মাইকেল মধুসূদন দত্তর কবিতা
*
শ্রী পঞ্চমী
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

নহে দিন দূর, দেবি, যবে ভূভারতে
বিসর্জ্জিবে ভূভারত, বিস্মৃতির জলে,
ও তব ধবল মূর্ত্তী সুদল কমলে ;----
কিন্তু চিরস্থায়ী পূজা তোমার জগতে!
মনোরূপ-পদ্ম যিনি রোপিলা কৌশলে
এ মানব-দেহ-সরে, তাঁর ইচ্ছামতে
সে কুসুমে বাস তব, যথা মরকতে
কিম্বা পদ্মরাগে জ্যোতিঃ নিত্য ঝলঝলে!
কবির হৃদয়-বনে যে ফুল ফুটিবে,
সে ফুল-অঞ্জলি লোক ও রাঙা চরণে
পরম-ভকতি-ভাবে চিরকাল দিবে
দশ দিশে, যত দিন এ মর ভবনে
মনঃ-পদ্ম ফোটে, পূজা, তুমি, মা, পাইবে!—
কি কাজ মাটীর দেহে তবে, সনাতনে?

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কবিতা
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

অন্ধ যে, কি রূপ কবে তার চক্ষে ধরে
নলিনী ? রোধিলা বিধি কর্ণ-পথ যার,
লভে কি সুখ কভু বীণার সুস্বরে ?
কি কাক, কি পিকধ্বনি,--- সম-ভাব তার !
মনের উদ্যান-মাঝে, কুসুমের সার
কবিতা-কুসুম-রত্ন ! ----দয়া করি নরে,
কবি-মুখ-ব্রহ্ম-লোকে উরি অবতার
বাণীরূপে বীণাপাণি এ নর-নগরে |---
দুর্ম্মতি সে জন, যার মনঃ নাহি মজে
কবিতা-অমৃত-রসে ! হায়, সে দুর্ম্মতি,
পুষ্পাঞ্জলি দিয়া সদা যে জন না ভজে
ও চরণপদ্ম, পদ্মবাসিনি ভারতি !
কর পরিমলময় এ হিয়া-সরোজে—
তু  ষ যেন বিজ্ঞে, মা গো, এ মোর মিনতি |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
আশ্বিন মাস
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

সু-শ্যামাঙ্গ বঙ্গ এবে মহাব্রতে রত |
এসেছেন ফিরে উমা, বত্সরের পরে,
মহিষমর্দ্দিনীরূপে ভকতের ঘরে ;
বামে কমকায়া রমা, দক্ষিণে আয়ত-
লোচনা বচনেশ্বরী, স্বর্ণবীণা করে ;
শিখীপৃষ্ঠে শিখীধ্বজ, যাঁর শরে হত
তারক--- অসুরশ্রেষ্ঠ ;  গণ-দল যত,
তার পতি গণদেব, রাঙা কলেবরে
করি-শিরঃ ;---- আদিব্রহ্ম বেদের বচনে |
এক পদ্মে শতদল !  শত রূপবতী –
নক্ষত্রমণ্ডলী যেন একত্রে গগনে !---
কি আনন্দ !  পূর্ব্ব কথা কেন কয়ে, স্মৃতি,
আনিছ হে বারি-ধারা আজি এ নয়নে ?---
ফলিবে কি মনে পুনঃ সে পূর্ব্ব ভকতি ?

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সায়ংকাল
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

চেয়ে দেখ, চলিছেন মৃদে অস্তাচলে
দিনেশ, ছড়ায়ে স্বর্ণ, রত্ন রাশি রাশি
আকাশে |  কত বা যত্নে কাদম্বিনী আসি
ধরিতেছে তা সবারে সুনীল আঁচলে !---
কে না জানে অলঙ্কারে অঙ্গনা বিলাসী ?
অতি-ত্বরা গড়ি ধনী দৈব-মায়া-বলে
বহুবিধ অলঙ্কার পরিবে লো হাসি,----
কনক-কঙ্কণ হাতে, স্বর্ণ-মালা গলে !
সাজাইবে গজ, বাজী ; পর্ব্বতের শিরে
সুবর্ণ কিরীট দিবে ; বহাবে অম্বরে
নদস্রোতঃ, উজ্জ্বলিত স্বর্ণবর্ণ নীরে !
সুবর্ণের গাছ রোপি, শাখার উপরে
হেমাঙ্গ বিহঙ্গ থোবে ! --- এ বাজী করি রে
শুভ ক্ষণে দিনকর কর-দান করে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সায়ংকালের তারা
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কার সাথে তুলনিবে, লো সুর-সুন্দরি,
ও রূপের ছটা কবি এ ভব-মণ্ডলে ?
আছে কি লো হেন খনি, যার গর্ভে ফলে
রতন তোমার মত, কহ, সহচরি
গোধূলির ? কি ফণিনী, যার সু-কবরী
সাজায় সে তোমাসম মণির উজ্জ্বলে ?---
ক্ষণমাত্র দেখি তোমা নক্ষত্র-মণ্ডলে
কি হেতু ? ভাল কি তোমা বাসে না শর্ব্বরী ?
হেরি অপরূপ রূপ বুঝি ক্ষুণ্ণ মনে
মানিনী রজনী রাণী, তেঁই অনাদরে
না দেয় শোভিতে তোমা সখীদল-সনে,
যবে কেলি করে তারা সুহাস-অম্বরে ?
কিন্তু কি অভাব তব, ওলো বরাঙ্গনে,---
ক্ষণমাত্র দেখি মুখ, চির আঁখি স্মরে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিশা
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

