ভ্যাবলা কান্ত কবি নিমাই মিত্র মিলনসাগরে প্রকাশকাল ০৯.০৯.২০১৫
সকলে ওকে ভ্যাবলা কান্ত নামেই চিনত। কিন্ত ওর আসল নাম ছিল শ্রী শ্রীকান্ত। যখন চালের দাম আড়াই টাকা কিলো পাঠ শেষে ভ্যাবলা একটা কাজ জুটিয়েছিল। ছোট ভাই বোন মিলে ওরা তিন জন মা বাবা এবং পাশে থাকত আত্মীয় স্বজন। পাড়া পড়শি বলে ভ্যাবলার ভাগ্য ভাল সেই সুফলেই নাকি চাকরিটা পেয়েছিল।
যাকগে, যখন বয়স বেড়ে হল ঊনত্রিশ বিয়ের দিন ঠিক হল মাঘের শেষে চব্বিশ। মেয়ের বাড়ি ডাইনে বেঁকে সোজা উত্তরে তেমন কাছে নয়, সাড়ে তিন ক্রোশ দূরে। স্রোত না চলা ছোট্ট এক চরা নদীর বাঁয়ে মোটামুটি পরিচিত এক গঞ্জ শহর গাঁইয়ে। আশেপাশে বাঁশ বাগানের ফালে গড়া গ্রাম বর্ষা কালে ফলে অনেক আনাজ লেবু জাম। সেই গাঁয়ে দুপুর রাতে টোপর মাথায় দিয়ে এক কান্না ভেজা কনের সাথে ভ্যাবার হল বিয়ে। নানান লোকের আনাগোনায় ভর্তি বিয়ে বাড়ি একটু তবু এদিক সেদিক ছিল কেউ তারি। লোকের ভিড়ে ভ্যাবলা প্রথম ঘাবড়ে গিয়েছিল ভাবল মনে, বিয়ের দিনে একি বিপদ হল ? সবই কেমন হছে যেন ভীষণ এলোমেলো। ক’দিন বাদেই সব অবসাদ ক্ষান্ত হয়ে গেল।
দুতিনটি দিন কাটত মজায় শ্বশুর বাড়ি গেলে লাগত ভাল আড়াল থেকে বৌয়ের দেখা পেলে কোনদিনই গিন্নি সাথে হয় নি ঝগড়াঝাটি ভালবেসে হত আড়ি মনের কাটাকাটি। পাড়ার সকলে বলত ডেকে দেখলে তো শ্রীকান্ত শাড়ির আঁচল কেমন করে করলে তোমায় শান্ত?
হাসি খেলায় আমোদ করে কাটতে থাকে দিন চাওয়া পাওয়ার হিসাব কষে দুর্ভাবনা লীন। এমনি করে ক্রমে যখন কাটল বছর দশ হঠাৎ করে সংসারটায় ভাঙল নেমে ধ্বস। বউটা জ্বরে হারিয়ে গেল অচেনা এক দেশে ভ্যাবলা কান্ত দিশেহারা, গেল নিরুদ্দেশে ।
চিনেছি তোমায় কবি নিমাই মিত্র মিলনসাগরে প্রকাশকাল ০৯.০৯.২০১৫
পূর্ণ যৌবনে যখন তোমার দোলায়িত অঘ্রাণ দূর হতেও অনুভব করেছি সুবাসিত সুঘ্রাণ। নিরীক্ষণ করে শান্ত ঝিলমিল হাসি মুখ ভীষণ বিষণ্ণ হৃদয়ও পেয়েছিল নানা সুখ। জ্যোৎস্নার অঙ্গনে চুপিসারে কোলে তুলে রেখেছিলাম একান্তে চন্দ্রিমা ছায়াতলে। শুধু আদর লেপে তন্দ্রা ভরেছি দুই চোখে তৃপ্তির মোহে জড়িয়ে ধরেছি অশান্ত বুকে। ক্লান্তির শেষে শান্তির অবসরে দুলে দুলে তুমি আর আমি বেড়িয়েছি কত দিগন্ত ভুলে। কোথায় হারালে নিমেষে কে জানে অবশেষে তারপর কতকাল পরে দেখা, অবেলায় এসে। গঞ্জ শহর এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে দশ দিক আজ সেই তোমাকেই চিনতে পেরেছি আমি ঠিক। এই অবেলায় এসেও তোমায় আনমনে দেখি যত এখনো তুমি সুন্দরী যেন ঠিক প্রথম দিনের মত।
রেলগাড়ি চলে যায় কবি নিমাই মিত্র মিলনসাগরে প্রকাশকাল ০৯.০৯.২০১৫
সারাদিন ঝিকঝিক রেলগাড়ি চলে যে ভাবনা বসে ভাবে কবে বাড়ি যাবে সে। বাসা বাড়ির অদূরেই বড় রেল স্টেশান কত লোক ওঠে নামে হাসে কাঁদে গায় গান। বাউল কন্ঠ ছাড়ে লোক কথা সাজিয়ে অন্ধ গান তোলে ডুগডুগি বাজিয়ে। প্ল্যা্টফরম গমগম্ লুচি পুরি আহারে আম জাম লেবু কলা নানা ফল বাহারে।
প্রতিদিন কতবার রেলগাড়ি চলে যায় কিছুতেই ডাকবেনা যতই না যেতে চায়। মনে মনে বকে দেয় তুই বড় নিষ্ঠুর আড়চোখে রেলগাড়ি চলে যায় বহুদূর। ভোঁ বাজায় ইঞ্জিন কামরূপ এক্সপ্রেস আজকের যাত্রায় হাওড়ায় কাল শেষ। তবু যেন মনে হয় সব কিছু ফাঁকারে ভাবনা নির্জনে থাকে বিশ্বের ওপারে।
