মাইকেল মধুসূদন দত্তর কবিতা
*
সৃষ্টিকর্ত্তা
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কে সৃজিলা এ সুবিশ্বে, জিজ্ঞাসিব কারে
এ রহস্য কথা, বিশ্বে, আমি মন্দমতি ?
পার যদি, তুমি দাসে কহ, বসুমতি ;---
দেহ মহা-দীক্ষা, দেবি, ভিক্ষা চিনিবারে
তাঁহায়, প্রসাদে যাঁর তুমি, রূপবতি,---
ভ্রম অসম্ভ্রমে শূন্যে !  কহ, হে আমারে,
কে তিনি, দিনেশ রবি, করি এ মিনতি,
যাঁর আদি জ্যোতিঃ, হেম-আলোক সঞ্চারে
তোমার বদন, দেব, প্রত্যহ উজ্জ্বলে ?----
অধম চিনিতে চাহে সে পরম জনে,
যাঁহার প্রসাদে তুমি নক্ষত্র-মণ্ডলে
কর কেলি নিশাকালে রজত-আসনে,
নিশানাথ |  নদকুল, কহ, কল কলে,
কিম্বা তুমি, অম্বুপতি গম্ভীর স্বননে |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সূর্য্য
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

এখন ও আছে লোক দেশ দেশান্তরে
দেব ভাবি পূজে তোমা, রবি দিনমণি,
দেখি তোমা দিবামুখে উদয়-শিখরে,
লুটায়ে ধরণীতলে, করে স্তুতি—ধ্বনি ;----
আশ্চর্য্যের কথা, সূর্য্য, এ না মনে গণি |
অসীম মহিমা তব, যখন প্রখরে
শোভ তুমি, বিভাবসু, মধ্যাহ্নে অম্বরে
সমুজ্জ্বল করজালে আবরি মেদিনী !
অসীম মহিমা তব, অসীম শকতি,
হেম-জ্যোতিঃ—দাতা তুমি চন্দ্র-গ্রহ-দলে ;
উর্ব্বরা তোমার বীর্য্যে সতী বসুমতী ;
বারিদ, প্রসাদে তব, সদা পূর্ণ জলে ;---
কিন্তু কি মহিমা তাঁর, কহ, দিনপতি,
কোটি রবি শোভে নিত্য যাঁর পদতলে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
*
সীতাদেবী
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

অনুক্ষণ মনে মোর পড়ে তব কথা,
বৈদেহি !  কখন দেখি, মুদিত নয়নে,
একাকিনী তুমি সতি, অশোক কাননে,
চারি দিকে চেড়ীবৃন্দ, চন্দ্রকলা যথা
আচ্ছন্ন মেঘের মাঝে !   হায়, বহে বৃথা
পদ্মাক্ষি, ও চক্ষুঃ হতে অশ্রু-ধারা ঘনে !
কোথা দাশরথি শূর---- কোথা মহারথী
দেবর লক্ষ্মণ, দেবি, চিরজয়ী রণে ?
কি সাহসে, সুকেশিনি, হরিল তোমারে
রাক্ষস ? জানেনা মূঢ়, কি ঘটিবে পরে !
রাহু-গ্রাহ-রূপ ধরি বিপত্তি আঁধারে
জ্ঞান-রবি, যবে বিধি বিড়ম্বন করে !
মজিবে এ রক্ষোবংশ, খ্যাত ত্রিসংসারে,
ভূকম্পনে দ্বীপ যথা অতল সাগরে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
মহাভারত
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কল্পনা-বাহনে সুখে করি আরোহণ,
উতরিনু, যথা বসি বদরীর তলে,
করে বীণা, গাইছেন গীত কুতূহলে
সত্যবতী-সুত কবি,---- ঋষিকুল—ধন !
শুনিনু গম্ভির ধ্বনি ;   উন্মীলি নয়ন
দেখিনু কৌরবেশ্বরে, মত্ত বাহুবলে ;
দেখিনু পবন-পুত্রে, ঝড় যথা চলে
হুঙ্কারে ! আইলা কর্ণ---- সূর্য্যের নন্দন---
তেজস্বী |   উজ্জ্বলি  যথা ছোটে অনম্বরে
নক্ষত্র, আইলা ক্ষেত্রে পার্থ মহামতি,
আলো করি দশ দিশ, ধরি বাম করে
গাণ্ডীব ---- প্রচণ্ড-দণ্ড-দাতা রিপু প্রতি |
তরাসে আকুল হৈনু এ কাল সমরে,
দ্বাপরে গোগৃহ রণে উত্তর যেমতি |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নন্দন-কানন
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

লও দাসে, হে ভারতি, নন্দন-কাননে,
যথা ফোটে পারিজাত ; যথায় উর্ব্বশী,---
কামের আকাশে বামা চির-পূর্ণ-শশী,---
নাচে করতালি দিয়া বীণার স্বননে ;
যথা রম্ভা, তিলোত্তমা, অলকা রূপসী
মোহে মনঃ সুমধুর স্বর বরিষণে,---
মন্দাকিনী বাহিনীর স্বর্ণ তীরে বসি,
মিশায়ে সু-কন্ঠ-রব বীচীর বচনে !
যথায় শিশিরের বিন্দু ফুল্লফুল-দলে
সদা সদ্যঃ ; যথা অলি সতত গুঞ্জরে ;
বহে যথা সমীরণ বহি পরিমলে ;
বসি যথা শাখা-মুখে কোকিল কুহরে ;
লও দাসে ; আঁখি দিয়া দেখি তব বলে
ভাব-পটে কল্পনা যা সদা চিত্র করে |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সরস্বতী
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

