কবি জয়দেব বিশ্বাসের কবিতা
*
স্মৃতি
কবি জয়দেব বিশ্বাস

সাদা ফুলগাছের নিচে তুলসীতলায় ,
আর কিত্ কিত্ খেলা হয় না
কত ... খেলা হত ওখানে ।
একবার গাদন খেলায় পাড়ার এক বৌদি -
আমাকে 'পচা' বানিয়েছিল ।
ছোটরা, বড়রা সবাই মিলে খেলতাম ।
কত দর্শকও হ'ত ।

আমি চলে এসেছি, ওখানে থাকি না ,
বৌদি তুলসীতলায় ঘুমোচ্ছে-
কেউ ডাকে না ।
সাদা ফুল গাছটাও যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ,
তুলসীতলায় এখন অনেক তুলসী গাছ হয়েছে ।

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
একটু বাঁচার জন্য
কবি জয়দেব বিশ্বাস

কি করে বলি মাগো আমি মুক্ত ,
ছ'টা বছর শরীরের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছি ।
এই চার দেওয়ালের মধ্যে লজ্জা, ঘেন্না চেটে খাচ্ছি -
তবে খুব সুখেই আছি !
অন্তত তোমার পোষ্য কুকুর গুলোর জোর-
জবরদস্তি থেকে নিস্তার পেয়ে ।

প্রতিদিনের কথা মনে পড়লে
আমার রক্তে যেন উজান স্রোত বয় ।
আমার স্কুল যাওয়ার পথে, ওরা আমাকে
হিংস্র মাংসাশী প্রাণীর মতো শিকার করেছিল ।
আমি আর বাড়ী ফিরিনি ।
শেষ অবধি বেছেই নিয়েছি, চার দেওয়ালে
আবদ্ধ সুখের কাজ।

অনেক টাকা পাই ,
আর আমি গরীব নই ,
আজ আমার সবই আছে এই অন্ধকার জগতে ।

মা ! এ জীবনটা তো আমি চাইনি ,
পাঁচজনের মতো আমিও বাঁচতে চেয়েছিলাম ,
আজ বাইশ বছরেও এই অন্ধকারেই
আলো খুঁজে বেড়াই ।
বাইরের জগত আজ আমার কাছে অচেনা
কিম্বা আমিই ওদের কাছে ।
এত ভিড়ের মাঝে তবু আমি একা ,
এ সমাজ কি আমার জন্য নয় ?

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ছিঁটমহল স্বাধীনতা
কবি জয়দেব বিশ্বাস

আমাগো কোনো দ্যাশ নাই ,
শুধুই স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা আসে
সেবার ওদের তাড়িয়ে ১৯৪৭ -এ পেলুমগে পাকিস্তান
সে কি অত্যাচার হতি লাগলো
খানেরা এসি আমাগো বউ ছেলে মেয়ের ইজ্জত লুটতিছে

আবারো লড়াই করতি হবে ,
লেগি পড়লাম হক্কলে মিলে
১৯৭১- এ বাংলাদেশ  হ'ল ।
সে তো আর আমার দ্যাশ বললেই হ'ল না ,
বাংলাদেশ কইছে ও নাকি আমার দ্যাশ না ,
ভাবতি লাগলাম ভারতে পড়ি গিছি ।
আবারও কতো ঝামেলা হতি লাগলো
কোনো দ্যাশ আমাগো পরিচয় দিলো না গো ,
ছিটমহলে পড়ি গিছি নাকি আমরা !
কোন দ্যাশের দায় নাই আমাগো নিয়ে ,
ছাওলটাকে ভারতের ইশকুলে
ভরতি করি দিলুম,
সবাই ভয় দেখাতি লাগলো ,
ওরে পুলিশে দেবে ও বাংলাদেশি ।

পড়াশুনো হ'ল না আর , বিদেশে চলি গেল যে ছাওয়ালটা ,
কেরালাতে এখন রাজমিস্ত্রি কাজ করতিছে ।

এতগুলা বছর পর আজ আবার এই ২০১৫ -এ স্বাধীনতার স্বাদ পেলুম ,

এই আনন্দের দিনেও একটু কষ্ট থেকি গেল -
মা আসতি চেল না ,
ও ভিটে ছাড়তি চাইছে না ,
বড় মায়া পড়ি গেছে ভিটেটার 'পর  ।
আমারো তো ভবিষ্যৎ আছে ,
ছেলেপুলেও মানুষ হবে ভালোভাবে ,
আগামী যদি ওদের জন্য কিচু করে !
তাই চলি এলুম ।

আবারো স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করতি হবে কিনা জানি নে ,
তবু সকাল থেকি সবাইরে মিস্টি মুখ করাতেছি ,
তেরঙা পতাকা নিয়ে ছুটে বেড়াতেছি ,
উৎসব হতিছে আমাগো -তৃতীয় স্বাধীনতার ,

আজ বুক ফুলিয়ে বলতি পারবো - আমি ভারতীয় ,
বড় গর্ব হতিছে আমার

বেঁচে থাকার জন্যি অন্তত এটটা দ্যাশ তো পেলুম !

.                    ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অন্ধকার গলি ১
কবি জয়দেব বিশ্বাস

বুকের দুটো বোতাম খুলে রাখলেই পুরুষত্ব বাড়ে না ,
শিড়দাড়া ভাঙা নপুংসক তুমি ।

এবার অন্তত পুরুষ হও ,
ছেঁড়া শাড়িটা আর চলছে না ।
না ! জুয়া খেলে শাড়ি আনতে হবে না ।

চালিয়ে নেব কটা দিন কোনভাবে ,
ওপারের আলম ভাই যদি না আসত  ,
কি করে চলতো এই চারটি পেট ?
বুধবার , শনিবার আমার খুউব কষ্ট হয় ,
ও ছাড়তে চায় না খিদে না মেটা পর্যন্ত ।

আগের দিন ওর নোখের আচড়ে দ্যাখো কালশিটে পড়ে গেছে ।

ভেবেছি ছেলেটাকে কোন গ্যারেজে কাজে পাঠাবো ,
খেয়ে পরে অন্তত বাঁচবে ।

রীতার মা বলছিল -কোলকাতায় ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে কাজের জন্য ১২-১৪ বছরের
মেয়ে খুঁজছে ।

মেয়েকে না হয় ওখানে পাঠিয়ে দেব
অভাব তো ঘুচবে -

জানি তুমি বাঁধা দেবে না
আমাদের উপার্জনের টাকায় হয়তো মদ জুয়ার বহরটা বাড়বে ।

মনে আছে, সেবার তোমাকে টাকা দিইনি বলে  ,  উনুনের ওপর ভাতের হাড়িতে
লাথি মেরে বলেছিলে -
মাগি তোর বেশ্যামির টাকায় রান্না খাব না  ।

কেমন স্বামী তুমি স্ত্রীর শরীর বেচা টাকা ওড়াও !
কেমন বাপ ছেলেমেয়ের মুখে দুটো খাবার তুলে দিতে পার না !

তোমার মত পুরুষের মৃত্যু হোক ........
    মৃত্যুই হোক  ।

.                 ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অন্ধকার গলি ২
কবি জয়দেব বিশ্বাস

সারাদিন কষ্টের হাপর টানে
বাবু খুশি হলেই ক'টা টাকা মিলবে ।
যেন কোনো ঘরছাড়া কাকের দুঃস্বপ্নের শহরে খাবার খুটে বেড়ানো ।

শহরের রাস্তা ভালো করে চেনে না ,
তবু এ গলিটা যেন তার বহুদিনের পরিচিত ।
ছোট মেয়েটিকে মা বলেছিল -
শহরে যাস , খাবার কষ্ট হবে না ,
রোজ দুপুরে মিড ডে মিলের জন্য আর তোকে স্কুলে দৌড়াতে হবে না ।

সারা দিনের ভাবনা যার মাথায় , এক বেলার খাবারে তার কি পেট চলে ?

তাই তো শহরে আসা মেয়েটির ,
কি সুন্দর হয়েছে মেয়েটি ,
মুখে রং না মাখলেও যে কোন পুরুষ তার যৌবনের গন্ধ পায় ।
চোখ দিয়ে চেটে খায় তার সমস্ত শরীর ।

আজ যে কোনো কষ্ট নেই ,
একটা ল্যাপটপ কিনেছে , স্মার্ট ফোনে ফেসবুক করে ছুটির সময়গুলো কাটায়।

আজ ফুরফুরে আবহাওয়ায় মনটা যেন খুব চনমনে হয়ে গেল ।

সকাল থেকে রবীন্দ্রনাথে পেয়েছে ।

.                 ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
সেই রাতের কাহিনী
কবি জয়দেব বিশ্বাস

রাতের শরীরে মাছি বসে
খুচরো টাকা দিয়ে পিঠ চুলকায়
দগদগে ঘা থেকে শুধুই রক্ত ঝরে

অভাগা সময় বেগবতী নদী

টাকার উপর টাকা জমে
লোকে বলে 'চামড়া বেঁচা' টাকা

খারাপ লাগলেও অবাক হয়নি
সেখানে পাপ ছিল না

তুমি বলেছিলে গল্পটা কাল বলবো
এক এক করে তো অনেক গুলো দিন কেটে গেল

গল্প যে গল্পই থেকে গেল
শোনা হ'ল না আর ।

সেই রাতের কাহিনী
নির্জন  সেই মঞ্চ ,
আর টাকা দিয়ে কাড়াকাড়ি
নিলামটা হয়েছিল বেশ ।

আজ যখন দু'জনের সেই সেদিনের ছবি দেখি
একা একা মালা গাথি সুখ-স্মৃতি আর আনন্দমুখর দিনগুলির ।

আজ তোমার শরীরে যে ভাইরাস গুলো রাত্রি যাপন করে
তুমি ভেবে নিও
-এ প্রাপ্তি শুধু তোমার নয় ,
যারা প্রজাপতির মতো সুন্দর শরীরে থাবা বসিয়েছে
যারা লাল চোখ দেখিয়েছে  ,
যারা বলেছে ছিঃ ছিঃ

তারাও তো এর অংশীদার ।

তুমি এ ভাইরাস যন্ত্রনা একা কেন সবে ?
এই সু-সময়ে সঙ্গী করে নিও ঐ মধু লোভীদের ।

একটু উঠে দাড়িও না হয় আবার।

.                 ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আতঙ্ক
কবি জয়দেব বিশ্বাস


আবারও কিছু প্রতিশ্রুতি
সেই স্বপ্নভঙ্গ
অপেক্ষার দিনলিপি ।

আর আমার মাঝরাতের সওয়ারি
বিবর্তনের চাবিকাঠি ।

সভ্যতার সু-সমাজ এগিয়ে চলে
দালাল আর বেশ্যাদের আস্তাবলে
ন্যাকামিপনা , বর্বরতার অন্ধকার ,
রং মাখা মুখের খদ্দেরের গলি -
-- পৃথিবীময় এক ছায়াযুদ্ধ ।


একটি কাটা মাথার গোপন গুহা ,

যেখানে বিতংসী শরীরের নিঃশব্দ গর্জনে
শুধুই মিলনের আতঙ্ক ।

.                 ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
উপহার
কবি জয়দেব বিশ্বাস

যে প্রেম দেখেছিলাম আমি সর্বনাশা চোখে
তা অস্পষ্ট হয়ে গেছে মরূভূমির কুয়াশায়
মাটির গন্ধে এখন আর বৃষ্টি নামে না ,
যৌবনের বৈতরনী পার করে সে আজ নিমেষে হারিয়ে যায় ।
ইচ্ছেগুলো জমাট বেঁধে যে পর্বত হয়েছিল
তার চূড়ায় আজ বিষাক্ত স্মৃতি বাসা বেঁধেছে ।

এখন সিগারেটের ধোঁয়ায় সুখ খোঁজে ঠোট ।
স্পর্শের কাছাকাছি আর কোন নীরবতা নেই
যার বুকে 'জীবন' লিখেছিলাম -
সে বুকে কেউ পেরেক ঠুকেছে ,
একটি ঠোঙায় তাকে 'প্রেম' উপহার দিয়েছিলাম ।

জীবনের জীর্নতায় সে ছুটেছে যাযাবরের মতো ,
সেই সাঁওতালি মেয়েটি আজ তীক্ষ্ণ খুঁজে বেড়ায়-
শুধুই সাপের গর্ত ।

.                 ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আত্মবিশ্বাস
কবি জয়দেব বিশ্বাস

আমি রাতের অন্ধকারে সূর্যকে দেখি
সে এক অজানা স্বপ্নে -
তার চুল আমার চোখে ভেসেছিল ।

মনে মনে তার যে ছবি এঁকেছিলাম
বৃষ্টির জলে তা ধুয়ে গেছে কিম্বা
ভেসে গেছে অন্য কোন মোহনায় ।

এলোকেশী ঝড় হয়ে সে এসেছিল
এসেছিল মাধবীলতার মতো
বনলতা সেনের চোখ নিয়ে ।
উন্মত্ত ঝড়ের মতো চোখবাধা সমাজের
নগ্ন শরীরে ক্যানসার নিয়ে খেলেছিল ।
অসময়ের কবিতা লিখেছিল -
রাজপথ , প্রতিবাদ , মৌনমিছিল নিয়ে ।

সেদিন তার দু'চোখে আবিষ্কার হয়েছিল
ভয়ের এক নতুন সংজ্ঞা , বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাস ।

.                 ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মুক্তি
কবি জয়দেব বিশ্বাস

ওর বুকটা চিরে গেছে ,
তবু পতাকা হাতে দাড়িয়ে
আচলটা দিয়ে ক্লান্তি মোছে আর বলে-

আমি নিয়ে যাব আমার পাওনা,

দিনের পর দিন গোনে ,
ইচ্ছাগুলোর এক সময় মৃত্যু ঘটে ।
তেরঙা পতাকা ঢেউ খেলতে থাকে ।
বিচার গড়িয়ে পড়ে টাকার উপর ।
পায়ের নীচ থেকে মাটিও সমর্থন তুলে নেয় ।

অন্ধকারে টাকা আসে ,
'তুই বোবা হয়ে যা '।

কেড়ে নিল তার কথা , তার সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ।
যে চোখে চোখ রাখা যেত না ,
সেই দৃষ্টিতে যে শক্তি ছিল  তা যেন শান্ত করে দিয়েছে ।

একদিন সকালে খবর এল মেয়েটি ঝুলছে সিলিং ফ্যানে ,

এখন পতাকা উড়ছে অনেক উঁচুতে ।

আর 'তারা' বসেছে কয়েকটা বোতলের সাথে মুখরোচক খাবার নিয়ে ।
আজ যে মুক্তির দিন ।

.                 ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর