সরে দাঁড়াও
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
“দেশ সুবর্ণজয়ন্তী কবিতা সংকলন ১৯৩৩-১৯৮৩” থেকে।
বর্ষার ছিন্নভিন্ন রোদ ইলিশ-আঁষের মতো
ছড়িয়ে-ছড়িয়ে পড়ে।
বহুদূরে
মেঘ বাতাস। কাছে ঠাণ্ডা ঝাপটা।
আধপোড়া সিগারেট। গতরাতের আধপড়া বই। চায়ের কাপটা
ফাটা।
কচি ভুট্টা
পথে হাঁকে। চাকর বাকরে : কখন ফিরবে?
আপিসের দেরি। জুতো পালিশ হয়নি
স্নান বাকি, দাড়িও কামাইনি।
কন্যার অঙ্কটা কষে দিতে হবে
ধোবি দু-সপ্তাহ কামাই : কাকে পাঠাবে?
গেঞ্জি স্যাঁতসেঁতে, মোজা ভিজে
বাসে ভিড় বাড়ছে---কী যে
করি! কী যে করি---
মধুসূদন শ্রীহরি...
সরে দাঁড়াও সরে দাঁড়াও পাওনাদার কবিতা
এখন ভিড় করতে নেই জানো না তা?
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
|
ঠাট্টা
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত রংমশাল পত্রিকার পৌষ ১৩৪৪ সংখ্যা (ডিসেম্বর ১৯৩৭)
থেকে।
সকাল সবে আট্ টা :
উঃ! এ’ কে বেজায় জোরে মারলে মাথায় গাঁট্ টা?
. চমকে উঠে’ চেয়ে দেখি,
. সেজ-কাকা দাঁড়িয়ে একি!
আমায় দেখে’ হেসে’ বলেন,---“ও কিছু নয় ; ঠাট্ টা!”
মাথার মাঝে আলু ফলে, এমনি মজার গাঁট্ টা!!
দুপুর যখন গড়িয়ে গিয়ে বিকেল হ’য়ে আসে :

দাদার ঘুঁড়ি
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত “রংমশাল” পত্রিকার আশ্বিন ১৩৪৫ সংখ্যা (সেপ্টেম্বর ১৯৩৮)
থেকে।
দাদা তুমি ওড়াও ঘুঁড়ি ছাতের ওপরে
. একটি পাশে চুপটি করে থাকি :
খোলা আকাশ নীল হয়েছে মেঘের কিনারে,
. নিজের মনে সোনার স্বপন আঁকি।
মজার রঙের হাজার ঘুড়ি উড়ছে আকাশে
. কেউ বা নীল কেউ বা সাদা লাল,
তোমার ঘুঁড়ি বুক ফুলিয়ে উড়ছে তাদের পাশে
. নীল আকাশে উড়িয়েছে তার পাল।
মেঘের পাহাড় লাল হয়েছে পলাশ ফুলের মত
. কত রঙ---গাঢ় ফিকে নীল ;
বকের সারি দিচ্ছে পাড়ি কোন্ সে নদীর চরে
. সোনার বালু স্বচ্ছ ঝিলমিল।
তোমার ঘুঁড়ি দিগ্বিজয়ী ঘোরে খেয়াল মত
. আকাশখানি এপার ওপার চিরে,
সন্ধ্যে হলে রাত্রি যখন ঝোলায় তারার বাতি
. তোমার ঘুঁড়ি তখন আসে ফিরে।
আমি যদি দিগ্বিজয়ী তোমার ঘুড়ি হতাম
. যেতাম উড়ে অনেক দূরে চলে,
সন্ধ্যে হলে অন্ধকারে আকাশ কালো হয়ে
. যেখানেতে তারার বাতি জ্বলে।
পলকা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের তরোয়াল
. সাঁতার দিয়ে যেতাম ঘুঁড়ির মত,
অনেক দূরে যেখানেতে স্বপন বুড়ির গ্রাম
. ভীড় করেছে ছোট্ট তারা যত।
দাদা তুমি ওড়াও ঘুঁড়ি ছাতের ওপরে
. একটি পাশে চুপটি করে থাকি :
খোলা আকাশ নীল হয়েছে মেঘের কিনারে,
. নিজের মনে সোনার স্বপন আঁকি।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
তোমাকে চিনেছি আমি, আজ নয়, আগামী কালের,
শতাব্দীর সিঁড়ি ভেঙে ধাপে ধাপে এসেছ এখানে।
সর্বাঙ্গে সহস্র ক্ষত, রক্তাক্ত স্বেদাক্ত দেহ, মুখে
স্মিত হাসি। সুন্দর নিষ্ঠুর তুমি, জন্ম-মৃত্যুঞ্জয়॥
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ক্ষমা কোরো
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” ২য় খণ্ড (১৯৯৩)
কাব্যসংকলন থেকে।
তোমাকে বুলেট থেকে বাঁচাতে পারিনি।
কিন্তু পার্ক স্ট্রিট্রের মোড়ে
তোমার দারুণ একটা স্ট্যাচু বানিয়েছি।
চব্বিশ ঘন্টা রাইফেল নিয়ে
পাহারা দিচ্ছি।
ক্ষমা কোরো।
তুমি নতুন পথ দেখিয়েছিলে
কিন্তু নতুন পথ বানাতে পারিনি আমরা।
যে পথটায় বিভত্স জঞ্জাল
আর ঘেয়ো কুত্তা আর বেশ্যা আর দালাল
সেই পথটার নাম
পালটে রেখেছি তোমার নাম।
ক্ষমা কোরো॥
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
এই গাছ
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “আধুনিক বাংলা কবিতা” (১৯৪০) কাব্যসংকলন থেকে।
এই বজ্রদগ্ধ গাছের শিরা বেয়ে
পৃথিবী একদিন ফুল হয়েছিলো, কখনো ফল,
কখনো সবুজ, কখনো সৌরভ।
শীতের সায়াহ্নে সে আজ দূরের নদী দেখছে,
যেখানে মৃতদেহ দগ্ধ হাড়, গুঁড়ো হাড়ের মতো বালি,
চাকার দাগ, যারা বেঁচে রইলো তাদের অশ্রু।
এই গাছ শুধু দেখছে :
নদীর ওপারের বন ছুঁয়ে চাঁদ উঠে এলো,
নটীর মতো নিটোল, চোখের নিচে কালি,
প্রথমে লাল, পরে সাদা, হাসপাতালের নার্সের মতো।
এই গাছ ভাবছে :
একদিন চৈত্রের ঝড়ে তার দেহ মর্মরিত ছিলো,
একদিন ভ্রমরের ভীড় ঘিরে ছিলো স্তাবকের মতো,
একদিন পৃথিবী তাকে ছুঁয়েছিলো---
আজ সে-পৃথিবী ভুলে গেছে।
স্তব্ধ রাত্রির মধ্য-আকাশে রুপালি-আগুন-লাগা চাঁদ,
শীতের শুকনো নদীতে কয়েকটা শেয়াল সন্তর্পণে ঘুরছে,
মাঝে মাঝে পোড়া কাঠ আর গুঁড়ো হাড়ের মতো বালি
আর একটি বজ্রদগ্ধ গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ছায়া
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও কবি সরল দে সম্পাদিত “পাঁচশো বছরের কিশোর কবিতা”
(১৯৮৮) কাব্যসংকলন থেকে।
ছায়া দাও ছায়া দাও
দু’চোখ ভরে নামুক ছায়া পৃথিবী উধাও।
কোখায় পাবো ভাবছি না তা
ভাবছি হবে পেতে,
এখান থেকে অনেক দূরের স্বপ্ন-সবুজ ক্ষেতে।
ছায়ায় ঘেরা ঘুমের দেশে পরীর দেশে এসে
বিশ্বরণের অন্য ঘাটে থামবে অবশেষে।
কালো নদীর উজান ঠেলে চলছে ঘুমের নাও
এম্ নি যেন হয় সে ছায়া, এম্ নি ছায়া দাও।
আমায় দিও একটি ছায়া তুলনা যার চলে
অনেক রাতের স্বপ্ন-ভাঙা ঘুমের অঞ্চলে।
আলো হাওয়ার মিশ খাওয়ানো ঝির-জিরানো মন
একটি শুধু বইছে নদী-ঘুমের বিশ্মরণ।
সে ছায়াতে এলে তুমি এমন দৃষ্টি পাও
ভাবনা যাবে উড়ে আর পৃথিবী উধাও।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
চন্দ্র-করোটি
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবি দিপক রায় সম্পাদিত “আধুনিক বাংলা কবিতা”
(১৯৯২) কাব্যসংকলন থেকে।
সায়াহ্নের স্তব্ধতায় আমি রিক্ত, উদ্দাম তবুও
মনে মনে কথা বলি ব্যর্থতার গৌরবের গান
অশরীরী ছায়া যত ভিড় ক’রে জানায় কামনা
অধুনা
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
“দেশ সুবর্ণজয়ন্তী কবিতা সংকলন ১৯৩৩-১৯৮৩” থেকে।
কী আছে আশ্বাস?
ট্রাম থেকে নেমে ভাবি বড় জোর তাস।
বন্ধ ঘরে ধূর্ত চোখ, জোরালো আলোয়
কখনো বা মিটমিটে। কখনো শিরায়
জ্বালা ধরে। কখনো কি পাবে তাকে ফিরে?
কত রৌদ্র পার হয়, কত জ্যোত্স্না পার হয়---তারপর
সবুজ ফসলে বুঝি রাখলো স্বাক্ষর!
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
সাক্ষর
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
“দেশ সুবর্ণজয়ন্তী কবিতা সংকলন ১৯৩৩-১৯৮৩” থেকে।
অখণ্ড স্তব্ধতা শুধু। ক্ষয়িষ্ণু তারার
নাড়ির স্পন্দন আর ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ পড়ার
জ্বালা এক : ছোট নাম---
তবু
কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
সুকামার সেন সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” (১৯৯১) কাব্যসংকলন থেকে।
তবু তুমি একবার পিছনেতে চাও।
এই সব রূপকথা রাত :
তোমার আলোকে তারা ধানে শীষের মতো
. হয়েছিল সোনালী-সবুজ।
. জীবনের হিসেবী দেবতা
. নিয়ে গেছে
. সময়ের রথে।
তবু তুমি একবার পিছনেতে চাও।