কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়ার গান ও কবিতা
*
বাবা কে জানে না, মা গিয়েছে কাজে
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

বাবা কে জানে না, মা গিয়েছে কাজে
দিদির বয়স সাত
দেড় বছরের নোংরা শিশুটা
চেটে খায় ফুটপাথ |
পাশেই মেট্রোরেলের বাইরে
সূর্য ঢালছে খিদে
সরু ফুটপাথে বেয়াড়া আপদ
হাঁটা কী যে অসুবিধে !
আমি চলে যাই যে ভাবে সবাই
চলেছে স্রোতের মতো
কী হবে তা দেখে বুকে লিখে রেখে
মধ্যদিনের ক্ষত !

শিশু কাঁদলে দিদি ছুটে আসে
বুকে তুলে নেয় তাকে
খুরি ভরে তার ঠোঁটে দেয় জল
সান্ত্বনা খিদে ঢাকে
পাশেই সিনেমা হলের বাইরে
ভিড় করে থিক থিক
তরুণীর চোখে রোশন জ্বলছে
হৃত্বিক হৃত্বিক !

আমি চলে যাই যেভাবে সবাই
চলেছে স্রোতের মতো
কী হবে তা দেখে গানে লিখে রেখে
মধ্যদিনের ক্ষত |

যারা ভালো আছো আরো ভালো বাঁচো
ভরে নাও দুই হাত
সাত দশকের স্বাধীন স্বদেশ
চেটে খাক ফুটপাথ |

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কাঁদতে কাঁদতে এখনও কান্না আছে
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া
এই কবিতাটি দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার ২৩ মার্চ ২০০৭ তারিখের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
আমরা মিলনসাগরে তা সংগ্রহ করে রেখেছিলাম আমাদের
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কবিতার সংগ্রহে
আমাদের সংগ্রহে এই কবিতাটি পড়তে এখানে ক্লিক্ করুন

কাঁদতে কাঁদতে এখনও কান্না আছে,
এখনও কি বেঁচে আছে গো চোখের জল ?
নতজানু হয়ে বসেছি তোমার কাছে
ভরে দাও ভরে দাও দুটি করতল |

এতকাল ধরে ভরে দিলে এ দু-হাত
ক্ষুধার অন্নে তাই এই বেঁচে থাকা
এখন থালায় যত বার বাড়ি ভাত
কিষান তোমার রক্তে অন্ন মাখা---

এ আমার পাপ আমিও আসলে খুনি
মধ্যবিত্ত ভেসেছি বিশ্বায়নে
পুঁজির মন্ত্রে ‘রচি মম ফাল্গুনী’
মগজ রেখেছি হুজুরের শ্রীচরণে |

এখন দু-ফোঁটা অশ্রু আমায় দেবে ?
ভয় মুছে নেব বুকের গোপন ঘরে
হয়তো আমিও বুলেটের মুখে যাব
পাপ মুছে দেখা হবে জন্মান্তরে |

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বাঁচতে বাঁচতে --- সোনার নাও
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

বাঁচতে বাঁচতে --- সোনার নাও
ঢের হয়েছে মেঘ ছায়া রোদ
সোনার নাওয়ে ফসল ভরা
ঢের হয়েছে কাব্য ছেনে
গান গান মূর্তি গড়া
ঢের হয়েছে খুঁজতে যাওয়া
চেতনার শেষ সীমাও
এখন আমি কার কাছে যাই---

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিজ যোনি থেকে নিজ সন্তান
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

নিজ যোনি থেকে নিজ সন্তান
টেনে বের করে মা,
কতটা রক্ত কত যন্ত্রণা
কেউ দেখছিল না |
দু-হাত অসাড় নাড়ি ছিঁড়ে নীচে
পড়েছে সদ্যোজাত
হাসপাতালের টেবিলটি ছাড়া
কেউ দেখছিল না তো !
শুধু দুশো টাকা পারেনি মা দিতে
দিন আনে দিন খায়
অতএব তার থ্যাঁতলানো শিশু
মৃত্যু ঘুম পাড়ায় |
শিশুটির ঘিলু-মজ্জা-রক্ত
আমার শরীরে ঝরে
কার কাছে যাব কোথায় পালাব
বাঁচতে লজ্জা করে |
শিশুটিকে খুন করেছে মা নিজে,
বলে সক্কলে মিলে,
এমন কী হত ? সবাই থাকত
দুশো টাকা দিয়ে দিলে
অপরাধী মাকে বেদম পেটাল
আয়া আর ঝাড়ুদার,
‘কতটা রক্ত শরীরে শালীর
দেখে নেওয়া দরকার |’
রক্ত ফুরোল কান্না জুড়োল
মা তখন পায়ে পায়ে
দু-হাত বাড়িয়ে অনন্ত হয়ে
শিশুটির দেশে যায় |
হে মহামন্ত্রী, নেতা বা পুলিশ
দুধে ভাতে থাকো ঘরে
আমি নিরুপায় গানওয়ালা এক
বাঁচতে লজ্জা করে |

