কবি জোহরা উম্মে হাসান-এর কবিতা
*
লখমী
কবি জোহরা উম্মে হাসান

অনেক দিন বাদে সূর্যটা যখন মেঘের সাথে ভাব কোরেছে
নরম নরম আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে সবুজ পাতা ভরা কদম গাছটার
তল, তখন লাল ডুরে শাড়ি কালো দুচোখ শ্যামল মেয়েটির
মনটা বেজায় ফুরফুরে ! রোদের তেজ কম হলে নিশ্চিন্তে
কাজ করা যায় বটে !

যদিও তাঁর নাকের ডগায় রোদা রোদা ঘাম , সিঁদুর লাল
টিপ গলে গলে ঝরে পড়ছে বুকের তলায় , তবুও আজ অনেক দিন
পর মেঘের ছায়া ! চারপাশে ছড়ানো টুকরো টুকরো ভাঙ্গা লাল রঙ
ইটের গাদা  বেড়ে বেড়ে ছোট্ট পাহাড়ি টিলার মতো
হয়ে  যাচ্ছে  ধীরে ধীরে!

কয় ঝুড়ি ইট ভাঙ্গলি রে আজ লখমি - কুমীর মুখো লোকটার
রাত দিন খবরদারী আর যত ঘুর ঘুর মেয়ে মজুরদের আশে
পাশে ! কাজের  অছিলায় সে ঘুরে ফিরে মেয়েদের শরীরের
চঞ্চল উঠানামায় মনে মনে আঁচর কেটে কেটে একসময়
হতাশ হয়ে  ফেরে যেন!

একহাতে টিপসহি অন্য হাতে মজুরি- এই তো চলে
প্রতি সন্ধ্যায় । মেয়েদের মজুরি কম তবে সুরকির ঝুরি গোনার
হিসেব একই ! টাকা মিটিয়ে দিতে অনেকক্ষণ মেয়েদের
শরীরের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ ঐ  লোকটির ! আজও
তার ব্যতিক্রম হলোনা ! তবে   বিশ টাকা কাঁটা গেল
আজ লখমির-কারণ সে সারাদিন কেবলি একমনে
কাজ করছিলো !

.                   ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নয় ক্যামেলিয়া
কবি জোহরা উম্মে হাসান

অরন্যের আদি অকৃত্রিম সৌন্দয নিয়ে যে মেয়েটি আমার দরজায় এসে  দাঁড়িয়েছিল
সেদিন-
তাঁকে হঠাৎ করে দেখতে পেয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না ।
পরনে তাঁর গোলাপ রং শাড়ি দু হাঁটুর উপরে দোল খাওয়া । গায়ে দোপাটি নীল
ছুঁইছুঁইখাটো হাতা ব্লাউস !
কৃষ্ণ কালো দীঘল চুল খোঁপার বন্ধনে বাঁধা উঁচু করে!
গলায় রুপোর সরু হার, নাকে ভারি নাকছাবি কানের লতি জুড়ে টুকরো বন ফুল !
তাঁকে দেখে সত্যি সত্যি থমকে গেলেম ! ইট –পাথরের এই মরুময় শহরে সে যেন বড়ই
বেমানান !
বড়ই বেমানান সে !

আমার  চোখের ভাষা চটজলদি পড়ে নিয়ে বাড়ীর দারোয়ান সাহস করে বললে -
মেম সাহেব, কাজ করার জন্য মানুষ চেয়েছিলেন
পথ দিয়ে যাচিছল , ধরে নিয়ে এলাম !
আমার সে মুহূর্তে বাহিরে যাবার বেজায়
তাড়া ছিলো ।লেবারদের মান্থলি স্যালারি দিতে হবে,
সামনে ফ্যাকটরির বোর্ড মিটিং , নতুন দুজন বায়ারের সাথে মিট করতে হবে ইত্যাদি ,
ইত্যাদি !
তাই ছুটতে হবে গাজীপুর ! জ্যাম, সময় ওয়েদার এসবের কথা মনে পরতেই
বেশ একটু কঠিন সুরেই দারোয়ানকে বললাম-
তুমি জানো না ফ্যাকটরিতে যাবার সময় আমি বাহিরের কাউকে এন্টারটেইন করি না ?

ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট !
মেয়েটি ভয়ে ভয়ে দাড়ালো গিয়ে দেয়ালের গভীর বুক জুড়ে। দারোয়ানের ভয়ার্ত দু চোখ !
এসব আড়চোখে দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত তৃপ্তিবোধ  নিয়ে বসলাম গাড়ির
পেছনের সিটে ।

পথচলা শুরু হলে , নির্ভার মনটা হঠাৎই যেন
প্রশ্ন কোরল নিজেকে- ঐ দেহাতি মেয়েটির অপার  সৌন্দরযের কাছে  হার মেনেই কি
একটু বেশী কঠিন হোয়ে গেলেম আজ ? মন বললো -হবে হয়তো , হয়তো বা না ------!

চলতে চলতে গাড়ির জানালার কাঁচ গড়িয়ে দেখি , যুবক দারোয়ান একটা হলুদ গাঁদা গুঁজে
দিচ্ছে মেয়েটির দোলন খোঁপায় । বড়ই কষ্ট পেলাম মনে -
আহা , মেয়েটি ক্যামেলিয়া হতে পারতো ,না হয়ে হোল করুন গাঁদা ফুল !!

.                         ****************                  
            
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
মে দিবস
কবি জোহরা উম্মে হাসান

আজ মে দিবস! আজ সত্যি সত্যি
অন্য রকম দিন! মহাব্যস্ত সাহেব আজ মিল- ফ্যাক্টরি বাদ দিয়ে
বন্ধু-বান্ধব,  ক্লাব পার্টি, বার ইত্যাদি নিয়ে  ব্যস্ত থাকবেন ।
গাড়ি  ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজেই হাঁকাবেন সাধের লেটেসট  মডেলের গাড়ি !
মেমসাহেব তাঁর হিসেব টানা ডায়েটিং,  বিউটি এন্ড স্পা  ক্লাব
ইত্যাদি বাদছাদ দিয়ে আজ মহাব্যস্ত  দিন কাটাবেন মিটিং , মিছিল , সভা, সমিতি,
টিভি শো ইত্যাদি নিয়ে ! এসব  সবের  জন্য অবশ্য মেমসাহেবের   
চাই আলাদা রকম সাজ পোশাক,  কেশবিন্যাস, মেকআপ !   
তাঁর সাথে  রপ্ত করা  আলাদা রকম
কথা বার্তা , ভাব-সাব  ,  অঙ্গ –ভঙ্গি ইত্যাদি , ইত্যাদি !   
জয়তুন এসব দেখে আর ভাবে - আহা , মেম আম্মা যা পরে
তাতেই তাকে কত না মানায়! আয়নায় দাঁড়িয়ে সাদা–কালো সুতি শাড়ীর কুচি
ঠিক করতে করতে
মেম আম্মা হাসি হাসি মুখে  জিজ্ঞেশ করে -
কেমন লাগছে রে আমাকে জয়তুন , মানাচেছ ? আহা, কি বলবে জয়তুন
মেম সাহেবের মতো সুন্দরি এ তল্লাটে নাই , তাঁর রুপে পাগল হয়েই
নাকি সাহেব পরথম বিবিকে ছেড়ে ------- ! যাকগে সেসব শোনা কথা
পাগলে কিনা কয়  আর ছাগলে কিনা খায় ------! জয়তুন বিড়বিড় করে !
মেম আম্মার আজ মন মেজাজ খুব ভালো , অন্য দিন হলে  অবশ্য জয়তুনকে
এ ধরনের সামান্য  অন্যমনস্কতার জন্য  অনেক খেশারত দিতে হতো বৈকি !
মেম সাহেবের কত ক্ষমতা , তয়  জয়তুনের মনের ভিতর  যাওয়ার  ক্ষমতাতো
তাঁর নাই  ।  থাকলে কি হতো ?    জয়তুন বিড়বিড় করে , আর মনে মনে
সাহেবের বড় বিবির পক্ষ নিয়ে , কয়েক দফা বকা ঝকা করে
মেম সাহেবকে , সাহেবও  বাদ পরে না !

মেম আম্মার হাতে সুন্দর গোটাগোটা অক্ষরে সাজানো কথামালা-
সাহেবই দিয়েছে লিখে কাল রাতে !  শ্রমিকের দাবিতে ভরা  কতশত
প্রতিশ্রুতি দেয়া  সে সব কথা ! আট ঘণ্টা কাজ , ন্যায্য মুজুরি
বেতন, ভাতা ,  চিকিৎসা , ঘর, বাড়ি ,  অবসর , বিনোদন ----- কত আরও
কত কি ! জয়তুন এসবের সবটা বোঝে না ! তবে বেশ বুঝতে পারে
বেগম আম্মার  কথার   জোরে কাল থেকে
নির্ঘাত  সাহেবের  কারখানার গরীব  মানুষগুলোর  ভাগ্য যাবে পালটে !

কি বলিস রে জয়তুন বিড়বিড় কোরে , কি বলিস ? মেম আম্মা জিজ্ঞেস করে ।
জয়তুন তাঁর পান জরদা মাখা ভাঙ্গা দু গাল ঠেলে মিন মিন করে বলে-
আম্মাগো, কাইল থাইকা আমারে সাহেবের কারখানায়  একডা শ্রমিকের
চাকরি দিয়া দেবেন ------?

.                         ****************                  
          
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কফি ক্যাপিচিনো সন্ধ্যে
কবি জোহরা উম্মে হাসান

তেমন কিছু নয় - এক কাপ কফি খাওয়ার
বড় সাধ হয়েছিলো তাঁর , মনের মানুষের সাথে
আলো ঝলমল কোন এক সন্ধ্যেয় !
তাঁর মতো ভালবাসা ফেরি করে ফেরে  যে সব ক্ষয় ধরা তরুণীঁ
রাত্রি-দিন হেথা হোথা তাঁদের  জন্য
এ এক অদ্ভুত ইচ্ছা বটে !
ছুঁই- ছুঁই আঁধারে , পথে ঘাটে মেকি ভালবাসার খেলা
খেলতে খেলতে বড় কালন্ত, অবসন্ন হোয়ে পরেছিল
সে  , তাই কেবলি ছোঁয়া পেতে চেয়েছিল একটু
মুগ্ধতার ! হোক ভাড়া করা ক্ষণিক মুগ্ধতা !

সে বসেছিল একাকী, কেবলি প্রতীক্ষায়
সেই সন্ধ্যেয় ! পরনে  তাঁর লাল বাহারি শাড়ি
গলায় নকল মুক্ত-মালা, ঝুলানো দুল
হাতে লাল গোলাপ , আর দু চোখ জুড়ে প্রতীক্ষা ভালবাসার !
চিনিচিনি বলে চিনে নেয় তাঁকে, রেস্তোরার
লাল শার্ট বেয়ারা । এখানে এলে খাবার খেতে হয়
বলে দেয়-  আর  ফিস ফিস কোরে  চলে যেতে বলে
বেমানান , বেমানান বড় সে, আলো ভরা এই জলশায়  ।

কফি,  কফি ক্যাপিচিনো ! আসে , সাথে
ধুমায়িত মাগ, সাদাকালো ফুল আঁকা
কিন্তু তার মনের মানুষ ?  সন্ধা গড়িয়ে রাত হয়
রাত গড়িয়ে একটু একটু  কোরে বাড়ে রাত !
কফি ক্যাপিচিনো শীতল  থেকে হয় শীতলতর,তিক্ত, বিস্বাদ !
ধীরে ধীরে তা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে তাঁর ঘুম ঘুম
শরীরে,শাড়ির আঁচলে, নকল মুক্তো-মালায় ।
তারপর লাল শার্ট বেয়ারা এক ফাঁকে তাঁকে ঠেলে ফেলে দেয়
রেস্তোরার ফাঁকা সুড়ঙ্গ পথ পেরিয়ে রাজ পথে
পেছনে পড়ে রয় সন্ধ্যে রাতের কফি ক্যাপিচিনো !

.                         ****************                  
        
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
লছমী
কবি জোহরা উম্মে হাসান

লছমিরে দান লিবি ত পরান খুইলে কথা কইবি না ?

সে কথথা বইল্ব কি পকারে করতা ? উ যে ছাত ছাতটা মাসের পুয়াতি। প্যাটে ওর ছাত
মাসের ছোল !

ছোল ? ছোল কিসের রে ব্যাটা ? তুই কি জানিস , তর বুয়ের চ্যালা হবে কি মেয়েয়ে?
ব্যাটা গরধপ? ক্যাবল মজা লুটিস বউয়ের কামাই খেয়েয়ে!

হ করতা। মাথা নাড়ে বারে বার লছমির স্বামী । করতা মানুষ ত নয় দেব্বতা!

তুর বুউরে কথা কইতে দে ব্যাটা । শুনিছ নাই -
ছরকারের যত মাথথা ব্যথা এই তুদের মত মানুছদের নিয়ে । এই তুর বহুদের মত
মেয়েমানুষদের নিয়ে।কথথা কইতে দে উদেরকে ! মনের জত্ত কথথা!

হ করতা। মাথা নাড়ে বারে বার লছমির স্বামী । করতা মানুষ ত নয় দেব্বতা!

এ লছমী –তু ত এবার কিচু বুল । বুবা হয়ে গেলি নাকি রে !বুবা হয়্যা গেলি
ত দান নিবি কি করে ? দান নিবি ত পরান খুলে কথা কইবি না । আচ্ছা কথথা
না কইতে ইচ্ছা করে ত একডু হাছ । একডু হাচ পরআন খুলে ।
প রান ভ ইরা দেখি !

করতা ,উহার প্যাটে ----!

থামত ব্যাটা , প্যাট প্যাট কইরা কত উছিলা দিবি । তু কি বানরের প্যাটে হহইয়াছিস?
মাটির প্যাটে ? নদ্দীর প্যাটে ? এই লছমীর মতই ত মাইইয়া মানুস ছিল তর মা !

মুর মা ? সে ত ঢের ঢের ছুন্দরি ছিল করতা। কুত্থ্যায় লছমী  আর কুত্থ্যায় মোর মা!রাম
রাম  স্বর্গাসীন মায়ের উদ্দেশ্যে বার কয়েক কপালে হাত ঠেকায় লছমির স্বামী !

তুর বুবা বহুকে লয়ে তুই ঘর যা ব্যাটা । ঘর জা । কথা না কইলে , হাছি না দিলে
পয়াতির কে খেতি হয় , বুজা উকে !

এই লছমী, লচমী! তুই কথা ক। হাছ। করতার কথা গায়ে লাগে না তর? ডর লাগে না?

লছমী কথা কয় না। হাসে না। সাত সাতটা মাসের পুয়াতি সে।

.                         ****************                  
      
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বুক জুড়ে কেবলি হলদিবাড়ী
কবি জোহরা উম্মে হাসান

ট্রেনটা ছুঁই ছুঁই গন্তব্য পার্বতীপুর রেলওয়ে ষ্টেশন
এরপর হলদিবাড়ী ২২/এক , ব্যাস এটুকুই । তারপর
ভাবনা বদল , টিপ টিপ চলতে চলতে এই তো আর
বড়জোড় আর কয়েক মিনিট , পার্বতীপুর রেলওয়ে ষ্টেশন
গন্তব্য হলদিবাড়ী ২২/এক , ব্যাস এটুকুই !

তেমন কিছুই নেই সাথে, হাতে ধরা ব্যাগ , কিনবা সুটকেস
চামড়ার ! কাঁধে ঝোলানো অজন্তা ব্যাগ বড়জোড় শান্তিপুরী
স্লিপারে পাছে লেগে যায় পাড় শাড়ীর, তাই তাড়াহুড়া বাদ
আলতো খোঁপা নয় বাহারী , তারপরও খুলে উঁচিয়ে বাঁধা
ঝুমকো লতায় আটা কাঁটা!

গন্তব্য হলদিবাড়ী ২২/এক , সারি সারি মানুষ নেমে যায় একে একে
কত রঙ , কত ঢং , কত সাজ, হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকি । তাঁকেই কেবল
চেনেনা কেউ , শুধুই একজন যে থাকে হলদিবাড়ী ! সিঁড়ি দুই কিংবা
তিন । এরপর লাল ইট বুকে বিশাল প্লাটফর্ম , এপার ওপার
যায় না দেখা লোকের ভিড়ে । মানুষের সমুদ্দুর । যাওয়া আসা
যেন জোয়ার ভাটার খেলা , সারা বেলা !

রেল বাবুর কামরা একটু এগোলেই , ভয়ানক ব্যস্ত । যেন তাঁর
চোখের সামনে রাহুটা । গাড়ীটাকে কাঁটা ধরে না তাড়ালেই নয় !
লাল ঝাণ্ডা , খাকী প্যান্ট , সাদা কোট চোখে চশমা পাশেই । সন্ধ্যে
ছুঁইছুঁই , একে একে জ্বলে উঠে আলোর পাখিরা । রাতের তারারা যেন
অগুন্তি জ্বলে আর নেবে , রেলের আকাশ মাথার উপরে!

কমলা ঝুড়ি কাঁধে দেহাতি নারী , ছোকরা বুট বাদাম গলে বাবড়ী চুল
জুতা পালিস লাল কালো কালি ঢিব্বা ওয়ালা, পা নুলো ভিখিরি , ক্লান্ত কয়লা
শ্রমিক, আলো আঁধারিতে বারোয়ারী নারী আর মিলিত হাসি ফিক ফিক ।
যৌবন ছুঁই ছুঁই বালক বালিকা, চাপা জিন্স ট্রেট্রন যুবক , ঘোমটা বধূ
এক দুই তিন রাবনের দলবল ।

হলদিবাড়ী ২২/এক । লোহার গেট , এক পাশে টিকিট চেকার
উল্টায় পালটায় টিকিট দ্বিতীয় শ্রেণী। দেরী করে যেমন সচারাচর
করে পুরুষ মন্থন নারী ছল ছুতোয় ।এরপর দুই চাকা রিক্সা
অথবা চারচাকা টেম্পো গাড়ী, আগ্রহ মুখ ক্লান্ত চালক
উথসুক পথচারী , হলদিবাড়ী ২২/এক তাঁর বাড়ী !

ঠিকানাটা হাতে লেখা , দেখে দেখে বারে বারে জীর্ণ পাতা
কালি অস্পষ্ট ফ্যাঁকাসে , নিজের মতো যেন ! অন্ধকার অচেনা পথ
আলো আধারী ইটের বাড়ী সার সারি , নিস্তেজ বটের পাতা । বাতাসে
দোল খায় অদেখা নারীর শাড়ী , বেলোয়ারী ! হলদিবাড়ী
২২/এক সে কোন বাড়ী ?

সে কি এখনও সেই ঠিকানায় । এখনও কি একই বাড়ী , একা ?
নাকি দোকা , পাশে রূপসী অবুঝ রমণী ! খোলা চুলে বনলতার ছায়া
যেন এক আশালতা দেবী । তবে সে কে ? পরনে সবুজ অবুঝ শাড়ী
স্লিপারে ক্লান্ত চরণ। অজন্তা ব্যাগ শান্তিপুরী । বুক জুড়ে কেবলি হলদিবাড়ী !

.                                ****************                  
    
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
হে মার্কেট ডে
কবি জোহরা উম্মে হাসান

যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে , কবে বেঁধেছিল চুল
সেই মেয়েটি ? দেখেছিল কবে আকাশের তারা
চাঁদের আলো, জানালার শার্সিতে দাঁড়িয়ে একাকী
একা ?

মধুকাল নেই, নেই মধুরাতি, মধু চন্দ্রিকা
আর মধুবন ! মনস্তাপ আর মনান্তর ভরা
দিন রাত ! কাজ , কাজের পরে কাজ
কেবলি আগুন, চুলোর পার, ক্লান্ত হেঁশেল
শয্যা বিহীন উঠোন , ঘর প্রাচীর দেয়াল
ব্যস্ত হাত বাঁধা মেশিনের হাতলে , লোহার
বন্ধনী , গাড়ীর চাকা , রক্ত চক্ষু শানিত
ক্রোধ , হোমানল ! আঘাত আর রক্তাক্ত প্রহর !

আজ আলোর প্রদীপ জ্বালাবার দিন , মনোহর
পাখীর ডানায় উড়বার দিন ! সবুজ ঘাসে ঘাসে পা মেলে
ভাসবার । আকাশের মেঘগুলো চুপচাপ দেখবার আর
বাতাসের বুকে মুখ রেখে কথা কইবার !
অযত্নে পরে থাকা খড়ের গাদার পাশে জীর্ণ শীর্ণ
দড়ীটির মতো ,চুলগুলো বাঁধবার দিন আজ !
বেনুনী কিংবা খোঁপা । এলে মেলো হাওয়ায় উড়ানো
চুল , যা হোক তাইই সই ! নিজেকে নিয়ে ভাববার
দিন আজ, চাইবার দিন
যেখানে আছে চির অধিকার জমা
দিনের পরে দিন!

মুখ বুজেঁ থেকেছে সে কেবলই আঘাত আর অত্যাচার
ভগ্নদূত , ভগ্ন স্তূপ আর ভগ্নাবশেষ
মড়ক মজ্জাগত , মথিত ভস্মাচ্ছন্ন দীপক দীপ!
দুর্দম কন্ঠ আজ মন্ত্র কন্ঠ
ডাক দিয়ে ফেরে হিমাদ্রি , উঁচিয়ে হিরণ
পতাকা বিজয়ের ! দুনিয়ার মজদুর যত এক হও
আর নয় দ্বীপান্তর ,এক হও দেদীপ্যমান
অধিকার আদায়ের সংগ্রামে !

.                     ****************                  
  
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পুতুলগুটি চলবে
কবি জোহরা উম্মে হাসান

ডল কি জানে না সেই মেয়েটি , তাঁর মা যেমন চেনে না ডলার
টাকা চেনে , চিনতেই হয় ক্ষুধার তাড়নায়! মেয়েটি পুতুল খেলে
মায়ের এক টুকরো ছেঁড়া শাড়ির আচলে তিনকড়ি  লাল সুতোয় গিট দেয়া
তাই কত ? রাজপথের জলন্ত বুকের এককোণে বাতির স্তম্ভ , সেখানে সে
একাকি ঠায় বোসে । তিন কিংবা বড় জোর চার  বয়স ! এ বয়সেও ফেলে দেয়া
দারুন অরক্ষিত সে ! মা গেছে , বাসা বাড়ীর কাজে , কোন ফাঁকে  চলে আসা
প্রকাশ্য রাজপথে । মা  নিশ্চয় এতক্ষণে খুঁজছে তাঁকে
তার পরও লাল নীল বাতি , ভেঁ পো, রাস্তা , মানুষ, পুতুল !

পুতুল হাতে জ্যাম গাড়ীতে বসা লালচে কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটি - দেখ মামনি , খুদে
মেয়েটির হাতে কি সুন্দর ডল ! মা, মুখ বাঁকাল , ডল নয় ত্যানার পুতুল ! ত্যানা কি মা?
ডল আর পুতুলে কি ফারাক ? পরে বুঝবি , মায়ের তড়িঘড়ি উত্তর ।  নোরা নামের
মা-টি মনে মনে  ভাবল ,  সে  আজ থেকে আর কোন ডল কিনে দেবে না , মেয়েকে !
মেয়ের ভাগ্যও  যদি তার মত পুতুল পুতুল হয়ে যায় ? আর ঐ ক্ষুদে মেয়েটি , তাঁর
কোন কপাল নেই , দেখা যায় স্পষ্ট লিখন কপালের ! ও পুতুল খেললেই কি , না খেললেই
বা কি?

বোকা পুলিশ লাল বাতি জ্বালিয়ে বসে আছে অহেতুক
জটলা কম এ পাশটায়  । ছেড়ে দেয়া যায় অল্পসার গাড়ী ! না, রাজা যায় ও পথে
যাওয়া চলবে না , থামাও । তবে থামা কিছুটা নিধারিত !
ডলারের দাম বাড়ল কি কমল, রাজা  এখন আর  মোটেও নন চিন্তিত   
কদিন পর বাসা বাড়ীর চাকরি হারাবে ক্ষুদে মেয়েটির মা
তবুও তো অরক্ষিত রাজপথে চলছিল পুতুল পুতুল খেলা ! মন্দ হলেও মন্দ
নয় একেবারেই ! এখন পুতুল খেলবে কেবল রাজা-রানীরা, মাঝে মধ্যে ডলার দেশের
মানুষগুলো এসে চেলে দেবে দাবার দাবার গুঁটি ! পুতুলগুটি চলবে , দারুন !

.                                  ****************                  

.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
অসময়ে সময়ের সন্ধানে
কবি জোহরা উম্মে হাসান

কিছুই কি বলার নেই তোমার আমাকে কিংবা আমার তোমায় ?
যে শয্যায় আসন পেতেছ হয়তো বা ক্ষনিকের জন্য
সেখানে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের ভবিষ্যৎবিহীন অতীতের চিহ্ন ।
জানালার বিবর্ণ কাঁচে আঁকা  ছবি এলোমেলো দুজনার
মনে করে দেয় পরিবতিত সময়ের কথা। সময়ের পিছুটান
নেই আজ কারো অথবা ঘরে ফেরার তাড়া।

চলো আজকে না হয় দুজনে একটু বেহিসেবী হই
সামান্য সময়ের জন্য। গুমোট ভ্যাপসা গুহার অর্গল ছেড়ে
মিলে যাই আলোর ছোঁয়ায়। যেখানে ল্যাম্পপোস্টের গাঁ ঘেঁষে
গুবরে পোকাদের আলো খেলা চলে রাতভর
তিরতিরে অন্ধকারে অহর্নিশ আলো আলো করে
শানাই বাজিয়ে ফেরে আনন্দের ।
তারপর ভুরীভোজে দম ফেটে মরে
ফুটো বেলুনের মতো সশব্দে।

চলো যাই রুক্ষ ডোবাটার ধারে, যেখানে বুড়ো আলো এসে
অকারণ উঁকি মারে নুয়ে পড়া ভিখারিনির মতো
জংলা গাছের ডগায় । কুকুরের সজাগ চিৎকারে পালাবার পথ
খুঁজে ফেরে বার বার । অথবা ফিরে যাই চিলতে নদীটার ধারে
বাতাসের তৃষ্ণায় স্থির হয়ে পড়া ঢেউগুলো তার
কালগুনে চলে রাত্রির উতলা কুমারীর প্রতীক্ষায়।
চলো আজকে না হয় একটু বেহিসেবী হই
সামান্য সময়ের জন্য। এই বিবর্ন গুহা ছেড়ে
চলো যাই, আলো জল বাতাসের খেলায়
দুজনায়, অসময়ে সময়ের সন্ধানে  !

.                         ****************                  

.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কবিকে
কবি জোহরা উম্মে হাসান

কবি, আমাকে অমন চুপিসারে খুঁজতে হবে না তোমায়
বলতে হবে না মাধুকরী ভালবাসার কথা
দিতে হবে না সুদৃশ্য উপহার বনমালী
ফাগুনের গান, আগুনের আলপনা হার
অথবা অচিন পাখির নোলক !

আমার জন্য কিছুই রেখ না তুমি , ভেবনা কিছুই
এই পেলব দুহাতে চুড়ির রিনিঝিনি , বলে দেয় তুমি আছো
কপালের মায়া মায়া টিপ , কাজল কালো দুচোখের ভাষা
সব সব বলে দেয় , এইতো আছো তুমি আমার
সবটা জুড়ে , সবটা জুড়ে
তারপরও কেন যে এ লুকোচুরি খেলা !

যদি সময়ের মেঘ ঢেকে দেয় সারাটা শহর, সারাটা
পাড়া , অলি, গলি , রাজপথ , বন্দর
কানু ঘোষের ডিসপেনসারি , শুকুল পট্টির ঢেউ তোলা
দোচালা টিনের বাড়ি , চালাঘর , দোকান –পাঠ , লালদীঘির দুপার -তবুও যেন কবি,
আমি আছি
আমি আছি , তোমার সঙ্গে
যেমন ছিলেম বহু বছর আগে !!

.                         ****************                  

.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর