রস-সাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর সমস্যা পূরণ কবিতা
|
রাম রাম রাম
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার দূরে কোন এক জায়গায় রসসাগর তাঁর প্রবাসী বন্ধুর বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন।
সেই বন্ধু তাকে প্রশ্ন করলেন, “রাম রাম রাম।” তখন রসসাগর মহাশয় সেই বন্ধুকেই লক্ষ্য
করে পরিহাস করে এই সমস্যাটী পূরণ করে দিয়েছিলেন . . .
সমস্যা --- “রাম রাম রাম।”
সমস্যা পূরণ ---
সম্পূর্ণ যুবতী নারী রেখে দিয়া ঘরে
চলিল তাহার পতি বাণিজ্যের তরে |
মধুমাস, --- মন্দ মন্দ বহে সমীরণ,
নিশায় বিদেশী জন দেখিল স্বপন |
স্বপন দেখিয়া পতি উঠিয়া বসিল,
বাটীতে যাইব বলি’ মনেতে ভাবিল |
তিন দিবসের পথ এক দিনে যাব,
নারী-সঙ্গে রস-রঙ্গ অদ্যই করিব |
এত ভাবি’ তাড়াতাড়ি যেতে নিজ ধাম,
উছট খাইয়া বলে ‘রাম রাম রাম |’
. *******************
[ ব্যাখ্যা - ইষিকা মানে তুণ অর্থাৎ কাটি। রসসাগরের রসিকা ব্রাহ্মণী সাংসারিক দুঃখের
জ্বালায় নাক-চাবিটীও বিক্রী করে ফেলেছেন। পাছে নাকের ছিদ্রটি বুজে যায়, এই আশঙ্কায়
তিনি নাকে একটি কাটি দিয়ে রেখেছেন। ]
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
রামের কঠিন প্রাণ, সীতার কোমল
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একদিন সন্ধ্যায় গিরীশচন্দ্রের সভায় রামায়ণ-গান হচ্ছিল। গান শেষ হয়ে গেলে মহারাজ
রসসাগরকে এই সমস্যাটী পূরণ করতে দিলেন, “রামের কঠিন প্রাণ, সীতার কোমল!”
রসসাগর এভাবে পূরণ করে দিয়েছিলেন . . .
সমস্যা --- “রামের কঠিন প্রাণ, সীতার কোমল!”
. ( শ্রী কৃষ্ণের প্রতি বৃন্দার উক্তি )
সমস্যা পূরণ ---
দশ মূর্ত্তি ধরি’ হরি! দশ অবতারে
কি কাণ্ড না করিয়াছ আসিয়া সংসারে !
রাম-অবতারে তুমি ক’রেছ যে সব,
চক্ষু দিয়া জল আসে শুনিলে কেশব !
বিষম দুর্জ্জয় বীর বালীর জীবন
বিনা দোষে চোরা বাণে করিলে হরণ !
গর্ভবতী সীতা সতী তোমারি কৃপায়
বাল্মীকির বনে গিয়া প্রাণরক্ষা পায় !
লঙ্কাপুরে সীতা অগ্নি-পরীক্ষাও দিয়া
বিষম মনের দুঃখে ছিলেন বাঁচিয়া !
শেষ অগ্নি পরীক্ষার কথা শুনি’ কাণে
অগ্নি কুণ্ডে ঝাঁপ দিয়া মরিলেন প্রাণে !
শুনিয়া তোমার কাণ্ড হ’য়েছি বিহ্বল,
‘রামের কঠিন প্রাণ, সীতার কোমল !’
রেখেছি একটী ইষিকা
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
মহারাজ গিরীশচন্দ্র রসসাগরকে এতটাই ভালবাসতেন যে, তাকে না দেখে থকতে পারতেন
না। তবে রসসাগর খুবই তেজস্বী ছিলেন, মাঝে মাঝে মহারাজকে দু এক কথা শুনিয়ে
দিতেন। মাঝে মাঝে এরকম হত যে, মহারাজ বিরক্ত হয়ে কিছুদিনের জন্য তার বেতন
বন্ধ করে দিতেন। একবার রসসাগরের বেতন কিছুদিনের জন্য বন্ধ হওয়াতে তিনি
অভিমান করে বাড়িতে বসেছিলেন। রাজবাড়িতে বেতনও পাওনা ছিল তার। কিন্তু
অভিমান করে তিনি রাজবাড়িতে যেতেন না এবং বেতনও চাইতেন না। রসসাগর নিরন্ন,
--- তার সংসার চলছে না। ব্রাহ্মণী তাকে রাতদিন তিস্কার করেন। মহারাজ অনেকদিন
রসসাগরকে না দেখতে পেয়ে তার খবর নিতে একজন কর্ম্মচারীকে তার বাড়িতে
পাঠালেন। রসসাগরের বাড়ি অতি সামান্য। স্ত্রী-পুরুষের সাংসারিক দুঃখের কথা
কর্ম্মচারীটি বাড়ির বাইরে থেকে শুনতে পেলেন। রসসাগরের স্ত্রী বুদ্ধিমতী ও সুরসিকা
ছিলেন। তিনি বিনীত ভাবে স্বামীকে বললেন, “ঠাকুর! সংসারের কষ্ট আর সহ্য হয় না।
আমার কথা বলে ও আমাদের দুঃখ জানিয়ে একটি কবিতা লিখে মহারাজকে দিন, তাহলে
তিনি খুশী হবেন এবং আমাদের সংসারও সুখে স্বচ্ছন্দে চলবে।” ব্রাহ্মণীর কথা ব্রাহ্মণ
স্বীকার করলেন এবং মহারাজের সাথে দেখা করবার জন্য বাড়ির বাইরে এলেন, তখনও
মহারাজের কর্ম্মচারী বাড়ির বাইরে থেকে উভয়ের কথা শুনছিলেন। রাজকর্ম্মচারীর সাথে
রসসাগরের দেখা হবার পর কর্ম্মচারীটি বললেন, “রসসাগর মহাশয়! মহারাজ আপনাদের
খবর নিতে আমাকে পাঠিয়েছেন।” রসসাগর মহাশয় এটা শুনে আনন্দিত হলেন এবং তার
সাথে রাজবাড়িতে গেলেন। দেখা হওয়ামাত্র মহারাজ স্মিত হেসে রসসাগরকে বললেন, ”
ব্রাহ্মণী কেমন আছেন!” উত্তরে তিনি বললেন, “মহারাজ! ব্রাহ্মণী আপনাকে একটি দরখাস্ত
দিয়েছেন। তবে ভীষণ অর্থাভাবের জন্য কাগজ, কলম না থাকায় তার একটি কথা
আপনাকে জানাতে এসেছি।” মহারাজ বললেন, “কি কথা বলুন।” রসসাগর বললেন,
“রেখেছি একটী ইষিকা।” তখন মহারাজ বললেন, “আপনার ব্রাহ্মণীর সমস্যা আপনিই পূরণ
করে দিন।” রসসাগর সাথে সাথেই ব্রাহ্মণীর ধ্বনি দিয়ে করুণ-রসে সমস্যাটি পূরণ করে
দিলেন। কবিতায় দুঃখ-বর্ণনা শুনে মহারাজ দুঃখিত হয়ে রসসাগরকে পুরস্কার
দিয়েছিলেন।
সমস্যা --- “রেখেছি একটী ইষিকা।”
সমস্যা পূরণ ---
নিবেদন করে দাসের দাসী, রস-সাগরের রসিকা,---
দয়া ছেড়েছেন নাথের নাথ, মন্দির ছেড়েছে মূষিকা |
আভরণ করেছি বিক্রয়, সুবর্ণ-বঞ্চিত নাসিকা |
পাইব আশায়, আজিও নাসায়, ‘রেখেছি একটী ইষিকা’ |