রস-সাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর সমস্যা পূরণ কবিতা


.                        *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
পিতার বৈমাত্র ভাই নিজ সহোদর
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র বয়স্কলোকের সামনে রসসাগরকে দিয়ে সমস্যা পূরণ করিয়ে
মহান আনন্দ অনুভব করতেন। তিনি একদিন একটি উত্কট প্রশ্ন করলেন, “পিতার বৈমাত্র
ভাই নিজ সহোদর।” রসসাগর নিজের দৈবশক্তির প্রভাবে তখনি এভাবে পূরণ করে দিলেন
. . .

সমস্যা ---
“পিতার বৈমাত্র ভাই নিজ সহোদর।”
সমস্যা পূরণ ---

      ১ম পূরণ
অদিতি-নন্দন সেই দেব পুরন্দর,
শিবাজ্ঞায় পঞ্চ ইন্দ্র দ্রৌপদীর বর |
কৃষ্ণার্জ্জুন প্রতি যে যে কন্ বৃকোদর,
‘পিতার বৈমাত্র ভাই নিজ সহোদর |’

এটা শুনে যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র বললেন, “রস-সাগর মহাশয়! আপনি রসের সাগর। সুতরাং
আপনার রস কিছুতেই শুকনো হবার নয়। অন্য ভাবে এটা আপনাকে পূরণ করতে হবে।”
এটা শুনেই রস-সাগর পুনরায় বললেন . . .

          ২য় পূরণ
তর্পনের কালে কুন্তী যুধিষ্ঠিরে কন্ ,
তোমার অগ্রজ কর্ণ রাধার নন্দন |
ইহা শুনি ধর্ম্মপুত্র ভাবেন সত্বর,----
‘পিতার বৈমাত্র ভাই নিজ সহোদর |’
                                         


.                        *******************

[ ব্যাখ্যা - মহাবীর কর্ণ সূর্য্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পূর্ব্বে এই গুপ্ত
কথা কেউ জানতেন না। কর্ণ বধের পরে স্বয়ং কুন্তীই এই কথা পঞ্চ-পাণ্ডবদের কাছে
প্রকাশ করেন। কর্ণ এই সম্পর্কে মাদ্রীপুত্র নকুল ও সহদেবের বৈমাত্রেয় ভাই হলেন। অন্য
সম্পর্কে সূর্য্য-পুত্র অশ্বিনী-কুমার কর্ণের বৈমাত্রেয় ভাই ছিলেন। অশ্বিনী-কুমারের ঔরসে
মাদ্রীর গর্ভে নকুল ও সহদেবের জন্ম হয়েছিল। সুতরাং কর্ণ এক পক্ষে নকুল ও সহদেবের
বৈমাত্রেয় ভাই, অন্য পক্ষে তাদের পিতারও বৈমাত্রেয় ভাই। ]

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
পিতার বৈমাত্র যে সে আমারো বৈমাত্র
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

প্রসিদ্ধ কবিয়াল লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস মাঝে মাঝে কৃষ্ণনগরে গান করতে যেতেন। গান করা
শেষ হলে বক্ শিস নেবার জন্য তিনি মহারাজের সহিত দেখা করতে যেতেন। একবার
তিনি সভায় রস-সাগরকে অপ্রস্তুত করবার জন্য একটি জটীল সমস্যা পূরণ করতে দিলেন।
রস-সাগর দৈবী শক্তির প্রভাবে তখনি সেই সমস্যাটি পূরণ করে সভার সকল লোকজনকে
স্তম্ভিত ও লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাসকে অপ্রতিভ করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“পিতার বৈমাত্র যে সে আমারো বৈমাত্র।”
সমস্যা পূরণ ---

তর্পণের কালে কুন্তী প্রকাশিল মাত্র,
উচ্চ-রবে কাঁদে তবে মাদ্রীর দুই পুত্র |
ষড়্ যন্ত্রে বধিলাম এমন সুপুত্র,
‘পিতার বৈমাত্র যে সে আমারো বৈমাত্র |’
                                      


.                     *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
পুণ্যবলে যশোলাভ হয় ভূমণ্ডলে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন রস-সাগর মুদির দোকানে জিনিস-পত্র কিনতে গিয়েছেন। সেখানে একজন ভদ্রলোক
উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন,-- “পুণ্যবলে যশোলাভ হয় ভূমণ্ডলে।”
রসসাগর তখনই এটা পূর্ণ করে তাহার মনোরঞ্জন করেছিলেন।

সমস্যা ---
“পুণ্যবলে যশোলাভ হয় ভূমণ্ডলে।”
সমস্যা পূরণ----

কুন্তী ও দ্রৌপদী হায় এই দুই জন
প্রত্যেকে ভজিলা পঞ্চ পতির চরণ |
তবু তাঁরা মহাসতী, --- সকলেই বলে,
‘পূণ্য-বলে যশোলাভ হয় ভূমন্ডলে |’
                                   


.                                 *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
পুণ্যময় রাম-নাম বিচিত্র ব্যাপার
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

নবদ্বীপ-নিবাসী কোন এক পণ্ডিত কৃষ্ণনগর-রাজসভায় গিয়ে রস-সাগরকে এই সমস্যাটি
পূরণ করতে দেন, --- “পূণ্যময় রাম-নাম বিচিত্র ব্যাপার।” রসসাগরও তখনি ভক্তিভাবে
পুরণ করে সভার সব লোকজনকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন।

সমস্যা ---
“পুণ্যময় রাম-নাম বিচিত্র ব্যাপার।”
.             ( মানব-গণের প্রতি রাম-নাম-ভক্ত হনুমানের উপদেশ )
সমস্যা পূরণ ---

রা অক্ষর উচ্চারিলে                 মুখটী যাইবে খুলে
.       হৃদয়ে সঞ্চিত পাপ পলাবে সত্বর |
পাছে তাহা পুনরায়                 হৃদয়ে আসিতে চায়
.       এই ভয় হয় যদি রে অবোধ নর !
তত্পর হইয়া তবে                 ‘ম’ অক্ষর উচ্চারিবে
.       অমনি মুদিয়া যাবে মুখটী তোমার |
হেন নাম লও মুখে                  সদাই থাকিবে সুখে,
.       ‘পুণ্যময় রাম-নাম বিচিত্র ব্যাপার |’
                                


.                      *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
পুত্রবধূ ইচ্ছা করে শ্বশুর লাগুক গায়
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একবার রাজ-সভায় একটি সমস্যা উঠেছিল, “পুত্রবধূ ইচ্ছা করে শ্বশুর লাগুক্ গায়।”
রসসাগর এভাবে পূরণ করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“পুত্রবধূ ইচ্ছা করে শ্বশুর লাগুক গায়।”
সমস্যা পূরণ ---

দ্রৌপদী সুন্দরী ব্যস্ত রন্ধনের ঘরে,
অগ্নি-তাপে প্রাণ তাঁর ছট্ ফট্ করে |
আলু-থালু কেশে বেশ বাহিরেতে গিয়ে
বাতাস লাগাতে গায় রহেন বসিয়ে |
রস-সাগরের রস উথলিয়া যায়, ---
‘পুত্রবধূ ইচ্ছা করে শ্বশুর লাগুক্ গায়!’
                                             


.                                   *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
পৃথিবীর মত ভার মস্তকে সহিব
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন রাজসভায় সমস্যা উঠল, “পৃথিবীর মত ভার মস্তকে সহিব!” রসসাগর এই সমস্যা
এভাবে পূরণ করে দিয়েছিলেন . . .

সমস্যা ---
“পৃথিবীর মত ভার মস্তকে সহিব!”
সমস্যা পূরণ ---

.                   ( বালিকার প্রার্থনা )
সীতা-সম হব সতী                     রাম-সম পাব পতি
.            দ্রৌপদীর মত সবে রাঁধুনী হইব।
দূর্ব্বা-সম লজ্জাশীলা                   গঙ্গা-সম সুশীতলা
.            ‘পৃথিবীর মত ভার মস্তকে সহিব!’
                                         


.                     *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
পোড়া বিধাতার লেখা
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন মহারাজ গিরীশচন্দ্র রসসাগরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিভাবে আপনার সংসার
চলছে?”রসসাগর উত্তর দিয়েছিলেন, “মানুষ কবি হলে তাহার অন্ন হয় না, ইহাই পোড়া
বিধাতার বিধি।” রসসাগরও প্রাণের কথা খুলে সমস্যাটি পূরণ করে মহারাজকে খুশী করে
দিলেন . . .

সমস্যা ---
“পোড়া বিধাতার লেখা।”
সমস্যা পূরণ ---

শুন হে গিরীশ-চন্দ্র! করি নিবেদন,---
যখন গিরীশ তুমি, তুমি ত্রিনয়ন!
যে নেত্রে উত্তাপ তব, সেই নেত্র দিয়া
একবার মোর দিকে দেখ তাকাইয়া।
দর দর করি’ ঘর্ম্ম-বিন্দু দিগ দেখা,
ঘুচে যাগ্ যত ‘পোড়া বিধাতার লেখা।’
                                      


.                     *******************

[ ব্যাখ্যা - এই কবিতার শেষ চরণে যে “কর” শব্দটি আছে, তা শ্লিষ্ট। তার অর্থ, - এক
দিকে “হস্ত”, অন্য দিকে “কিরণ”। ]

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
প্রচণ্ড সূর্য্যের কর কিন্তু বুকে রাখে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন সকালবেলায় যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র মহাশয় রসসাগরকে সাথে নিয়ে বেড়াতে
গিয়েছিলেন। পথের পাশে একটি পুকুরে পদ্ম ফুটতে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, “প্রচণ্ড
সূর্য্যের কর কিন্তু বুকে রাখে।” রসসাগরও তখনি তা পূরণ করে দিলেন।

সমস্যা ---
“প্রচণ্ড সূর্য্যের কর কিন্তু বুকে রাখে।”
সমস্যা পূরণ ---

যে যারে না ভাল বাসে গুণটীও তার
তার চক্ষে দোষ বলি’ হইবে বিচার |
কিন্তু যারে ভাল বাসে হায়, সেই জন,
দোষটাও গুণ তার বলিবে তখন |
পদ্মিনী চাঁদের সুধা চক্ষে বিষ দেখে,
‘প্রচণ্ড সূর্য্যের কর কিন্তু বুকে রাখে |’
                                   


.                     *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
প্রাণ-পাখী ফাঁকী দিয়া যাবে পলাইয়া
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন রাজসভায় প্রশ্ন উঠল, “প্রাণ পাখী ফাঁকী দিয়া যাবে পলাইয়া!” এই সমস্যাটি
রসসাগর এভাবে পূরণ করে দিলেন . . .

সমস্যা ---
“প্রাণ-পাখী ফাঁকী দিয়া যাবে পলাইয়া!”
সমস্যা পূরণ ---

এ দেহ-পিঞ্জর, --- তায় আছে নব দ্বার,
প্রাণ-পাখী তার মধ্যে করিহে বিহার |
এদিক্ ওদিক্ করি’ ঘুরিছে সদাই,
পাছে পাখী যায় চ’লে, --- এই ভয় পাই |
জানি না পিঞ্জর হ’তে কোন্ দ্বার দিয়া
‘প্রাণপাখী ফাঁকী দিয়া যাবে পলাইয়া!’
                                


.                     *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
প্রাণেশ্বরে রে মম্মথ
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

কোন এক সময়ে রাজসভায় প্রশ্ন হয়েছিল, “প্রাণেশ্বরে রে মন্মথ!” রসসাগর তা এভাবে
পূরণ করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“প্রাণেশ্বরে রে মম্মথ!”
সমস্যা পূরণ ---

অশোক-কাননে সীতা শোকে সমাকুল,
ভাবে কিসে শোকার্ণব পাব আমি কুল |
ফেল রে রামের পাশে শূন্যে আমি রথ,
প্রাণ জুড়াক্ দেখে ‘প্রাণেশ্বরে রে মন্মথ !’