প্রিয়ম্বদা দেবীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
পরিচয়
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার ভাদ্র ১৩১৭ সংখ্যা (আগস্ট ১৯১০) থেকে
নেওয়া।

তুমি যে সুন্দর তাহা দেখিনু নয়নে
নয়ন-ভুলান এই তোমার ভূবনে ;
তুমি যে অসীম তাও জেনেছি হৃদয়ে
আপনার হৃদয়ের প্রেমের বিস্ময়ে ;
করুণা সাগর হয়ে তবু ন্যায়বান
বুঝিলাম দেখি তব এ বিশ্ব মহান,
উচ্চনীচ, ভালমন্দ যেথা নির্বিচার
ভুঞ্জে অবারিত দান আলোক আঁধার,
জল, বায়ু, পুষ্প, ফল, তব বনচ্ছায়া
নীলকান্ত আকাশের সীমাহীন মায়া,
জরা মরণের চির অমোঘ বিধান
সম্রাট দরিদ্র’পরে নিয়ত সমান।

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
অচেতন
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার আষাঢ় ১৩১৮ সংখ্যা (জুন ১৯১১) থেকে
নেওয়া।

ছিদ্র নৌকা খানি
.        বাঁধা থাকে ঘাটের কিণারে
সারাদিন কত যাত্রী
.        লয়ে যায় এপারে ওপারে
নদীর আনন্দ স্রোত
.        তারি নীচে বহে কলস্বরে
তরঙ্গেরা ছুটে এসে
.        দোল দিয়ে যায় সমাদরে।
একপারে কত লোক
.        তারি পরে যাত্রী হ’য়ে যায়
অন্য পারে আরো কত
.        বসে থাকে তারি প্রতীক্ষায়,
পার মাঝি মহানন্দে
.        নৌকা বাহি চলে ভরানীরে
তাঙা (ভাঙা ?) ছিদ্র নৌকা খানি
.        পড়ে থাকে শুষ্ক নদীতীরে ;
বুকের পঞ্জর যত
.        সবগুলি দেখা যায় তার
ভুলে কভু তার পানে
.        চাহেনাক কেহ একবার।
পার নৌকা নাহি জানে
.        আপনার সৌভাগ্য যেমন
ভগ্নতরী হতভাগ্যে
.        সেই মত নিত্য অচেতন।

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
চিরমৌন
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার ভাদ্র ১৩১৮ সংখ্যা (আগস্ট ১৯১১) থেকে
নেওয়া। এই কবিতাটি শ্রী প্রিয়ম্বদা নামে প্রকাশিত হয়েছিল! শ্রী প্রিয়ম্বদা ও প্রিয়ম্বদা দেবী
কি একই ব্যক্তি ?

হে বসন্ত বায়ু
.                তোমার আছে অনেক সুর
.                        অনেক কথা জোটে,
.                সখা তোমার সাড়া পেয়ে
.                        অনেক গানই ছোটে,

বসন্তে বনের মাঝে মর্ম্মরিয়া যাও,
নীরব আঁধার সাঁঝে, উদাসীন গাও,
বিশ্ব ভরা জাগে আশা, আকাশেতে শোক
বর্ষ কাব্যে কত ছন্দে নিত্য নব শ্লোক!

আমি শুধু পড়ে আছি ধরণীর মত ;
বহু দূরে চাপা আছে দুঃখ তাপ যত ;
অঙ্কুরিয়া ওঠে তৃণ বক্ষে নব আশা,
পুষ্প মাঝে কেঁপে সারা মোর ভালোবাসা!

সখা যবে মোর বনে সাড়া দিয়ে যাও,
কুসুমের গন্ধ লুটে ছুটিয়া পলাও ;
কুহরিয়া উঠে পিক নির্ঝরিণী গায়
আমি শুধু স্তব্ধ থাকি ধরণীর প্রায়।

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
সৌভাগ্য
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার আশ্বিন ১৩১৮ সংখ্যা (সেপ্টেম্বর ১৯১১)
থেকে নেওয়া।

যেদিন কবিতা দেবী কৃপাপরবশ
পরাণে সিঞ্চিয়া দেন তাঁর সুধারস
অকস্মাৎ সর্ব্ব ঋতু আসে যেন ছুটে
একসাথে বরষের সব ফুল ফুটে!
চাতক ময়ূর পিক কলহংস গায়
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব্ব বায়ু বহে যায়,
বর্ণগন্ধ গীতছন্দে আকুল পরাণ
কি রাখিবে কিবা ছেড়ে করিবে প্রয়াণ

পারেনা বুঝিতে, যদি এতটুকু পায়
পিছনে অনেক তবু পড়ে থাকে হায়!
ক্ষুদ্র এই সীমা বদ্ধ মানুষের মন
সে কেমনে অসীমতা করিবে ধারণ ?
অনন্ত আকাশ আকাশ বিশাল ধরায়
ঋতুগুলি একে একে দেখা দিয়ে যায়!

