পৃথিবী প্রবীণ আরো হতে থাকে দ্বন্দ্বে ও সংঘাতে, মিরুজিন নদীটির তীরে নয়------ ঊরু ও জঙ্ঘাতে | নারীর প্রতীক—দেহে বাস্তবিক নেই কোনো সিঁড়ি দৃঢ়তর সিদ্ধান্ত নেয়ার?----আছে কি রূপালী গিরি ঊর্ধ্বারোহণের?----আছে যদি তবে কেন মানবিক পরিচ্ছদ হয়েছে বিলীন ?
সমুদয় জাগতিক নিয়ম-কানুন বদলাতে চেয়েছে অনেক বীর | বস্তুত, বদলে গেছে ---নারী : সভ্যতার নদীতীর ; রণনীতি ; পৃথিবীর সোনালী মানব প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী সভ্যতা গড়ে তবে নিজস্ব নিয়মে বন্দী হতে ভালবাসে |
মুদ্রায়-মননে দ্বন্দ্ব, পরাজিত আর বিজয়ীর মধ্যে বিপন্ন নির্বোধ শিল্প ভীত- চোখে ইতিউতি চায়,----বীরভোগ্য বসুন্ধরা নারী গলায় পরায় মালা---- অর্জুনের : জয়ী তরবারি ইচ্ছা মতো উপভোগ করে তাকে |
মন্দভাগ্য বলে অনুন্নত দেশের সন্তান তীব্র মনস্তাপে জ্বলে অবৈধ বাণিজ্য নয়, তাকে আজ---সমুখ সমরে শত্রুকে পরাস্ত করে--- তুলে নেল শাশ্বতের ঘরে ||
চৈত্রের এক মধ্যরাতে বুকের কপাট খুলে দু’বাহু বাড়িয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম কোনো এক নারীর জন্যে---- কৃষিজমিতে দাঁড়িয়ে যে-রকম অপেক্ষা করে উন্মুখ কৃষক ফসল-ফলানো বৃষ্টির জন্যে----
আমি অপেক্ষা করছিলাম একজন নারীর জন্যে, সম্পূর্ণ রমণী---- যার স্পর্শে এই পাথর সোনা হয়ে উঠবে ব্রোঞ্জ, তামা আর দস্তার সমারোহময় এই দেশে ;
আমি অপেক্ষা করছিলাম চৈত্রের নির্জন মধ্যরাতে দু’হাত পাখির মতো মেলে ধ’রে হৃদয়ের মধ্যযুগ-উত্সারিত সমস্ত আবেগ সঞ্চারিত ক’রে নিছক এক নারীর আকাঙ্ক্ষায়---
কী এক অচেনা আবেগের ভরে আমি অপেক্ষা করছিলাম মেঘহীন গুমোট গরমে খরাপীড়িত বাঙলায় চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে দু’বাহু মেলে ধ’রে, বুকের টনটনে ব্যথা নিয়ে এক পরিপূর্ণ নারীর জন্যে : যে নারী আমার ছোট্ট এক কামরার গুহাতুল্য বায়ুচলাচলহীন ম্রিয়মাণ ঘরে শতাব্দীর সুবাতাস বয়ে চলে আসবে অকাতরে : তার গৃহপ্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে উঠবে ঘরময় সকল আসবাব, যার প্রতি পদপাতে সুরভিত রক্তপদ্ম ফুটে উঠবে, আমার বিছানার প্রান্তে বসার সঙ্গে-সঙ্গে তার নিতম্বের নীচে একরাশ রজনীগন্ধা হেসে উঠবে---- দীর্ঘদিন অবহেলা ও অযত্নে পড়ে থাকা আমার ক’টি তুচ্ছ কবিতার বই সে স্পর্শ করামাত্র প্রতিটি পৃষ্ঠা থেকে বসরাই গোলাপের গন্ধ বেরুতে থাকবে--- অবশেষে, এই চুম্বনরহিত ঠোঁটে সে তার ঠোঁট মেলাতেই সৌগন্ধ্যমণ্ডিত আমার ওষ্ঠ থেকে অবিরল ধারায় নিঃসারিত হতে থাকবে গালিবের গজলের মতো কালজয়ী অনিঃশেষ পঙক্তি সমূহ---
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য-কোনো দাবি, অনেকে অনেক-কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায় : বাড়ি, গাড়ি, টাকাকড়ি---- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে ; আমার সামান্য দাবি : পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর---- ভাত চাই---- এই চাওয়া সরাসরি ---- ঠাণ্ডা বা গরম, সরু বা মোটা রেশনের লাল চালে হলে কোন ক্ষতি নেই ---- মাটির শানকি-ভর্তি ভাত চাই ; দু’বেলা দু’মুঠো হলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি |
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি, নেই যৌন ক্ষুধা--- চাইনি তো : নাভিনিম্নে –পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক ; যে চায় সে নিয়ে যাক---- যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে দাও---- জেনে রাখো : আমার ও-সবে কোনো প্রয়োজন নেই | যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি, তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে ; ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইস্টানিস্ট, আইন-কানুন---- সম্মুখে যা-কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে : থাকবে না কিছু বাকি---- চলে যাবে হা-ভাতের গ্রাসে | যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধরো, পেয়ে যাই---- রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে |
সর্বপরিবেশগ্রাসী হলে সামান্য ভাতের ক্ষুধা ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ ক’রে |
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা নদী-নালা, গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত, চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী--- উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি--- আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেল্ না নয় আজ |
তুমি যে-সব ভুল করতে সেগুলো খুবই মারাত্মক ছিলো | তোমার কথায় ছিল গেঁয়ো টান, অনেকগুলো শব্দের করতে ভুল উচ্চারণ : ‘প্রমথ চৌধুরী’কে তুমি বলতে ‘প্রথম চৌধুরী’ ; ‘জনৈক’ উচ্চারণ করতে গিয়ে সর্বদাই জৈনিক বলে ফেলতে | এমনি বহুতর ভয়াবহ ভুলে-ভরা ছিলো তোমার ব্যক্তিগত অভিধান | কিন্তু সে-সময়, সেই সুদূর কৈশোরে ঐ মারাত্মক ভুলগুলি তোমার বড়ো-বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলুম |
তোমার পরীক্ষার খাতায় সর্বদাই সাধু ও চলতির দূষণীয় মিশ্রণ ঘটাতে | ভাষা-ব্যবহারে তুমি বরাবরই খুব অমনযোগী ছিলে | বেশ ভালো হাবাগোবা গোছের লাজুক ও অবনতমুখী মেয়ে ছিলে তুমি | ‘শোকাভিভূত’ বলতে গিয়ে ব’লে ফেলতে ‘শোকভূত’ | তোমার উচ্চারণের ত্রুটি, বাক্যমধ্যস্থিত শব্দের ভুল ব্যবহারে আমি তখন এক ধরনের মজাই পেতুম |
২০-বছর পর আজ তোমার বক্তৃতা শুনলুম | বিষয় : ‘নারী- স্বাধীনতা’ ! এতো সুন্দর, স্পষ্ট ও নির্ভুল উচ্চারণে তোমার বক্তব্য রাখলে, যে, দেখে অবাক ও ব্যথিত হলুম |
আমার বুকের মধ্যে জেঁকে-বসা একটি পাথর বিশ বছর পর নিঃশব্দে নেমে গ্যালো ||
খণ্ডিত ব্রীজের মতো নতমুখে তোমার প্রতিই নীরবে দাঁড়িয়ে আছি : আমার অন্ধতা ছাড়া আর কিছুই পারিনি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে উপেক্ষা করো না তবু, রাণী--- তোমার অনুপস্থিতি করুণ, বেদনানয়--- বড় বেশি মারাত্মক বাজে বুকের ভিতরে কী-যে ক্রন্দনের মত্ত রলরোলে |
দালি-র দুঃস্বপ্নে তুমি, আর্তো-র উন্মাদ মনো-ভূমে, সবুজ মৎস্যের মতো অবচেতনের অবতলে রঙিন শ্যাওলা-ঝাড়ে সুজাতার মতো সরলতা |
আমার নিকট তুমি এক মূর্তিমান অভিধান খুচরো অথবা খুব দরকারি ভারি শব্দাবলি টেবিলে ঈষৎ ঝুঁকে নিষ্ঠাভাবে যে-রকমভাবে দেখে নিতে হয়, প্রয়োজনে তোমাকে তেমনি পড়ি | তুমিই আমার হও বিশ্বাস-স্থপনযোগ্য সেই বিশুদ্ধ মৌলিক গ্রন্থ : তোমাকে পড়েই শিখে নিই শব্দের সঠিক অর্থ, মূল ধাতু, নির্ভুল বানান |
তোমাকে দেখেই জেনে নিই কোন ঠিকানায় আছে সুন্দরের ঘরদোর,--- বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের বিরুদ্ধে কী-কী অস্ত্র প্রয়োগের প্রয়োজন, তা-ও জানা হয় |
তোমার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মুহূর্তেই শেখা হয় কবিতায় ব্যবহার্য সমস্ত ছন্দের মূলসূত্র | এজন্যে আমাকে কোনো প্রবোধচন্দ্রের গ্রন্থাবলি কোনোদিন পড়তে হয়নি ---- এবং একথা সত্য, পড়ব না---- যতদিন নৃত্যপর নারীর শরীর আমার চোখের সামনে প্রকৃতির মতো র’য়ে যাবে |
হরিচরণের কাছে, আপাতত , কোণো ঋণ নেই : যতদিন পৃথিবীতে তোমরা রয়েছ, ততদিন প্রয়োজন নেই কোনো ব্যাকরণ কিংবা অভিধানে ; সত্যি কথা বলতে গেলে , এমনকি দরকার নেই কোনো ফুলে | কেননা, নারীর নগ্ন শরীরের মতো ঘ্রাণময় ফুল আমি এ-জীবনে কখনো শুঁকিনি | যে সৌগন্ধ্য রয়েছে নারীর---- সে রকম গন্ধবহ ফুলের সাক্ষাৎ আমি এখনো পাইনি কোনো ফুলে | . আমার হাতের কাছে সর্বদা সরল শব্দকোষ হয়ে আছে, আজীবন | যদি বা দৈবাৎ পড়ে যাই দুর্বোধ্য, অপরিচিত, রুক্ষ শব্দাবলির সম্মুখে ---- স্বভাবত, তোমাকে দেখেই সাহস সঞ্চয় করি |
সুন্দরের দিকে রয় আমার প্রধান প্রবণতা : তোমার শরীর হয় কবিতার পবিত্র পুরাণ,