কবি গীতিকার কালাচাঁদ দালাল - জন্মগ্রহণ করেন শান্তিপুরে। সেখানেই তাঁদের আদি বাড়ী ছিল।
তার পিতার নাম বলাইচাঁদ দালাল এবং মাতার নাম শিশুবালা দালাল। পুত্র শ্বদেশ দালাল জানিয়েছেন যে
মৃত্যুকালে তাঁর পিতার বয়স হয়েছিল ৫১। সেই থেকে তাঁর জন্মের সাল দাঁড়ায় ১৯২১।
কালাচাঁদ দালাল লেখাপড়া বিশেষ কিছুই করতে পারেন নি। তবে খেলাধূলায় তিনি অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন।
ভালো গান গাইতেন, গান লিখতেন, সুর করতেন। নাটকের প্রতি তার ব্যপক আগ্রহ ছিল। ভাল অভিনয়
করতেন। কর্মসূত্রে তিনি তাঁত চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পাড়ার লোকেদের মধ্যে তার প্রভাব ছিল
ব্যাপক। মৃত্যুর পরেও সেই অঞ্চলের মানুষজন কালাচাঁদ দালালকে ভোলে নি।
কালাচাঁদ দালালের দাদা নন্দলাল দালাল ছিলেন শান্তিপুরের অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
মা, শিশুবালা দালাল ছিলেন সি.পি.এম–এর আঞ্চলিক মহিলা সংগঠনের সেক্রেটারী। মা লেখাপড়া জানতেন
না। এই এঞ্চলের একজন ছিলেন প্রেসিডেন্ট। তিনি লেখাপড়ার দিকটা সামলাতেন। মা, শিশুবালা সাংগঠনিক
দিকটা দেখতেন।
শ্রী শ্যামসুন্দর সরকারের স্মৃতিচারণায় জানা যাচ্ছে যে কালাচাঁদ দালাল দিনান্তে একবার খেতেন। কোনদিন
রাত্রে বা কোনদিন দুপুরে একবার খেতেন। কোন কোন দিন খাওয়াও জুটতো না। তিনি খৈনী খেতেন।
চারু মজুমদারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট। স্বয়ং চারু মজুমদার তাঁদের সঙ্গে দেখা করার
জন্য শান্তিপুরে গিয়েছিলেন। চীন ভারত যুদ্ধ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সি.পি.আই.এম নেতা
প্রমোদ দাশগুপ্তর সঙ্গে তাঁর প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। কালাচাঁদ দালাল প্রমোদ বাবুকে গালমন্দ করে আসেন।
সি.পি.আই.এম.-কে তাঁরা আর বিপ্লবী বলতে চাইছিলেন না। বিপ্লবী সংগঠন গড়ার জন্যই তাঁরা সি.পি.আই.
এম.এল. দল গড়েন।
১২ই মে ১৯৭২ এর দর্পণ পত্রিকার সংখ্যা থেকে জানা যায় যে ১৯৭২ সালের ৩রা মে তারিখে, নদীয়া
জেলার শান্তিপুর ও ফুলিয়ার মাঝামাঝি একটি আমবাগানে এনকাউন্টার হয়। নদীয়ার নকশাল নেতা অজয়
ভট্টাচার্যর স্ত্রী তথা আই.পি.টি.এ. ও নকশালবাড়ী আন্দোলনের কর্মী শ্রীমতী জয়শ্রী ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণা
থেকে জানা যাচ্ছে যে কালাচাঁদ দালাল, বিশ্রাম নিচ্ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য, মধুসূদন চট্টোপাধ্যায় ও শম্ভূনাথ
সরকারের সঙ্গে। হঠাৎ অ্যান্টি নকশাল স্কোয়াড সহ, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, বিরাট পুলিশ বাহিনী চারদিক
দিয়ে তাঁদের ঘিরে ফেলে। তাঁদের কাছে ছিল তিনটি রাইফেল ও গ্রেনেড। পুলিশের প্রথম গুলি লাগে
অজয়ের পায়ে। কালাচাঁদ তাঁকে কাঁধে করে গাছে বসিয়ে দেন। শুরু হয় গুলি বিনিময়। পুলিশের পক্ষে
বারবার মাইকে আত্মসমর্পণ করার কথা ঘোষিত হয়। কিন্তু অজয় ভট্টাচার্য তীব্রকণ্ঠে বলেন ---
“প্রাণ থাকতে আত্মসমর্পণ নয়, আমরা সর্বপ্রকার ভীরুতাকে ঘৃণা করি।” আবার গুলি বিনিময় শুরু হয় এবং
পুলিশ আবার আত্মসমর্পণ করার কথা ঘোষণা করে। এবারে অজয় বলেন --- “আমরা জীবনের শেষ বিন্দু
দিয়ে লড়াই করবো। আমরা আত্মসমর্পণ কে ঘৃণা করি।” তাঁদের দিক থেকে একটি গ্রেনেড মিস্ হয়। গুলি
ফুরিয়ে আসে। অবশেষে পুলিশের অজস্র গুলি এসে তাঁদের শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত
বিপ্লবীরা স্লোগান দেন --- “ভারতবর্ষে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরা মৃত্যু বরণ করছি। বিপ্লব
দীর্ঘজীবী হোক।” বিপ্লবীদের তেজোদীপ্ত ব্যবহারে সেদিন পুলিশও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। চার বিপ্লবীর
মৃত্যুর পর পুলিশের দিক থেকে সকলে মাথার টুপি নামিয়ে নীরবতা পালন করে বলেছিলেন --- “এরকম বীর
সাহসী লড়াকু ব্যক্তি খুব কমই হয়।”
শ্রীমতী জয়শ্রী ভট্টাচার্যের ৭ই নভেম্বর ১৯৯৬ সালে, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত অধুনা জলার্ক প্রকাশিত
“সত্তরের শহীদ লেখ শিল্পী” গ্রন্থ, ১৯৯৮ কে দেওয়া স্মৃতিচারণা বা সাক্ষাত্কার থেকে আরও জানা যায় যে
১৯৭৪ নাগাদ তিনি সি.পি.আই.এম.এল-এর মহাদেব মুখার্জীর টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে শুরু
করেছিলেন। ধরা পড়লেন ধানবাদে। সেখানে তাঁর দাদাকেও ধরে আনা হয়েছিল। জয়শ্রী দেবী তাঁর আসল
পরিচয় যাতে কবুল করে নেন, তার জন্য তাঁর দাদার উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের
(এস.বি.) অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এ.সি.) অমর মুখার্জী এবং ডি.ডি.-র সন্তোষ। এই সন্তোষই অর্চনা গুহর
উপরে অত্যাচার (টরচার) চালায়। অমর মুখার্জী সেদিন জয়শ্রীকে তাঁর রিভলভার দেখিয়ে বলেছিলেন -
জানিস, ওই রিভলভারটা দিয়ে আমি সরোজ দত্তকে মেরেছি।
তাই আমরা মিলনসাগরে কবি কালাচাঁদ দালালের কবিতা ও গীত তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে
দিতে পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।
আমরা কবি রাজেশ দত্তর কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ, কবি কালাচাঁদ দালালের এই পাতাটি তৈরী করার
সবরকম তথ্য, আমাদের দেবার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। আমরা আরও কৃতজ্ঞ শ্রী চিররঞ্জন
পালের ( +৯১৯৪৩৪৫১৬৮৯৮) কাছে তাঁর নানাভাবে এই পাতাটি তৈরী করতে সাহায্য করার জন্য।
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত “এবং জলার্ক” থেকে ২৫.০৫.১৯৯৮ তারিখে প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখক
শিল্পী”, গ্রন্থ থেকে নেওয়া তথ্যাদি নেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞ।
উত্স - শান্তিপুরের চার শহীদ, দর্পণ ১২ই মে ১৯৭২, পুলিশের গুলিতে নিহত নকশাল নেতা অজয়ের
. কাহিনী, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত অধুনা জলার্ক প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখ শিল্পী” গ্রন্থ,
. ১৯৯৮।
. স্বদেশ দালাল, কালাচাঁদ দালালের কথা, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত অধুনা জলার্ক প্রকাশিত
. “সত্তরের শহীদ লেখ শিল্পী” গ্রন্থ, ১৯৯৮।
. কালাচাঁদ দালাল : স্মৃতিচারণায় শ্যামসুন্দর সরকার, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত অধুনা জলার্ক
. প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখ শিল্পী” গ্রন্থ, ১৯৯৮।
. রুবি বা জয়শ্রী ভট্টাচার্য, তীরবিদ্ধ শিকার, তৃতীয় পর্ব পৃষ্ঠা ১৬২ স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত
. অধুনা জলার্ক প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখ শিল্পী” গ্রন্থ, ১৯৯৮।
কবি গীতিকার কালাচাঁদ দালালের একটি গান "ভুলবো না"-এর স্বরলিপির জন্য এখানে ক্লিক্ করুন।
কবি কালাচাঁদ দালালের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ৫.১১.২০১৫
...