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
প্রেম
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার কার্তিক ১৩১৮ সংখ্যা (অক্টোবর ১৯১১) থেকে নেওয়া।

ওরে প্রেম ওরে সঙ্গোপনে
অগাধ সাগর জলে                কোথায় আছিস ফ’লে
শক্তি মাঝে মুক্তার মতন
দরিদ্রের আশাতীত ধন!

শুভ লগ্নে দুর্লভ নিমেষে
দূরতম স্বর্গ ছাড়ি                  স্বাতির অমৃত বারি
অশ্রু সমুদ্রে পড় এসে
অতুলন সৌন্দর্য্যের বেশে।

বিশ্ব মাঝে ত্রিদিবের সায়---
প্রাণপণ সাধনায়                যে তোরে খুঁজিয়া পায়
অতলের তল মিলে যায়---
মর্ত্ত্য জন্ম সার্থক তাহার!

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
সিন্ধুসংবাদ
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার পৌষ ১৩১৮ সংখ্যা (ডিসেম্বর ১৯১১) থেকে
নেওয়া।

.                ১
দিগ্বিজয়ী হে বীরেন্দ্র হে সিন্ধু মহান,
সমর উদ্যোগ নিত্য মহা অভিযান্
সাজাইয়া লক্ষ তরঙ্গের অক্ষৌহিণী
অহরব অবিরাম বিপুল বাহিণী
সংগ্রাম সঙ্গীত মত্ত, পড়িছ আছাড়ি
নিরুদ্যম তটবক্ষে ; দিগন্ত প্রসারি
অনন্ত আগ্রহ তব ব্যগ্র আয়োজন
ব্যর্থ যেন, কোথা প্রতিপক্ষ যোধগণ,
কোথা যুদ্ধ কোথা সন্ধি কোথা পরিণাম
কোথা অপার শান্তি, একান্ত বিশ্রাম
যুদ্ধ শেষে, ছুটিয়াছে রণ তুরঙ্গম
ফেণমুখ হ্রেষারবে, জয় শঙ্খসম
একাগ্র গম্ভীর, কোথা বিজয় সংবাদ
কোথা পরাজয় স্তব্ধ প্রশান্ত বিষাদ ?


.                ২
ওগো শান্ত ধরণীর উদ্যাম প্রেমিক
আন্দোলিয়া উঠিছেন, প্রসারি নির্ভীক
মত্ত তরঙ্গের বাহু আসিছ ছুটিয়া
রাত্রি দিন, চাহিতেছ লইতে লুটিয়া
প্রমত্ত আবেগভরে মিলনবিমুখ
বসুধার আলিঙ্গন, সুপ্রশান্ত সুখ
বক্ষ ভরি, এ মত্ততা’দৃপ্ত দুর্নিবার
এ অশান্তি এব্যগ্রতা ক্ষুদ্র লালসার
নিরন্তর আন্দোলন, নহে অভিনব
সৃজন প্রভাত হতে প্রচণ্ড ভৈরব
এই মত আক্রমণে আগ্রহে উচ্ছাসে
আসিছ ছুটিয়া, বসুন্ধরা ভীত শ্বাসে
পলায়ে সুদূরে, তাই মাঝে দোহাকার
সুবিশাল ব্যবধান তপ্ত বালুকার।


.                ৩
নমস্কার মহাসিন্ধু রুদ্র ভয়ঙ্কর
প্রমত্ত অধীর ভীম দুরন্ত প্রখর,
নিয়ত উদ্যোগ তব দৃপ্ত উদ্দীপনা
নিশিদিন নিরন্তর সংগ্রাম ঘোষণা
শ্রান্তিহীন অশান্ত আবেগে শান্ত আমি,
হে বিপুল হে বিরাট হে অনন্ত গামী,
আশা ছিল অবারিত প্রমুক্ত প্রসার
বিশার হৃদয়ে তব হৃদয় আমার
নিমগ্ন করিয়া রাত্রিদিন ভরি লব
চিরন্তন সমুদার সাম্য মন্ত্রে তব,
কবির সঞ্চয় অন্তহীন সান্ত্বনার
পূর্ণ পরিতোষ : শান্তি কোথা বেদনার!
মৌন আনন্দের গান হৃদয় নিভৃতে,
ভয়ার্ত্ত ব্যাকুল বক্ষ বিপ্লব সঙ্গীতে।


.                ৪
সিন্ধু তুমি সৃজনের কারম সাগর
অন্তহীন জীবনের জনম জঠর
তরঙ্গ বিক্ষোভ মত্ত অনন্ত মন্থনে
দ্বীপ পুঞ্জ, শৈলমালা সুন্দর গঠনে
উঠিছে জাগিয়া দিকে দিকে অবিরাম,
তাই শান্তি নাহি তব নাহি বিশ্রাম।
আন্দোলন, আস্ফালন, নিত্য আয়োজন
চলিয়াছে অহরহ, গম্ভীর গর্জ্জন
ধ্বনিছে নিয়ত, ওগো তুমি সে আবার
সৃজনের পরিণাম স্তব্ধ পারাবার
প্রলয়ের, চিরশান্তি ছোটে রাত্রি দিন
দূর দূরান্তর হইতে তাই সংখ্যাহীন
নদ নদী তোমাপানে, আজন্ম সঞ্চয়
ঢালি ও বিরাট বক্ষে লভিছে আশ্রয়।


.                ৫
বহুদিন য়ে হৃদয় জড় অচেতন
তার কাছে সিন্ধু তব উত্থান পতন
উদ্দাম উদ্যোগ, নিত্য অস্থির উত্সাহ
নিরন্তর আন্দোলিত এ উর্ম্মি প্রবাহ
নিয়ত কল্লোল মত্ত সঙ্গীত ভৈরব
শ্রান্তিহীন তৃপ্তিহীন অনন্ত বিপ্লব
আনে চেষ্টা আনে শক্তি আনে জাগরণ,
বিস্মৃতি বিলোপ করে, করে প্রসারণ
মুগ্ধ দৃষ্টি অনন্তের পানে। কিন্তু হায়
আপন আবেগে নিত্য উন্মাদের প্রায়
যে হৃদয় জাগ্রত অধীর নিশি দিন
তারে শান্ত কর তুমি সুষুপ্তি নিলীন
একেবারে, শ্রাবণের প্লাবন সঙ্গীতে
নির্ঝর বিলাপ স্তব্ধ যেমন চকিতে।

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
বিশ্ব-স্বয়ম্বরা
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার ফাল্গুন ১৩১৮ সংখ্যা (ফেব্রুয়ারী
১৯১২) থেকে নেওয়া।

বাসবের দীপ্ত সহস্রলোচন
.        নিমেষ-বিহীন তারা,
ধরণীর শ্যাম রূপের ধেয়ানে
.        সারানিশি জেগে সারা!

বরুণ কাঁদিছে করুণ রোদনে
.        নিয়ত সাগর জলে,
শ্যামা বসুধার প্রেমের লাগিয়া
.        পড়িয়া চরণ তলে!

করিতেছে বায়ু ক্ষয় পরমায়ু
.        নিশিদিন হাহাকার,
শ্যামল তনুর পরশ লালসে
.        ছুটে আসে বার বার!

অন্তহীন ব্যোম সুধাভরা সোম
.        তোমারে মিনতি করে,
দিহন্তে লুটায়, জ্যোত্স্নাধারায়
.        সোহাগে ঘেরিয়া ধরে!

একব্রতা তুমি ওগো মর্ত্ত্যভূমি,
.        সতী পার্ব্বতীর মত ;---
শিবের মতন শুভ্র কিরণ
.        সবিতায় ধ্যানরত!

তুষ্ট আরাধনে অক্ষয় যৌবনে
.        সাজালেন কলেবর,
পুষ্পধনুর কুসুমমাধুরী
.        চিরদিন সহচর,

প্রচ্ছন্ন গভীর নিবিড় তিমির
.        খনির বুকের তলে
অচপল জ্যোতি মাণিকের আলো
.         তাঁহারি প্রসাদে জ্বলে!

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
বর্ষশেষ
কবি প্রিয়ম্বদা দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত, “ভারতী” পত্রিকার চৈত্র ১৩১৮ সংখ্যা (মার্চ ১৯১২) থেকে নেওয়া।

গেল বর্ষ গেল পুরাতন,
হিমবায়ু তিরোধান,                  স্বপ্ন সম অবসান
বসন্তের সুখের স্বপন,
রাঙায়ে ধরণীতল                    ঝরিল অশোক দল
হোরি খেলা হল সমাপন।
ফুটায়ে আমের গুটি                   মুকুল পড়িল টুটি
মধু তার সার্থক জীবন।

অস্তে গেল বর্ষ পুরাতন,
চৈতালি শস্যের ভার                  ক্ষীণ প্রাণ সুকুমার
গোধূলির কিরণ যেমন,
ধরার বুকের পরে                 আজিকে লুটায়ে প’ড়ে
বিছাইল বিশ্রাম শয়ন,
শূন্য মাঠ শস্যহীন                       সুদূর দিগন্তে লীন
ঝঞ্ঝার শেষে সিন্ধুর মতন!

যাবে বর্ষ আসিবে নূতন,
দীক্ষার আদেশ দিয়ে                  চলিল বিদায় নিয়ে
চৈত্র শেষ সন্ধ্যার তপন,
শঙ্খসনে বাজে ঢাক                  বলে আজ পড়ে থাক
ক্ষণিকের তুচ্ছ আয়োজন,
সর্ব্বত্যাগী মহেশ্বর                    বিষাণে পূরিয়া স্বর
ডাক আজি দেন ঘন ঘন!

বসুন্ধরা করি যোগাসন,
বসিতে পাইবে ধ্যানে                   রুদ্ধ করি দুনয়নে
উন্মীলিয়া ললাট নয়ন,
অলোক আলোক বলে                 কমল ফুটিবে জলে
ফলে হবে অমৃত সিঞ্চন,
দূরতর দিগন্তরে                     দেখা দিবে স্তরে স্তরে
নব মেঘে নবীন জীবন।

.         *************************            
.                                                                                
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর