রস-সাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর সমস্যা পূরণ কবিতা

.                            *******************

[ ব্যাখ্যা - মহারাজ নন্দকুমার অভিযোগ করেছিলেন যে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন
হেস্টিংস সাহেব ঢাকার মণিবেগমের কাছে থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন। এই কাজে হেস্টিংস-
এর নিকটের লোক ছিলেন কান্ত বাবু। এই কবিতাটি একটি সত্য ঐতিহাসিক ঘটনাকে
কেন্দ্র করে।

মণিবেগমের কাছ থেকে ঘুষ নেবার কাজে কান্তবাবু বিশেষভাবে জড়িয়ে ছিলেন। মহারাজ
নন্দকুমার এটা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছিলেন। কলিকাতা কাউন্সিলের কাছে তিনি সাক্ষ্য
দিতে এসে মণিবেগমের একটি চিঠি দেখান। সেই চিঠিতে মণিবেগমের পদোন্নতির জন্য
এক লক্ষ টাকা মুরশিদাবাদে ও আর এক লক্ষ টাকা কলকাতায় দেবার কথা উল্লেখ ছিল।
পূর্বে যে দেড় লক্ষ টাকা দেবার কথা ছিল, এই দুই লক্ষ টাকা তার থেকে আলাদা।
মণিবেগমের সেই মূল চিঠি নন্দকুমারের কাছ থেকে হেষ্টিংস কিংবা তার কোন লোক
নিয়েছেন কিনা, এই প্রশ্ন কাউন্সিল থেকে জিজ্ঞাস করা হলে  নন্দকুমার উত্তর দেন যে
মণিবেগম কান্তবাবুকে দিয়ে তা পেশ করতে বলেন। কান্তবাবুকে মূল চিঠি না দেওয়ায়
তিনি ইহার নকল নিতে চান, সে দিন সন্ধ্যা হয়ে যাবার জন্য পরদিন নেবার কথা হয়।
কাউন্সিল থেকে এই সব বিষয় প্রমাণের জন্য কান্তবাবুকে সময় দেওয়া হয়, কিন্তু  
হেষ্টিংসের নিষেধে তিনি প্রথমে উপস্থিত হন নি। সুতরাং কাউন্সিলের সভ্যরা   
নন্দকুমারের তোলা অভিযোগটি নিজেদের বিবেচনায় বিচার শেষ করেন।

বারবার কাউন্সিলের অবমাননার জন্য পুনরায় কান্তবাবুর নামে সমন পাঠানোর বিষয়ে
কাউন্সিলে বাদানুবাদ হয়। বারওয়েল সাহেব প্রথমে আপত্তি করেন। গভর্ণর জেনারেল
হেষ্টিংস সাহেব তাকে কলকাতার সর্ব্ব প্রধান দেশীয় অধিবাসী বলে উল্লেখ করে বলেন
যে, সাধারণ বেনিয়ানদের মত তিনি গন্য হতে পারেন না। এই সময়ে তিনি কান্তবাবুর  
বংশ-মর্য্যাদার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ক্লেভারিং সাহেব তাকে সাধারণ বেনিয়ান বলেই
মনে করতেন। তিনি বলেছিলেন যে কান্তবাবু যখন কোম্পানীর ইজারদার তখন তিনি
কাউন্সিলের আদেশ মানতে বাধ্য। বারওয়েল সাহেব প্রথমে আপত্তি করলেও পরে  
ক্লেভারিং-এর এই প্রস্তাবে মত দেন। পরে কান্তবাবুর নামে সমন পাঠানো হয়ে তিনি  
তাদের সামনে উপস্থিত হন। তাকে আগের সমনে উপস্থিত না হবার কারণ জিজ্ঞেস  
করাতে তিনি বলেন গভর্ণর সাহেব মানা করায় তিনি উপস্থিত হন নি। স্থানীয় অধিবাসীরা
গভর্ণরের আদেশের পরে কাউন্সিলের আদেশ মান্য করে। গভর্ণর যদি উপস্থিত হতে
বলতেন তাহলে কাউন্সিলের আদেশ মানতে ভূল করতেন না।

কাউন্সিলের অবমাননার জন্য ক্লেভারিং সাহেব প্রস্তাব করেন যে, কান্তবাবুকে গুরুতর
শাস্তি দেওয়া হোক গভর্ণর জেনারেল বলেন কান্তবাবু উচ্চপদস্থ বলে সকলে তাকে সম্মান
করে। তার কোন রকম শাস্তি হতে পারে না। বিশেষত তিনি গভর্ণর জেনারেলের
কর্ম্মচারী বলে সুপ্রিমকোর্টের সীমার আওতায় ও কাউন্সিলের সীমার বাইরে। হেষ্টিংস
আরও বলেন যে, তিনি নিজের জীবন দিয়েও কান্তবাবুকে রক্ষা করতে প্রস্তুত। অনেক
তর্ক-বিতর্কের পর ক্লেভারিং সাহেব পুনরায় প্রস্তাব করেন যে, গভর্ণর অতি সামান্য
অপরাধের কারণে প্রত্যেকদিন দুর্ভাগা হিন্দুদের যে রকম শাস্তি দিয়ে থাকেন, আমি
কান্তবাবুকেও সেই রকম শাস্তি দিতে চাই। যাহোক কান্তবাবু তখন অবমাননার হাত
থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। ]


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কান্ত বাবু হ’য়ে কাবু হাবু-ডুবু খায়
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন যুবরাজ শ্রীশচন্দ্রের এক বন্ধু তার সভায় বসে রস-সাগরকে এই সমস্যাটি পূরণ
করতে দিয়েছিলেন,---- “কান্ত বাবু হয়ে কাবু হাবু-ডুবু খায়।” রস-সাগর এভাবে পূরণ
করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“কান্ত বাবু হ’য়ে কাবু হাবু-ডুবু খায়।”
সমস্যা পূরণ ---
           


.                            *******************

[ ব্যাখ্যা - একদা মুর্শিদিবাদে নবাব আলিবর্দ্দী খাঁর প্রাসাদে এক সভা হয়। বর্দ্ধমান, নদীয়া,
রাজসাহী প্রভৃতি নানা স্থান হতে রাজা ও মহারাজাগণ তাঁদের দেওয়ান, উকীল ও অন্যান্য
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ সেই সভায় যোগদান করেছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই সময়ে নবাব
আলিবর্দ্দী খাঁর কারাগারে বন্দী ছিলেন। রঘুনন্দন মিত্র নামে এক উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থ-সন্তান
এই সময় মহারাজের দেওয়ান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রভুভক্ত ও দক্ষ ব’লে মহারাজ
কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশানুসারে তাঁরই প্রতিনিধি হয়ে সেই সভায় যান। ভিড় থাকায় সেই
সভায় বসার যায়গা ছিলনা। সেই ভিড়ের জন্য প্রবেশকালে রঘুনন্দনের
পরিচ্ছদের একাংশ বর্দ্ধমান রাজার দেওয়ান মাণিকচাঁদের অঙ্গ স্পর্শ করে। মাণিকচাঁদ
ক্রোধে হিন্দিতে বললেন, “দেখতে নেহিঁ পাজি?”  রঘুনন্দন জবাব দিলেন, হাঁ নওকর! সব
হি পাজি হ্যায়, কোই ছোটা কোই বড়া।“ একথা শুনে সভাশুদ্ধ সকলেই হেসে উঠলেন।
কিন্তু মাণিকচাঁদ রঘুনন্দনের উপর রাগ পুষে রাখলেন। কিছুকাল পর মাণিকচাঁদ বর্দ্ধমান
রাজার চাকরি ছেড়ে আলিবর্দ্দী খাঁর দেওয়ান হয়ে গেলেন। এর পরেই তিনি রঘুনন্দনের
সর্বনাশ করার উপায় ভাবতে লাগলেন।

এই সময়ে একবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারী, পলাশী পরগণার মধ্য দিয়ে, হুগলী থেকে
মুর্শিদাবাদ যাবার সময়ে, বর্দ্ধমান রাজের কয়েক লক্ষ টাকা দুর্বৃত্তেরা লুঠ করে।
কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারীরা তা অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায়নি। মাণিকচাঁদ এই ঘটনার জন্য
রঘুনন্দনকেই দায়ী করে তাঁকে গ্রেফতার করে মুর্শিদাবাদ ও কৃষ্ণনগরের প্রধান প্রধান
রাজপথে গাধার পিঠে বসিয়ে ঘুরিয়ে শেষে তাঁকে কামানের গোলা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।

এই রঘুনন্দনই তাঁর বুদ্ধি-কৌশলে প্রচুর টাকা সংগ্রহ করে আলিবর্দ্দী খাঁকে পাঠিয়ে,
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। তাঁরই হুকুমনামাকে বলা হয়
“রঘুনন্দনী ছাড়”। তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রঘুনন্দনের বংশধরগণকে
পলাশী পরগণার ১৪০০ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। ]


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কামানের গোলা দিয়া উড়াইয়া দিলি
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একবার কলকাতা হতে কয়েকজন শিক্ষিত ও ধনী ব্যক্তি কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে কোন
বিশেষ কাজে গিয়েছিলেন। তখন মহারাজ গিরীশচন্দ্র সভায় উপস্থিত থেকে তাদের সঙ্গে
আলাপ করেছিলেন। কথায় কথায় তাদের মধ্যে একজন রস-সাগরকে প্রশ্ন করলেন
“কামানের গোলা দিয়া উড়াইয়া দিলি।” তিনি আরও অনুরোধ করলেন যে  আপনাকে
নবাব সরকারের কোনও বিষয় নিয়ে এই সমস্যাটি পূরণ করতে হবে। সে সময় বাংলা
দেশের ঘটনাবলীর কথা রসসাগরের কন্ঠস্থ ছিল। তিনি সময়নষ্ট না করে এই সমস্যা পূরণ
করে দিলেন।

সমস্যা ---
“কামানের গোলা দিয়া উড়াইয়া দিলি।”
সমস্যা পূরণ ---

আলিবর্দ্দী-নবাবের কারাগারে পশি’
কতদিন কৃষ্ণচন্দ্র রহিলেন বসি’ |
তাঁহার উদ্ধার হেতু শ্রীরঘুনন্দন
সহিলেন কত কষ্ট, কে করে গণন !
ধিক্ রে মাণিকচাঁদ ! ধিক্ ধিক্ তোরে,
চড়ালি তাঁহারে তুই গাধার উপরে |
তাহাতেও জাতক্রোধ না তোর মিটালি,
‘কামানের গোলা দিয়া উড়াইয়া দিলি |’
        


.                            *******************

[ ব্যাখ্যা - পুত্র মীরণের  বজ্রাঘাতে মৃত্যু হলে মীরজাফর পুত্রশোকে একেবারে ভেঙে
পড়লেন। তখন তার জামাই মীরকাশিম তার সিংহাসনে বসেন। মীরকাশিম ইংরেজদের
আধিপত্য থেকে মুক্তি  পাবার  জন্য মুরশিদাবাদ ত্যাগ করে মুঙ্গেরে রাজধানী স্থাপন
করেন। তিনি ইংরেজদের পরম শত্রু হয়ে উঠলেন, এবং যাদের ইংরেজদের মিত্র বলে
মনে করতেন তাদের নানান ছলে নিজের দিকে টানতেন। একবার নবাব, মহারাজ  
কৃষ্ণচন্দ্রকে হুগলী আসতে আদেশ দেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সাথে নিয়ে
সেখানে উপস্থিত হলেন। তারা নবাবের সাথে কথা বলে শিবপুরে মোহনারকাছে উপস্থিত
হলে নবাবের একজন দূত এসে বলে, “মহারাজ আপনাদের পুনরায় নবাব ডাকছেন।”
মহারাজ এটা শুনেই বললেন “এ ডাক ভাল বলে মনে হচ্ছে না।” তখন মহারাজ শিবচন্দ্রের
পরামর্শে আবার হুগলী গেলেন। তারা সেখানে পৌঁছানো মাত্র তাদের বন্দী করে মুঙ্গের
দুর্গে পাঠানো হল। মুঙ্গেরে পিতা-পুত্রে কারাগারে বাস করতে লাগলেন।

১৭৬৩ সালে কাটোয়া, গড়িয়া, উদয়নালা এইসব জায়গায় ইংরেজদের সাথে মীরকাশিমের
যুদ্ধ হয়। এই তিনটি যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়েছিল। নবাব এতদিন মুঙ্গেরে ছিলেন। তার
সৈন্যের বার বার পরাজয়ের খবর শুনে তিনি রাজমহলে চলে গেলেন, কিন্তু সেখানেও
পরাজিত হয়ে আবার মুঙ্গেরে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ইংরেজ সৈন্য তার পেছনে গেল।
গর্গিণ নামে একজন রণকুশল আর্মাণী নবাবের সেনাপতি ছিলেন। তার এক ভাই  
কলকাতায় থাকতেন। ভ্যান্ সিটার্ট সাহেব গর্গিণের ভায়ের সাথে বন্ধুত্ব করে তাকে নিজের
পক্ষে আনেন, এবং এতেই নবাবের পরাজয় হয়।

মীরকাশিম ইংরেজদের ভয়ে মুঙ্গের থেকে পাটনায় পালাবার চেষ্টা করছিলেন, এমন সময়
তার সেনাপতি গর্গিণের বিশ্বাস-ঘাতকতার জন্য রাগে অন্ধ হয়ে বন্দীগণকে বধ করার
আদেশ দিলেন। তিনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও শিবচন্দ্র উভয়কে তাড়াতাড়ি হত্যা করবার
আদেশ দিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন যে নবাবকে মুঙ্গের থেকে পালাতেই
হবে, এবং তিনি উপায় খুঁজতে লাগলেন যাতে তাদের বধ করতে আরও দেরী হয়।

যে সময়ে হতভাগ্য বন্দীগণের প্রাণদন্ডের আদেশ প্রকাশ হবে, ঠিক তার আগেই পিতাপুত্র
বিশেষ সমারোহে পূজা করতে বসলেন। অনেকদিন বন্দী থাকার ফলে তাদের চুল দাড়ি
নখ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। তারা সারা গায়ে গঙ্গা মাটি মেখে এবং গলায় রুদ্রাক্ষ-
মালা পড়েছিলেন। তাদের উভয় দিকে ধূপ দীপ নৈবেদ্য ইত্যাদি ছিল। তারা আন্তরিক
ভক্তি ভরে পূজা করছিলেন। এমন সময় নবাবের প্রহরিগণ তাদের বধ করার জন্য নিতে
এল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অনুরোধ করলেন একটু অপেক্ষা কর আমরা জন্মের মত  
ভগবানের পূজা করে নিই। পূজা শেষ হলে তোমাদের সঙ্গে যাব। তারা পূজা করছেন
আর জল্লাদগণ বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। জল্লাদগণ পূজা শেষ করার জন্য যত তাড়া
দিতে থাকে মহারাজ ততই বলেন, “এই শেষ হল, এই শেষ হলো।” এদিকে দেরী হচ্ছে আর
অন্য দিকে নবাব সঙ্গীসহ পালাবার ব্যবস্থা করছেন। একারণে দুর্গের মধ্যে ভীষণ  
কোলাহল ও গোলমাল শুরু হলো। জল্লাদগণ নবাবের পলায়ন দেখার জন্য চলে গেল।  
শোনা যায় এসময় মহারাজ জল্লাদগণকে অর্থের লোভ দেখিয়ে ছিলেন। যাহোক ভগবানের
কৃপায় মহারাজ ও তার পুত্র আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এদিন পিতাপুত্র
যে বেশে ও যেভাবে মুঙ্গের দুর্গে পূজা করতে বসেছিলেন তার অবিকল চিত্র কৃষ্ণনগর
রাজবাড়িতে বহুদিন ছিল।

যখন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও শিবচন্দ্র মুঙ্গের দুর্গে বন্দী ছিলেন, তখন মুঙ্গের দুর্গের কারাগারে
বন্দীগণের মৃত্যুসংবাদ চারিদিকে প্রচারিত হয়েছিল। এজন্য মহারাজের ছোট পুত্র শম্ভুচন্দ্র
মনে করেছিলেন যে, পিতা ও ভ্রাতা দুজনেই নবাবের আদেশে নিহত হয়েছেন। তখন
শম্ভুচন্দ্র পিতা ও ভ্রাতার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করে পিতার সম্পত্তি এ ধনাগার অধিকার
করেন, এবং মহাসমারোহে পিতার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু পরে যখন শুনলেন যে, তারা
দুজনেই মুঙ্গের থেকে মুরশিদাবাদে উপস্থিত হয়েছেন, তখন তিনি লজ্জিত হয়ে পিতাকে
একটি চিঠি লেখেন। শম্ভুচন্দের এই আচরণে মহারাজ তার নিজের মুন্সীকে দিয়ে যথোচিত
উত্তর লিখিয়ে সই করেন এবং নিজে এই কয়টি লাইন লিখে দিয়েছিলেন . . .

“হস্তি-শুণ্ডে লক্ ড়ি দিলে ছাড়ান মুস্কিল,
কুশার ভূমিতে বীজ কাড়ান মুস্কিল |
মনঃশিলা ভাঙ্গিলে যোড় লাগান মুস্কিল,
জাঁহাদিদা খাদিমেরে ভুলান মুস্কিল ||” ]


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কারো ভাগ্যে পৌষ-মাস, কারো সর্ব্বনাশ
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একবার মহারাজ গিরীশচন্দ্রের দত্তক পুত্র যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র রস-সাগরকে বললেন, “অদ্য
আপনাকে একটি সমস্যা দিব, কিন্তু আমাদের রাজবংশের কোন এক জনকে লক্ষ্য করে
আপনাকে এখনই পূরণ করিতে হবে।” সমস্যাটি এই --- “কারো ভাগ্যে পৌষ-মাস, কারো
সর্ব্বনাশ।” রস-সাগর সাথে সাথেই সমাধান করে যুবরাজ ও সভার সকল লোকদের মুগ্ধ
করে দিলেন।

সমস্যা ---
“কারো ভাগ্যে পৌষ-মাস, কারো সর্ব্বনাশ।”
সমস্যা পূরণ ---
     


.                            *******************

[ ব্যাখ্যা – এই কবিতাটির ভাব অত্যন্ত সুন্দর। এইরকম গূঢ়-ভাবাত্মক কবিতাকে সংস্কৃত
ভাষায় “অন্তরালাপ” বলে। “কারো স্বস্তি” অর্থাৎ কারো কারো সন্তোষ। “কারো নাস্তি”
অর্থাৎ কারো কারো স্বস্তি ( সন্তোষ ) নেই,  অর্থাৎ অসন্তোষ। “কারো মহোল্লাস” অর্থাৎ
কারো কারো অত্যন্ত আনন্দ।

কৃতীর দানের মহান আড়ম্বর দেখে সুমেরুর ত্রাস হচ্ছে। অরুণ-বাজী অর্থাৎ সূর্য্য-সারথি
অরূণের অশ্ব আনন্দে নাচছে এবং পদ্মিনী আহ্লাদে হেসে যাচ্ছে। দানের আড়ম্বর দেখে
এদের এরূপ হবার কারণ কি? কারণগুলি অতি গূঢ় ও ভাবগর্ভ। দানের ঘটায় সুমেরুর
ভয় পাবার অনেক কারণ আছে। সুমেরু সোনা দিয়ে তৈরী পর্ব্বত। পাছে মহারাজ তাহা
খন্ড খন্ড করে প্রার্থিগণকে দান করেন, এই কারণেই সুমেরুর স্বস্তি নেই, অর্থাৎ ত্রাস হচ্ছে।
সূর্য্য-সারথি অরুণের অশ্ব আহ্লাদে নাচছে কেন? এরও কারণ আছে। যদি মহারাজ
সোনা দান করবার জন্য সুমেরু পর্বত ধ্বংস করেন, তাহলে সূর্য্য-দেবকে বহন করে নিয়ে
যাবার পথ সহজ হয়ে যায়, অর্থাৎ দুর্গম সুমেরু পর্বত অতিক্রম করে যেতে হয় না, এজন্য
অরুণ-বাজীর “স্বস্তি” অর্থাৎ মহান সন্তোষ। পদ্মিনীর হাসার কারণ এই যে সুমেরু পর্বত
নষ্ট হলে সূর্য্য আর অস্ত যাবে না, এজন্য পদ্মিনীর “মহোল্লাস”। ]



.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কারো স্বস্তি, কারো নাস্তি, কারো মহোল্লাস
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন মহারাজ গিরীশচন্দ্র সভায় বসে ছিলেন, এমন সময়ে রস-সাগর ও অনেকগুলি
প্রাচীন সুপণ্ডিত লোক মহারাজের সাথে দেখা করতে এলেন। কথায় কথায় মহারাজ তার
প্রপিতামহ মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্রের কথা বললেন। মহারাজ বললেন সমস্ত
বাংলাদেশে কৃষ্ণচন্দ্র, নবকৃষ্ণ ও গঙ্গাগোবিন্দের মত কেউ কখনো মহাসমারোহে মাতৃশ্রাদ্ধ
করেন নি এবং আগামীতে কেউ করতে পারবেন না। বিশেষ করে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র
যেভাবে মুক্তহাতে হীরে, ভূমি, রূপো দান করেছিলেন,  সেরকম আর কেউ করতে পারবে
না। ঐ শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা সকলে সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। তখন রস-
সাগর বললেন না মহারাজ! কৃষ্ণচন্দ্রের মাতৃশ্রাদ্ধে কেহ কেহ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সেই
শ্রাদ্ধে “কারো স্বস্তি, কারো নাস্তি, কারো মহোল্লাস হইয়াছিল।” তখন গিরীশচন্দ্র বললেন
আপনার সমস্যা আপনিই পূরণ করুন।  কিন্তু এটা তিন চরণে আপনাকেই পূরণ করতে
হবে। রস-সাগর সাথে সাথেই তা পূরণ করে সভার সবাইকে মুগ্ধ করে দিলেন।

সমস্যা ---
“কারো স্বস্তি, কারো নাস্তি, কারো মহোল্লাস।”
সমস্যা পূরণ ---

দেখিয়া দানের ঘটা সুমেরুর ত্রাস,
নাচিছে অরুণ-বাজী, পদ্মিনীর হাস,
“কারো স্বস্তি, কারো নাস্তি, কারো মহোল্লাস |”

  


.                            *******************


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কার্য্য শেষ হলে আর কেহ কারো নয়
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন রস-সাগর ও আর কয়েকজন ভদ্রলোক মহারাজ গিরীশচন্দ্রের বাড়ি খাওয়া-দাওয়া
সেরে নিজেদের বাড়ি ফিরছিলেন, এমন সময় একজন মহারাজের বাড়ির খাবারের বিষয়ে
নিন্দা করলেন। ইহা শুনে রস-সাগর আর থাকতে না পেরে বললেন, “কার্য্য শেষ হ’লে আর
কেহ কারো নয়!” তখন রস-সাগরকে এই সমস্যাটি পূরণ করতে বলায় তিনি এভাবে পূরণ
করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“কার্য্য শেষ হলে আর কেহ কারো নয়!”
সমস্যা পূরণ ---


.                            *******************


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কালী-পদ বক্ষে তাই ধরেন শঙ্কর
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

নবদ্বীপ নিবাসী কোন এক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত মহাশয় এই সমস্যাটি রস-সাগরকে পূরণ করতে
দিয়েছিলেন --- “কালী-পদ বক্ষে তাই ধরেন শঙ্কর।”

সমস্যা ---
“কালী-পদ বক্ষে তাই ধরেন শঙ্কর।”
সমস্যা পূরণ –

ওমা কালি ! এই তব চরণ-কমল
মুক্তিপ্রদ তায় পুনঃ পরম শীতল |
তাই মাগো !  মনে মনে বুঝিয়া শঙ্কর
রেখে তব পা-দুখানি বক্ষের উপর
পাইয়া পরম সুখ বিভোর হইয়া
দুর্জ্জয় বিষের জ্বালা গেছেন ভুলিয়া |
ছাড়িলে বিষের জ্বালা পাছে ঘোরতর,
“কালী-পদ বক্ষে তাই ধরেন শঙ্কর !”
    


.                            *******************


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কাঁদিতে বসিয়া কেহ কাঁদিতে না পাবে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

একদিন যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র রস-সাগর মহাশয়কে এই সমস্যাটি পূরণ করতে দিলেন, ---
“কাঁদিতে বসিয়া কেহ কাঁদিতে না পাবে!” রস-সাগর মহাশয় দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের
মার শ্রাদ্ধকে লক্ষ্য করে এটা পূরণ করেছিলেন।

সমস্যা ---
“কাঁদিতে বসিয়া কেহ কাঁদিতে না পাবে!”
সমস্যা পূরণ ---
 


.                            *******************


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কি করে তা দেখি
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

কলকাতা নিবাসী প্রসিদ্ধ সুরসিক, সুভাবুক ও সুবক্তা লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস  কৃষ্ণনগরে
একসময় পাঁচালি গান করতে গিয়েছিলেন। তাঁর একটি চোখ ছিল না বলে তাকে “লোকে
কানা” বলত। তিনি রস-সাগরের নাম শুনে তার সাথে আলাপ করতে আসেন। অনেক
তামাসা কৌতুক ও রসালাপের পর তিনি রস-সাগরকে প্রশ্ন করলেন, “কি করে তা দেখি!”  
রস-সাগর সাথে সাথেই এই গভীর-ভাব-সূচক সমস্যাটি পূর্ণ করে লক্ষ্মীকান্তকে স্তম্ভিত করে
দিয়েছিলেন . . .

সমস্যা ---
“কি করে তা দেখি!”
সমস্যা পূরণ---

আশুতোষ! দেহি গঙ্গা, আশুতোষ হ’য়ে,
নারায়ণ ব’লে মরি তাঁর জলে র’য়ে।
আমি হে পাতকী অতি, ---যমে দিয়া ফাঁকি
যম-দূতে বিষ্ণু-দূতে ‘কি করে তা দেখি।’


.                            *******************


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কি ছার পতঙ্গ
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

মহারাজ গিরীশচন্দ্রের কোন এক পারিষদ রস-সাগরকে বললেন, “আপনি মহাকবি  
কালিদাসের মত সুরসিক ও সুভাবুক।” রস-সাগর স্বভাবে অতি নিরীহ ও বিনীত ছিলেন।
এ কথা শুনেই তিনি কানে আঙ্গুল দিয়ে বললেন আমি “কি ছার পতঙ্গ!” তখন সেই পারিষদ
বললেন, “রস-সাগর মহাশয়! আপনার সমস্যা আপনাকেই পূরণ করে দিতে হবে। রস-
সাগর মহাশয় এভাবে সমস্যাটি পূরণ করেছিলেন . . .

সমস্যা ---
“কি ছার পতঙ্গ!”
সমস্যা পূরণ ---

স্বয়ং বলেন বাণী যাঁহার বদনে,
সেই কালিদাস হত বেশ্যার ভবনে।
মুনীনাঞ্চ মতিভ্রম, ভীম-রণ-ভঙ্গ,
এ রস-সাগর ভবে ‘কি ছার পতঙ্গ॥’


.                            *******************


.                                                                                
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর      
কি নাটক অভিনয় না করেছি আমি
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।

যখন রস-সাগর মহাশয় জীবনের শেষভাগে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে অবসর নিয়ে
শান্তিপুরে জামাই-এর বাড়িতে ছিলেন, সেইসময় তার এক প্রতিবেশী বন্ধু বললেন, “রস-
সাগর মহাশয়! কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে থেকে অনেকরকম লোকের সাথে মেলামেশা করতে
হয়েছে!” এটা শুনে তিনি বললেন “কি নাটক অভিনয় না করেছি আমি!” তখন তার বন্ধু
তাকে এই সমস্যাটি পূরণ করতে বলায় তিনি এ ভাবে পূরণ করেছিলেন।

সমস্যা ---
“কি নাটক অভিনয় না করেছি আমি!”
সমস্যা পূরণ ---