তপনের তাপে তাপি পথিক যেমতি
পড়ে গিয়া দড়ে রড়ে ছায়ার চরণে ;
তৃষাতুর জন যথা হেরি জলবতী
নদীরে, তাহার পানে ধায় ব্যগ্র মনে
পিপাসা-নাশের আশে ; এ দাস তেমতি,
জ্বলে যবে প্রাণ তার দুঃখের জ্বলনে,
ধরে রাঙা পা দুখানি, দেবি সরস্বতী !—
মার কোল-সম, মা গো, এ তিন ভুবনে
আছে কি আশ্রম আর ? নয়নের জলে
ভাসে শিশু যবে, কে সান্ত্বনে তারে ?
কে মোচে আঁখির জল অমনি আঁচলে ?
কে তার মনের খেদ নিবারিতে পারে,
মধুমাখা কথা কয়ে, স্নেহের কৌশলে ?—
এই ভাবি, কৃপাময়ি, ভাবি গো তোমারে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ঈশ্বরী পাটনী
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

“সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী |”
                              অন্নদামঙ্গল |
কে তোর তরিতে বসি, ঈশ্বরী পাটনি ?
ছলিতে তোরে রে যদি কামিনী কমলে,---
কোথা করী, বাম করে ধরি যারে বলে,
উগরি, গ্রাসিল পুনঃ পূর্ব্বে সুবদনী ?
রূপের খনিতে আর আছে কি রে মণি
এর সম ? চেয়ে দেখ, পদ-ছায়া-ছলে,--
কনক কমল ফুল্ল এ নদীর জলে---
কোন্ দেবতারে পূজি, পেলি এ রমণী ?
কাঠের সেঁউতি তোর, পদ-পরশনে
হইতেছে স্বর্ণময় !  এ নব যুবতী ---
নহে রে সামান্যা নারী, এই লাগে মনে ;
বলে বেয়ে নদী-পারে যা রে শীঘ্রগতি |
মেগে নিস্, পার করে, বর-রূপ ধরে
দেখায়ে ভকতি, শোন্, এ মোর যুকতি !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বসন্তে একটি পাখীর প্রতি
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে,
মাধবের বার্ত্তাবহ ; যার কুহরণে
ফোটে কোটি ফুল-পুঞ্জ মঞ্জু কুঞ্জবনে !—
তবুও সঙ্গীত-রঙ্গ করিছ যে মতে
গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে !
মধুময় মধুকাল সর্ব্বত্র জগতে,---
কে কোথা মলিন কবে মধুর মিলনে,
বসুমতী সতী যবে রত প্রেমব্রতে ?---
দুরন্ত কৃতান্ত-সম হেমন্ত এ দেশে*
নির্দ্দয় ; ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি !
না দেয় শোভিতে কভু ফুলরত্নে কেশে,
পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি !---
ডাক তুমি ঋতুরাজে, মনোহর বেশে
সাজাতে ধরায় আসি, ডাক শীঘ্রগতি !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রাণ
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কি সুরাজ্যে, প্রাণ, তব রাজ-সিংহাসন !
বাহু-রূপে দুই রথী, দুর্জ্জয় সমরে,
বিধির বিধানে পুরী তব রক্ষা করে :-----
পঞ্চ অনুচর তোমা সেবে অনুক্ষণ |
সুহাসে ঘ্রাণের গন্ধ দেয় ফুলবন ;
যতনে শ্রবণ আনে সুমধুর স্বরে ;
সুন্দর যা কিছু আছে, দেখায় দর্শন
ভূতলে, সুনীল নভে, সর্ব্ব চরাচরে !
স্পর্শ, স্বাদ, সদা ভোগ যোগায়, সুমতি !
পদরূপে দুই বাজী তব রাজ-দ্বারে ;
জ্ঞান-দেব মন্ত্রী তব --- ভবে বৃহস্পতি ;----
সরস্বতী অবতার রসনা সংসারে !
স্বর্ণস্রোতোরূপে লহু, অবিরল-গতি,
বহ্নি অঙ্গে, রঙ্গে ধনী করে হে তোমারে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কল্পনা
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

লও দাসে সঙ্গে রঙ্গে, হেমাঙ্গি কল্পনে,
বাগ্ দেবীর প্রিয়সখি, এই ভিক্ষা করি ;
হায়, গতিহীন আমি দৈব-বিড়ম্বনে,---
নিকুঞ্জ-বিহারী পাখী পিঞ্জর-ভিতরি !
চল যাই মনানন্দে গোকুল-কাননে,
সরস বসন্তে যথা রাধাকান্ত হরি
নাচিছেন, গোপীচয়ে নাচায়ে ; সঘনে
পূরি বেণুরবে দেশ ! কিম্বা, শুভঙ্করি,
চল লো, আতঙ্কে যথা লঙ্কায় অকালে
পূজেন উমায় রাম, রঘুরাজ-পতি ;
কিম্বা সে ভীষণ ক্ষেত্রে, যথা শরজালে
নাশিছেন ক্ষত্রকুলে পার্থ মহামতি |--
কি স্বরগে, কি মরতে, অতল পাতালে,
নাহি স্থল যথা, দেবি, নহে তব গতি !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর