রস-সাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর সমস্যা পূরণ কবিতা


.                        *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বিদ্যা বুদ্ধি না থাকিলে কি ফল জীবনে?
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

মহারাজ গিরীশচন্দ্রের পিতা ও মহারাজ শিবচন্দ্রের পুত্র মহারাজ ঈশ্বরচন্দ্রের সেরকম
বিদ্যা-বুদ্ধি না থাকায় শিবচন্দ্র দুঃখ করে মাঝে মাঝে বলতেন, “বিদ্যা না রহিল যদি কি
ফল জীবনে!” রসসাগর গিরীশচন্দ্রের মুখে এই কথাটী শুনে সেই সমস্যা এভাবে পূরণ
করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“বিদ্যা বুদ্ধি না থাকিলে কি ফল জীবনে?”
সমস্যা পূরণ ---

বিদ্যায় কি ফল, যদি কবিত্ব না রয়,
দান যদি নাহি রয়, ধনে কিবা হয়?
দয়া যদি নাহি থাকে, কিবা ধর্ম্মে মতি?
নৃপে কিবা ফল, যদি নাহি তার নীতি?
পুত্রে কিবা ফল, যদি না থাকে বিনয়?
পতি ভক্তি না থাকিলে পত্নীতে কি হয়?
গঙ্গাতীরে না মরিলে কি ফল মরণে?
‘বিদ্যা বুদ্ধি না থাকিলে কি ফল জীবনে?’
                                     


.                                           *******************

[ ব্যাখ্যা – মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পিতামহ রাজা রামজীবন এবং পিতামহের অগ্রজ রাজা রামচন্দ্র ও
পিতামহের সৎভাই রাজা রামকৃষ্ণ এই তিন জন নির্দ্ধারিত রাজস্ব নবাব-সরকারে জমা না দেওয়াতে  
তাদের ২০ লক্ষ টাকা দেনা হয়। এর মধ্যে তাদের পিতামহ রামজীবন ও পিতা রঘুরাম ১০ লক্ষ টাকা  
পরিশোধ করেছিলেন। বাকী ১০ লক্ষ টাকা নবাব-সরকারের কাছে দেনা থাকে। এছাড়া নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ
নজরাণা বলে তার কাছে ১২ লক্ষ টাকা দাবী করেন। এই নজরাণার টাকা দিতে না পারায় আলিবর্দ্দি খাঁ  
তাকে নিজ গৃহে বন্দী করে রাখেন। মহারাজের জমীদারী মহারাষ্ট্রীয়গণ কর্ত্তৃক বারে বারে লুন্ঠিত হওয়াতে  
প্রজাগণের এত দুর্দ্দশা হয়েছিল যে, তারা এই বিপদ থেকে মহারাজকে মুক্ত করতে সম্পূর্ণভাবে অসমর্থ  
হয়েছিল। মহারাজ কারাগারে প্রধান প্রধান কর্ম্মচারীকে ডেকে দেনা পরিশোধের পরামর্শ করতে লাগলেন,  
কিন্তু কেউ কোন সন্তোষ-জনক পরামর্শ দিতে পারল না। রঘুনন্দন সর্ব্বাধিকারী জাতিতে কায়স্থ।

তিনি মহারাজের একজন সামান্য কর্ম্মচারী হয়েও বললেন, “মহারাজ! যদি কিছুদিনের জন্য আপনার  
অধিকার ও ক্ষমতা আমাকে দেন, তা হলে আমি মহারাজকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারি।” তিনি  
যে উপায়ে মহারাজকে মুক্ত করতে পারেন তা সবিস্তারে বললেন। বিচক্ষণ মহারাজ খুশী হয়ে তাকে  
দেওয়ানী-পদ প্রদান ও তার ক্ষমতা অর্পণ করে মুর্শিদাবাদ থেকে কৃষ্ণনগরে পাঠিয়ে দিলেন।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে তার পুত্র, জামাই, ও ভাগ্নেগণ জমীদারীর অনেক অংশ ইজারা নিয়ে ইচ্ছেমত  
কর দিতেন। দেওয়ানেরা তাদের উপরে বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ করতে না পারার জন্য তাদের অনেক টাকা
খাজনা বাকী পড়েছিল। রঘুনন্দন মহারাজ প্রদত্ত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অল্প দিনের মধ্যে অনেক টাকা  
সমগ্রহ করে নবাব-সরকারে জমা দিয়ে অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করার বন্দোবস্ত করে কৃষ্ণনগর  
রাজবাড়িতে ফিরে এলেন। রঘুনন্দনের বুদ্ধি-কৌশলে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আলিবর্দ্দী খাঁর কারাগার থেকে  
মুক্তিলাভ করেছিলেন। এই রঘুনন্দনই কিছুদিন পরে আলিবর্দ্দীর দেওয়ান মাণিকচাঁদের বিরাগ-ভাজন হন,  
এবং তারই আদেশে কামানের গোলার সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নজরাণার টাকা দিয়ে নবাবের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বটে, কিন্তু তার পিতামহ ও  
পিতার দেয় রাজস্ব ২০লক্ষ টাকার মধ্যে মাত্র ১০লক্ষ টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ১০লক্ষ  
টাকার জন্য কৃষ্ণচন্দ্র দায়ী ছিলেন। এই টাকা দিতে না পারার জন্য তিনি আরও একবার আলিবর্দ্দীর  
কারাগারে বন্দী হয়েছিলেন। নবাব মহারাজের গুণে খুশী হয়ে তার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। তিনি  
সবসময় তাকে কাছেকাছেই রাখতেন। বিশেষকরে প্রত্যেক সন্ধ্যাবেলায় কৃষ্ণচন্দ্রের সাথে শাস্ত্রালাপ  
করতেন। কৃষ্ণচন্দ্রও মহাভারত, রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থের বিশেষ বিশেষ অংশগুলি ঊর্দ্দুভাষায় অনুবাদ  
করে তাকে শোনাতেন এবং তার মনোরঞ্জন করতেন। এই কয়েক লক্ষ টাকা মাফ্ পাবার জন্য মহারাজ  
নবাবের কাছে অনেক আবেদন করেছিলেন, কিন্তু কোন লাভ হয়নি।

এই সময়ে নবাব জলপথে কলিকাতায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলে মহারাজও তার সঙ্গী হবার জন্য প্রার্থনা  
করলেন। নবাব খুশী হয়ে তাকে সঙ্গী হবার অনুমতি দিলেন। সঙ্গীগণ ও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে নবাব মহা
সমারোহে  কলিকাতার দিকে যাত্রা করলেন।  সুবিখ্যাত পলাশীক্ষেত্র মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জমীদারীর  
অন্তর্গত। নবাবের পোতাবলী পলাশীর কাছে এলে মহারাজ বললেন, ধর্ম্মাবতার! আমার পলাশী-পরগণার  
অবস্থা একবার দয়া করে দেখুন। কোন জায়গা জলশূন্য, কোনও জায়গা বনাকীর্ণ, কোন কোন জায়গা  
অনুর্ব্বর। এখান থেকে পরিমাণমত অর্থ-সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য। নবাবের পোতাবলী নবদ্বীপের নিকটে  
উপস্থিত হলে মহারাজ বললেন, ধর্ম্মাবতার! আমার জমীদারীর মধ্যে নবদ্বীপ সর্বপ্রধান। এখানে একটিও  
পাকাবাড়ি নেই। মাত্র কয়েকটি তৃণাচ্ছাদিত গৃহ। আমি কিরকম ভাগ্যবান, এই গ্রামই তার পরিচয় দিচ্ছে।
নবাব এটা শুনে কোন কথা বললেন না। অবশেষে নবাবের পোতাবলী কলিকাতায় পৌঁছল। তখন  
কলিকাতা একখানি সামান্য গ্রাম-মাত্র ছিল। এর কেবল উত্তর দিকে গঙ্গার ধারে কয়েক ঘর লোকের বসতি
ছিল, এবং পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দিক সম্পূর্ণরূপে বাদা-বন ছিল। তার জমীদারী কলিকাতার পূর্ব্ব ভাগের অবস্থা  
কেমন তা নবাবকে দেখাবার জন্য মহারাজ বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলেন। মহারাজের ইচ্ছেমত নবাব  
কিছুদূর গিয়েই দেখলেন চারিদিকে অরণ্য! এই সময়ে মহারাজের শিক্ষানুসারে নবাবের সঙ্গীগণ বলতে শুরু
করলেন এ জায়গায় বাঘ ও হিংস্র জন্তুর ভয় আছে। এটা শুনেই নবাব ফিরে যাবার আদেশ দেবেন, এমন
সময় মহারাজ পুনরায় বললেন “ধর্ম্মাবতার! কষ্ট স্বীকার করে যখন এতদূর এলেন তবে কৃপা করে আরও  
একটু চলুন।”  তখন নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ বললেন, “কৃষ্ণচন্দ্র! আর বেশী দূর যাবার দরকার নেই। আজ
তোমাকে পৈতৃক দায় থেকে মুক্ত করে দিলাম।”  মহারাজও নবাবকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে তার সাথে  
ফিরে এলেন। নদীয়া জেলায় ঐ টাকার দায়, রাজাদের বিশ-লাখি দায় বলে খ্যাত ছিল। ]

.                                                      .                                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বিশ-লাখি দায়
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন মহারাজ গিরীশচন্দ্র সভায় বসে রসসাগরের সাথে তার পূর্ব্ব পুরুষ-গণের সম্বন্ধে
কথার প্রসঙ্গে বললেন “বিশ-লাখি দায়।” তখন রসসাগর মহারাজের অভিপ্রায় বুঝতে
পেরে এভাবে সমস্যাটী পূরণ করে দিলেন . . .

সমস্যা ---
“বিশ-লাখি দায়।”
সমস্যা পূরণ ---
                                              


.                  *******************

.                                                  .                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বিষয়-তৃষ্ণার মত বড় কিছু নাই
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র রস-সাগর মহাশয়কে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। রসসাগর আম খেতে
ভীষণ ভালোবাসতেন। তিনি একে একে অনেকগুলি আম খাবার পর যুবরাজকে বললেন,
“বিষয়-তৃষ্ণার মত বড় কিছু নাই!” তখন যুবরাজ তাকে এই সমস্যাটী পূরণ করতে আদেশ
করায় তিনি এভাবে পূরণ করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“বিষয়-তৃষ্ণার মত বড় কিছু নাই!”
সমস্যা পূরণ ---

পর্ব্বত অত্যন্ত বড়, --- কেনা তাহা জানে,
তা হ’তে সমুদ্র বড়, --- হেন লয় মনে।
সমুদ্র হ’তেও বড় অনন্ত গগন,
তা হ’তেও বড় পূর্ণ ব্রহ্ম সনাতন।
পূর্ণ-ব্রহ্ম হইতেও বড় বস্তু আছে,
তাহার বিষয়-তৃষ্ণা নামটী র’য়েছে।
এ রস-সাগর তাই কহিতেছে ভাই,---
‘বিষয়-তৃষ্ণার মত বড় কিছু নাই!’
                                           


.                  *******************

[  ব্যাখ্যা - জীবনের শেষ সময়ে পতিত-পাবনী গঙ্গা-দেবীর গর্ভে দেহত্যাগ করতে পারলে
মানুষ শিবত্ব বা বিষ্ণুত্ব লাভ করে থাকেন, এটা শাস্ত্রের কথা। এটাই নশ্বর মানবের চির-
প্রার্থনীয় ধন। কিন্তু গঙ্গা-ভক্ত সাধক কবি এই কবিতায় বিষ্ণুত্ব প্রার্থনা না করে শিবত্ব
প্রার্থনা করছেন। শিবত্ব লাভ করলে তিনি গঙ্গা-দেবীকে পরম-সুখে মস্তকে ধারণ করতে
পারিবেন, কিন্তু বিষ্ণুত্ব লাভ করিলে অবশ্যই তাকে বিষম-কষ্টে চরণে ফেলে রাখতে হবে।
এই জন্যই কবি এই কবিতায় গঙ্গা দেবীর কাছে বিষ্ণুত্ব কামনা না করে শিবত্ব কামনা
করছেন। ]

.                                                  .                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বিষ্ণুত্ব পাইতে মোর ইচ্ছা নাহি রয়
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন রাজসভায় সমস্যা উঠেছিল, --- “বিষ্ণুত্ব পাইতে মোর ইচ্ছা নাহি রয়!” রসসাগর তা
এভাবে পূরণ করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“বিষ্ণুত্ব পাইতে মোর ইচ্ছা নাহি রয়!”
সমস্যা পূরণ ---

ওমা গঙ্গে! রঙ্গে ভঙ্গে তরঙ্গ সকল
বিস্তারিয়া বিষ্ণু-পদে থাক অবিরল।
পরম আদরে থাকি’ শিবের মাথায়
কি অপূর্ব্ব শোভা মাগো! ধ’রে থাক তায়।
তাই বলি ওমা গঙ্গে! তোমায় যখন
এই দেহ খানি করিব অর্পণ,
দেখ মা! শিবত্ব মোরে দেওয়া যেন হয়,
‘বিষ্ণুত্ব পাইতে মোর ইচ্ছা নাহি রয়!’
                                        


.                  *******************

.                                                  .                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বুঝিলাম যে বিচার করিবেন কালী
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন রসসাগর মহাশয় সভায় বসে মহারাজ গিরীশচন্দ্রকে তার সাংসারিক দুরবস্থার
কথা বলছিলেন। মহারাজ হাসতে হাসতে বললেন, “আপনি সুপণ্ডিত ও জ্ঞানী লোক।
অতএব জগদম্বার দরবারে দুঃখের আরজি দিয়ে এলেই অবশ্যই তিনি আপনার প্রতি
সুবিচার করবেন।” এই কথা শোনামাত্র রসসাগর মহাশয় দীর্ঘ-নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“বুঝিলাম যে বিচার করিবেন কালী।” তখন মহারাজ গিরীশচন্দ্র বললেন, আপনার সমস্যা
আপনিই পূরণ করে দিন। মহারাজের আদেশ পেয়ে রসসাগর এভাবে সমস্যাটী পূরণ করে
দিয়েছিলেন . . .

সমস্যা ---
“বুঝিলাম যে বিচার করিবেন কালী।”
সমস্যা পূরণ ---

মেয়ে হ’য়ে যুদ্ধ করে উলঙ্গ হইয়া,
বহায় রক্তের স্রোত চারি দিক দিয়া।
দয়া মায়া নাই কিছু, পাষাণের মেয়ে,
ডাকিনী যোগিনী কত সঙ্গে যায় ধেয়ে।
পতি-বক্ষে পদ রাখে, লজ্জা নাহি তায়,
লক্ লক্ করে জিহ্বা রক্তের তৃষ্ণায়।
নর-মুণ্ড-মালা গলে দোলে অবিরল,
রণে-মদে চলে যবে, কাঁপে রসাতল।
হাজির হ’য়ে আরজি দিলে পাছে দেয় গালি,
‘বুঝিলাম যে বিচার করিবেন কালী।’
                                     


.                  *******************

.                                                  .                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বুঝিলাম যে বিচার করিবেন হর
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

মহারাজ গিরীশচন্দ্র পূর্বের পূরণ শুনে রসসাগরকে বললেন, “কালীর সুবিচার অসম্ভব।
এখন তার কর্ত্তার দরবারে গিয়ে আরজি দিন। তাহলে তার কাছে সুবিচার হবে।” এটা
বলেই মহারাজ প্রশ্ন করলেন, “বুঝিলাম যে বিচার করিবেন হর।”  তখন রসসাগর এই
সমস্যাটী এভাবে পূরণ করে দিলেন . . .

সমস্যা ---
“বুঝিলাম যে বিচার করিবেন হর।”
সমস্যা পূরণ ---

নিজে নিত্য দিগম্বর, মত্ত ধুতুরায়,
শ্মশানে বেড়ায় সদা, ভস্ম মাখে গায় |
গলায় হাড়ের মালা, --- দেখে লাগে হাঁপ্,
জটার ভিতরে সাপ, --- বাপ্ রে বাপ্ |
সিদ্ধি খেয়ে বুদ্ধি টুকু হ’য়েছে বিকল,
মাথার উপরে গঙ্গা করে কল কল |
ভীষণ ত্রিশূল হাতে, নন্দী ভৃঙ্গী দূত,
পিছে পিছে ধাইতেছে লক্ষ লক্ষ ভূত |
তিন চক্ষু আছে, কিন্তু ভক্তের কি ফল ?
সিদ্ধি গাঁজা খেয়ে তাজা, বোজা অবিরল |
হাজির হইয়া আর্ জি দিতে লাগে ডর,
‘বুঝিলাম যে বিচার করিবেন হর |’
                                  


.                  *******************

.                                                  .                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বুদ্ধি-শুদ্ধি নাহি থাকে বিপৎ-সময়
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন সমস্যা উঠল, “বুদ্ধি-শুদ্ধি নাহি থাকে বিপৎ-সময়।” রসসাগর এভাবে  সমস্যাটি
পূরণ করে দিলেন . . .

সমস্যা ---
“বুদ্ধি-শুদ্ধি নাহি থাকে বিপৎ-সময়।”
সমস্যা পূরণ ---

হরিলে পরের নারী দোষ নাহি রয়,
এ কথা রাবণ কেন করিল প্রত্যয় !
সোনার হরিণ হয়, --- কে শুনে কোথায়,
তবু রাম কেন তার পিছে পিছে ধায় !
কি কারণে পাশা খেলি যুধিষ্ঠির রাজা
ধনে মানে পাইলেক শত শত সাজা !
এ রস-সাগর কহে হইয়া তন্ময়,----
‘বুদ্ধি-শুদ্ধি নাহি থাকে বিপৎ-সময় !’
                               


.                  *******************

.                                                  .                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বেশ্যা রহিয়াছে বশে, --- কে শুনে কোথায়
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একবার মহারাজ গিরীশচন্দ্র হাসতে হাসতে সমস্যা দিলেন, “বেশ্যা রহিয়াছে বশে, --- কে
শুনে কোথায়!” রসসাগরও হাসতে হাসতে তা পূরণ করে দিলেন এইভাবে . . .

সমস্যা ---
“বেশ্যা রহিয়াছে বশে, --- কে শুনে কোথায়!”
সমস্যা পূরণ ---

কমলা অচলা রন্ কাহার বাটীতে?
রাজা হইয়াছে মিত্র কোথায় জগতে?
শরীর র’য়েছে স্থির, ---- কোথা শুনা যায়?
‘বেশ্যা রহিয়াছে বশে, ---- কে শুনে কোথায়?’
                            



.                  *******************

.                                                  .                           
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বেহায়ার চুপ্ ক’রে থাকাই মঙ্গল
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একবার কোন এক কাজের জন্য মহারাজ গিরীশচন্দ্রের বাড়িতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতমশাইদের
বিদায় দেওয়া হচ্ছিল। নবদ্বীপ থেকে আসা এক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সভায় বসে নানা রকম তর্ক-
বিতর্ক করছিলেন। তিনি সুপণ্ডিত হলেও মনসংযোগ ও বৃথা কথা বলবার জন্য সামান্য
ছাত্রগণের কাছে বিচারে পরাজিত হলেন। অবশেষে অধ্যক্ষ মহাশয়ের দেওয়া বিদায়ে
খুশী না হয়ে মহারাজের কাছে গিয়ে নানা প্রকারে তার বিদ্যা-বুদ্ধির প্রচার করতে লাগলেন
। তখন মহারাজ তার অহঙ্কার সহ্য করতে না পেরে রসসাগরের দিকে ইশারা করে এই
সমস্যাটি পূরণ করতে দিলেন, “বেহায়ার চুপ করে থাকাই মঙ্গল।” রসসাগর মহারাজের
ইশারা বুঝতে পেরে তীব্রভাবে এই সমস্যাটি পূরণ করে দিলেন . . .

সমস্যা ---
“বেহায়ার চুপ্ ক’রে থাকাই মঙ্গল!”
সমস্যা পূরণ ---

ধিক্ ধিক্ শত ধিক্ তোমায় সাগর !
কত কাণ্ড হ’ল তব বুকের উপর !
লক্ষ লক্ষ দেবাসুর একত্র হইয়া
লণ্ড ভণ্ড ক’রে দিল তোমায় মখিয়া |
যে সব বানর ঘুরে ফিরে ডালে ডালে,
তারাও লঙ্ঘন করি গেল পালে পালে |
নুড়ি নাড়া জড় করি বানর বানরী
সেতু বেঁধে রেখে দিল বুকের উপরি |
অগাধ অপার তুমি, শুনি নিরন্তর,
অগস্ত্য গণ্ডূষে পুরে পেটের ভিতর |
সহ্য করিয়াও তুমি এত অপমান
এখনও প্রাণ ধরি আছ বিদ্যমান |
তৃষ্ণার্ত্ত পথিক জল খাইলে তোমার
লোণা জলে মুখখানি পুড়ে যায় তার |
ভীষণ গর্জ্জন তব, ভীষণ তরঙ্গ,
এই সব লইয়াই কর কত রঙ্গ |
মুখের সাপট্ তব পরম প্রবল,
‘বেহায়ার চুপ্ করে থাকাই মঙ্গল !’
                         


.                        *******************

.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
বিদ্যাহীন ভট্টাচার্য্য, মহা-বিড়ম্বন
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন মহারাজ গিরীশচন্দ্রের সভায় এক ব্রাহ্মণ এসে উপস্থিত হলেন। ইনি স্ব্যাস্থবান
পুরুষ, কিন্তু এর কথায় বেশ ভালভাবে বোঝা গেল যে, ইনি সম্পূর্ণ নিরক্ষর। তখন
মহারাজ রসসাগরকে বললেন, “বিদ্যাহীন ভট্টাচার্য্য মহা বিড়ম্বন!”  হাসতে হাসতে রসসাগর
এই সমস্যাটী এভাবে পূরণ করে দিলেন . . .

সমস্যা ---
“বিদ্যাহীন ভট্টাচার্য্য, মহা-বিড়ম্বন!”
সমস্যা পূরণ ---

হরি-হীন শেষ-নাগ, গঙ্গাহীন দেশ,
তৈল-হীন কেশপাশ, উর্ণা-হীন মেষ।
ভূমি-হীন ভূমি-পতি, গন্ধ-হীন ফুল,
নারী-হীন অট্টালিকা, পুত্র-হীন কুল।
বারি-হীন সরোবর, ধর্ম্ম-হীন জন,
‘বিদ্যা-হীন ভট্টাচার্য্য, মহা-বিড়ম্বন!’