কবি রফিক আজাদ-এর কবিতা
*
শাশ্বতের ঘরে
কবি রফিক আজাদ

পৃথিবী প্রবীণ আরো হতে থাকে দ্বন্দ্বে ও সংঘাতে,
মিরুজিন নদীটির তীরে নয়------ ঊরু ও জঙ্ঘাতে |
নারীর প্রতীক—দেহে বাস্তবিক নেই কোনো সিঁড়ি
দৃঢ়তর সিদ্ধান্ত নেয়ার?----আছে কি রূপালী গিরি
ঊর্ধ্বারোহণের?----আছে যদি তবে কেন মানবিক
পরিচ্ছদ হয়েছে বিলীন ?

সমুদয় জাগতিক
নিয়ম-কানুন বদলাতে চেয়েছে অনেক বীর |
বস্তুত, বদলে গেছে ---নারী : সভ্যতার নদীতীর ;
রণনীতি ; পৃথিবীর সোনালী মানব প্রতিদ্বন্দ্বী
বিরোধী সভ্যতা গড়ে তবে নিজস্ব নিয়মে বন্দী
হতে ভালবাসে |

মুদ্রায়-মননে দ্বন্দ্ব, পরাজিত
আর বিজয়ীর মধ্যে বিপন্ন নির্বোধ শিল্প ভীত-
চোখে ইতিউতি চায়,----বীরভোগ্য বসুন্ধরা নারী
গলায় পরায় মালা---- অর্জুনের : জয়ী তরবারি
ইচ্ছা মতো উপভোগ করে তাকে |

মন্দভাগ্য বলে
অনুন্নত দেশের সন্তান তীব্র মনস্তাপে জ্বলে
অবৈধ বাণিজ্য নয়, তাকে আজ---সমুখ সমরে
শত্রুকে পরাস্ত করে--- তুলে নেল শাশ্বতের ঘরে ||

.             *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
কোনো এক নারীর জন্যে
কবি রফিক আজাদ

চৈত্রের এক মধ্যরাতে
বুকের কপাট খুলে দু’বাহু বাড়িয়ে
আমি অপেক্ষা করছিলাম
কোনো এক নারীর জন্যে----
কৃষিজমিতে দাঁড়িয়ে
যে-রকম অপেক্ষা করে উন্মুখ কৃষক
ফসল-ফলানো বৃষ্টির জন্যে----

আমি অপেক্ষা করছিলাম
একজন নারীর জন্যে, সম্পূর্ণ রমণী----
যার স্পর্শে এই পাথর সোনা হয়ে উঠবে
ব্রোঞ্জ, তামা আর দস্তার সমারোহময় এই দেশে ;

আমি অপেক্ষা করছিলাম
চৈত্রের নির্জন মধ্যরাতে
দু’হাত পাখির মতো মেলে ধ’রে
হৃদয়ের মধ্যযুগ-উত্সারিত সমস্ত আবেগ সঞ্চারিত ক’রে
নিছক এক নারীর আকাঙ্ক্ষায়---

কী এক অচেনা আবেগের ভরে
আমি অপেক্ষা করছিলাম
মেঘহীন গুমোট গরমে
খরাপীড়িত বাঙলায়
চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে
দু’বাহু মেলে ধ’রে, বুকের টনটনে ব্যথা নিয়ে
এক পরিপূর্ণ নারীর জন্যে :
যে নারী আমার ছোট্ট এক কামরার
গুহাতুল্য বায়ুচলাচলহীন ম্রিয়মাণ ঘরে
শতাব্দীর সুবাতাস বয়ে চলে আসবে অকাতরে :
তার গৃহপ্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে হঠাৎ আলোর
ঝলকানি লেগে ঝলমল করে উঠবে
ঘরময় সকল আসবাব, যার প্রতি পদপাতে
সুরভিত রক্তপদ্ম ফুটে উঠবে, আমার বিছানার
প্রান্তে বসার সঙ্গে-সঙ্গে তার নিতম্বের নীচে
একরাশ রজনীগন্ধা হেসে উঠবে----
দীর্ঘদিন অবহেলা ও অযত্নে পড়ে থাকা
আমার ক’টি তুচ্ছ কবিতার বই
সে স্পর্শ করামাত্র প্রতিটি পৃষ্ঠা থেকে
বসরাই গোলাপের গন্ধ বেরুতে থাকবে---
অবশেষে, এই চুম্বনরহিত ঠোঁটে
সে তার ঠোঁট মেলাতেই সৌগন্ধ্যমণ্ডিত
আমার ওষ্ঠ থেকে অবিরল ধারায়
নিঃসারিত হতে থাকবে গালিবের গজলের মতো
কালজয়ী অনিঃশেষ পঙক্তি সমূহ---

.         *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ভাত দে হারামজাদা
কবি রফিক আজাদ

ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি : উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে----- প্রতিপলে---- সর্বগ্রাসী ক্ষুধা !
অনাবৃষ্টি --- যেমন চৈত্রের শস্যক্ষেত্রে --- জ্বেলে দেয়
প্রভূত দাহন----- তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ !

দু’বেলা  দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য-কোনো দাবি,
অনেকে অনেক-কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায় :
বাড়ি, গাড়ি, টাকাকড়ি---- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে ;
আমার সামান্য দাবি : পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর----
ভাত চাই---- এই চাওয়া সরাসরি ---- ঠাণ্ডা বা গরম,
সরু বা মোটা রেশনের লাল চালে হলে
কোন ক্ষতি নেই ---- মাটির শানকি-ভর্তি ভাত চাই ;
দু’বেলা দু’মুঠো হলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি |

অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি, নেই যৌন ক্ষুধা---
চাইনি তো : নাভিনিম্নে –পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক ;
যে চায় সে নিয়ে যাক---- যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে দাও----
জেনে রাখো :  আমার ও-সবে কোনো প্রয়োজন নেই |
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে ;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইস্টানিস্ট, আইন-কানুন----
সম্মুখে যা-কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে :
থাকবে না কিছু বাকি---- চলে যাবে হা-ভাতের গ্রাসে |
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধরো, পেয়ে যাই----
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে |

সর্বপরিবেশগ্রাসী হলে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ ক’রে |

দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী---
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি---
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেল্ না নয় আজ |

ভাত দে হারামজাদা, তা-না হ’লে মানচিত্র খাবো |

.         *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
তুমি : বিশ বছর আগে ও পরে
কবি রফিক আজাদ

তুমি যে-সব ভুল করতে সেগুলো খুবই মারাত্মক ছিলো | তোমার
কথায় ছিল গেঁয়ো টান, অনেকগুলো শব্দের করতে ভুল উচ্চারণ :
‘প্রমথ চৌধুরী’কে তুমি বলতে ‘প্রথম চৌধুরী’ ; ‘জনৈক’ উচ্চারণ
করতে গিয়ে সর্বদাই জৈনিক বলে ফেলতে | এমনি বহুতর ভয়াবহ
ভুলে-ভরা ছিলো তোমার ব্যক্তিগত অভিধান | কিন্তু সে-সময়, সেই
সুদূর কৈশোরে ঐ মারাত্মক ভুলগুলি তোমার বড়ো-বেশি ভালোবেসে
ফেলেছিলুম |

তোমার পরীক্ষার খাতায় সর্বদাই সাধু ও চলতির দূষণীয় মিশ্রণ
ঘটাতে | ভাষা-ব্যবহারে তুমি বরাবরই খুব অমনযোগী ছিলে |
বেশ ভালো হাবাগোবা গোছের লাজুক ও অবনতমুখী  মেয়ে ছিলে
তুমি | ‘শোকাভিভূত’ বলতে গিয়ে ব’লে ফেলতে ‘শোকভূত’ | তোমার
উচ্চারণের ত্রুটি, বাক্যমধ্যস্থিত শব্দের ভুল ব্যবহারে আমি তখন
এক ধরনের মজাই পেতুম |

২০-বছর পর আজ তোমার বক্তৃতা শুনলুম | বিষয় : ‘নারী-
স্বাধীনতা’ ! এতো সুন্দর, স্পষ্ট ও নির্ভুল উচ্চারণে তোমার বক্তব্য
রাখলে, যে, দেখে অবাক ও ব্যথিত হলুম |

আমার বুকের মধ্যে জেঁকে-বসা একটি পাথর বিশ বছর পর
নিঃশব্দে নেমে গ্যালো ||

.         *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
মাধবী এসেই বলে : ‘যাই’
কবি রফিক আজাদ

খণ্ডিত ব্রীজের মতো নতমুখে তোমার প্রতিই
নীরবে দাঁড়িয়ে আছি :  আমার অন্ধতা ছাড়া আর
কিছুই পারিনি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে
উপেক্ষা করো না তবু, রাণী--- তোমার অনুপস্থিতি
করুণ, বেদনানয়--- বড় বেশি মারাত্মক বাজে
বুকের ভিতরে কী-যে ক্রন্দনের মত্ত রলরোলে |

দালি-র দুঃস্বপ্নে তুমি, আর্তো-র উন্মাদ মনো-ভূমে,
সবুজ মৎস্যের মতো অবচেতনের অবতলে
রঙিন শ্যাওলা-ঝাড়ে সুজাতার মতো সরলতা |

মুহূর্তের নীলিমায় তরুণ ধ্যানীর মনে হয়
তুমি হও ছলাকলাহীন, রূপশালী ধান-ভানা
জীবনানন্দের মনো-বাঙলার এক শাদাসিধে
নেহাৎ রূপসী | তবু কেন প্রাণপাত পরিশ্রমে
যায় না তোমাকে পাওয়া ? ---- তুমি নেই মস্তিষ্কে, হৃদয়ে |

কখনো জ্যুরিখে তুমি, কিয়োটোতে, বাম-তীরে,
গ্রীনিচ পল্লীতে কিংবা রোমে পড়ে থাক ; কখনো-বা
যোগ দাও পোর্ট-সৈয়দের নোংরা বেলেল্লাপনায় |

তোমার স্বভাব নয় স্থিরতায়----- অস্থির, অধীর
তুমি আছ অনুভবে, তুমি আছ শিশুর স্বভাবে |

ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পরিশ্রমে গড়ে-ওঠা রম্য
অট্টালিকা, স্বভাবের ডালপালা---- বিশ্ব-চরাচর |
যেন-বা কোথাও গর্জে ওঠে ভয়াবহ অগ্নিগিরি
সোনালি লাভার স্রোতে ভরে দিল গ্রাম ও নগর |
যেন গর্ভগৃহ থেকে নেমে ডিনামাইটের মতো
অসম্ভব তোলপাড় জুড়ে দিল একটি শৈশব |

অবিশ্বাস্য উষ্ণতায়, চাপে দ্রুত গলে যেতে থাকে
ঘড়ির ডায়াল আর তোমারও নিটোল অবয়ব |

তুমি সেই লোকশ্রুত পুরাতন অবাস্তব পাখি,
সোনালি নিবিড় ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে যার
চতুর্দিকে আনন্দ, টাকার থলি, ভীষণ সৌরভ !

রোমশ বালুকা-বেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে
অস্বিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে
কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে----

সুন্দর শাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে ---- ‘যাই’ ||

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
আমার অভিধান
কবি রফিক আজাদ

আমার নিকট তুমি এক মূর্তিমান অভিধান
খুচরো অথবা খুব দরকারি ভারি শব্দাবলি
টেবিলে ঈষৎ ঝুঁকে নিষ্ঠাভাবে যে-রকমভাবে
দেখে নিতে হয়, প্রয়োজনে তোমাকে তেমনি পড়ি |
তুমিই আমার হও বিশ্বাস-স্থপনযোগ্য সেই
বিশুদ্ধ মৌলিক গ্রন্থ : তোমাকে পড়েই শিখে নিই
শব্দের সঠিক অর্থ, মূল ধাতু, নির্ভুল বানান |

তোমাকে দেখেই জেনে নিই কোন ঠিকানায় আছে
সুন্দরের ঘরদোর,--- বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের বিরুদ্ধে
কী-কী অস্ত্র প্রয়োগের প্রয়োজন, তা-ও জানা হয় |

তোমার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মুহূর্তেই শেখা হয়
কবিতায় ব্যবহার্য সমস্ত ছন্দের মূলসূত্র |
এজন্যে আমাকে কোনো প্রবোধচন্দ্রের গ্রন্থাবলি
কোনোদিন পড়তে হয়নি ---- এবং একথা সত্য,
পড়ব না---- যতদিন নৃত্যপর নারীর শরীর
আমার চোখের সামনে প্রকৃতির মতো র’য়ে যাবে |

হরিচরণের কাছে, আপাতত , কোণো ঋণ নেই :
যতদিন পৃথিবীতে তোমরা রয়েছ, ততদিন
প্রয়োজন নেই কোনো  ব্যাকরণ কিংবা অভিধানে ;
সত্যি কথা বলতে গেলে , এমনকি দরকার নেই
কোনো ফুলে | কেননা, নারীর নগ্ন শরীরের মতো
ঘ্রাণময়  ফুল আমি এ-জীবনে কখনো শুঁকিনি |
যে সৌগন্ধ্য রয়েছে নারীর---- সে রকম গন্ধবহ
ফুলের সাক্ষাৎ আমি এখনো পাইনি কোনো ফুলে |
.        আমার হাতের কাছে সর্বদা সরল শব্দকোষ
হয়ে আছে, আজীবন | যদি বা দৈবাৎ পড়ে যাই
দুর্বোধ্য, অপরিচিত, রুক্ষ শব্দাবলির সম্মুখে ----
স্বভাবত, তোমাকে দেখেই সাহস সঞ্চয় করি |

সুন্দরের দিকে রয় আমার প্রধান প্রবণতা :
তোমার শরীর হয় কবিতার পবিত্র পুরাণ,

গরিবের কানাকড়ি, বিধবার শেষ শাদা শাড়ি ||

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর