কবি নলিনীমোহন মণ্ডল-এর কবিতা
*
টাইটানিক পোত
কবি নলিনীমোহন মণ্ডল
কেশবচন্দ্র গুপ্ত ও কৃষ্ণদাস চন্দ্র সম্পাদিত “অর্চ্চনা” পত্রিকা, জৈষ্ঠ ১৩১৯ সংখ্যা (মে ১৯১২)
টাইটানিক দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৫ই এপ্রিল ১৯১২ তারিখে।

সাগরের পথে ছুটিছে নির্ভয়,
সাধ্য কার করে দিকের নির্ণয়?
ভেদিয়া ঝটিকা তরঙ্গ নিচয়,
টাইটানিক পোত ঐ জগতে বিদিত।

ডুবিবার ভয় কেহ নাহি করে,
সুবৃহৎ পোত ধরণী ভিতরে,
ভীরুর ও বাসনা ভ্রমিতে সাগরে ;
নির্ম্মাণ-নৈপূণ্য হেরি সকলে বিস্মিত॥

তুলি উচ্চ শির আকাশ ভেদিয়া,
সগর্ব্বে ব্রিটিশ পতাকা ধরিয়া,
পবনের বেগে চলিছে ধাইয়া,
উপেক্ষিয়া জলধিরে করিয়া বিদ্রূপ।

করিল এ পোত সিন্ধু-দর্প চূর ;
সাগরের পথে বাইতে সুদূর,
আরোহিরা লভে আনন্দ প্রচুর,
স্বপনে করেনি শঙ্কা কেহ কোনরূপ॥

সাগরের জলে ডুবিল তপন,
আঁধার আকাশ, বারিধি ভীষণ,
উঠিছে পড়িছে ঊর্ম্মি অগণন,
নীরধিতে প্রকৃতির প্রমত্ত আকার।

জলধির বক্ষে গভীর নিশায়,
আরোহিরা কেহ সুখে নিদ্রা যায়,
কেহ বা নিমগ্ন স্বদেশ চিন্তায়,
কেহ হাসে কেহ খেলে, উল্লাস সবার॥

তুষার পর্ব্বতে সহসা আহত,
বাজিল সহস্র অশনির মত,
নিয়তির চক্র ঘুরিছে নিয়ত,
বিদীর্ণ অর্ণবপোত, কাঁপিল সঘনে।

চমকি উঠিল আরোহি সকলে,
কাঁদিল সন্তান জননীর কোলে,
আর্ত্তনাদ উঠে রমণি-মণ্ডলে,
চকিতে চাহিল স্বামী প্রেয়সী-বদনে॥

“পোতাধ্যক্ষ ত্বরা ঈঙ্গিতে জানায়,---
সাবধান হও আরোহি সবায়,
বিপদ নিকটে, নাহিক উপায়,
জীবন রাখিতে ধর জীবন-তরণী।

বাঁচাও রমণী শিশুর পরাণ---
বীরদম্ভে মর ব্রিটিশ-সন্তান---
ব্রিটিশ তোমরা বিটেনের মান---
বিটিশ-শোণিতে পূর্ণ, সবার ধমনী॥”

কেহ যায় ছুটে কেহ পায়ে লুটে---
কেহ বা স্তম্ভিত, কথা নাহি ফুটে---
কেহ বা কাপ্তেনে ধরি করপুটে
কাতরে যাচিছে স্বীয় পতি ভিক্ষাদান।

কেহ না তাদের শুনে হাহাকার ;
গভীরা রজনী, চৌদিক আঁধার,
দুস্তর বারিধি অতল অপার,
ঈশ্বরে সঁপিল প্রাণ, পেতে পরিত্রাণ॥

ফুরাইল সব প্রাণের বাসনা
মুখে নাহি বাণী নাহিক চেতনা
বেহাগে করুণে বাজিল বাজনা
সাগর-কল্লোল সনে মিশিল সে স্বর।

সিন্ধু গ্রাসে পোত উচ্চ নাদ তুলি,
প্রেমের প্রতিমা, স্নেহের পুতুলি,
কোথা গেল সব ধরণীরে ভুলি!
পূত স্মৃতি ধরামাঝে জাগে নিরন্তর॥

.              ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর