রস-সাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর সমস্যা পূরণ কবিতা
|
ধর্ম্ম সম সার বস্তু কি আছে কোথায়?
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
মহারাজ গিরীশচন্দ্র পরম ধার্ম্মিক ছিলেন। দিনরাত তিনি পূজা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
একদিন সকালে পূজা শেষ করে রাজসভায় এসে দেখলেন, রস-সাগর মহাশয় বসে আছেন।
তখন তিনি রসসাগরের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “ধর্ম্ম সম সার বস্তু কি আছে
কোথায়?” রসসাগর মহারাজের মনের কথা বুঝতে পেরে সমস্যাটি এভাবে পূর্ণ করে
দিলেন . . .
সমস্যা --- “ধর্ম্ম সম সার বস্তু কি আছে কোথায়?”
সমস্যা পূরণ ---
কিবা ইহলোক, কিবা পরলোকে আর
ধর্ম্ম সম সার বস্তু খুঁজে মিলা ভার |
ধর্ম্মই প্রকৃত সূর্য্য ঘোর অন্ধকারে,
ধর্ম্মই বিপদ্ হতে রক্ষা করে নরে |
এ তুচ্ছ সংসারে ধর্ম্ম অমূল্য রতন,
ধর্ম্ম তার বন্ধু, যার নাই বন্ধু জন |
ধর্ম্মই সহায় সেই অন্তিম দশায়,
‘ধর্ম্ম সম সার বস্তু কি আছে কোথায় ?’
. *******************
[ বর্দ্ধমান-রাজ জাল প্রতাপচাঁদের বিষয় নিয়েই এই কবিতাটি রচিত হয়েছে। ]
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ধান ভান্তে মহীপালের গীত
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার মহারাজ গিরীশচন্দ্র রসসাগরকে প্রশ্ন করলেন, “ধান ভান্তে মহীপালের গীত।”
রসসাগর তা তখনি পূরণ করে দিলেন . . .
সমস্যা --- “ধান ভান্তে মহীপালের গীত।”
সমস্যা পূরণ ---
অম্বিকা কালনায় ভাই চিত্ত চমকিত,
মরা মানুষ জিয়ে এযে করে রাজনীত |
পরাণে সহে না আর এত বিপরীত ,
খেতে শুতে ‘ধান ভান্তে মহীপালের গীত |’
ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ রবে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একদিন সভায় মহারাজ গিরীশচন্দ্রের প্রশ্ন হল, “ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ রবে।”
রসসাগর মহাশয় তখনি এভাবে পূরণ করে দিলেন . . .
সমস্যা --- “ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ রবে।”
সমস্যা পূরণ ---
কৃষ্ণলীলা শুনি’ যার মন নাহি মজে,
রাধা প্রেম শুনি যার হৃদয় না ভিজে ;
শুনি’ ব্রজ-গোপিকার রসময়ী কেলি
না হয় যাদের মন কভু কুতূহলী,
মৃদঙ্গ কীর্ত্তন-কালে জানাইছে সবে,---
‘ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ ধিক্ তান্ রবে |’
ধিন্ তা ধিনা, পাকা নোনা
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
এক সময়ে কোন লোক সমস্যা দিয়েছিলেন, “ধিন্ তা ধিনা, পাকা নোনা।” রসসাগর তা
এভাবে পূরণ করেছিলেন . . .
সমস্যা --- “ধিন্ তা ধিনা, পাকা নোনা।”
সমস্যা পূরণ ---
চৈত্রে শিবের আরাধনা,
জিহ্বা ফোঁড়েন ঢেকির মোনা |
ছোলা কলা গুড় পানা,
‘ধিন্ তা ধিনা, পাকা নোনা |’
ধূধূ করে মরে বিধু নিধুর নিকটে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
প্রসিদ্ধ গায়ক নিধুবাবু ( রামনিধি গুপ্ত ) দীর্ঘজীবী পুরুষ ছিলেন। তিনি ১১৪৮ বঙ্গাব্দে
জন্মগ্রহণ করে ১২৩৫ বঙ্গাব্দে ৮৭ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির
সাথে নিধু বাবুর ঘনিষ্ট সম্বন্ধ ছিল। রাজবাড়িতে যখনই কোন অনুষ্ঠান হত, তখনই
নিধুবাবু নিমন্ত্রিত হতেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, শিবচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র ও গিরীশচন্দ্র, --- এই চার
পূরুষ ধরে তিনি কৃষ্ণনগরের রাজসভা অলঙ্কৃত করেছিলেন। এই চার মহারাজকেই তিনি
গান শুনিয়ে মুগ্ধ করে আসতেন। মহারাজ গিরীশচন্দ্রের সময়ে তিনি একবার রাজবাড়িতে
গিয়ে গান শুনিয়েছিলেন। তার গান শুনে রসসাগর এত মুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি
সভাস্থলেই নিধুবাবুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এই দৃশ্য দেখে মহারাজ গিরীশচন্দ্র বললেন,
“আকাশের বিধু আর ভূতলের নিধু ||” তখন রসসাগর হাসতে হাসতে বললেন, মহারাজ!
“নিধুর সহিত বিধুর তুলনা হইতেই পারে না!” এটা বলেই রস-সাগর বললেন, “ধূধূ করে
মরে বিধু নিধুর নিকটে!” তখন মহারাজের আদেশে রসসাগর ঐ সভাতে নিধুবাবুর সামনে
বসে সমস্যাটি পূরণ করে দিয়েছিলেন।
সমস্যা --- “ধূধূ করে মরে বিধু নিধুর নিকটে!”
সমস্যা পূরণ ---
সকলেই বলে, বিধু অতি মনোরম,
আমি কিন্তু বলি, ইহা মানুষের ভ্রম ,-----
বিধুর মালিন্য আসে দিবস আসিলে ,
নিধুর মালিন্য হায় নাই কোন কালে !
বিধুর কিরণ –গ্রাস করে মেঘচয়,
নিধুর কিরণ রয় সকল সময় !
বিধুর কলঙ্কী নাম জানে সর্ব্ব জন,
নিধুর শরীরে নাই কলঙ্ক কখন !
বিধুর মানসে সদা থাকে রাহু-ভয়,
নিধুর কখনো সেই ভয় নাহি রয়
বিধুর দর্শন নাই অমাবস্যা হ’লে,
নিধুর দর্শন কিন্তু মিলে সব কালে !
বিধু চন্দ্র, নিধু চন্দ্র, --- দুই চন্দ্র বটে,
‘ধূধূ ক’রে মরে বিধু নিধুর নিকটে !’
নন্দ-কুমারের ফাঁসি শুনে বুক ফাটে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
মহারাজ নন্দকুমার, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মহাশয়কে ভীষণ সম্মান করতেন। একবার
নন্দকুমার লক্ষ ব্রাহ্মণের পদধূলি নেবার একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে কর্ম্মাধ্যক্ষ ও রাণী ভবানীর ভাণ্ডারী দয়ারামকে তার নিজের
ভাণ্ডারের প্রধান করে রেখেছিলেন। একদিন মহারাজ গিরীশচন্দ্র রসসাগরের সাথে এই
বিষয়ে আলোচনা করতে করতে মনের আবেগে রসসাগরের দিকে ইশারা করে বললেন,
“নন্দ কুমারের ফাঁসি শুনে বুক ফাটে!” শোনামাত্রই রসসাগর এই সমস্যাটি এভাবে পূরণ
করলেন . . .
মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি হয় প্রাতঃকালে, শনিবার, ১১৮২ বঙ্গাব্দের ৩১শে শ্রাবণ অর্থাৎ
৫ই আগস্ট ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দ। তাঁর শাক্ত-পদাবলীর পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . .
সমস্যা --- “নন্দ-কুমারের ফাঁসি শুনে বুক ফাটে!”
সমস্যা পূরণ ---
. *******************
[ উৎস – ত্রিবেণী-নিবাসী সুপ্রসিদ্ধ শ্রুতিধর, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন
১১৩ বছর বয়সে ত্রিবেণীর ঘাটে গঙ্গাগর্ভে দেহত্যাগ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি সমগ্র
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান জমীদার, রাজা, মহারাজ, নবাব ও ইংরেজ-বাহাদুরগণের
প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। একবার কোন এক বিশেষ কাজে মহারাজ নন্দকুমার তাকে
আমন্ত্রণ করেছিলেন। মহারাজ অনুরোধ করার পরেও জগন্নাথ তার বাড়িতে না খেয়ে
ফিরে এসেছিলেন। এতে মহারাজ নন্দকুমার ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। জগন্নাথ অনেকদিন
পর্যন্ত মহারাজের বাড়িতে না যাওয়াতে তাকে তার ভবনে দেখা করতে আসার জন্য
অনুরোধ করেন। তেজস্বী ও অভিমানী জগন্নাথ তার অনুরোধ রক্ষা না করে বিদ্রূপ-
সহকারে নন্দকুমারকে কৃষ্ণ সাজিয়ে একটি চিঠিতে একটি সংস্কৃত শ্লোক লিখে পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন। রসসাগরের এই কবিতাটি সেই শ্লোকের ভাবার্থ মাত্র। ]
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
নন্দের দুলাল তুমি, আদুরে গোপাল
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একদিন যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র রসসাগরকে বললেন, “এখনই আপনাকে একটি সমস্যা পূরণ
করতে দেব। কোন বিখ্যাত ঘটনা অবলম্বন করেই আপনাকে এটা পূরণ করতে হবে।”
এটা বলেই তিনি সমস্যাটি পূরণ করতে দিলেন, --- “নন্দের দুলাল তুমি, আদুরে গোপাল!”
রসসাগর যুবরাজের ইচ্ছে বুঝতে পেরে এভাবে পূরণ করে দিলেন . . .
সমস্যা --- “নন্দের দুলাল তুমি, আদুরে গোপাল!”
( মহারাজ নন্দকুমারের প্রতি জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ব্যঙ্গোক্তি )
সমস্যা পূরণ ---
না ভাল সুন্দর-বন, ভাল কচু-বন
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার যুবরাজ শ্রীশচন্দ্রের সমবয়সী একজন প্রশ্ন করেছিলেন, "না ভাল সুন্দর-বন, ভাল
কচু-বন।” রসসাগর সাথে সাথেই এভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন . . .
সমস্যা --- “না ভাল সুন্দর-বন, ভাল কচু-বন।”
সমস্যা পূরণ ---
করি এই নিবেদন বিশাল সুন্দর-বন !
. ধ’রে আছ কত হিংস্র জন্তু অগণন |
ধন্য ক্ষুদ্র কচু-বন কচুর জীবন-ধন
. ‘না ভাল সুন্দর-বন, ভাল কচু-বন |’
নারী নাহি তৃপ্ত রয় বহু নর ল’য়ে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার রসসাগরের এক বন্ধু তাকে এই সমস্যাটি পূরণ করতে দিয়েছিলেন, ‘নারী নাহি
তৃপ্ত রয় বহু নর ল’য়ে। রসসাগর এভাবে পূরণ করেছিলেন . . .
সমস্যা --- “নারী নাহি তৃপ্ত রয় বহু নর ল’য়ে।”
সমস্যা পূরণ ---
অনলের তৃপ্তি নাই বহু কাষ্ঠ খেয়ে,
মহোদধি তৃপ্ত নয় বহু নদী পেয়ে ;
যম তৃপ্ত নয় বহু প্রাণী পেটে দিয়ে,
‘নারী নাহি তৃপ্ত রয় বহু নর ল’য়ে |’
নাহি যায় বলা
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার রাজসভায় প্রশ্ন হয়েছিল, “নাহি যায় বলা।” রসসাগর তখনই এভাবে সেই সমস্যা
পূরণ করে দিয়েছিলেন . . .
সমস্যা --- “নাহি যায় বলা।”
সমস্যা পূরণ ---
যদি আঁব পাওয়া যায় সিমুলের তলা,
বিনা জলে নিবে যদি নিজ ঘর জ্বলা,
পরের ঘাড়ে যদি যায় বিদেশেতে চলা,
তাহে যত সুখ রয় ‘নাহি যায় বলা |’