বসন্তে কুসুম-কুল যথা বনস্থলে,
চেয়ে দেখ, তারাচয় ফুটিছে গগনে,
মৃগাক্ষি ! --- সুহাস-মুখে সরসীর জলে,
চন্দ্রিমা করিছে কেলি প্রেমানন্দ-মনে |
কত যে কি কহিতেছে মধুর স্বননে
পবন—বনের কবি, ফুল্ল ফুল-দলে,
বুঝিতে কি পার, প্রিয়ে ? নারিবে কেমনে,
প্রেম-ফুলেশ্বরী তুমি প্রমদা-মণ্ডলে ?
এ হৃদয়, দেখ, এবে ওই সরোবরে,--
চন্দ্রিমার রূপে এতে তোমার মূরতি !
কাল বলি অবহেলা, প্রেয়সি, যে করে
নিশায়, আমার মতে সে বড় দুর্ম্মতি |
হেন সুবাসিত শ্বাস, হাস স্নিগ্ধ করে
যার, সে কি কভু মন্দ, ওলো রসবতি ?

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিশাকালে নদী-তীরে বটবৃক্ষতলে শিব মন্দির
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

রাজসূয়-যজ্ঞে যথা রাজাদল চলে
রতন-মুকুট শিরে ; আসিছে সঘনে
অগণ্য জোনাকীব্রজ, এই তরুতলে
পূজিতে রজনী-যোগে বৃষভ-বাহনে |
ধূপরূপ পরিমল অদূর কাননে
পেয়ে, বহিতেছে তাহে হেথা কুতূহলে
মলয় ; কৌমুদী, দেখ, রজত-চরণে
বীচী-রব-রূপ পরি নূপুর, চঞ্চলে
নাচিছে ; আচার্য্য-রূপে এই তরু-পতি
উচ্চারিছে বীজমন্ত্র |  নীরবে অম্বরে
তারাদলে তারানাথ করেন প্রণতি
( বোধ হয় ) আরাধিয়া দেবেশ শঙ্করে !
তুমিও, লো কল্লোলিনি, মহাব্রতে ব্রতী,---
সাজায়েছ, দিব্য সাজে, রব কলেবরে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ছায়া-পথ
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কহ মোরে, শশিপ্রিয়ে, কহ, কৃপা করি,
কার হেতু নিত্য তুমি সাজাও গগনে,
এ পথ,--- উজ্জ্বল কোটি মণির কিরণে ?
এ সুপথ দিয়া কি গো ইন্দ্রানী সুন্দরী
আনন্দে ভেটিতে যান নন্দন-সদনে
মহেন্দ্র,--- সঙ্গেতে শত বরাঙ্গী অপ্সরী,
মলিনি ক্ষণেক কাল চারু তারা-গণে ---
সৌন্দর্য্যে ? --- এ কথা দাসে কহ, বিভাবরি !
রাণী তুমি ; নীচ আমি ; তেঁই ভয় করে,
অনুচিত বিবেচনা পার করিবারে
আলাপ আমার সাথে ; পবন-কিঙ্করে,---
ফুল-কুল সহ কথা কহ দিয়া যারে,
দেও কয়ে ; কহিবে সে কানে, মৃদুস্বরে,
যা কিছু ইচ্ছুক, দেবি, কহিতে আমারে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কুসুমে কীট
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কি পাপে, কহ তা মোরে, লো বন-সুন্দরি,
কোমল হৃদয়ে তব পশিল,--- কি পাপে---
এ বিষম যমদূত ? কাঁদে মনে করি
পরাণ যাতনা তব ; কত যে কি তাপে
পোড়ায় দুরন্ত তোমা, বিষদন্তে হরি
বিরাম দিবস নিশি !  মৃদে কি বিলাপে
এ তোমার দুখ দেখি সখী মধুকরী,
উড়ি পড়ি তব গলে যবে লো সে কাঁপে ?
বিষাদে মলয় কি লো, কহ, সুবদনে,
নিশ্বাসে তোমার ক্লেশে, যবে লো সে আসে
যাচিতে তোমার কাছে পরিমল-ধনে ?
কানন-চন্দ্রিমা তুমি কেন রাহু--গ্রাসে ?
মনস্তাপ—রূপে রিপু, হায়, পাপ-মনে,
এইরূপে, রূপবতি, নিত্য সুখ নাশে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বটবৃক্ষ
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে ,
নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি,
তরুরাজ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে,
বিধির করুণা তুমি তরু-রূপ ধরি !
জীবকুল-হিতৈষিণী, ছায়া সু-সুন্দরী,
তোমার দুহিতা, সাধু! যবে বসুধারে
দগধে আগ্নেয় তাপে, দয়া পরিহরি,
মিহির, আকুল জীব বাঁচে পূজি তাঁরে |
শত-পত্রময় মঞ্চে, তোমার সদনে,
খেচর----অতিথি—ব্রজ, বিরাজে সতত,
পদ্মরাগ ফলপুঞ্জে ভুঞ্জি হৃষ্ট—মনে  ;---
মৃদু-ভাষে মিষ্টালাপ কর তুমি কত,
মিষ্টালাপি, দেহ-দাহ শীতলি যতনে !
দেব নহ ; কিন্তু গুণে দেবতার মত |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর