কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্তর কবিতা
|
শক্তিভিক্ষা
প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
ভারতী পত্রিকা, জৈষ্ঠ ১৩৩৩ সংখ্যা (এপ্রিল ১৯২৬) থেকে নেওয়া।
শক্তিদাতা শক্তিরূপী যদি কেহ রহ,
এ সৃষ্টির এ বিশ্বের সর্ব্বভার বহ,
তৃণ, ধূলি, জীব, নর নিয়ন্তা সবার,
পার্থ সম দক্ষ ধরিবারে ক্ষিতিভার,
শক্ত কর শক্তিহীনে, বীর্য্য দাও দীনে,
সভয়ে নির্ভয় কর, দৃপ্ত কর ক্ষীণে।
ঋজু কর দুঃখন্যুব্জ ব্যথাকুব্জ দেহে,
আশা-আলো জ্বালো আশা-হত হৃদিগেহে,
ক্লিষ্ট পিষ্ট চিত্তে মোর শকতি বিদ্যুৎ
ঝলকি খেলায়ে দাও, জাগুক অদ্ভুত
নব বেগ, নব বল, নব প্রভঞ্জন,
শূলপাণি মহেশের প্রলয় নর্ত্তন।
. দুঃখ দলি, মৃত্যু দলি, দীনতা ক্ষীণতা
. ভীম সম করি নাশ সকল ক্ষুদ্রতা।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
সপ্তর্যি
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
সুকুমার সেন সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” প্রথম খন্ড থেকে নেওয়া।
. [ রামমোহন রায় ]
সত্যজ্ঞান, আত্মজ্ঞান, এ বিশ্বচৈতন্যজ্ঞান উদ্বোধিত ভারতের বুকে ;
সে জ্ঞান আছিল গুপ্ত শত শত শতাব্দীর অজ্ঞতার লাঞ্ছনা দুখে |
হে রাম, হে ধনুষ্পাণি, প্রজ্ঞা-অস্ত্রে করি ভেদ যুগ যুগ-সঞ্চিত জঞ্জাল |
লক্ষ মুগ্ধ আঁখি পরে উজলিয়া দেখাইলে সে জ্ঞানমাণিক্য রশ্মিজাল |
মূঢ়তা-নিশ্চল এই পাষাণী অহল্যা সম ভারতবর্ষেরে, তুমি রাম,
সঞ্জীবিলে স্পর্শ তব ; আজো তব প্রাণাবেগ চিত্তে তার স্পন্দে অবিরাম |
. [ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ]
আলসে বিলাসে নিরাশে যে-দেশ নতপ্রাণ
সেথায় শুদ্ধ পুণ্য যাগের বহ্নিমান
জ্বলিলে, হে বীর, আলস বিলাস ভষ্ম ছাই |
দৃপ্ত কঠোর ভাষ্ম অটল, তুলনা নাই |
পিতা তুমি নব বঙ্গের অবিনায়ক নেতা,
দুঃখ দলন দুঃখ হরণ শঙ্কা জেতা |
কর্কশ বটে গিরি তবু বুকে প্রস্রবণ,
কর্মকঠোর তব বুকে দয়া সঞ্জীবন |
. [ মধুসূদন দত্ত ]
বিদ্রোহী তুমি, উদ্দাম তুমি শাসন-জয়ী |
পদ্মা সমান প্রলয়ঙ্কর বহ্নি
শৈবালদল-রুদ্ধ বঙ্গ-কাব্য-নদী
করিলে সবেগ, উত্তাল ছোট সে নিরবধি |
গভীর রাত্রে বৈশাখ-মেঘে বজ্রসম
তব মেঘনাদে ছুটালে তন্দ্রা, নাশিলে তম |
বঙ্গের গৃহে নহ তুমি বীর প্রদীপ-শিখা,
কক্ষে কক্ষে জ্বলিলে তাহার বিজলি-শিখা |
. [ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ]
গুপ্ত ছিল ভাষা-গঙ্গা বিস্মৃতি মহেশ জটাজালে ;
হে তপস্বী ভগীরথ, সাধনা উজ্জ্বল টীকা ভালে
নিনাদিয়া শঙ্খ তুমি, সে গঙ্গারে মুক্ত করি দিয়া
শুষ্ক-বঙ্গ-চিত্ত-ক্ষেত্র প্রাণাঙ্কুরে দিলে সঞ্জীবিয়া |
দিলে রস, দিলে গতি, দিলে হর্ষ, মন্ত্র ও সাধন ;
একা পার্থ লক্ষজয়ী করে ধর্মরাজ্যের স্থাপন |
না ছিল মুকুট, দণ্ড, সিংহাসন, প্রাসাদ বিরাট |