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ছিচকাঁদুনে মেঘগুলোকে
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

ছিচকাঁদুনে মেঘগুলোকে
দুহাত দিয়ে সরিয়ে দাও,
হলুদ রোদের গয়না গড়ে
দুব্বো ঘাসে ছড়িয়ে দাও,
তোমার মনের শিউলিগুলো
আজ সারারাত ঝরিয়ে দাও ;
ভোরের আলোর রুমাল দিয়ে
ফুলগুলোকে জড়িয়ে দাও |
ফুলের কাছে খুঁজো,
পুজো |
আলোর নাচে খুঁজো,
পুজো |

আজকে আমার আলোর ছুটি
ও কালো মেঘ দুয়ো
মা-র কাছে যাও ময়লা তোমার
সাবান জলে ধুয়ো |
এবার পরো আলোর পোশাক
ঝকমকানো সাদা
দেখবে কেমন তোমার ডানায়
পুজোর ছুটি বাঁধা
ফুলের কাছে খুঁজো,
পুজো |
আলোর নাচে খুঁজো,
পুজো |

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত লাগে
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত লাগে
ক্লান্ত লাগে মৃত্যুটাও
এখন আমি কার কাছে যাই
কোন্ ঘাটে ভিড়াই সোনার নাও

ঢের হয়েছে মেঘ ছায়া রোদ
সোনার নাওয়ে ফসল ভরা
ঢের হয়েছে কাব্য ছেনে
গান গান মূর্তি গড়া
ঢের হয়েছে খুঁজতে যাওয়া
চেতনার শেষ সীমাও---
এখন আমি কার কাছে যাই
কোন্ ঘাটে ভিড়াই সোনার নাও |

সোনার নাওয়ের কাছে এসে
জীবনও ভিক্ষে চায়
সোনার নাওয়ের কাছে এলে
মরণেরও কান্না পায় |

ঢের হয়েছে কান্না হাসি
চেতনার বর্ণমালা
ঢের হয়েছে বোধ পুড়িয়ে
ফসলের আগুন জ্বালা
ঢের হয়েছে সামনে চলা
ঢের হয়েছে সব থামাও
এখন আমি কার কাছে যাই
কোন্ ঘাটে ভিড়াই সোনার নাও |

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আপাদমস্তক, ভদ্দরলোক
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

আপাদমস্তক,
আমি এখন বুদ্ধিজীবী ভদ্দরলোক |
এক লহমায় বিক্রি করি
চুল থেকে পায়ের নখ,
ভদ্দরলোক |

ধান্দাবাজির সব সুতোতেই
বাঁদর নাচ নাচতে পারি
স্বপ্নতে রোজ ধান্দা মেশাই
ধান্দা ধান্দা পেশাদারি |

রাজনীতির বড়দাদাদের
খাচ্ছি চুমু যথাস্থানে
মধু কিছু মিলতে পারে
রাজনৈতিক মৌ বাগানে |

অকাদেমির গ্রুপ থিয়েটার
সত্যজিৎ, ক্রফো, গোদার
সুমনের গান শোনবার ঝোঁক
প্রগতিশীল ভদ্দরলোক |

রাবীন্দ্রিক ভাবকে মেশাই
আঁতেল মার্কা চায়ের ভাঁড়ে
সার্ত্রে নিয়ে টেবিল ফাটাই
বান্ধবীদের সংখ্যা বাড়ে |

রংচটা জিন্ স উদাসী চুল
পাঞ্জাবীটা খদ্দুরে হোক
তবেই না ভ্যান-গঘের মেজাজ
বলেছে আর্টিস্ট ভদ্দরলোক |

লাল জল আর নীল ছবিতে |
চারপাশ বেশ রঙিন লাগে
তখন কেমন কবি কবি
পদ্য লেখার দুঃখু জাগে |

স্বপ্ন মানে ভাতের হাঁড়ি
স্বদেশ আমার হাড়হাভাতে
আর্টে একটু এসব দিলেই
বুদ্ধিজীবী প্রথম জাতের |

নারী শরীর পণ্য হলে
তবেই জমে সৃষ্টির শোক
নারী প্রগতির পক্ষে আছি
একটু শুধু শিল্পের ঝোঁক |

প্রতিবাদ শব্দটাকে
দিই আদর্শবান বোকাকে
ন্যাংটো হবার চর্চা করি
বুদ্ধিজীবীর এই পোশাকে
গুছিয়ে নেবার চর্চাও হোক,
প্রগতিশীল ভদ্দরলোক |

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মৃত্যু তুমি কি একলাই সব চেটেপুটে নেবে
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

মৃত্যু তুমি কি একলাই সব চেটেপুটে নেবে,
কিছই দেবে না ভাঙা খুদকুঁড়ো জীবনের ভাগে ?
অনেক মৃত্যু জীবন শেখাল কিন্তু এখন,
স্বার্থপরের মতন তোমাকে একলা লাগে |

নিজেকে ভেবেছ স্বপ্নের চেয়ে ঢের বেশি দামি !
তাই কি আগুন প্রাণভোমরার ডানার ওপর
ভেবেছ সৃষ্টি তোমার দুপায়ে করবে গোলামি ?
কবিতা পোড়ানো উত্সবে তাই সাজাচ্ছ ঘর |

অথচ জীবন সমাধির  ‘পরে রেখেছে বকুল
পৃথিবীর ক্ষত স্নেহে ধুয়ে নেয় শিশিরকণা
নীলে ডুব দিয়ে আকাশ খুঁজছে জীবনের মূল
জীবন এখনও জীবনের স্নানে মোছে যন্ত্রণা |

মৃত্যু যতই অপরাজিতর মুকুট চাপাও
জড় পৃথিবীর ছক কেটে যাও রাত্রিদিন |
কিন্তু মৃত্যু সার কথাটাই কেন ভুলে যাও,
অস্তিত্ব তোমরো জীবন ছাড়া যে অর্থহীন |

.                  ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
তোমার দুচোখে ঝরে একা এক নদী
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

তোমার দুচোখে ঝরে একা এক নদী
আমার দু-হাতে ঝরে আমলকী বন
ঢেউয়ের জানালা খুলে দেখি ইছামতী |
এখানে হলুদ পাতা ঘুমাবে এখন |

বউবাজারের মোড়ে চৌরাস্তায়
ভোরের কাগজ এসে ছুঁড়ে দিয়ে যায়---
শাহেদল সুমিতের কাটা লাশ মুখ
ধার্মিক চাটছে রক্তের সুখ |
তোমার নদী কি জানে এখনও জীবন ?
এখানে হলুদ পাতা ঘুমাবে এখন |
এখন শিকড়ে মাখা ধর্মের পুঁজ
উন্মাদ ঝরছে শাখার সবুজ |

কোথায় কিশোর ঠোঁটে অপাপ ঝিনুক
প্রতিটি মানুষে খুঁজি মানুষের মুখ |
তোমার নদী কি জানে মানবিক শোক
ভালোবেসে নোনাজলে ভরবে দুচোখ,
তোমার নদী কি জানে এখনও জীবন ?
এখানে হলুদ পাতা ঘুমাবে এখন |

.               ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কত স্বচ্ছন্দ ছিল সাগর বুকের মধ্যে
কবি পল্লব কীর্ত্তনীয়া

কত স্বচ্ছন্দ ছিল সাগর বুকের মধ্যে
কত অনায়াস ছিল হৃদপিণ্ডে তুলি ডুবিয়ে
জীবনের রং বদল
দুঃসাহসের চুমুকে শেষ করা যেত
এক পেয়ালা আগুন ---
এখন চোখের জলও বেজম্মা
আকাশের কোথাও মন কেমন করা
শুদ্ধ আলো নেই
শুধু মাঝে মাঝে পলাশ শিমূলে রক্ত লাগলে
মাটিকে জড়িয়ে শুই
ধুলোকে চুমু খেতে খেতে বলি
কেউ ডাকে না,
তেমন করে কেউ ডাকে না

.               ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর