কবি রমণীমোহন ঘোষের কবিতা
*
দেবশিশু
কবি রমণীমোহন ঘোষ
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত,
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকবি সরল দে সম্পাদিত পাঁচশো
বছরের কিশোর কবিতা থেকে নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।

নগ্ন শিশুটি পথপাশে বসি খেলিছে মনের সুখে,
কচি হাতে লয়ে মুঠা মুঠা ধূলি মাখিছে মাথায় বুকে |
ফুলের মতন মুখখানি ভরা মৃদু নির্মল হাস,
পাখীর কাকলিসম সুমধুর কন্ঠে অফুট ভাষ |
তস্কর সেথা আসি হেন কালে দেখে--- কোথা নাই কেহ,
খেলিছে একেলা সুকুমার শিশু, স্বর্ণভূষিত দেহ |

ত্বরিতে শিশুর দেহ হতে খুলি নিল আভরণ রাশি,
কাঁদিল না শিশু, মুখে চেয়ে তার কেবল উঠিল হাসি |
নিমেষর তরে রিক্ত-ভূষণ গৌর শিশুর পানে
চাহি---কি বেদনা উঠিল জাগিয়া চোরের কঠোর প্রাণে |
‘মরি মরি ! একি অপরূপ রূপ ! ধূলি-ধূসরিত কায়
সোনার পুতলি, শিশু-সন্ন্যাসী ! আয়, বাছা, কোলে আয় !’
এই বলি চোর কোলে লয়ে তারে ধূলি মুছি দিল ধীরে,
যেখানে যা ছিল --- রতনে ভূষণে সাজাইয়া দিল ফিরে |
কোথা গেল তার অর্থলালসা, কোথা গেল পাপে মতি,
মুগ্ধ নয়নে রহিল চাহিয়া গৌর শিশুর প্রতি |

.                  ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
জিজ্ঞাসা
কবি রমণীমোহন ঘোষ
১৯৯১ সালে প্রকাশিত, সুকুমার সেন সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” থেকে নেওয়া।  
১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৮৯৯খৃষ্টাব্দ) প্রকাশিত কবির “মুকুর” কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মিলনসাগরে
প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।

প্রভাতে সাঁজের বেলা                কত না করেছি খেলা
.        মুকুলিত উপবনে তটিনীর তীরে ;
দূরে কে গাহিত গান                  বাঁশীতে ধরিয়া তান,
.        বুঝি নাই ভাষা তার চাহি নাই ফিরে |

আজি সে বাঁশীর স্বরে               পরাণ আকুল করে
.        বিকশিয়া উঠে মনে নব সাধ, আশা ;
.        বল্ সখি, বল্ মোরে,
                  একি ভালবাসা ?

আজি মনে লয় হেন                  মধু-পূর্ণিমায় যেন
.        পুলক-চঞ্চল হৃদি-সমুদ্র আমার ;                              
আজি কোটি কোটি চোখে         অতন্দ্রিত চন্দ্রালোকে
.        শুধু দেখিবারে চাই মূরতি তাহার |
আজি সেই উপবনে               বসি সান্ধ্য সমীরণে
.        কোটি কর্ণে শুনিবারে চাহি তার ভাষা ;
.       বল্ সখি, বল্ মোরে---
.                       এক্ ভালবাসা ?

আজি হেন সাধ যায়                 প্রাণ মন সঁপি তায়
.        অধরে ফুটে না, হায়, মরমের বাণী !
শতকাজে অনিবার                 মনে পড়ে মুখ তার,
.        নিশীথে স্বপন দেখি তারি মুখখানি |
সারাদিন সারারাতি                 সে যে কল্পনার সাথী,
.        তবু সদা জাগে প্রাণে যেন কি পিপাসা !
.        বল্ সখি, বল্ সখি ----
.                       একি ভালবাসা ?

.                          ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
রূপগর্ব
কবি রমণীমোহন ঘোষ
২০১০ সালে পরিবর্ধিত ও পুনর্মুদ্রিত, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় সংকলিত ও সম্পাদিত
“বাংলা গীতিকবিতা : উনিশ শতক” কবিতার সঙ্কলন থেকে নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ -
৯.১.২০১৬।

গিরিমূলে সপ্তধারে বহে উষ্ণ বারি যেথা---
.                একদা প্রভাতে
মগধ-মহিষী ক্ষেমা স্নানে আসিলেন সেথা
.               সখীগণ সাথে |

বিম্বিসার-নৃপতির নয়নের মণি রাণী
.                  রতনে মন্ডিতা,
ঐশ্বর্যে বিলাসে মগ্না ভূবনদুর্লভ রূপ---
.                 যৌবন-গর্বিতা |

সেদিন শরদাগমে বুদ্ধ ভগবান্ আসি’
.                  গিরিব্রজপুরে
আলো করি গিরিশৃঙ্গ ভক্তবৃন্দ মাঝে ছিলা
.                  আসীন অদূরে |

সখী-মুখে বার্তা শুনি’কহে রাণী,--- “যাব আমি
.                   বুদ্ধ দরশনে,
দেখিব--- কি দেখি’ তাঁর নরনারী ছুটে আসে
.                   তাঁহার চরণে |”

নূপুরশিঞ্জিত পদে শিলাপথ বাহি’ ক্ষেমা
.                   উঠে সানুদেশে
যেথা প্রভু তথাগত --- আসন-সম্মুখে তাঁর
.                   দাঁড়াইল এসে |

দেখিল সে--- দিব্যাসনে বসিয়া আছেন দেব
.                   প্রশান্ত মূরতি,
নেত্রযুগ হ’তে ঝরে অনন্ত করুণাধারা
.                    সর্বজীব প্রতি |

সম্ভ্রমে দাঁড়ায়ে পাশে ব্যজন করিছে তাঁরে
.                    তরুণী সুন্দরী,
সৌন্দর্যের প্রভা যার ক্ষেমার অনিন্দ্যরূপ
.                    দিল ম্লান করি |

দেখিতে দেখিতে সেই বরাঙ্গনা—দেহে ঘটে
.                    কি পরিবর্তন !
কোথায় মিলায়ে গেল যৌবন-লাবণ্য তার
.                    নয়ন-রঞ্জন |

বিগত-যৌবনা প্রৌঢ়া---বৃদ্ধা জরাকবলিতা
.                    ক্রমে সে যুবতী,
বিস্ময়বিহ্বলা, ক্ষেমা নারী-রূপ যৌবনের
.                    হেরি’ পরিণতি |

ছুটিল সকল গর্ব, আকুল হৃদয়ে ভাসি’
.                    নয়নের জলে |
লুটিয়া পড়িল ক্ষেমা অমনি বুদ্ধের রাঙা
.                    পাদপদ্ম তলে |

.                          ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
মানসী
কবি রমণীমোহন ঘোষ
১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৮৯৯খৃষ্টাব্দ) প্রকাশিত কবির “মুকুর” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
বানান যথা দৃষ্টং তথা লিখিতং! মিলনসাগরে প্রকাশ - ৮.৮.২০২০।

আর কত বল                 ভূলাবে আমারে
মানসকুঞ্জবাসিনি !
নবীন শোভায় নিত্য বিকশি'
চিত্তগগনে পূর্ণিমা-শশী,
একিগো রঙ্গে খেলা কর বসি'
সুন্দর-শুভহাসিনি !
নব নব সাধ                    জাগাও পরাণে
নীরব মঞ্জুভাষিণি !


হেরি রূপ তব                     নিত্য নূতন
অয়ি নির্ম্মলবরণে।
মনে নাই কবে কোন্‌ সুলগনে
কোথা আমাদের দেখা দুই জনে ;
কি মূরতি ধরি' অয়ি বরাননে
নূপুর-মুখর চরণে
পাশেছিলে আসি'                হৃদয়ে আমার
আজ নাই তাহা স্মরণে।


সংসার নিতি                আসে মোর পাশে
হাতে লয়ে মায়া-শিকলি,
প্রকৃতি আমায় করে আবাহন
দেখায়ে তাহার শোভা অগণন ;
পারে না বাঁধিতে কেহ মোর মন---
তুচ্ছ নেহারি সকলি।
উজ্জ্বল তব                        রূপ অতুলন
জেগে থাকে হৃদে কেবলি।


তাই হেথা বসি'                  বিজন বিপিনে
বনমর্ম্মরপবনে,
মানসে শ্রীমুথ করি' দরশন,
শুনি' শুধু তব অমিয় বচন,
ভুলে' আছি আমি জীবন মরণ
কঠিন মলিন ভুবনে।
দ্রিবব রজনী                     রেখেছ ভুলায়ে
স্বর্গের নব স্বপনে।


কত নব নব                      ছলনার পাশে
রেখেছ হৃদয় বাঁধিয়া !
কভু মুখ ঢাক' টানি' আবরণ,
কখনো মুক্ত অবগুণ্ঠন,
কভু হাসি, কভু আন অকারণ---
কখনো বা উঠ কাঁদিয়া !
কখন মৌন,                     কখনো সোহাগে
সান্ত্বনা কর সাধিয়া।


কাছে থাকি' তবু            থাকিবে কি দূর ;---
কখনও চির জীবনে,
অয়ি মায়াবিনী অরুণ-অধরা,
আকুল-অলকা, নীল-অন্বরা,
বাহুবন্ধনে দিবে না কি ধরা
মর্ত্ত্য বাসর-শয়নে !
বাহিরিয়া আসি'                     অন্তর হ'তে
থাকিবে নয়নে নয়নে !

ই কবিতাটিই ২০১০ সালে পরিবর্ধিত ও পুনর্মুদ্রিত, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় সংকলিত ও সম্পাদিত
“বাংলা গীতিকবিতা : উনিশ শতক” কবিতার সঙ্কলন থেকে নেওয়া। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৮৯৯ খৃষ্টাব্দ)
প্রকাশিত কবির “মুকুর” কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।


আর কত বল ভুলাবে আমারে,
.                 মানসকুঞ্জবাসিনী !
নবীন শোভায় নিত্য বিকশি’
চিত্তগগনে পূর্ণিমা-শশী,
একি গো রঙ্গে খেলা কর বসি’
.                 সুন্দর শুভহাসিনি !
নব নব সাধ জাগাও পরাণে
.                নীরব মঞ্জুভাষিণি !
হেরি রূপ তব নিত্য নূতন,
.                 অয়ি নির্মলবরণে !
মনে নাই কবে কোন্ সুলগনে
কোথা আমাদের দেখা দুইজনে ;
কি মুরতি ধরি’ অয়ি বরাননে
.                 নূপুর-মুখর চরণে
পশেছিলে আসি’ হৃদয়ে আমার
.              আজ নাই তাহা স্মরণে |
সংসার নিতি আসে মোর পাশে
.                 হাতে লয়ে মায়া-শিকলি,
প্রকৃতি আমায় করে আবাহন
দেখা’য়ে তাহার শোভা অগণন,
পারে না বাঁধিতে কেহ মোর মন,
.                 তুচ্ছ নেহারি সকলি |---
উজ্জ্বল তব রূপ অতুলন
.                 জেগে থাকে হৃদে কেবলি !
তাই হেথা বসি’ বিজন বিপনে,
.                  বনমর্মর পবনে,
মানসে ও মুখ করি দরশন,
শুনি’ শুধু তব অমিয় বচন,
ভুলে আছি আমি জীবন-মরণ
.                  কঠিন মলিন ভুবনে |
দিবস রজনী রেখেছ ভুলায়ে
স্বর্গের নব স্বপনে |
কত নব নব ছলনার পাশে
.                   রেখেছ হৃদয় বাঁধিয়া !
কভু মুখ ঢাক টানি’ আবরণ,----
কখনো মুক্ত অবগুন্ঠন,
কভু হাসি,---- কভু মান অকারণ,
.                   কখনো বা উঠ কাঁদিয়া !
কখনো মৌন, কখনো সোহাগে
.                   সান্ত্বনা করে সাধিয়া |
কাছে থাকি তবু থাকিবে কি দূর,----
.                   কখনো চির-জীবনে,
অয়ি মায়াবিনি, অরুণ-অধরা,
আকুল-অলকা,  নীল-অম্বরা,
বাহুবন্ধনে দিবে নাকি ধরা
.                   মর্ত্য বাসর-শয়নে !---
বাহিরিয়া আসি’ অন্তর হ’তে
.                   থাকিবে নয়নে নয়নে !

.                          ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিকাশ
কবি রমণীমোহন ঘোষ
১৩৩৮ বঙ্গাব্দে (১৯৩১ খৃষ্টাব্দ) প্রকাশিত,
রাধারাণী দেবীনরেন্দ্র দেব সম্পাদিত “কাব্য-দীপালি”
সংকলনের ২য় সংস্করণ থেকে নেওয়া। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৮৯৯খৃষ্টাব্দ) প্রকাশিত কবির “মুকুর” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।

ওহে সুন্দর                            মম অন্তরে
একি উচ্ছ্বাস নব,
একি   আকুল পুলক                             হিল্লোল প্রিয়
নব সঙ্গীত রব !

আজি মধুময় ধরা         শোভা সৌরভে ভরা
নিভৃত আমার কুঞ্জ কুটীরে
আজি কি মহোত্সব !

বিকশিত আজি                     নব গৌরবে
হৃদয় কমল মম,
তাই   উচ্ছ্বসি যেন                      উঠিছে প্রাণের
লাবণ্য নিরুপম |

নবীন ভাবনা কত           ফুটে উঠে অবিরত
চেয়ে আছে তব প্রেমালোক তরে
সূর্য্যমুখীর সম |

কতদিন হায়                     জেগেছো রজনী
কতনা বিষাদভরে,
তবু    পারনি বুঝিতে                    মোরে কতশত
ব্যগ্র প্রশ্ন করে’ |

কত নব ভালবাসা             আবেগ পূর্ণ ভাষা
লজ্জা কাতরা বালিকার কাছে
বিফলে গিয়াছে মরে |

আজি ফেলে দিব                       তুচ্ছ জীর্ণ
হীন লাজ আচরণ,
তুমি   এস, হৃদয়েশ,                         হৃদি মন্দিরে
হৃদি-মন্থন ধন !

গোপন মরম মম                  দেখ অন্তরতম !
দেখ, কোন্ পদে সঁপিয়াছি আমি
তরুণ জীবন মন !


মৌন মূঢ় সে                         বালিকা চিত্তে
দেখ, কি মত্ত আশা !
আজি  মিটাতে চাহে সে                     প্রেমতৃষা তব
ঢালি চির ভালবাসা !

চাহেসে পরাণ খুলে            কহিতে শ্রবণ মূলে
যুগে যুগে যত প্রণয়িণীগণ
করিয়াছে প্রেমভাষা !

ওহে বাঞ্ছিত !                   দেখ্  আজি মোর
একি ব্যাকুলতা নব !
চাহে  ক্ষুদ্র হৃদয়                             পুরাইতে তব
আশা আকাঙ্খা সব !

রেখেছি বক্ষ ভ’রে               সান্ত্বনা তব তরে,
ওগো অতৃপ্ত আছে এ হৃদয়ে
সর্ব্ব তৃপ্তি তব |

.                          ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
আবাহন
কবি রমণীমোহন ঘোষ
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী পত্রিকার চৈত্র ১৩১৭ ( এপ্রিল ১৯১১ ) সংখ্যা থেকে
নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।

এসগো বসন্তলক্ষ্মি! ---চঞ্চল পবন
ব্যাকুল লভিতে মধু পরশ তোমার ;
তোমারে বন্দিতে আজি প্লাবিয়া ভুবন
কোকিল পাপিয়া কণ্ঠে অশ্রান্ত ঝঙ্কার।

.                          ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
মৃত্যু
কবি রমণীমোহন ঘোষ
১৩৬৯বঙ্গাব্দে (১৯৬২ খৃষ্টাব্দ) প্রকাশিত,
কবিশেখর কালিদাস রায় সম্পাদিত “মাধুকরী”
কাব্য সংকলন, থেকে নেওয়া। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৮৯৯খৃষ্টাব্দ) প্রকাশিত কবির “মুকুর”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।

.                                ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
সুখ-দুখ বিজড়িত                            এই নর জনমের
মৃত্যুই কি মহাপরিণাম ?
যত আশা ভালবাসা                      অতৃপ্ত বাসনারাশি
তারি কোলে লভিবে বিরাম!

অনন্ত সাগরতীরে                           বালুকার খেলাঘর
যদি এই মানবজীবন,
তবে কেন তার তরে                      এ বিশাল বসুন্ধরা
*
বর্ষা-আবাহন
কবি রমণীমোহন ঘোষ
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত “ভারতী” পত্রিকার আষাঢ় ১৩১০ ( জুলাই ১৯০৪ ) সংখ্যা
থেকে নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।

এস এস নব বরষা,
তাপিত-ভুবন-ভরসা।

সেগো সজলা                স্নিগ্ধ শ্যামলা
নবযৌবনা সরসা।

আন মেঘভার গগণে
গুরুগর্জনে সঘনে

আকাশের দ্বার                 খুলিয়া আবার
এস নামি’শুভলগনে।

এসগো রঙ্গে শোভনে,
উতলা আর্দ্র পবনে

আন হিল্লোল                কলকল্লোল
অলস তটিনী জীবনে।

আন নব সাধ বাসনা
জাগাও নূতন বেদনা।

আন দূরস্মৃতি                মল্লার গীতি
দিবস বিবস চেতনা।

.                          ***************                          
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পল্লী-জননী
কবি রমণীমোহন ঘোষ
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত “ভারতী” পত্রিকার পৌষ ১৩১০ ( জানুয়ারি ১৯০৪ )
সংখ্যা থেকে নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৯.১.২০১৬।

তোমার স্নেহের                        বক্ষে আবার
.               তুলে লও মোরে, জননি!
.               দেশে দেশে ফিরি বৃথা দুরাশায়
.               শ্রান্ত হৃদয়ে সন্ধ্যা বেলায়---
.               তোমার নদীর ঘাটে আসি’ আজি
.               বাঁধিয়াছি মোর তরণী।

জুড়াব আবার                        ক্লান্ত শরীর
.               তোমার শীতল পবনে ;
.               দেখিব আবার---সুনীল বরণ
.               তোমার উদার মুক্ত গগন,
.               দিগ্ দিগন্তে প্রসারিত মাঠ

.                            ***************                  
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সহযাত্রিনী
কবি রমণীমোহন ঘোষ
১৯৫৯ সালে প্রকাশিত, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় সংকলিত ও
সম্পাদিত “উনবিংশ শতকের গীতিকবিতা সংকলন” থেকে নেওয়া। কবির “দীপশিখা”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

.                
যযাতি
আজিকে বিদায় তবে দেহ, দেবযানি,
ত্যাগ করি’ আজন্মের রাজধানী
চলিয়াছি বনাশ্রমে ৷

.                
দেবযানী
.                        এখনি বিদায় !
কোন্‌ অপরাধ দাসী করিয়াছে পায়?
এখনি সহস্র বর্ষ হয়েছে কি শেষ,
টুটেছে কি যৌবনের প্রমত্ত আবেশ,
নিত্যনব সুধা মোর কিছু নাই আর---
প্রিয়তম, ভোগতৃষ্ণা মিটেছে তোমার?

.                
যযাতি
মিটে নাই। মিটিবার নহে তো বাসনা,
ঘৃতাহুতি যত পায়---অনল-রসনা
তত বেশী জ্বলি উঠে। এ কি ভ্রান্তি হায়,
ভোগানলে দহিবারে চাহি বাসনায় !
যৌবন-মদিরা পান করি’ নিশিদিন
জানি নাই বর্ষ মাস কেমনে বিলীন
হয়েছে ন্বপনসম। ভোগ-অভিলাষ
তবুও বাড়িছে নিত্য, নাহি তা'র হ্রাস ;
তবুও জাগিছে চিত্তে অতৃপ্ত পিপাসা।
এতদিন পরে বুঝি আজি দীর্ঘ নিশা
হয়েছে প্রভাত, তাই মেলি দুটি চোখ
দেখিতে পেয়েছি শুভ্র জ্ঞানের আলোক।
আজি লভিয়াছি সত্যের আভাষ---
মরীচিকা নাহি পারে মিটাতে তিয়াষ।
ভোগ নহে, সুখ নহে, অটল অক্ষয়
পরিপূর্ণ শান্তি তাই খুঁজিছে হৃদয়।

.                
দেবযানী
চল তবে, প্রিয়তম, ছাড়ি লোকালয়
শান্তিপূর্ণ তপোবনে লভিতে আশ্রয়।
যেখানে যাইবে তুমি ছায়ার মতন
দাসীও যাইবে সাথে।

.                
যযাতি
.                        আবার বন্ধন !
রমণীর প্রেমে ভুলি’ ছিলাম সংসারে
আজি যাব বনবাসে, সেথাও কি তা'রে
লয়ে যাব সাথে করি’ !
.                অয়ি দেবযানি,
পরিপূর্ণ ছিল মোর এ হৃদয়খানি
তোমার মোহনরূপে ; কখনো বাহিরে
অনন্ত বিশ্বের পানে চাহি নাই ফিরে।
অলস মণ্ডুক যথা অবরুদ্ধ কূপে,
মগ্ন হয়ে ছিনু আমি রমণীর রূপে।
আজি সেই মায়ামোহ---সোনার শৃঙ্খল
সবলে ছিঁড়িয়া, শুধু আত্মার মঙ্গল
খুঁজিতে করেছি পণ। থাক তুমি, প্রিয়া,
একা আমি যাব আজি ; অরণ্যে পশিয়া
করিব দুশ্চর তপ।---বিদায় এখন।

.                
দেবযানী
হায়, নাথ, নারী শুধু বিলাসের ধন !
যৌবনের কাম্যবস্ত---ক্ষণিক অসার
খেলনা পুরুষহস্তে, নাহি কিছু আর
প্রয়োজন তা'র---খেলা হলে সমাপন !
ছিন্নদলপুষ্প-সম হেলায় তখন
দূরে ফেলে দিবে তা’রে ! বিলাস-রঙ্গিণী
নারী শুধু ! মুমুক্ষুর হইতে সঙ্গিনী
নাহি কোন অধিকার? ধিক্‌ নারী-প্রাণ,
নীরবে কেমনে সহে এত অপমান
পলে পলে?
.        শুন আজ কহিব সে কথা,
গোপন হৃদয়তলে ছিল যেই ব্যথা
এতদিন। যবে পুত্রে সঁপি’ জরাভার
তরুণ যৌবন মাগি’ লইলে তাহার
ভুঞ্জিতে বিষয়সুথ---রূপ রমণীর---
আসিলে আমার পাশে পুলকে অধীর
আকুল করিলে মোরে সোহাগে আদরে---
তখন সহসা নারীজনমের পরে
জাগিল কি ঘৃণা মনে ! জন্মিল ধিক্কার
এ রূপ লাবণ্যে---যাহে ছিল অহঙ্কার---
হেরি তব প্রত্যাগত নবীন যৌবনে
শুধু বাসনার জ্বালা ? জ্ঞান হল মনে
মোর প্রতি তোমার সে অজস্র উচ্ছ্বাস
আদরের---প্রাণহীন শূন্য পরিহাস।
নীরবে আপনি সেই বিষ করি' পান
তবুও তোমায় সুধা করিয়াছি দান।
আজি নাথ শুভদিন, এস ব্রত ধরি’
হও তুমি ব্রহ্মচারী, আমি সহচরী
তপস্বিনী। মহারাজ, চল দুইজনে
ত্যজি রাজ্যভোগ যাই বিজন কাননে
পবিত্র প্রেমের ব্রত করি উদযাপন।
নিবে না বাসনা-বহ্নি যোগালে ইন্ধন,
তপস্যার শান্তি-বারি করিয়া। সেচন
নির্বাপিত কর তা'রে। করো না বর্জন
পুণ্যপথে এ দাসীরে।

.                
যযাতি
.                        অয়ি সুচরিতা,
কুসুম-কোমল তুমি--বিলাস-লালিতা ;
কঠোর তপস্যা কভু সাজে কি তোমার?
প্রিয় গৃহ পরিজন করি’ পরিহার
কেমনে কাটাবে কাল অরণ্য-আশ্রমে
অনাসক্ত পতি-সনে? অয়ি নিরুপমে
ভাল করে ভেবে দেখ।

.                
দেবযানী
.                        ভুলো না রাজন্‌,
ঋষি-কন্যা আমি, ভালবাসি তপোবন।
শিখিয়াছি সতীধর্ম সে নির্জন বনে
প্রতিদিন ফুল তুলি আনিব যতনে
পূজিতে দেবাদিদেবে ; প্রভাতে প্রদোষে
গায়িব বন্দনাগীতি পরম সন্তোষে
কলকণ্ঠ-কণ্ঠ সনে মিলাইয়া স্বর।
হৃদয়ে বহিবে সদা তৃপ্তির নির্ঝর,
বিষয় বাসনা-জ্বালা, দুঃখ অবসাদ
স্পর্শিবে না কভু প্রাণ। দেব-আশীর্বাদ
যোড়করে যাচি’ ল'ব দুজনার শিরে
ভক্তিভরে।

.                
যযাতি
.                        ধন্য আমি, সহধর্মিণীরে
চিনিতে পারিনু আজি। ---তাই হোক প্রিয়া,
ভঙ্গুর বিষয়-ভোস্পৃহা৷ বিসর্জিয়া
চল তবে যাই মোরা শান্ত তপোবনে,
আত্মার অক্ষয় ধন---শাস্তি-অন্বেষণে।

.                 ***************                   
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর