রস-সাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর সমস্যা পূরণ কবিতা
|
. *******************
[ ব্যাখ্যা - মহারাজ প্রতাপাদিত্য সুন্দর-বনের অন্তর্গত যশোর নগরে তাঁর রাজধানী তৈরী
করেছিলেন। তার মনে এই বাসনা ছিল যে তিনি সমস্ত বাংলা দেশের স্বাধীন রাজা হবেন।
তিনি তার রাজ্য নিরাপদে রাখার জন্য তার কাকা বসন্ত রায়কে হত্যা করেছিলেন।
তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে প্রতাপাদিত্য বসন্ত রায়ের পুত্রটিকেও হত্যা করার জন্য তত্পর
হন। মহারাণী পুত্রটির প্রাণরক্ষার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটী করেন নি। মায়ের আদেশে
পুত্রটি কচুবনে লুকিয়ে থেকে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক
ঘটনাটি নিয়ে রস-সাগর এই সমস্যাটি পূরণ করেছিলেন। ]
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ক্ষুদ্র হতে মহতেরো হয় উপকার
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
কৃষ্ণনগরের যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নিজের পূর্ব-পুরুষ-গণের
ইতিহাস তার ভালো জানা ছিল। একদিন তিনি রস-সাগরকে বললেন, আপনাকে অন্য
একটি সমস্যা পূরণ করতে দেব। কিন্তু কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বন করে তা
আপনাকে পূরণ করতে হবে।” এটা বলেই তিনি প্রশ্ন করলেন “ক্ষুদ্র হতে মহতেরো
প্রাণরক্ষা হয়!” রস-সাগরের দৃষ্টি নানা বিষয়ের উপর ছিল। তিনি যুবরাজের মনের ভাব
বুঝতে পেরে তত্ক্ষাণাৎ এভাবে এই উত্তর দিয়েছিলেন . . .
সমস্যা --- “ক্ষুদ্র হতে মহতেরো হয় উপকার।”
সমস্যা পূরণ ---
খলের সর্ব্বাঙ্গে, বিষ রহে সর্ব্বক্ষণ
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র, রস-সাগররে বললেন, “এই পৃথিবীতে কোন জন্তু সর্ব্বাপেক্ষা
বিষাক্ত?” রস-সাগর বললেন, “খলের সর্ব্বাঙ্গে বিষ রহে সর্ব্বক্ষণ!” তখন শ্রীশচন্দ্র বললেন,
“আপনার সমস্যা আপনাকেই পূরণ করে দিতে হবে।” রস-সাগর সেই সমস্যা এভাবে পূরণ
করেছিলেন . . .
সমস্যা --- “খলের সর্ব্বাঙ্গে, বিষ রহে সর্ব্বক্ষণ!”
সমস্যা পূরণ ---
তক্ষকের দন্তে বিষ, মক্ষিকার শিরে,
বৃশ্চিকের পুচ্ছে বিষ, --- হেরি এ সংসারে |
এ রস-সাগর কহে,---- একি অলক্ষণ,---
“খলের সর্ব্বাঙ্গে বিষ রহে সর্ব্বক্ষণ !”
খেটে খেটে জান গেল, --- মাহিনা না পাই
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
মহারাজ গিরীশ-চন্দ্রের আর্থিক কষ্টের জন্য রস-সাগর কয়েক মাস বেতন পান নি। একদিন
মহারাজের দেওয়ান রামমোহন মজুমদারের কাছ থেকে বেতন আনতে গিয়ে খালি হাতে
ফিরে এলেন। এরপর ভীষণ রেগে তিনি মহারাজের সভায় উপস্থিত হয়ে বললেন, “খেটে
খেটে জান গেল, --- মাহিনা না পাই!” মহারাজ হাসতে হাসতে বললেন “আপনার সমস্যাটি
আপনি পূরণ না করলে ছাড়া হবে না।” রস-সাগর সমস্যাটি এভাবে পূরণ করেছিলেন . . .
সমস্যা --- “খেটে খেটে জান গেল, --- মাহিনা না পাই।”
সমস্যা পূরণ ---
খেতে খেতে খেলে না
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
মহারাজ গিরীশ-চন্দ্রের পিতা মহারাজ ঈশ্বরচন্দ্র কৃষ্ণনগর থেকে এক ক্রোশ পূর্ব্ব-দক্ষিণ-
ভাগে অঞ্জনা নদীর তীরে একটি রমনীয় প্রাসাদ ও তার চারিদিকে মনোরম উদ্যান তৈরী
করে তার নাম “শ্রীবন” রেখেছিলেন। মহারাজ গিরীশচন্দ্র মাঝে মাঝে রস-সাগর ও
পারিষদ-গণকে নিয়ে শ্রীবনে গিয়ে সময় কাটাতেন। একবার পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ হবার কথা
ছিল। মহারাজ পূর্ণগ্রাস গ্রহণ দেখার জন্য রস-সাগর ও পারিষদ-গণকে সাথে নিয়ে ঐ
সুরম্য প্রাসাদের উপরিভাগে উঠলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য-বশতঃ পূর্ণগ্রাস হল না --- কিছুটা বাকী
ছিল। তখন মহারাজ বললেন “খেতে খেতে খেলে না”। রস-সাগর সাথে সাথেই সেই সমস্যা
পূরণ করে দিলেন।
সমস্যা --- “খেতে খেতে খেলে না।”
সমস্যা পূরণ ---
গগন-মণ্ডলে শিবা ডাকে হোয়া হোয়া
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার এক ভদ্রলোক রস-সাগরকে অপ্রস্তুত করবার জন্য মহারাজ গিরীশচন্দ্রের সভায়
অনেক লোকের সামনে বললেন, রস-সাগর মহাশয়! আজ একটি কঠিন সমস্যা আপনাকে
দেব। যদি আপনি এখনই পূরণ কপরে দিতে পারেন, তাহলে আপনাকে মহাকবি বলব।
এটা বলেই তিনি প্রশ্ন করলেন, “গগন-মণ্ডলে শিবা ডাকে হোয়া হোয়া”। রস-সাগর তখনই
এটা পূরণ করে প্রশ্নকর্ত্তাকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছিলেন।
সমস্যা --- “গগন-মণ্ডলে শিবা ডাকে হোয়া হোয়া।”
সমস্যা পূরণ ---
গগনে ডাকিছে শিবা হুয়া হুয়া করি
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একবার কোন একজন লোক রস-সাগরকে প্রশ্ন করলেন, “গগনে ডাকিছে শিবা হুয়া হুয়া
করি।” রস-সাগরও তখনি এভাবে পূরণ করে দিলেন।
সমস্যা --- “গগনে ডাকিছে শিবা হুয়া হুয়া করি।”
সমস্যা পূরণ ---
শক্তি-শেলে পড়িলেন ঠাকুর লক্ষ্মণ,
পর্ব্বত লইয়া গেল পবন-নন্দন।
গমনের বেগে গিরি কাঁপে থরহরি,
‘গগনে ডাকিছে শিবা হুয়া হুয়া করি।’
গঙ্গাতীরে বাস করি’ চায় কূপ-জল
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
একদিন রস-সাগর ও তার এক প্রতিবেশী বন্ধু একসাথে গঙ্গায় স্নান করতে গিয়েছেন। স্নান
করতে করতে তার বন্ধু বলেন, “রস.সাগর ভায়া! আমরা এতই দুর্ভাগা যে, শান্তিপুরে
গঙ্গাগর্তে বাস করেও আমরা গঙ্গাস্নান করি না।”তখন রস-সাগর বলেন, “গঙ্গাতীরে বাস
করি’ চায় কূপ-জল।” এটা শুনেই রস-সাগরের বন্ধু বলেন, “আপনার সমস্যা আপনিই পূরণ
করে দিন।” রস-সাগরও সেই সমস্যা এভাবে পূরণ করে দিলেন . . .
সমস্যা --- “গঙ্গাতীরে বাস করি’ চায় কূপ-জল।”
সমস্যা পূরণ ---
দেব দেব বাসুদেব করি’ পরিহার
যেই জন পূজা করে অন্য দেবতার,
সে দুর্ম্মতি পিপাসায় হইয়া বিহ্বল
“গঙ্গাতীরে বাস করি’ চায় কূপ-জল |”
গজের উপরি গজ, তদুপরি অশ্ব
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
কোন এক সময়ে নবদ্বীপের একজন অসাধারণ পণ্ডিত মহারাজ গিরীশচন্দ্রের সভায় এসে
উপস্থিত হলেন। মহারাজের একজন পারিষদ রস-সাগরকে লক্ষ্য করে বললেন, “এবার
পণ্ডিত মহাশয়ের একটি কঠিন সমস্যা পূরণ করতে না পারলে সাগর শুকিয়ে যাবে।” রস-
সাগর বললেন, “প্রশ্ন করুন”। তখন পণ্ডিত মহাশয় প্রশ্ন করলেন, “গজের উপরি গজ,
তদুপরি অশ্ব।” কোন রকম অবহেলা না করে রস-সাগর সহাস্য বদনে সমস্যা পূরণ করে
দিলেন।
সমস্যা --- “গজের উপরি গজ, তদুপরি অশ্ব।”
সমস্যা পূরণ ---
গমনের আয়োজন শমনের ঘরে
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
নবদ্বীপের কোন এক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত মহাশয় কৃষ্ণনগরে মহারাজ গিরীশচন্দ্রের সাথে দেখা
করতে গিয়ে এই সমস্যাটি পূরণ করতে দিয়েছিলেন --- “গমনের আয়োজন শমনের ঘরে!”
রস-সাগরও হাসতে হাসতে এটা এইভাবে পূরণ করে দিয়েছিলেন . . .
সমস্যা --- “গমনের আয়োজন শমনের ঘরে।”
সমস্যা পূরণ ---
গাভীতে ভক্ষণ করে সিংহের শরীর
কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী
কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর সংগৃহিত ও সম্পাদিত, "রসসাগর কবি
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ থেকে নেওয়া, (১৯২০)।
কোন কোন দিন মহারাজ গিরীশচন্দ্র ভোরবেলায় কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরবার
জন্য বাড়ি থেকে বার হতেন। একদিন তিনি মল্লিক পাড়ার বারোয়ারী তলায় গিয়ে
দেখলেন, দেবী প্রতিমা তৈরী হচ্ছে। দারুণ রোদের তাপে মূর্ত্তিগুলি ফেটে যাচ্ছে, এবং
সিংহের শরীরের খড়গুলি টেনে টেনে গরু খাচ্ছে। মহারাজ মনে মনে ঠিক করে
রেখেছিলেন, তিনি বাড়ি ফিরে এসেই রস-সাগরকে সামনে দেখতে পেয়েই প্রশ্ন করলেন,
“গাভীতে ভক্ষণ করে সিংহের শরীর!” রস-সাগর মহারাজের ভাব তখনি বুঝতে পেরেই
সমস্যাটি পূরণ করেন এভাবে . . .
সমস্যা --- “গাভীতে ভক্ষণ করে সিংহের শরীর।”
সমস্যা পূরণ ---
মহারাজ নিজধাম হইতে বাহির,
বারোয়ারী মা ফেটে হলেন চৌচির |
ক্রমে ক্রমে খড় দড়ি হইল বাহির,
‘গাভীতে ভক্ষণ করে সিংহের শরীর |’