প্রথম দিনের মত কবি নিমাই মিত্র মিলনসাগরে প্রকাশকাল ০৯.০৯.২০১৫
ঠিক দুপুরের একটু পরে সূর্য তখন হেলে পড়ে , দূর আকাশে এলোমেলো একটু সাদা একটু কালো ঘন মেঘের পাঁজর ছিঁড়ে তপন দহন এলো ফিরে । তপ্ত পাগল রোদের কণা এদিক সেদিক ছড়িয়ে সোনা নামলো নীচে উঠোন পাড়ে তুলসী বেদীর একাধারে। ছাউনি পাতা গাছের ডালে ঢেউ খেলা টিনের চালে সিমেন্ট লেপা ইট পাথরে শান্তি নীড়ে বসার ঘরে। চাদর পেতে পালিশ খাটে হেলান দিয়ে বালিশ পিঠে কিংবা কখন সোফায় বসে ঠোঁট রাঙিয়ে পানের রসে। ঘরের সদর দরজা খুলে মায়ে ঝিয়ে সবাই মিলে এক মনে শুনছিল সে গান স্থায়ীর শেষে অন্তরাতে তান।
ঠিক তখনই উঠোন দ্বারে অনেকগুলি বছর পরে হাজির হল পান্থ বিশেষ মনে নিয়ে আশা অশেষ। আগন্তুকে দেখবে বলে একলা নিজেই বাইরে এলে। একটু দেখেই চেনার পরে করলে বরণ আপন করে অনেক বছর দিনের পরে ডাকলে আবার অমন করে। সেই প্রথম যেদিন দেখেছিলে তেমন করেই তাকিয়েছিলে আলতা রাঙা গাঁয়ের মেয়ে খানিক আগেই এলে নেয়ে।
অতিথি সে ধন্য হল বড় তার আমন্ত্রণে প্রথমতঃ , তার আপ্যায়নে দ্বিতীয়তঃ , তার আলাপনে তৃতীয়তঃ , সেই প্রথম দিনের মত ।
স্মৃতিকণামণি কবি নিমাই মিত্র মিলনসাগরে প্রকাশকাল ০৯.০৯.২০১৫
তুমি কেমন আছ স্মৃতিকণামণি ? কত বছর পেরিয়ে গেছে, দেখা হয় নি। তবে কখনো কোনও অবকাশে বসন্ত ঋতু কি শরৎ বাতাসে তোমার কথা যে পড়েনি মনে কিংবা ভাবিনি কারণ অকারণে তা এতটুকু সত্যি নয় কিছুতেই। এখনো ভীষণ অবাক লাগে ভাবতেই- শেষ বিকেলের বওয়া দুরন্ত তুফান অশুভ আতঙ্ক আর্ত কান্নার রোল দুঃসংবাদ হয়ে দাঁড়াল সামনে সটান। এলোমেলো চুলে তুমি চলে গেলে দূরে, আরও অনেক দূরে , আকাশ ছুঁয়েছে মোহনা যেখানে সেই তীরে।
তুমি নিঝুম রাতের স্বপ্ন মধুর পরী ছিলে সাকাল সাঁঝে প্রিয় অনন্যা নারী। দুচোখে পড়েনি কখনো একটি অশ্রু কণা ছিলে করুণা বিমুখ পেয়েও গ্লানি বেদনা। মান অপমান নীরবে সয়েও রয়েছ অব্যক্ত
সুচেতনা করেছিল ভিত আরো দৃঢ় শক্ত। দেখেছ পিতার মলিন হওয়া নির্মল মুখ-হাসি , মাতৃ হৃদয়ে পাষাণ জমেছে কেঁদে অনন্ত রাশি। নিরাময় তরে সান্ত্বনা বাণী ছিল না তোমার কাছে জ্বালা যন্ত্রণা হারমানা ছাড়া আর সব ছিল মিছে। আত্মাভিমানে আঁধার দুয়ারে তাই বুঝি ঠাঁই নিলে প্রয়াস হয়নি ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ হবে বলে।
জানো কেমন তর ? ক্লান্তি শেষে ঘুমিয়ে পড়া স্তব্ধ আঁধার রাতে জোনাক যখন আলোর মেলায় বেড়ায় উড়ে ঘুরে ঝিঁঝিঁ তখন আমোদ করে ডাকে রিরি স্বরে , যৌবনা এক ছোট্ট চারা গাছে শান্ত কোমল ঝিরিঝিরি কচি পাতার শিরে উছল হাসির দ্যুতি নিয়ে চুপটি করে বসে- কামিনীর সেই স্পর্শ বিহীন গন্ধ পাগল করা কুঁড়ি ফোটা বরফ সাদা ফুলটি যেমন – ওরই মত। শীতের রাতের শিশির স্নাত ফুলের রাশি দেবালয়ে উপচে পড়ে ঝুড়ি বেয়ে , লজ্জাবতীর হাসির ঝিলিক ঘাসের পথে পথিক মাতায় স্নিগ্ধ ঘ্রাণে – ওরই মত । কিংবা যেন সবুজ রঙের নতুন পাতার মাঝে হঠাৎ মেলে দেখা – হলদে রঙের ঐ যে ফোটে ফুল সে গো চাঁপা – ওরই মত । কুঁড়িয়ে নিয়ে তোমায় ফাঁকি দিয়ে আপন মনে সাজিয়ে নিয়ে ডালা যত্ন করে রেখে ছিলেম আমার অনেক কাছে তখন তুমি বুঝতে পারনি তা ।