সকলি রচিলে বলে, ছত্রদণ্ডে শোভিলে সম্রাট |
. [ স্বামী বিবেকানন্দ ]
আচার-বন্ধন-পিষ্ট জর্জরিত দেশে
দাঁড়ালে পিনাক-হস্ত ভৈরবের বেশে ;
ডঙ্কা ও বিষাণ তব ফুকারি ফুরারি
শঙ্কা দিলে ভণ্ডে যত, যত অত্যাচারী |
গুহাগুপ্ত জ্ঞানভেরী তারে তুলি নিয়া
মন্দ্রিলে যে বাণী-মুগ্ধ প্রতীচ্যের হিয়া |
বৃদ্ধ ভারতের তুমি দৃপ্ত সিংহশিশু,
ধর্মী কর্মী অতুলন---- শঙ্কর ও যীশু |
. [ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
স্নেহকোমল ছায়াশীতল শস্যশ্যামল বঙ্গভূমি ;
সে বঙ্গেরি চিত্তখানির মূর্তি যেন জাগ্ লে তুমি |
স্নেহ আছে, প্রেমও আছে, আছে ছায়া, শ্যামলতা,
কাব্যে তোমার মেঘের মায়া, পদ্মানদীর চপলতা,
ফিঙের ধ্বনি, শিশুর হাসি, প্রিয়-প্রিয়ার গাঢ় চুমা ;
হাসাও তুমি, কাঁদাও তুমি, নাচাও, বলো --- ঘুমা, ঘুমা |
দেশে দেশে সকল মানুষ একটি প্রেমের সূত্রে বাঁধা ---
শিখিয়ে দিলে, ধন্য হল প্রেমগরবী বঙ্গমাতা |
মুগ্ধ জগৎ শুনছে তোমার প্রাণ জুড়ানো মোহন বেণু,
সবার ব্যথা বাজছে তাতে—আকাশ এবং ধূলি রেণু |
কবির শিরোমণি তুমি, বঙ্গ-ভালে দীপ্ত টীকা,
বিশ্বগেহের আঁধার হরে বঙ্গ প্রদীপ স্নিগ্ধ-শিখা |
. [ জগদীশচন্দ্র বসু ]
যে প্রাণে বলিষ্ঠ নর, বিহঙ্গ, তপন, গ্রহদল
সেই প্রাণ, সেই বীর্য, সেই বেগ উদ্ভিদে উচ্ছল,---
এ গুপ্ত প্রগূঢ় সত্য মণীষা-কিরণে তুমি, কবি,
লভিলে আপন চিত্তে, প্রকাশিলে কী বিচিত্র ছবি
শেষহীন জীবনের, এক যাহা ভিন্নরূপে মিশি |
তপ্ত পূর্ব পিতৃগণ যেই সত্যলোভী প্রধী ঋষি
হেরিল অখণ্ড প্রাণ চরাচরে অদ্বৈত অব্যয়,
তাদেরি সন্তান তুমি চিনে নিলে সে প্রাণ দুর্জয় |
আত্ম-মদ-গর্ব-ঘোষী পশ্চিমের প্রচণ্ড পিনাক ----
সত্যসন্ধ ভারতের জ্ঞানমন্ত্রে বিজিত, নির্বাক |
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
মেঘের সাগর
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
ভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৭ সংখ্যা (জুলাই ১৯২০) থেকে নেওয়া।
নীল আকাশে বুকটা জুড়ে’
. আজকে মেঘের হেলাফেলা,---
সাদায়-কালোয় ধূসর মিশে’
. দেদার ভাসে, দেদার খেলা।
বর্ষা-মিলন
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
ভারতী পত্রিকা, আষাঢ় ১৩২৮ সংখ্যা (জুন ১৯২১) থেকে নেওয়া।
বাহিরে ঝরঝরে আকুল জলধারা,
শাঙন ঘন মেঘে উজল রবি হারা,
চিলের ডাক
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
ভারতী পত্রিকা, জৈষ্ঠ ১৩২৯ সংখ্যা (মে ১৯২২) থেকে নেওয়া।
শান্ত দুপুর, কান্ত নীলে মেঘের ছুটোছুটি,
রোদের ক্ষণে লুকিয়ে যাওয়া আবার ওঠা ফুটি’,
একটি দুটি ডাকছে কাকে নিকট সুদূর হতে,
চিলের ধ্বনি উঠছে কেঁপে তীব্র সরু স্রোতে---
দুপুরবেলার দগ্ধ বুকে এ কোন বাধা জাগে
তপ্ত দিশির বেদন যেন কার করুণা মাগে!
মেঘের দোলা রোদকে দোলায়, নীল রয়েছে চেয়ে,
চিলের ধ্বনি অবোধ ব্যথায় বুকটা ফেলে ছেলে।
অগ্নি-বন্দনা
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
ভারতী পত্রিকা, আষাঢ় ১৩৩০ সংখ্যা (জুন ১৯২৩) থেকে নেওয়া।
[ ঋগবেদ ১ মণ্ডল ১ সূক্ত। অগ্নি দেবতা। মধুচ্ছন্দা ঋষি ]
বন্দি অগ্নি যজ্ঞ-যাজক,
দীপ্ত, দেবতা-মিলন-সাধক,
রম্য ধনের শ্রেষ্ঠ ধারক।
অপূর্ণ মিলন
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
শ্রীমতী রাধারাণী দেবী ও শ্রী নরেন্দ্র দেব সম্পাদিত “কাব্য-দীপালি” থেকে নেওয়া।
হঠাৎ যেতে ঘোম্ টা-ফাঁকে
. একটুখানি চাওয়া
সেই ত’ আমার সুখের সাগর,
. স্বর্গ সে ত’পাওয়া |
থম্ কে গিয়ে পথের মাঝে
. একটুখানি হাসি
সেই ত’ আমার চাঁদের আলো,
. সেই ত’ মধুরাশি |
কাজের মাঝে ক্ষণিক আড়ে
. একটি দুটি কথা
সেই ত’ আমার সোহাগ আদর
. জুড়িয়ে জ্বালা-ব্যথা |
আধেক ভয়ে আধেক লাজে
. একটু চুমো খাওয়া ----
সেই ত’ আমার শূন্য বুকে
. মন্দাকিনী-পাওয়া !
বিরহে
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
শ্রীমতী রাধারাণী দেবী ও শ্রী নরেন্দ্র দেব সম্পাদিত “কাব্য-দীপালি” থেকে নেওয়া।
তোমার আমার ব্যবধানের এই যে এ পথখানি
. পথ ত’ এটি নয়,
এ যে দোঁহার মিলন-আকুল হিয়ার প্রসারতা
. মাঝ্ –পথেতে জড়িয়ে দোঁহে রয় |
এ ব্যবধান একটি যেন সূতার মত বহে ----
. দুই পাশেতে দুইটি হিয়া গাঁথে,
ব্যবধানের এই নদীতে নিতুই অবিরত
. মনের তরী আনাগোণায় মাতে |
এ ব্যবধান --- মাঝখানেতে একটি যেন আলো ---
. তুমি আমি বাতায়নে বসে’,
সেই আলোতে তোমার আমার সহজ দেখাশোনা,
. দূরে সকল বন্ধ পড়ে খসে’ |
রহস্য
কবি প্যারীমোহন সেনগুপ্ত
শ্রী প্রমথনাথ বিশী ও ডঃ তারাপদ মুখপাধ্যায় সম্পাদিত “কাব্য বিতান” থেকে নেওয়া।
প্রতিদিন সন্ধ্যাকাশে রক্তিম চিতায়
আমার জীবন হতে খ’সে পুড়ে যায়
একে একে কত না দিবস ; প্রতি সাঁঝে
উছল আঁধার মোর শ্রবণের মাঝে
চুপি চুপি বলে যায়, ---- কোথা গেল ডুবে
কোন মৌন সিন্ধু মাঝে, অতলের কূপে
ক্ষুদ্র জীবনের তব মণিমাল্য হতে
একটি রতন ; মুগ্ধ নয়নের পথে
দেখি যেন ভেসে যায় সুদূর আকাশে
একটি পরম ক্ষণ সুদীর্ঘ নিশ্বাসে |
অন্তরে চাহিয়া দেখি, ---- এ ত আগুয়ান,
দিনে দিনে চ’লে চ’লে বাড়িছে পরান ;
আবার ভাবিয়া মরি, --- এ ত পিছে যাওয়া,
এ ত শুধু দিনে দিনে মরণেরে পাওয়া ||