড়ে নাকামার হাস্যময়তা - 1942সালের 5ই আগস্ট , সকাল - হটাত্ টেলিগ্রাফ আসে - বাবার মৃত্যুর খবরে হু হু করে ওঠে বুকটা - এই প্রথম সে মায়ের অভাবও অনুভব করলো - জাহাজে রওনা দিল সে - 6 ই আগস্ট - সাজানো হিরোশিমা তখন ঘুমন্ত , ঘুমিয়ে ছিলো ছোট্ট নাকামা তোজোর বিশ্বস্ত বুকে মাথা রেখে , ভোরের আলো-আঁধারি ওড়না ছিঁড়ে, হটাত্ লক্ষ রং মশালের ঝলকানি আর কোটি জয়ঢাকের কোরাস - আমেরিকান বোমা পড়লো ; শ্রেষ্ঠত্বের লেটেস্ট নিদর্শন - মুহূর্তেই সমস্ত শহরটাই আগুনের দলা- লক্ষ মানুষ পেলনা মৃত্যু-যন্ত্রণার সময়- আগুনে মেঘে প্রসবের আগেই হারিয়ে গেলো সূর্য - আর পুতুলের মতো নাকামা ! মৃত্যুর আগে আগুনে বাতাসে গলাটা শুকিয়ে এসেছিল - তার পোড়া হাত শেষবারের মতো মায়ের জন্য আকুল হয়েছিল - তোজোর ঝলসানো চোখে হয়তো শেষবারের মতো জল ঝরেছিল তার প্রিয়তমার জন্যে - বাপ মরে গিয়ে বাঁচিয়ে গেলো পিংকিকে , কিন্তু মরে গেলো প্রেম - মরে গেলো স্নেহ - মায়া - মমতা - মেয়েটা সেই নারকীয় অতীত আঁকড়ে আজও পড়ে আছে - শ্যামবাজারের ফুটপাতে , চোখের জল আর ঝরেনি - বোধ হয় শুকিয়ে গিয়েছিল ! কথা সে আর বলেনি - বোধ হয় চিরতরে হারিয়ে গেছে ! শুধু নাকামার কথা ভেবে যখন শুকনো বুকটা টনটন করত , তখন রেল লাইনে বসে একটা ছাগল-ছানাকে রোজ বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করত , তাই সে আজ পাগলী - আজ হিরোশিমার সেই ভোর শত শত পিংকির জন্ম দিয়েছে - ছি ! তোমরা সভ্যতার বড়াই করো ! এতো পশুত্ব ছিলো তোমাদের মনে যে , মায়ের কোল শূন্য করে উল্লসিত হও ! ওহে যুদ্ধবাজ , তোমাদের মানুষ বলে অপরাধী হতে চাই না , জানোয়ার তোমাদের দেখে লজ্জা পাবে - গল্প আমার শেষ- যুদ্ধ থেমেছে - শান্তি সংঘ এসেছে - এসেছে শান্তির বার্তা - Oh my son ! stop thy storm , Never , Never blood - sheed , Let the life live , Let them breathing fresh ; Don't stab me further , Don 't , Don't , Don't ! পাগলীটা আজও ঘোরে ফুটপাতে , আর সভ্য সমাজকে অব্যক্ত ভাষায় বলে - ''আমি জাপানি নই , আমেরিকান নই , ভারতীয় নই - আমি বাঁচতে চাওয়া মানুষ - আমি তোজোর প্রেমিকা - আমি ছোট্ট নাকামার স্বর্গ - ফিরিয়ে দাও আমার অতীত - তোমরাই কেড়েছো, তোমরাই ফিরিয়ে দাও ! কে শোনে তার কথা ! কে বোঝে তার ভাষা ! সবাই জানে - সে একজন ভবঘুরে পাগলী l